অটো থেকে নেমে পারমিতা সবে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগিয়েছে, মুষলধারে বৃষ্টি এল। চড়বড় চড়বড় করে বিরাট বিরাট ফোঁটা, তার সঙ্গে মেঘের ডাক। ছাতা খোলার সময়টুকুও পাওয়া গেল না। ভিজে চুপচুপে একেবারে। ভিজতে ভিজতেই হনহনিয়ে বাড়ির দিকে চলল সে। বেশ লাগছে বৃষ্টি মাথায় হাঁটতে। মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠছে মিয়াঁ মল্লার। সুর ভাঁজতে ভাঁজতে পা চালায় গানের ইস্কুলের দিদিমণি পারমিতা। সেই ছোট্ট বয়েস থেকেই গানের তালিম তার। নানা আসরে গাইবার ডাক আসে। রেডিও, টিভি তো আছেই। সোশ্যাল মিডিয়াতেও পারমিতা বোস বেশ পরিচিত নাম।
‘বোলে রে পাপিহারা’, আহা, এমন আকাশভাঙা বৃষ্টিতেই তো মল্লার গাইতে হয়। বাড়ি এসে গেছে প্রায়, গাড়িবারান্দাটা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির আদর সারা গায়ে মাখতে মাখতে পারমিতা সুরের পাখিকে উড়িয়ে দিচ্ছে তারসপ্তকে, ‘নিত মন প্যাসা, নিত মন তরসেএএএএ…..।’
ঠিক সেই সময় দৈববাণী হল, “মিউ।” চমকে এদিক ওদিক তাকায় সে। কে ডাকল?
“মিউ।” আবার সেই ডাক। ভীরু, কুণ্ঠিত। যেন মিয়াঁ মল্লারের কোমল গান্ধার। এত্তটুকু একটা সাদা বেড়ালছানা গাড়িবারান্দার তলায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে গেছে সাদা লোম। জড়সড় হয়ে বসে বসে পারমিতাকেই দেখছে। বোধহয় ভাবছে, বাড়ির দরজাটা এবার নির্ঘাত খুলবে। একছুট্টে যদি ভেতরে একবার ঢুকে পড়া যায় তো নিশ্চিন্দি। পারমিতার হঠাৎ মনে হল, ছানাটার ডাকটা বেশ সুরেলা তো? সুর আছে গলায়। গানের দিদিমণির কান এড়ায়নি। তবু আর একবার পরখ করে দেখতে চেয়ে পারমিতা গাইল, “বোলে রে পাপিহারাআআআআ…’
ছানাটা চোখদুটো পিটপিট করল, “মিউ।” বিজয়গর্বে পারমিতা ছানাটাকে কোলে তুলে নিল। এর গান হবে। গলায় কী সুন্দর সুর! যদিও ঠিকঠাক পর্দায় লাগাতে পারছে না, কিন্তু রেওয়াজ করলেই সুরে গলা খেলবে। দরজা খুললো হরি, মায়ের সর্বক্ষণের সহচর। খুলেই অবাক, “ওমা, ই কী? ভিজে কাক হয়েচ দেকচি, ছাতা নে’ যাওনি?” তাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকতে যাবে, হরির চোখ পড়ল পারমিতার কোলের দিকে।
– কোলে উটি কী গো দিদিমণি? বেড়ালছ্যানা? কী সব্বনাশ! কোত্থেকে আনলে? ঘন্টুর চোকে পড়লি আর রক্কে আচে?
– যা-যাহ, তুই সব জানিস, সবজান্তা। ঘন্টু আবার কী করবে? করার আছেই বা কী? ঘন্টুর বাড়ি নাকি এটা? ও কি বোসবাড়ির মালিক?
– সে তোমরাই জানো, ঘন্টুকে নিয়ে ঝা আদিক্যেতা তোমাদের! আদর দেকে আর বাঁচিনে!
– উফ, হরি, থামবি তুই? দেখছিস না, আমার সোনা বেড়ালছানাটা কেমন ভিজে চুপসে আছে? তোয়ালে দে, মুছিয়ে দিই। একটা বিছানা পাত ওর জন্যে। আর দুধ গরম কর দেখি?
– তার মানে? ও কি একেনে থাকবে নাকি? ই কী কতা? আমাদের ঘন্টু রয়েচে যে!
– কেন, বেড়াল আর কুকুর কি একবাড়িতে থাকে না? যা দেখি, দুধটা আন।
আরও পড়ুন: অন্বেষা দত্তর ছোটগল্প: জোড়াতালি
হরি গজগজ করতে করতে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই ধূমকেতুর মত উদয় হয় ঘন্টু। তাগড়াই অ্যালসেশিয়ান। বোসবাড়িতে তার সাংঘাতিক আদর। গোটা বাড়ির দৈনন্দিন রুটিন ঘন্টুকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। ঘন্টু কখন খাবে, কখন খেলবে, কখন বেড়াতে যাবে, কখন টিভি দেখবে, তাই নিয়েই বাড়ির লোক ব্যস্ত থাকে। এহেন ঘন্টু কোথায় ছিল, পারমিতার গলার আওয়াজে তীরের মত ছুটে এসে পায়ে মাথা ঘষতে গেল। এটা ঘন্টুর আদর করার ভঙ্গি। ভাবটা এমন, কতক্ষণ দেখিনি! পারমিতা আজ একটু ব্যস্ত হয়েই ঘন্টুকে ছাড়াতে চাইল।
– আচ্ছা, আচ্ছা, আদর হবে’খন, এখন ছাড় দিকি, কাজ আছে একটু।
ততক্ষণে ঘন্টুর নজর গেছে পারমিতার কোলের দিকে। উৎসাহে দু’পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল। থাবা দিয়ে বেড়ালটাকে ধরতে চায়। “ঘন্টুউউউউ…” পারমিতা চোখ পাকাল…
– খবদ্দার তুমি একে কামড়াবে না বলে দিচ্ছি। সর বলছি, সরে যাও!”
ধমক খেয়ে ঘন্টুর উৎসাহে জল পড়েছে, সরে গেছে একটু, লেজ নাড়ছে। রঙ্গমঞ্চে এবার কাকলি উদয় হলেন। পারমিতার মা।
– হ্যাঁরে, হরি কী বলছে, তুই নাকি.. ওমা এ কী? এ যে বেড়ালছানা! বিদায় কর, বিদায় কর, এক্ষুণি বাইরে রেখে আয়। নোংরায় বাড়িতে নরক হবে, খাবারে মুখ দেবে, ডিপথেরিয়া হবে সবার…
– মাআআআআ…
কাকলি থমকে গেলেন। রেলগাড়িতে চেন টেনেছে পারমিতা। মেয়ের গলার এ আওয়াজ তিনি চেনেন। ছোট্ট থেকেই জেদী। বেড়ালছানাটার মনে হচ্ছে এ বাড়িতেই পাকাপাকি বসত হবে। সেই ফাঁকে পারমিতা বেজে উঠল,
– মা ওর গলায় একেবারে নিখুঁত সুর গো, কী মোলায়েম সুরে ডাক দিল আমায়!
– অ্যাঁ? কাকলি থৈ পান না।
– ঘন্টুকে কম চেষ্টা করেছি? আদর করে মাংসভাত খাইয়ে, গলায় হাত বুলিয়ে বলেছি, ‘বল সা’। ওর গলা দিয়ে কোনওদিন ঘেউ ছাড়া অন্য কিছু বেরিয়েছে? এক্কেবারে বেসুর বেতাল!
– তা ঘন্টুর গান গাওয়ার দরকারটাই বা কী?
এবার বাবা রঞ্জন আসরে নামলেন। ঘন্টু তাঁর প্রাণ। তাকে যা তা কিছু একটা বলে দিলেই হল?
– বাহ্, টিপুর কথা শোনোনি? আব্দুল করিম খাঁর কুকুর? ওস্তাদের সা-এর সঙ্গে সা মেলাত? পারমিতা উদ্দীপ্ত। রঞ্জন দিশাহারা। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের জগতে তাঁর খুব একটা বিচরণ নেই। পারমিতার গানের গোড়াপত্তন তার মায়ের হাতে। প্রধান পৃষ্ঠপোষক ঠাম্মা। নিজে ভাল গাইতেন, গান নিয়ে প্রচুর পড়াশুনো। ছেলেকে, মানে রঞ্জনকে চেষ্টা করেছিলেন সুর চেনাতে, হয়নি। আসলের থেকে এখন সুদ বেশি মিষ্টি হয়েছে। পারমিতার গানের একনম্বর ভক্ত আর সমালোচক তার ঠাম্মা।
– আচ্ছা, সে গল্প হবে’খন। কাকলি এবার মধ্যস্থ হন।
– তুই যা, মাথাটাথা মুছে নে, ওকে দে হরির কাছে, দুধ খাক একটু।
– ওর নাম মন্টু। মন্টু বলে ডেকো সবাই, কেমন? পারমিতার ঘোষণা।
হরি গজগজ করতে করতে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই ধূমকেতুর মত উদয় হয় ঘন্টু। তাগড়াই অ্যালসেশিয়ান। বোসবাড়িতে তার সাংঘাতিক আদর। গোটা বাড়ির দৈনন্দিন রুটিন ঘন্টুকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। ঘন্টু কখন খাবে, কখন খেলবে, কখন বেড়াতে যাবে, কখন টিভি দেখবে, তাই নিয়েই বাড়ির লোক ব্যস্ত থাকে।
অতঃপর বোসবাড়িতে মন্টুর আসন কায়েম হল। হরির সাহায্যে বাড়ির এক কোণে সুন্দর বিছানা পাতা হল। ক্যাটস কর্নার। ঠাম্মার আলমারি থেকে লেস দেওয়া টেবিলঢাকা এনে বেডকভার হল। ঠাম্মা একটু গাঁইগুঁই করছিলেন। পারমিতা তাঁকে বোঝাল, আগে মন্টুকে মানুষ করে তুলতে হবে, তার বিড়াল-সত্বার ওপর মনুষ্যত্ব আরোপ করতে হবে, ঠিক যেমনটি ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ করেছিলেন তাঁর কুকুর টিপুর সঙ্গে। তবেই তো তাকে গানের তালিম দেওয়া যাবে! ওস্তাদের নাম শুনে ঠাম্মা আর দ্বিরুক্তি না করে টেবিলঢাকা বার করে দিলেন। পারমিতা মন্টুকে শাসাল।
– খবরদার যেন বিছানায় হিসি কোরও না, ওসব অসভ্যতা আমি পছন্দ করিনে।
মন্টু বলল, “মিউ।” আহা, কী মিষ্টি সুর!
ঘন্টু একটু দূর থেকে গোটা ব্যাপারটা দেখে যাচ্ছে। এবাড়ির সবার অখণ্ড মনোযোগ এতদিন তারই অধিকারে ছিল। এই পুঁচকে বেড়ালছানাটা সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে। তার পছন্দ হবার কথা নয়। একবার চান্স পেলেই খপ করে ধরবে ওটাকে। কিন্তু পারমিতার কড়া নজর। সুবিধে হচ্ছে না। মন্টুকে মানুষ করে তোলার পদ্ধতি এদিকে পুরোদমে চালু।
মন্টু কোনও কাঁচা জিনিস খায় না। বাজার থেকে তার জন্যে আলাদা করে নাড়িভুঁড়ি এনে জলে ফোটানো হয়। স্যুপ খায় মন্টু। পাতলা করে মাছের ঝোল দেওয়া হয়। বেশি তেলমশলা খাওয়া বারণ। গলা খারাপ হয়ে যেতে পারে। মন্টুও আস্তে আস্তে তার বিড়ালত্ব থেকে সরে আসছে। সেদিন হরি মাছের কাঁটা নিয়ে প্লেটে সাজিয়ে সামনে ধরল। মন্টু অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নিল। হরি মুখ বেঁকাল।
– ইঃ, বেড়াল বলে মাছ খাব না, আঁশ ছোঁব না, কাশী যাব!
বলেই দু’চারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নিল। পারমিতা শুনতে পেলে তাকে আস্ত রাখবে না। কারণ তালিম চলছে পুরোদমে। তানপুরাটি নিয়ে পারমিতা রেওয়াজে বসে। পাশে মন্টু। রেওয়াজ শুনতে শুনতে কান তৈরি হবে। সাধনার প্রথম ধাপ। গানের ঘরে কারও প্রবেশের অনুমতি নেই। একমাত্র ঠাম্মা ছাড়া। সেদিন ঠাম্মা ঘরে ঢুকে দেখলেন মন্টু ঘুমোচ্ছে। পারমিতা বিভোর হয়ে গাইছে শুদ্ধকল্যাণ। মন্টু তার দুই থাবায় মুখ গুঁজে গভীর ঘুমে অচেতন।
– ওরে ও রুমি, মন্টু যে ঘুমুচ্ছে!
– অ্যাঁ? ওহ, একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বোধহয় ঠাম্মা। সোজা পরিশ্রম তো করছে না? শুনবে একটু?
– কী শুনব?
– কেমন সা লাগাচ্ছে? এখনও অবশ্য অনেক বাকি, তবু মন্দ এগচ্ছে না।
– শোনা দেখি? ঠাম্মা উৎসাহিত।
আরও পড়ুন: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প: মাইনে
গুটিগুটি ঘন্টু ঢুকেছে গানের ঘরে। চুপটি করে বসেছে ঠাম্মার পায়ের কাছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পারমিতা আর মন্টুর দিকে।
– মন্টুর গানের স্কেলটা ঠিক করতেই কত দিন গেল। বেড়াল তো, ভাবলাম চড়ায় ধরি, সি শার্প। দেখলাম সুবিধে করতে পারছে না।
– আহা সে তো ঠিকই, প্রথমবার গাইছে, ওকে একটু নিচের স্কেলে দে, আস্তে আস্তে চড়ায় উঠবে’খন।
– মন্টু? ওঠ তো বাবা, এই দ্যাখ, ঠাম্মা এসেছে তোর গান শুনতে। পারমিতা আদর করে ডাকে। মন্টুর ঘুম আগেই ভেঙেছে, কথাবার্তা শুনে। ছোট্ট করে হাই তুলল সে। এ শার্পে সুর ছাড়ল পারমিতা, “সাআআআআ…”। মন্টু বলল, “ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা…”! ঠাম্মা চমৎকৃত।
– এ তো সত্যিই গাইছে রে! শুধু সুরের পর্দাটা মেলাতে পারছে না। আবার গাওয়া দেখি?
আবার সুর ছাড়ল পারমিতা, “সাআআআআ…”
মন্টুও তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, “ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা…”
– লেগে থাক রুমি। মন্টুর হবে। ওর গানের গলা আছে।
ঘন্টুকে একটু আদর করে দিয়ে ঠাম্মা উঠে পড়লেন। পারমিতা আহলাদে আটখানা।
– কেমন একখানি বেড়াল পেয়েছি বল?
ঘন্টু চেয়ে আছে ফ্যালফ্যাল। দু’দিনের বেড়াল এত আপন হল? শুধু গান গাইতে পারে বলে?
***
দিন যায়, মাস যায়। ঘন্টু পায়ে পায়ে ঘোরে। এখন আর মন্টুকে দেখলেই তাড়া করে না। বরং মুখ তুলে অবোধ্য আওয়াজে কী যেন বলতে চায়। মন্টুর জন্যে নিত্যিনতুন সাজসজ্জা আসে। সেদিন গলায় বাঁধার নতুন সিল্কের রুমালটা দেখে ঘন্টু এসে পায়ের ওপর মাথা ঘষল। তার গলার বকলসটা বহুদিনের পুরনো। পারমিতার সেদিকে নজরই নেই। তার মনখারাপ। মন্টুর সাধনা চলছে কিন্তু সুরের পর্দায় ঠিক লাগছে না। সা মিলছে না কিছুতেই। ঘন্টুকে তাড়া দেয়…
– সর দেখি একটু, সারাক্ষণ গায়ে পড়া ভাল্লাগে না।
লেজ নিচু করে ঘন্টু আস্তে আস্তে অন্যদিকে যায়।
একদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার পর পারমিতা হানা দিল ঠাম্মার ঘরে। ঠাম্মা তখন বই পড়ছেন। ভারতীয় সঙ্গীতের এনসাইক্লোপিডিয়া। পারমিতাকে দেখে তাকালেন।
– আয়। এই দ্যাখ, আবদুল করিম খাঁ সাহেবের কুকুরের কথাই পড়ছিলাম। অক্সফোর্ড লিখেছে, গানের অনুষ্ঠানের হ্যান্ডবিল ছাপা হত ‘টিপু’র নাম দিয়ে।
– বাব্বা, তাই নাকি গো?
– খাঁ সাহেবের সঙ্গে সুর মিলিয়ে টিপু সুর তুলতো ‘উউউউ’ বলে।
– আর আমার অবস্থা দেখো, মন্টু এখনো সা-তেই মেলাতে পারল না!” পারমিতার দুঃখ চাগাড় দিয়ে ওঠে।
– সে কী রে? এখনো পারছে না? সেদিন তো দেখে এলাম চেষ্টা করছে, এখনও হল না?
– নাহ। পারমিতা উদাস।
ঠাম্মা এবার বইটা মুড়ে রেখে উঠে বসেছেন।
– তুই ওকে ঠিক কী গাইতে বলছিস বল তো?
– কেন? সা?
– আর ও বলছে ‘ম্যা’, তাই তো?
– হ্যাঁ, ও তো ম্যা-ই বলবে, বেড়াল তো!
– ওইখানেই গন্ডগোল। তুই ওকে সুর দে ‘ম্যা’ কথাটা দিয়ে। দেখ তো মেলাতে পারে কিনা?
– ইউরেকা! পারমিতার মাথায় বিদ্যুৎচমক।
– এটা তো দারুণ বললে ঠাম্মা, এক্ষুণি যাই, দেখি চেষ্টা করে!”
মন্টু কোনও কাঁচা জিনিস খায় না। বাজার থেকে তার জন্যে আলাদা করে নাড়িভুঁড়ি এনে জলে ফোটানো হয়। স্যুপ খায় মন্টু। পাতলা করে মাছের ঝোল দেওয়া হয়। বেশি তেলমশলা খাওয়া বারণ। গলা খারাপ হয়ে যেতে পারে। মন্টুও আস্তে আস্তে তার বিড়ালত্ব থেকে সরে আসছে।
পারমিতার আর তর সয় না। কিন্তু মন্টু ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক সাধ্যসাধনার পর সে পাশ ফিরে শুল। ভাবটা, বিরক্ত কোরও না তো? ঘন্টু দূর থেকে দেখছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে পারমিতাকে চেটে দিল। যেন বলতে চায়,
– আমায় একটু ‘সা’ বলাও না গো?
পারমিতার মায়া হয়। আদর করে বলে,
– তোকে নিয়ে তো অনেক চেষ্টা করেছি ঘন্টু। সবার কি আর সব জিনিস হয়? তোরও গানটা হবে না। যাগগে, বাদ দে।
পরদিন রেওয়াজে বসল পারমিতা। পাশে মন্টু। ‘সা’-এর বদলে আজ ‘ম্যা’ দিয়ে চেষ্টা করা হবে। মন্টুর গলা কি সুরে মিলবে? পরীক্ষা সফল হলে ইতিহাস সৃষ্টি হবে। তানপুরা ছেড়ে পারমিতা আদর করে বলল, – বলো তো মন্টু, ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা…
মন্টু থতিয়ে গেছে একটু। সা শুনে শুনে অভ্যস্ত সে, এমন ধরতাই কোনওদিন শোনেনি। চোখ পিটপিট করল দু’বার।
– ভয় কী? বলো, ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা…। পারমিতা আবার বলে। মন্টুর গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে, “ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা…” এক্কেবারে নিখুঁত সুর। পারমিতা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আবার সুর দেয়, “ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা…।” তৎক্ষণাৎ মন্টু সুর মিলিয়ে গেয়ে ওঠে “ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা…”
পারমিতা বিহ্বল, এ কী শুনছে সে? মন্টুকে জড়িয়ে ধরেছে। লাফাচ্ছে আনন্দে।
– মা, ঠাম্মা, বাবা, শুনে যাও, মন্টু সা বলছে!
মা ছাদবাগান থেকে মাটি মাখা হাতে দৌড়ে আসেন। পিছনে হরি। বাবা দাড়িকামানোর ক্রিম গালে লাগিয়ে, ঠাম্মা তাঁর বই হাতে করে এসে হাজির হন। সবার সংশয় ভঞ্জন করে পারমিতার সঙ্গে মন্টু গেয়ে ওঠে, “ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা…।”
প্রত্যেকের চোখ বিস্ময়ে গোল, এ তো নিখুঁত সা! শুধু রঞ্জনের খুব একটা হেলদোল নেই, মন্টু সা বললে তাঁর কিছুই যায় আসে না। ফিরে চললেন অর্ধসমাপ্ত দাড়িকামানোটা শেষ করতে।
আরও পড়ুন: মাহবুব ময়ুখ রিশাদের ছোটগল্প: বাঘ
বন্ধুবান্ধবদের কাছে সগৌরবে পারমিতা মন্টুর কৃতিত্বের গল্প শোনায়। তারা বিশ্বাস করে না।
– যাহ, বেড়াল আবার সুর লাগাচ্ছে? তুইও যেমন পাগলি!
পারমিতা তাদের বুঝিয়ে পারে না। ওদিকে মন্টুর তালিম ও রেওয়াজ চলছে পুরোদমে। কিছুদিনের মধ্যেই মন্টু “সা” শব্দের সঙ্গে সুর মেলাতে শুরু করল। আর তাকে “ম্যা” বলে সুরের ধরতাই দিতে হয় না। বাড়িশুদ্ধু লোক মন্টুর মহিমায় স্তব্ধ। এমনকী হরিও তাকে সসম্ভ্রমে ‘মন্টুবাবা’ বলে ডাকছে।
– মন্টুবাবা কি এখন স্যুপ খাবে?
– মন্টুবাবা’র পাউডার ফুরিয়ে গেচে, এনে দিও।
পুরো বোসবাড়ি এখন মন্টুকে ঘিরে আবর্তিত। ঘন্টুর পদচ্যুতি ঘটেছে। রঞ্জনের পায়ে মাথা ঘষে সে তার বেদনা জানায়। বোসবাড়িতে একমাত্র রঞ্জনই মন্টু-তে মুগ্ধ নন। নিখুঁত সা লাগিয়ে মন্টু আহামরি কিছু করেনি, ভাবেন তিনি। কিন্তু বন্ধুরা হাসছে, বিশ্বাস করছে না। তাদের অবিশ্বাস পারমিতার বুকে শেল হয়ে বিঁধছে। শেষমেশ কাকলিই বুদ্ধি দিলেন,
– ভিডিও কর দেখি? ভিডিও তুলে দে ফেসবুকে। তাহলে বিশ্বাস করতে আর পথ পাবে না।
***
পরদিন রবিবারের সকাল। বাবা গানের ঘরে ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে রেডি। মা, ঠাম্মাও হাসি হাসি মুখে উপস্থিত। মন্টু জগদ্বিখ্যাত হওয়ার পথে। ঠিক আব্দুল করিমের টিপুর মত। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকবেন তাঁরা। ঘন্টুও কৌতূহলী, সবার দেখাদেখি ভেতরে চলে এল। বসেছে পা ছড়িয়ে। কী বুঝছে সে-ই জানে। দরজার বাইরে হরিও উঁকি দিচ্ছে।
এ শার্পে তানপুরা ছাড়ল পারমিতা। সুরে ভরে যাচ্ছে সকাল। সব্বাই টেন্সড। শুধু মন্টুর কোনো হেলদোল নেই। নির্বিকার। কাকলি মন্তব্য করলেন, “বড় গাইয়ের লক্ষণ।”
এবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভিডিও ক্যামেরা চালু। পারমিতা সরগম করে সা-তে গিয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে মন্টু নিখুঁত সুরে গলা মেলায়, “ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা…”। একটুও ভুল হয় না। গর্বে, আনন্দে পারমিতা ছলছল করে। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ। ভিডিওতে ধরা থাকছে মহামুহূর্ত।
হঠাৎ এ কী? সাদা একটা বিদ্যুৎঝলক উড়ে গেল ঘরের কোণে। সঙ্গে সঙ্গে যেন বাজ পড়ল। মন্টু নেই। লাফ দিয়ে কিসের ওপর গিয়ে পড়েছে। পারমিতার তানপুরা সেই ধাক্কায় পপাত ধরণীতলে। তানপুরার লাউয়ের খোল ভেঙে চুরমার। ঘরের মানুষগুলো বোবা হয়ে গেছে। ওদিকে মন্টু দেওয়ালের সঙ্গে জম্পেশ করে ঠেসে ধরেছে ছোট্ট কালো একটি ইঁদুর। অসহায় লেজটি তিরতির করে নড়ছে। ভিডিও বরবাদ! হরির মুখেই প্রথম কথা যোগাল,
– দিদিমণি, তোমার তানপুরো? ই কী কাণ্ড!
পারমিতা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। ঘন্টু লেজ নাড়তে নাড়তে চলে এসেছে কাছে, চেটে দিচ্ছে পায়ের পাতা। মাথা ঘষতে ঘষতে বলছে, “উউউউ।”
এক্কেবারে সুরে!
সংগ্রামী ইঞ্জিনিয়ার, পেশায় কনসালট্যান্ট। শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে চর্চা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর এ গ্রেড শিল্পী। লেখালেখির অভ্যাসও ছোট্টবেলা থেকে, বাবা-মা'র উৎসাহে। বর্তমানে কর্মসূত্রে নিউ জার্সির পার্সিপেনি শহরে বসবাস। তবে বিদেশে বসেও সাহিত্যচর্চা চলে জোর কদমে। নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত 'অভিব্যক্তি' ও 'অবসর' পত্রিকার সম্পাদক। এছাড়া ‘উদ্ভাস’, ‘প্রবাসবন্ধু’, টেকটাচটক, ‘গুরুচণ্ডা৯’, 'ইত্যাদি ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখিকা।
One Response
ধন্যবাদ।