আগের পর্বের লিঙ্ক: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০] [২১] [২২]
জামের গায়ের মতো অন্ধকার নেমে এসেছে, আলো জ্বালতে ভুলে গেছে টুনু। পরেশ বসে আছে দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে। মশাদের গুনগুনে স্বর নীচের বাগানে, গিয়ে দাঁড়ালেই মাথার ওপর ঝাঁক বেধে টোপর বানাবে।
পরেশ মাথা তুলল, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ, ‘তোমার দিদা বিশ্বাস করে না, বাবান মরে গেছে। তালগাছের নীচে গিয়ে ভাত রেখে আসে, এই আশায় যে ছেলে যদি খায়। জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সারাদিন, যদি ফিরে আসে।’
‘তাহলে একানড়ে?’
‘নেই।’ মাথা নাড়ল পরেশ।
‘আছে।’
অবাক হয়ে পরেশ তাকাল। টুনু অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘ছোটমামার খুব লেগেছিল। একানড়ে বলেছে আমাকে।’
‘কে? কী বলেছে?’
‘ছোটমামার ঘরের দেওয়ালে একটা ছোপ আছে, ছোটমামার যন্ত্রণা যখন বাড়ে, জায়গাটা ধকধক করে। তখন একজন একজন করে মরে যায়। তাতে যন্ত্রণা কমে আবার।’ একটু থেমে বলল টুনু, ‘একানড়ে বলেছে।’
পরেশ টুনুকে ধরে ঝাঁকাল, ‘কী সব বলছ তুমি! কী হয়েছে তোমার? কে বলেছে তোমায় এগুলো?’
টুনু পরেশের দিকে তাকাল, কেঁপে গেল তার ঠোঁট। দুই চোখ জলে ভরে উঠল, ‘আমার ভয় লাগছে। আমি চাইনি এসব, চাইনি।’
‘কী চাওনি তুমি? কী বলছ টুনু, আমি কিছু বুঝছি না !’
টুনু কাঁপতে কাঁপতে দেওয়ালের ধারে সরে গেল, ‘ছোটমামার খুব লেগেছিল’।
‘সব বাজে কথা।’
‘সত্যি কথা।’ টুনু মরিয়া হয়ে উঠল। পরেশমামা তাকে বিশ্বাস করছে না কেন? কী বললে বিশ্বাস করবে?
‘টুনু, তাকাও আমার দিকে, শোনো–‘
‘গুবলুরও খুব লেগেছিল।’
থেমে গেল পরেশ। ভূতগ্রস্তের মত টুনুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘মানে?’
টুনু কাঁপছিল, সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল নীরবে।
এগিয়ে এল পরেশ। নিচু গলায় বলল, ‘গুবলুর লেগেছিল, তুমি কী করে জানলে?’
‘একানড়ে বলেছে।’ তোতলাল টুনু।
‘তোমার বন্ধু, সুতনু, সে তোমার ওপর রেগে আছে কেন?’
‘কোথায়? না তো !’
‘একটু আগেই তো বললে—’
‘ভুল বলেছি তাহলে। কেউ রেগে নেই।’ অস্থির হয়ে উঠল টুনু।
‘কী কথা তুমি লুকোচ্ছ, টুনু?’ পরেশর চোখ তন্নতন্ন করে খুঁজছিল তার সর্বাঙ্গ।
টুনু উত্তর দিল না।
পরেশ টুনুর কাঁধের জামা খামচে ধরল, ‘বলো আমাকে, একানড়ে আর কী বলেছে !’
‘আমার ভয় লাগছে !’
‘টুনু—’
কান্নায় ভেঙে পড়ল টুনু, ‘আমি জানি না। কিচ্ছু মনে নেই আমার। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ক্যালকুলাস, সুতনু, সবাই চলে গেছে, আমি কিছু জানি না আর।’
পরেশ একটু সরে এসে চারপাশ দেখে নিল। তারপর সতর্ক গলায় বলল, ‘শোনো টুনু, আমি এক্ষুনি আসছি। কোথাও যেও না তুমি। ঘরেই শুয়ে থাকো। আমি যাব আর আসব, কেমন?’
কাঁদতে কাঁদতেই মুখ তুলল টুনু, ‘কোথায় যাবে?’
‘একটা ছোট্ট কাজ আছে। আধ ঘণ্টার বেশি লাগবে না। তুমি থাকতে পারবে তো?’
‘আমাকে ফেলে, যেও না—‘ টুনুর গলা ভেঙে গেল কান্নায়। এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল দেওয়াল ঘেঁসে।
‘টুনু, তোমার ভালর জন্যই আমি যাচ্ছি। যাতে তোমার আর কোনও ক্ষতি না হয়। এক্ষুনি চলে আসব। কিন্তু তুমি কোথাও যেও না।’ পরেশ ফোন বার করল। ফোন করল কাউকে একটা, অস্থির গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘দেবুদের কি সদরে চালান করে দিয়েছে? তাহলে? বড়বাবুকে গেলে এখন মিলবে? আমি আসছি, এখনই।’ পরেশ বেরিয়ে যাচ্ছিল, টুনু তার প্যান্ট খামচে ধরল, ‘আমি একলা থাকতে পারব না! তুমি যেও না।’
পরেশ ঝুঁকে টুনুর কাঁধে হাত রেখে গাঢ়স্বরে বলল ‘এখানেই থাকো টুনু ! আমি বলছি, কিছু হবে না। কোনও ক্ষতি হবে না! তোমার ভালর জন্যই বলছি।’
উদভ্রান্ত টুনু ধরতে যাবার আগেই পরেশ দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল। থানায় যাচ্ছে, টুনু বুঝেছে। তারপর সকলে মিলে আসবে, তাকে ধরতে, অথবা হয়ত পুড়িয়ে মারতে, যেমনটা মেরেছিল পাগলকে।
মেঝেতে সারি দিয়ে পিঁপড়ের দল, দেওয়ালেও উঠেছে। সারা ঘর দখল করে নেবে। ফাঁদে আটকে পড়া ইঁদুরের মতো টুনু চোখ চালাল, কোনদিক থেকে আসছে দেখার জন্য। বিছানার নীচে? ওখানেই যেন থিকথিক করছে। বিছানাটা তুলল। সারি সারি লাল পিঁপড়ে ঢেকে ফেলেছে, তবুও চিনতে অসুবিধে হবার কথা নয়, সে যতই পচে গিয়ে গন্ধ ছড়াক।
একটা কান। ছোট্ট শিশুর, যা নরম ফুলের মত লালচে ছিল।
কান হাতে নিয়ে টুনু টলতে টলতে শুয়ে পড়ল মেঝের ওপর। এ সমস্তই স্বপ্ন, মিথ্যে, কখনও ঘটেনি। আসলে তো সে এখনও আসানসোলেই আছে, না? কাল থেকে স্কুলের ছুটি শেষ, আবার দৌড়তে হবে ভোরবেলায়। মা টিফিন বানিয়ে ব্যাগে পুরে দেবে। দাদুর ড্রয়ার থেকে ছোটমামার ঘরের চাবি সরিয়ে আনা, নিজেকে লেখা চিঠি, এই কান— সমস্তই আসলে একটা বিশ্রী দুঃস্বপ্ন।
এবং দুঃস্বপ্ন নয়। এখন পুরোটাই মনে পড়ছে তার।
টুনু ধড়মড় করে উঠে পড়ল। চোখ পড়ল আয়নায়। হলুদ দাঁত বার করে নোংরা একটা মুর্তি অপলক তাকিয়ে— শিউরে উঠে চোখে হাত চাপা দিল, খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটা লাগাল সিঁড়ির দিকে।
দাদু আর দিদা নীচের ঘরে স্তব্ধ বসে, ঠিক যেমন গত পাঁচদিন মৃত পশুর মতো মুখ গুঁজে পড়ে আছে তাদের সমস্ত আছাড়িপিছাড়ি শোক ও আর্তনাদ, বা গত কুড়ি বছর, কে বলতে পারে! কিন্তু টুনুকে তার অংশভাগ হলে তো চলবে না, বরং পালাতে হবে, যেখানে তাকে খুঁজে পাবে না কেউ।
উদভ্রান্ত টুনু ধরতে যাবার আগেই পরেশ দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল। থানায় যাচ্ছে, টুনু বুঝেছে। তারপর সকলে মিলে আসবে, তাকে ধরতে, অথবা হয়ত পুড়িয়ে মারতে, যেমনটা মেরেছিল পাগলকে।
প্রথমদিন থেকে ছোটমামার ঘরে যে পচা গন্ধটা পাচ্ছিল, সেটা যে গুবলুর দেহের অংশ হতে চায়, তা তো শুরুতেই বুঝেছিল টুনু। দুপুরবেলা গুবলুকে দাওয়ায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে রীণামামিমা যদি সেদিন অন্য কাজে ব্যস্ত না-ও হত, তাহলেও কোনও না কোনওভাবে গুবলুকে চুপিচুপি তুলে এনে ছোটমামার খাটের নীচে লুকিয়ে রাখতেই হত। সবাই তো জানে ঘর দিনের পর দিন তালাবন্ধই থাকে, তাই ভাবতেও পারবে না ওখানে গুবলু আছে। ওটুকু কচি গলা, তাতে আঙুলগুলো শক্ত করে বসাতে কষ্ট হচ্ছিল, যখন ঠিকরে লাল হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল গুবলুর চোখ দুটো আর সমস্ত রক্ত জমা হচ্ছিল মাথায়, মনে হচ্ছিল ফেটে যাবে শিরাগুলো, কান্নাও পাচ্ছিল খুব, কিন্তু কী করতে পারত টুনু? সবাই গুবলুকে নিয়ে ব্যস্ত, তার সঙ্গে খেলে, তাকে খাওয়ায়, তাকে কোলে নিয়ে হেসে উঠলে বাগানে সজীবতা ফিরে আসে— একানড়ে কী তার কানে কানে এসব কিছুই বলেনি? বলেনি, গম্বুজের তলায় কুড়িয়ে পাওয়া ছুরি দিয়ে কী করতে হবে? পকেটের কানটা একবার ছুঁল টুনু। গুবলুর জন্য কি কাঁদেনি সে? হু হু করে ভাসিয়ে দেয়নি রাত্রির বুক? সুতনুর জন্যও তো কেঁদেছিল, খুব।
সাপের মতো ঠাণ্ডা ভয় টুনুর গলা টিপে ধরতে চাইছিল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বাগানে দাঁড়িয়ে বুক চেপে ধরল দুই হাতে। শক্ত করে জিভ কামড়ে নিজেকে ব্যথা দিতে চাইল, যেন জেগে ওঠে এই দুঃস্বপ্ন থেকে। তবুও, শুধুই যন্ত্রণা, জাগরণ নয়। মাথার চুল খামচে ধরে চাইল নিজেকেই ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে, তারপর থেমে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকল নির্নিমেষ। সেদিন এরকম অন্ধকার চোখেই সুতনু তাকিয়েছিল তার দিকে, যখন এই ভাঙা পাঁচিল বেয়ে বেলগাছে উঠে গেল। টুনু জেনেছিল, গুবলুর সবথেকে নিশ্চিন্ত আশ্রয় হতে পারে সুতনুই। সন্ধের অন্ধকারে ভাঙা পাঁচিলের ধাপে ধাপে পা রেখে একটু উঁচু ডালদুটো যেভাবে আড়াআড়ি, তাদের খাঁজে আটকে দিলে শান্ত ঘুমিয়ে থাকতে পারে যে শিশু, তাকে চুমু খেয়েছে টুনু। পরম স্নেহভরে তার মৃত মাথার চটচটে চুলে আঙুল বুলিয়ে দিয়েছে, তার পচা শরীরের গন্ধে ক্যালকুলাসের কথা মনে হলে জলে ভরে উঠেছে দুই চোখ। কিন্তু কান্না তো শুধুই গুবলুর জন্য ছিল না !
সুতনু জানত না যে তাকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেবার সময়েও টুনুর কান্না পেয়েছিল, টনটন করেছিল বুকের ভেতর। যতই টুনুর দিকে আর না তাকাক, পাত্তা না দিক, নতুন বন্ধু রোহনকে পেয়ে তার সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে ঘুরে বেড়াক সারাদিন, তবুও তো টুনুর প্রিয় ছিল সে, একমাত্র নির্ভরতা! তার হিংসেটুকুই কি সুতনু মনে রাখল শেষ অবধি, শোক নয়? ছাদ থেকে নেমে একলা ক্লাসরুমে বসে হু হু কেঁদেছিল অনেকক্ষণ, যখন নীচে ঘাড়ভাঙা সুতনুকে ঘিরে সবাই— কেউ ভাবতেও পারেনি সুতনু আসলে কীভাবে পড়েছে। টুনু বুঝল না, সুতনু না গুবলু, কার জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে! যদি গুবলু না থাকলে দিদা আবার সমস্ত মনোযোগটুকু তার দিকে দেয়, এক বাগান হাসি ঝিকিয়ে ওঠে রীণামামিমার দাঁতে এবং তার খোলা বুকের মতো আকাশের নীচে টুনু যদি পরম নিশ্চিন্তে কখনও চোখ মেলতে পারে–একানড়ে কি বলেনি এটাই? নাকি অন্য কিছু বলেছিল?
বলেছিল, প্রতিশোধ নিতে? বলেছিল কি?
মনে পড়ছে, সব মনে পড়ছে, আর একটা ভাষাহীন ভয় পেঁচিয়ে ধরছে টুনুকে। ভয় নিজেকে। পালাতে হবে। পরেশমামা, পুলিশ, দিদা, আগুন এই সবকিছুর থেকে তো বটেই, তার আগে নিজের থেকে, দূরে। মা আসবে না কোনওদিনই, কিন্তু কী আসে যায়! মা-কে সে চিনতেও পারবে না আর, বাবাকে তো নয়ই।
জ্বর কত, টুনু বুঝতেও পারছে না। মাথা ফেটে যাচ্ছে, কেঁপে উঠছে শরীর, নোংরা হড়হড়ে হলুদ দাঁত ঠকাঠক আওয়াজ করছে একে অন্যের গায়ে লেগে। কাঁপতে কাঁপতে টুনু অন্ধকার মাঠে পা রাখল। কোথায় পালাবে সে? কোথায় আছে সেই নিরাপদ বিস্মৃতি?
তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে, নিঃসঙ্গ সাক্ষী।
এই সেই গাছ, যা থেকে সবকিছুর শুরু, যেমনটি বলেছিল বিশ্বমামা। কিন্তু তবুও, একানড়ে কি তাহলে আছে, না নেই? সে টুনুর স্বপ্নেই আসুক অথবা বাস্তবে, তাকে কি সত্যিই দেখতে পেয়েছিল টুনু? ছুঁয়েছিল? তার মুখ?
আর এখানে, এই গাছের মাথায় ছোটমামা থাকত, এই বিশ্বাসেই না দিদা ভাত রেখে আসত! তার মানে গাছের মাথায় যদি কেউ থাকে, সে ভালবাসা পেতেও পারে। দগ্ধদিনের সামান্য সঞ্চয় একথালা ভাত কোথাও না কোথাও ঠিকই তার জন্য রেখে যাবে কেউ না কেউ। দিদা কি ভালবাসবে না তাকে, ছোটমামার মতো? সমস্তদিন তখন তারই পথ চেয়ে, তারই জন্য ভাতের আয়োজন?
যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠছে শরীর, এবার পা-টা খসে গেলেই হয়। এক পায়ে হাঁটা সবথেকে ভাল। লাফাতে লাফাতে এগিয়ে গেল টুনু। বাড়ি থেকে একটুকরো আলো এসে পড়েছিল মাঠে, টুনুর ছায়াটা লম্বাটে দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল এক পায়ে হাঁটছে যেহেতু অন্য পা-টা ভাঁজ করে গোটানো ছিল। তখন সে দেখল, একটা ঝোপের ওপর দাঁড়িয়ে সেই কালো বক তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
এ সমস্তই স্বপ্ন, মিথ্যে, কখনও ঘটেনি। আসলে তো সে এখনও আসানসোলেই আছে, না? কাল থেকে স্কুলের ছুটি শেষ, আবার দৌড়তে হবে ভোরবেলায়। মা টিফিন বানিয়ে ব্যাগে পুরে দেবে।
খুব খিদে পাচ্ছে। দুপুরে কী খেয়েছিল, আদৌ খেয়েছে কি না, মনেও নেই তার। পকেটে রাখা কানটাকে বার করল টুনু। নরম নরম, খাওয়া যেতেই পারে। নুনে জারিয়ে রাখলে আরও ভাল হত, কিন্তু তাড়াহুড়োয় খেয়াল ছিল না আর। টুনু কামড় বসাল। ভাল লাগছে এখন। জিভ রসস্থ হয়ে উঠছে আশ্লেষে।
এই তালগাছে ছোটমামা উঠেছে, কোমরে দড়ি না পরেই। তাকেও উঠতে হবে। লুকিয়ে পড়তে হবে সবার থেকে, অলক্ষ্যে, যেন কেউ কখনও আর খুঁজে না পায়, যেন ভুলে যায় টুনু বলে কেউ ছিল।
দুই দাঁতের পাটিতে কানটাকে কামড়ে ধরে টুনু গাছের গুঁড়িতে পা রাখল, আলিঙ্গন করল কাণ্ডটিকে। ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে কোমরের নীচ থেকে, কিন্তু উঠতে তাকে হবেই। একটু একটু করে, একদম শীর্ষে। পায়ে ঘষা লাগবে, কেটে যাবে চামড়া খড়খড়ে গুঁড়িতে, হয়ত চাপ চাপ রক্ত ভিজিয়ে দেবে পা দুটো, কিন্তু একদম ওপরের ছায়াঘেরা মনোরম কোলটিতে গেলেই বিলোল শ্রান্তিতে গা এলিয়ে দিতে পারবে।
সর্বশক্তি দিয়ে কোমরে হ্যাঁচকা টান মারল টুনু, আর কষে বেড় দিল দুই হাতে। এই তো, দিব্যি উঠতে পারছে! কষ্ট হলেও, ঠিকই উঠে যাচ্ছে একটু একটু করে। ভাল পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে লম্বা কাণ্ড। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, কাণ্ডটাও যেন পায়েরই অংশ। মোটা, হাতির পায়ের মতো দেখতে লাগবে তখন।
সহজ সরল মাঠ পরিতৃপ্ত কুয়াশার ভেতর ধ্যানস্থ হয়ে আছে। পৃথিবীর সমস্ত ইচ্ছে স্রোতের মতো উপরে উঠে গিয়ে জমা হয়েছে তালগাছের মাথায়, যেখানে সুষুপ্তি, স্নিগ্ধতাও সেখানেই। টুনু উঠতে লাগল। যতই বিভ্রম থাকুক না কেন, একানড়ে বলে যে আসলে কেউ নেই, পরেশমামা তো সেটা বলেই গেছে। কাজেই গাছের ওপরে কেউ থাকে না, ছিল না কখনও। বরং সেখানে মিলবে নিরাপদ ছাতামাথা আশ্রয়, আজীবন। সে আবিল অন্ধকারে একবার ঢুকে যেতে পারলে তালশাঁসের হিম মাংসের সুখ গায়ে মেখে ঘুমিয়ে পড়বে, নিরুদ্দেশে, বিবর্ণ দুঃখের মত নীল জ্বর তাকে আর ছুঁতে পারবে না। তখন যদি একটা পা খসেও যায়, কার কী ! টুনুর আর ভয় লাগছে না।
সমাপ্ত
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।