banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

গল্প: জানালা (প্রথম পর্ব)

ডঃ আনন্দ সেন

এপ্রিল ১৩, ২০২১

Bengali Love story
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

কণাদের ঘুমটা ভেঙে যায় একটা চেঁচামেচিতে। পরমা বেজায় ধমকাচ্ছে সবজিওলাকে, সে মাস্ক পরেনি বলে। সে একটু মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছিল– মা, মাস্ক পরলে বড় নিশ্বাসের কষ্ট হয়। আপনাদের বাড়িটা তিনতলায়, সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়, হাঁপ ধরে যায়। 

— তাহলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে পরবে। না পারলে আমাদের বাড়িতে এস না। 

কণাদ অনেকবার পরমাকে বলেছে, এত চিন্তার কিছু নেই। বাড়ির মধ্যে তো আর ঢুকছে না। 

— না, কিন্তু দরজায় আসছে। কাছাকাছি। আমার নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই, কিন্তু তুমি তো সবগুলো রিস্ক ফ্যাক্টরে দাগ দিয়ে বসে আছ। ওবিস, ডায়াবেটিক, হাঁপানির রুগি। 

কণাদ কোনওদিনই পরমার সঙ্গে তর্কে পেরে ওঠেনি। তিরিশ বছরের বিবাহিত জীবনে এই একটা সার সত্য উপলব্ধি করেছে, কোনওদিন পারবেও না। পাশের বাড়ির মুখার্জি গিন্নি চেঁচিয়ে ডাকছে — অভিনন্দন, অ্যাই অভিনন্দন। এদিকে আয়। কাপড় নামিয়ে দিচ্ছি।  

কণাদ বিছানা থেকে না উঠেও বুঝতে পারে অভিনন্দন ত্রস্ত পায়ে মুখার্জি গিন্নির বাড়ির দিকে এগচ্ছে। এরপর তিনতলার উপর থেকে দড়ির লিফ্‌টে চেপে এক ব্যাগ কাপড় নীচে নেমে আসবে। সেই ব্যাগ চলে যাবে ইস্ত্রিওয়ালা বাবার ইস্ত্রি গাড়িতে। অভিনন্দন ফোন থেকে অনলাইন হয়ে দেখে নেবে তার ক্লাসের পড়াটা। সকালে উঠেই পরমা জানলাটা খুলে দেয় আর জানলার বাইরে থেকে একটা চলমান জীবনের শব্দ কণাদের কানে এসে আছড়ে পড়ে। এই শব্দে আরাম হয় কণাদের। মনে হয় সে বেঁচে আছে।

— এখনও শুয়ে আছ? উঠে পড়। একটু পরেই তিন্নির ফোন আসবে। পরমা আলমারি থেকে টাকা বার করার জন্য ঘরে আসে। 

আজ শনিবার। মনে পড়ে যায় কণাদের। মনটা এবার একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আজ রাত্রে জুম কল। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে। প্রস্তাবটা সত্যজিৎ দিয়েছিল ওদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। গ্রুপটা তৈরি হয়েছিল একটু অদ্ভুতভাবে, বাণীব্রত মারা যাবার পর। বাণীর কঞ্জেনিটাল হার্ট ডিজ়িজ় ছিল, খুব সাবধানে থাকত।  

– আমার বেশি কাছে আসিস না। যে কোনও সময় ফেটে যেতে পারি। বলে যাত্রার খলনায়কের মত হাসত বাণী। মজাই করেছে সারাজীবন। লেগপুল করত সবার। হয়তো এই মজাটাই ওকে সুস্থ রাখত। তাই পয়লা এপ্রিল সকালে যখন ওর মারা যাবার খবরটা এল, সবাই সেটাকে এপ্রিল ফুলের ঠাট্টাই ধরে নিয়েছিল প্রথমে। ঘুমের মধ্যে ম্যাসিভ অ্যাটাক।  

শ্মশানে গিয়েছিল কণাদ। পুরো কলেজের রিইউনিয়ন, বেশিরভাগ মুখগুলোকে দেখেনি গত তিরিশ বছর। ভাঁজ পড়ে গেছে মুখগুলোতে, পুরনো সেই মুখগুলোতে হারজিত খুঁজেছিল কণাদ, পায়নি। শুধুই ক্লান্তি পেয়েছে। সবগুলো চোখ প্রাণপণে অতীত হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কণাদের চোখ পড়ে ফুল চন্দনে সাজানো বাণীর মুখটার দিকে। তার চোখ দুটো বোজা হলেও মুখের হাসিটা নির্ভুল। 

 

আরও পড়ুন: মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প: কোভিড

– কি বে শালা, এর পরের নম্বরটা কার বল্‌ দেখি? 

সত্যজিৎ ফোন করল কিছুদিন পরে। 

– বাণীর চলে যাওয়াটা অনেকের কাছেই খুব শকিং। আমরা পুরনো বন্ধুরা নিজেদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি। বর্তমানের সঙ্গে এত বেশি জড়িয়ে গেছি যে, অতীত আর মনে পড়ে না। একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপ খোলা হবে কথাবার্তার জন্য। ইন্টারেস্টেড? 

ভালই লাগত কণাদের। রাজনৈতিক আলোচনা থেকে শুরু করে খেলার খবর, সাহিত্য, ফাজলামো সবই চলত। একটু আধটু আদিরসাত্মক জোকের আদানপ্রদানও যে চলত না, তা নয়। মোট কথা, বেশ কলেজ কলেজ একটা আমেজ চলে এল এই আড্ডার আসরে।  

কণাদ বিছানা থেকে না উঠেও বুঝতে পারে অভিনন্দন ত্রস্ত পায়ে মুখার্জি গিন্নির বাড়ির দিকে এগচ্ছে। এরপর তিনতলার উপর থেকে দড়ির লিফ্‌টে চেপে এক ব্যাগ কাপড় নীচে নেমে আসবে। সেই ব্যাগ চলে যাবে ইস্ত্রিওয়ালা বাবার ইস্ত্রি গাড়িতে।  

সে সব বছর পাঁচেক আগের কথা। প্রথম দেখার চমক কাটলে সব কিছুই একটা অভ্যেসের মতো হয়ে যায়। নতুন প্রেমের উত্তেজনাও স্তিমিত হয়ে আসে। কণাদেরও তাই হল। কখন নিজের অজান্তেই নির্বাক দর্শক হয়ে গেল ও। রোজ বার দুয়েক যায় গ্রুপটাতে। বন্ধুদের ফরোয়ার্ডগুলো পড়ে নেয় একটু। বেশ কিছু কারেন্ট খবর জানা হয়ে যায়। কিন্তু কোনও মন্তব্য করে না। বন্ধুদের ছুঁয়ে থাকে, কিন্তু ঘরে ঢোকে না। 

এমনভাবে তরঙ্গহীন নদীর জলে ভাসতে ভাসতে বুড়ো থেকে বুড়োতর হচ্ছিল কণাদ আর তার বন্ধুরা। তারপর পৃথিবীটা পালটে গেল। পালটে দিল একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরজীবী ভাইরাস। প্রথমে কিছুটা উত্তেজনা, তারপর অবিশ্বাস, ভয়, তারপর  বিরক্তি, তারপর মেনে নেওয়া। গত ছ’মাস ধরে সারা পৃথিবী একসূত্রে গেঁথে গেছে। ছেলে, মেয়ে, ধনী, গরিব, তরুণ, বয়স্ক সবাই। কাছে আসার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হল, এক মানুষ থেকে আর এক মানুষের দূরত্ব বেঁধে দেওয়া হল। বন্ধ হয়ে যেতে লাগল ঘরের দরজাগুলো। বন্দি হল মানুষ। সারা পৃথিবীর আকাশে দৈব নির্ঘোষের মত একই শব্দ ধ্বনিত হল–  লকডাউন।

সত্যজিৎ ফোন করল একদিন। 

– অনেকে চাইছে দেখা করতে।
– এখন, এই সময়ে?
– হ্যাঁ, এটাই তো সময়, মুখোমুখি বসার, মনের কথা বলার।
– কিন্তু সেটা সম্ভব কী করে?
– কম্প্যুটার আছে না তোর বাড়িতে? জুম ডাউনলোড করে নে। আর দরকার হলে বাড়ির ওয়াই-ফাই কানেকশানটা একটু জোরদার কর।
– কিন্তু…
– শনিবার রাত দশটায়, ইউএসএ আর ইউকে থেকেও দু’ চারজন জয়েন করবে। 

সত্যজিৎ ছেড়ে দেয় বিভ্রান্ত কণাদকে ফোনের এপারে রেখে। ব্যাপারটা বুঝতে সময় লেগেছিল খানিকটা, তারপর এটাও অন্য অনেককিছুর মতোই স্বাভাবিক হয়ে গেল। 

– চিন্তার কিছু নেই বাবা, আমি তোমাকে সেট আপ করতে হেল্প করে দেব। এখানে আমরা সবাই এখন জুম ইউস করছি। খুব সোজা। 

তিন্নি, তার বস্টনে থাকা মেয়ে। বাবা, মা দুজনেরই জুম অ্যাকাউন্ট খুলে দিল। এখন তার সঙ্গেও সেখানেই কথা হয়। শুধু কথা নয়, চোখের দেখাটাও হয়ে যায়, নাতিকেও দেখতে পায়, যাদের দেখার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকত কণাদ আর পরমা। এখন দেখে, প্রায় প্রতি সপ্তাহে। চোখ দিয়ে স্পর্শ করে তাদের শরীরের ওম। 

 

আরও পড়ুন: ইন্দ্রাণী দত্তের ছোটগল্প: রথ্সচাইল্ডের জিরাফ

প্রথমদিন জুমে এসেছিল জনা দশেক। তাদের টাক মাথা, কলপ দেওয়া চুল, ভারী চশমা, আর হাল্কা মেক আপ। তারপর লোক একটু বাড়ল। সবাই যে রোজ আসতে পারে, তা নয়। কিন্তু তাদের সাপ্তাহিক আসরে লোকসমাগম ভালই হতে লাগল।
– শনিবার হলেই তোমার মেজাজটা দেখি ফুরফুরে হয়ে যায়। অনেকটা সময় নিয়ে চান করো, সারাদিন গুনগুন করে সুর ভাঁজছ, বই পড়ছ, কী সব যেন লেখও। নতুন করে প্রেমে পড়লে নাকি? 

পরমা ঠাট্টা করে। পরমা জানে। জানে এটা কণাদের জানলা। পরমার নিজেরও একটা জানলা হয়েছে এমন, স্কুলের বন্ধুদের। পরমা মনে মনে খুশিই হয়। আর্লি রিটায়ারমেন্টের পর থেকেই গুটিয়ে গিয়েছে কণাদ।
– ওঁর একটু মাইল্ড ডিপ্রেশন হয়েছে। কিছুদিন থেরাপিতে থাকলে ভাল হবে। বলেছিল ডাক্তার।
– না না ওসব কিছুর দরকার নেই। এসব পয়সা মারার ধান্দা ডাক্তারদের। আমি ঠিক আছি।
ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল কণাদ। কিন্তু পরমা দেখতে পায় একটা অবসাদ ধীরে ধীরে ঘিরে ধরছে কণাদকে। কথা কমে গেছে, হাসিও। আগে কণাদ মুহূর্মুহূ পরমার শরীর চাইত। বিছানায় ধামসাধামসি করত।

ভালই লাগত কণাদের। রাজনৈতিক আলোচনা থেকে শুরু করে খেলার খবর, সাহিত্য, ফাজলামো সবই চলত। একটু আধটু আদিরসাত্মক জোকের আদানপ্রদানও যে চলত না, তা নয়। মোট কথা, বেশ কলেজ কলেজ একটা আমেজ চলে এল এই আড্ডার আসরে।

– বুড়ো বয়েসে ভীমরতি। নাতি হয়ে গেছে, খেয়াল আছে?
– বুড়ো হলে কি প্রেম মরে যায়? তোমার কাছেই তো চাইছি।
– এটা প্রেম না কাম? আর জান না, অনেকদিন একসঙ্গে থাকলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভাইবোনের মতো হয়ে যায়?
– কোথায় শরীরের চাহিদার সীমারেখা শেষ হয়ে মনের চাহিদার পৃথিবীটা শুরু হয় এটা আমার ঠিক জানা নেই। জানা নেই শারীরিক ইচ্ছের এক্সপায়ারি ডেটটাও। আমার মাথার মধ্যে সবই মিলেমিশে গেছে। তোমাকে আমি চাই, আমার সবটুকু দিয়ে। 

এ সবই আগের কথা। এখন একটা ছোট খাটের দু’দিকে দু’জন শুয়ে থাকে মাঝে এক ক্রোশ দূরত্ব নিয়ে। খাট বড় হয় না, কিন্তু দূরত্ব বাড়তেই থাকে। বাড়তে বাড়তে একদিন দু’জন দু’টো ঘরে নিজেদের একাকীত্ব বেছে নেয়। মেয়ে তখন বস্টনে চলে গেছে। 

– তোমার নাক ডাকার শব্দে আমার ঘুম হয় না। এখন আমার ঘুম পাতলা হয়ে গেছে অনেক। আমি তিন্নির ঘরে শোব এখন থেকে।
পরমা ফরমান জারি করেছিল। কণাদ কিছু বলেনি। পরমা ভেবেছিল এই লকডাউন আরও ডিপ্রেসড করে দেবে কণাদকে, সেই সময় একদম অপ্রত্যাশিতভাবে এসে গেল এই ভার্চুয়াল আড্ডার জগৎ। জানলার পাল্লাটা খুলে বাইরের বাতাস ঘরে আসতে দিল কণাদ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পরমা। 

– এই জায়গাটা কোথায় রাজ? কোথা থেকে কথা বলছিস আজ? কণাদ একদিন জিজ্ঞেস করে রাজকে। রাজের মাথার পিছনে তুঁতে রঙের জল। পাশের শ্বেতশুভ্র গম্বুজের মাথার নীল মিশে যাচ্ছে জল আর  আকাশের সঙ্গে।
– সান্তোরিনি। 

সান্তোরিনি, একটা অনুরণন কণাদের মাথার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ডায়াবিটিস, আমেরিকার কোভিড, দেশের রাজনীতির গল্প কানে ঢোকে না তার। চোখ কম্প্যুটারের স্ক্রিন ভেদ করে চলে যায় মেডিটেরেনিয়ানের ধারে, যেখানে সাদা বালি আর নীল জল যুগলবন্দি খেলে, যেখানে ডোবার আগে সূর্য পাহাড়কে সাজায়, যেখানে ছোট্ট গ্রামে অলস পায়ে হেঁটে যায় সময়। এসব সে পরে পড়েছিল গুগল সার্চ করে। রাজ তার জুম ব্যাকগ্রাউন্ড প্রতি সপ্তাহে পালটায়। কখনও প্যারিস, কখনও গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, কখনও বা ব্রাজিলের ইগুয়াসু ফলস্‌। কণাদ ঘুরতে থাকে সেইসব জায়গায়।

আরও পড়ুন: ডাঃ রূপক বর্ধন রায়ের ইতিহাসের পাতায় ভ্রমণ: ড্রেসডেনের ডায়রি

মিটিংয়ের আগে ফোন করে রাজকে।

– আজ কোথায় যাবি রে?
– কিছু ঠিক করিনি। কেন? 
– না এমনি। আজ একটু আমাজন চল্‌ না।
– আমাজন? হঠাৎ?
– এমনি। দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি জানি না কী করে করতে হয়।
– আচ্ছা দেখছি। 

কথা রেখেছিল রাজ। সেদিন অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়িয়েছিল জঙ্গলে। দুটো ম্যাকাও, কিছু রেড হাউলার, ট্যারান্টুলা আর একটা গ্রিন অ্যানাকোন্ডার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আর বুক ভরে শুষে নিয়েছিল রেনফরেস্টের সোঁদা গন্ধ, যে গন্ধটায় তার ছোটবেলার বৃষ্টিভেজা মাঠের ছোঁয়া। আস্তে আস্তে ভরে যাচ্ছিল কণাদ, মুখিয়ে থাকত সারা সপ্তাহ শনিবারের জন্য। বাকি দিনগুলো সব কাটবার অপেক্ষা, একবগগা ঘোড়ার মত সময় শুধু শনিবারের দিকে এগিয়ে চলে। 

এক শনিবার সকালে সত্যজিতের মেসেজ এল। ভুল দেখছে না তো? না বেশ পরিষ্কার ভাবেই তো লেখা।

– দেরি করিস না। আজ দামু আসছে। 

দামু। দময়ন্তী মিত্র। কলেজের সবথেকে উজ্জ্বল, ছটফটে ছাত্রী। যেমন ভাল পড়াশুনোয়, তেমন তুখোড় ডিবেট, আবৃত্তি, অভিনয়ে। বস্তুতঃ দময়ন্তী আসার পর থেকে সারা কলকাতার কলেজ ফেস্টগুলো থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি প্রাইজ আসতে থাকে। দময়ন্তীকে ছেলে বা মেয়ে বলে লেবেল করাটা ভুল হবে। সে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে খিস্তি খেউড় করতে করতে সিগারেটও ফুঁকত, আবার সরস্বতী পুজোয় হলুদ শাড়ি পরে আলপনাও দিত। কলেজের দরোয়ানের মেয়ের থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার জন্য টাকা তুলত। দময়ন্তী ডানাকাটা পরি নয়, কিন্তু মুখটায় কিছু আছে, যেদিকে একবার তাকিয়ে দেখার পর আবার ফিরে তাকাতেই হয়। দময়ন্তী একটা দমকা হাওয়া। তাতে নেশা আছে, একটা দুর্দমনীয় আবেশ আছে।  

একটা অনুরণন কণাদের মাথার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ডায়াবিটিস, আমেরিকার কোভিড, দেশের রাজনীতির গল্প কানে ঢোকে না তার। চোখ কম্প্যুটারের স্ক্রিন ভেদ করে চলে যায় মেডিটেরেনিয়ানের ধারে, যেখানে সাদা বালি আর নীল জল যুগলবন্দি খেলে, যেখানে ছোট্ট গ্রামে অলস পায়ে হেঁটে যায় সময়।

কণাদ জানত দময়ন্তী তার কাছে জানলা দিয়ে দেখা দূর আকাশের পাখির মতো। দময়ন্তী যা পারে, তার কিছুই সে পারে না। তাই দূর থেকে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছু করার তার মুরোদ নেই, কথা বলা তো দূরস্থান। তাই দময়ন্তী ক্যান্টিনে তার উল্টোদিকে বসে সোজা তার দিকে চেয়ে যখন নিজেকে ইন্ট্রোডিউস করল, তখন কণাদ ভাবছে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে নিশ্চয়।

– হাই, আমি দামু। সেকেন্ড ইয়ার। সেম ব্যাচ। 
– হা-হাই। কণাদ তোতলায়।
– তুই তো কণাদ। কণাদ চুপ করে থাকে।
– শুনেছি তুই খুব ভাল কবিতা লিখিস? দু’ চারটে কবিতা শোনা তো। আমি এবার কলেজ ম্যাগাজিনের এডিটর। ভাল লাগলে ছাপব।
– কবিতা? কণাদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। হ্যাঁ, সে লেখে একটু আধটু ঠিকই, বন্ধুরা প্রশংসাও করে। কিন্তু তার লেখার পরীক্ষা এখন এভাবে দিতে হবে, ভাবেনি।
– কেন? আমি বুঝব না?
– না না তা নয়, কিন্তু আমার কাছে এখন তো…
– ওহহ্‌, আমার ধারণা ছিল সব কবির কাছেই নিবারণ চক্কোত্তির খাতা থাকে। ঠিক আছে কালকে নিয়ে আসিস। দময়ন্তী উঠে পড়ে।
– দাঁড়াও, দাঁড়া। মেয়েদের সামনে মাথা নিচু করে থাকা কণাদ সেদিন কোথা থেকে আশ্চর্যভাবে সাহস যুগিয়ে ফেলে।
– ইকনমিক্সের খাতার পিছনের পাতায় কাল কয়েক লাইন লিখেছিলাম। খুব র, কিন্তু আছে।
– এই তো, জানতাম। শোনা। 

আকাশ দেখা জানলা ঢেকে যখন তুমি ঠিক দাঁড়াবে
তখন তোমার ঠোঁটের তিলে আলগোছে মেঘ গল্প হবে
তোমার শাড়ির নীলের ভাঁজে, সন্ধ্যে নামার একটু আগে
মনভাসি রঙ থাকবে লেগে সুরের সাথে ইমন রাগে
সারাটা রাত ফিসফিসিয়ে গাছের পাতা বলবে কথা
মুঠো মুঠো তারার নিচে বারান্দাতে চেয়ার পাতা
কলম আবার উঠবে জেগে, খাতার বুকে ফুটবে আঁচড়
পাথর ফেটে ঝরনা আবার মাটির পায়ে রাখবে আদর
পথ চেয়ে তাই বসেই আছি কখন তুমি আসবে বলে
তোমার সাথে রাত কাটাব কালকে আবার বৃষ্টি হলে।

 

আরও পড়ুন: অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প: একটা দিকচক্রবাল আর কয়েক টুকরো সূর্যাস্ত

ওদিক থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে কণাদ দেখে চোখ বুজে আছে দময়ন্তী, মুখটায় অদ্ভুত অভিব্যক্তি, যেন স্বপ্ন দেখছে। আস্তে আস্তে চোখ খোলে। চোখের কোণায় কিছু কি টলটল করছে? মুহূর্তে সামলে নেয় নিজেকে দময়ন্তী।

– জয়ের চুরি। ছন্দ, ভাব সবটা। যাকগে, আমাদের ম্যাগাজিনের জন্য চলবে। নিয়ে আসিস কাল কয়েকটা। কণাদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে যায় দময়ন্তী। ফিরে আসে এক সপ্তাহ পরে।
– কাল বিকেল পাঁচটায় রাদুবাবুর দোকানে আয়, কবিতার খাতা নিয়ে।
– তুই কবিতা না লিখলে তোর সঙ্গে আমার প্রেম হত না। কণাদকে পরে বলেছিল দময়ন্তী।

দময়ন্তীকে ছেলে বা মেয়ে বলে লেবেল করাটা ভুল হবে। সে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে খিস্তি খেউড় করতে করতে সিগারেটও ফুঁকত, আবার সরস্বতী পুজোয় হলুদ শাড়ি পরে আলপনাও দিত। কলেজের দরোয়ানের মেয়ের থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার জন্য টাকা তুলত।  

কথাটা শুনতে যেমনই লাগুক, এটা যে সত্যি, সে কথা কণাদ জানে। কণাদের সঙ্গে কোনও মিল নেই, না চরিত্রে, না পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডে। কণাদ খুব কনজ়ারভেটিভ বাড়ির ছেলে। ঠাকুরদেবতা, নানা ধরনের রীতিনীতি, রেওয়াজ মেনে তার বেড়ে ওঠা।  উত্তর কলকাতায় মানুষ, শরীকি বাড়িতে বড় হয়েছে, জয়েন্ট ফ্যামিলিতে, যদিও তার গ্রন্থিটা আলগা। প্রেম তো দূরস্থান, তাদের বাড়িতে পালটি ঘর ছাড়া সম্বন্ধ আসেনি কোনওদিন।

শিক্ষিত পরিবার, কিন্তু শিক্ষাটা চিরকাল ভাল চাকরি পাবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার হতে দেখেছে কণাদ। সে নিজে পড়াশুনোয় খারাপ নয়, কিন্তু সোজা পথের বাইরে অন্য কিছু করবার ইচ্ছা কখনও তার বা তার বাড়ির লোকেদের মাথায় আসেনি। এক, সে কুঁড়ে বলে। আর কিছুটা তার কোনও চাপা প্রতিভা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পায়নি বলে। কবিতাটা তার হঠাৎ আবিষ্কার। এটা একদম নিজের ব্যাপার, চালিয়ে যাওয়া সোজা, বিশেষত কোনও অ্যাম্বিশন না থাকলে।

দময়ন্তীর বাবা কোন এক মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির সিইও। মা অভিনেত্রী, থিয়েটার আর ছোট পরদায় মূলত, দু’ একটা সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। খুব ভাল লাগত ওঁকে কণাদের। মনে হত কিছু কিছু মানুষ আছে যারা আলেকজান্ডারের মতো তলোয়ার নিয়ে নিজের হাতের রেখা তৈরি করে, উনি তেমন।
– লোকে কী চাইছে তোমার কাছ থেকে, তোমার বন্ধু, তোমার পরিবার– সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল তুমি কী চাইছ। বলতেন দময়ন্তীর মা। ‘দামুর একটা অটো ইমিউন ডিজ়অর্ডার আছে। আমি কোনওদিন চাইনি সেই রোগটার কাছে ও হেরে যায়। জীবন একটাই। কিন্তু তার জন্য আমি ওকে কখনও কিছু করতে বাধ্য করিনি। ও যা করে, নিজের ইচ্ছেতে করে।’ 

দময়ন্তীর বাড়িটা ঘুরে দেখতে দেখতে অবাক হয়ে গিয়েছিল কণাদ। চারিদিক খোলা বাড়ি, তাদের উত্তর কলকাতার গলির স্যাঁতসেঁতে বাড়ির কাছে এ বাড়ি মাঠ। কত বই সারা বাড়িতে, সাহিত্যের বই, নাটকের বই, বাম রাজনীতির বই। বইয়েরা আলমারি ছাপিয়ে জায়গা করে নিয়েছে সোফার উপর, বিছানায়, খাবার টেবিলে। আর একটা জিনিস লক্ষ করেছিল। কোনও ঠাকুরঘর নেই। 

দময়ন্তীর ভালবাসার জলোচ্ছাস কণাদকে ভাসিয়ে দিয়েছিল মাঝদরিয়ায়। কলেজের বন্ধুরা অবাক হয়েছিল এই অসম জুড়িকে দেখে। কিন্তু তারা গ্রাহ্য করেনি। তার প্রাণশক্তিতে কণাদ শুনেছিল মুক্তির গান, তার আগুনের আঁচে পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল কণাদের সংস্কার। তখন প্রায় প্রতিদিন কবিতা লিখত কণাদ। লেকের ধারে বসে শোনাত। 

ভুলে গেছি শুরুর কথা, কোথায় ছিল বাস 
চোখে তোমার অতল দিঘি, চুলে শ্রাবণ মাস

শ্যামল আস্যে, কটির লাস্যে, ঘটাও সর্বনাশ
কখন দেখি মাঝদরিয়ায় নৌকো টলোমলো।

বাতাস শুধু জেনেছিল এমন কিছু ঘটবে
তুমি আমার নদী হলে গুজব কিছু রটবে

করবে সবাই কানাকানি, পাড়ার লোকে চটবে
এসব জেনেও ভেসে গেছি, কী করি আর বল। 

কণাদের মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে ঠাট্টা করত দময়ন্তী

যে কোনওদিন তোকে আমি ছেড়েই যেতে পারি
কবিতাটা লিখিস বলে এখনও তোর নারী।            (চলবে)

ডঃ আনন্দ সেনের জন্ম কলকাতায়। হিন্দু স্কুল ও পরে সেন্ট জেভিয়ার্সে স্কুলজীবন কাটিয়েছেন। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে স্নাতকস্তরের পড়া শেষ করেই পাড়ি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই বাসা। পেশায় ডেটা সায়েন্টিস্ট হলেও কবিতা লেখা আজও প্যাশন। আরও এক প্যাশন বাংলা থিয়েটার। প্রবাসে থেকেও নিয়মিত থিয়েটারের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত আনন্দ। নিয়মিত লেখেন বিভিন্ন ই-পত্রপত্রিকাতেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com