সতেরো বছর আগে এক শরৎ সকালে বাবাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল আবাসনের ভিতরকার রাস্তার একপাশে, তাঁর প্রিয় শেফালি গাছটির নীচে। মাথার চুল কালো, টানটান মসৃণ ত্বক, আট বছর রোদ বাতাসে না বেরিয়ে গৌরবর্ণ ফেটে পড়ছে, কে বলবে এঁর বয়স আশি! শ্মশানযাত্রার ঠিক আগে মায়ের বুক ফেটে কান্নার চেয়ে তীব্র হাহাকার বেরিয়ে এসেছিল। “ওরে আমাদের মানুষটাকে ওরা ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেল।” আমার মনের মধ্যে তখন কী ছিল? শোক নয়। বরং এক অনুক্ত আক্ষেপ। আহা, এমন একজনের সঙ্গে ভাল করে কথা বলা হল না এ জীবনে।
বাবার সঙ্গে ক’টা কথা হয়েছে, তা হাতে গোণা যায়। সেইজন্যই প্রত্যেকটা কথা স্পষ্ট মনে আছে। কথা বললে বাবা উত্তর দিতেন ঠিকই, কিন্তু নিজে থেকে বিশেষ কিছু বলতেন না। ছোটবেলা থেকেই শাসন ছিল মায়ের দায়িত্ব। সেই শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল শিশুর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে রীতিমতো মারও। আমাকে অবশ্য মা মারতেন না, নাকি হাড়সর্বস্ব শরীরে মারার জায়গা খুঁজে পেতেন না বলে।

বাবার কাছে পেতাম কেবল স্নেহ। মায়ের উপর রাগ করে আলমারির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকলে হাত ধরে বার করে আনতেন বাবা। বাবার সঙ্গে বাজারে যেতে ভাল লাগত। যেদিন যেতাম না, বাবা বাজার থেকে এলে তাঁর পিঠে উপুড় হয়ে গলায় দু’হাত জড়িয়ে দোল-দোল খেলতাম। একবার কাগজে কোনও একটা বিজ্ঞাপনে উপহারের লটারি ছাপা হয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, যদি একটা স্কুটার পাই, তাহলে আমি আর তুমি রোজ কালীঘাট বাজারে যাব। সেটা অবশ্য ঘটেনি ।
কিন্তু মায়ের যাবতীয় শাসন পরিচালনায় বাবার নীরবতা সত্ত্বেও আমরা ভাইবোনেরা বুঝতে পারতাম, সেটা সম্মতির লক্ষণ নয়। চোদ্দো বছরের মেয়ে বিয়ে করে আনার পর মায়ের যাবতীয় ভবিষ্যত সম্ভাবনা নির্মূল করার নৈতিক দায়িত্ব বাবার উপরেই পড়েছিল। এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিজের কর্তৃত্ব বিসর্জন দেওয়াটাই তাঁর কাছে ছিল সবচেয়ে সহজ।
প্রথম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে ষোলো বছর বয়সে মায়ের প্রাণ সংশয় হয়। তারপর থেকে রক্তচাপ ও কিছু আনুষঙ্গিক উপসর্গ লেগেই থাকত। রাগ হলে এগুলো বাড়ত। কাজেই বাবার নেতৃত্বে আমাদের দায়িত্ব ছিল, মা যেন না রাগেন তা খেয়াল রাখা। ব্যতিক্রম ছিল বড়দা। মায়ের ১৮ বছর বয়সে বড়দা ভূমিষ্ঠ হয়। তার ও মায়ের মধ্যে পরস্পরকে রাগানোর একটা ব্যাপার লেগেই থাকত। এত দুরন্ত ছিল বড়দা, কোথায় লাগে বুথ সাহেবের সম্মিলিত বাচ্চারা।
বাবা নিজে থেকে কথা প্রায় বলতেনই না,কিন্তু তাই বলে আমার মানস-পৃথিবীতে তাঁর প্রভাব কিছু কম ছিল না। একটা ঘটনা মনে আছে। আমি তখন খুবই ছোট। বাড়িতে ‘বেতার জগত’ আসত। আমি পড়তে পারতাম না। একদিন প্রচ্ছদের একটা পুরো পাতাজোড়া ছবি দেখিয়েছিলেন বাবা। আলাদা করে আমাকে ছোট ঘরে ডেকে। এক মা, তার সদ্যোজাত সন্তানের গালে গাল লাগিয়ে হাসছে। বাবা বলেছিলেন, ‘দ্যাখো কী সুন্দর!’ কথাটা মনে এমন দাগ কেটেছিল যে, সেই মা ও শিশুর মুখ আমি এতদিন পরেও ভুলিনি। আজ ভাবি বছর চারেক বয়সের কনিষ্ঠ সন্তানকেই বাবা কেন এটা বলেছিলেন!

অতি অল্প বয়সে মায়োপিয়া ধরা পড়ার ফলে আমার বই পড়ার নেশা মায়ের মনে টেনশন সৃষ্টি করত। যতটুকু দৃষ্টি শক্তি আছে, তা পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনও খাতে নিয়োজিত হোক, তা কাম্য ছিল না। আমারও জেদ। কোণায়, আধো অন্ধকারে লুকিয়ে বসে বই পড়ার। বাবাকে এই অশান্তির পরিমণ্ডলে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রেখে চলতে হত। মা রাগলে তাঁর বাক্যবাণ মারের চেয়েও তীব্র মনে হত। বাবার কাছে গিয়ে কাঁদতাম।
কেবল শৈশবে নয়, যতদিন বাকশক্তি ছিল, আমাকে সান্ত্বনা দিতে বাবা একটি কথাই বলেছেন, ‘জান না, বেড়াল মায়ের দাঁত তার বাচ্চাকে লাগে না?’ কোনও বেড়াল পরিবারের কাছে গিয়ে এর সত্যতা যাচাই করতে পারিনি। কিন্তু মায়ের কথা আমাকে খুব ব্যথা দিত, মনের মধ্যে রক্তপাত হত।
বাবা এককালে কবিতা লিখতেন। কিন্তু নিজের কবিতা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে তাঁর অনীহা ছিল। ট্রাঙ্ক থেকে বার করে তাঁর পুরোনো খাতা ছোড়দাই আমাদের সামনে আনে। বাবার মত ছিল, সংসার আর লেখালিখি একসঙ্গে করা যায় না। এত সংসার করার কি কোনও দরকার আছে, আমি ভাবতাম। রোজ ঘেমে নেয়ে কাঁচা বাজার করা, মাছের রক্ত মাখা আলু কলের নীচে ধোওয়া, মায়ের রান্নাঘরে বছরে কয়েক হাজার ঘণ্টা কাটানো, মধ্যবিত্ত পরিবারে হয়তো এছাড়া উপায় ছিল না।
কিন্তু দরকারে সংসার ছাড়ব, লেখা ছাড়ব না, এমন একটা সিদ্ধান্ত আমি বারো বছর বয়সেই নিয়ে নিয়েছিলাম। রান্না অতি উত্তম শিল্প, কিন্তু রান্নাঘরে আমি ঢুকব না। স্থান আবণ্টনের লিঙ্গবৈষম্যে আমার পড়ার জায়গা হয়েছিল রান্নাঘরে। ওই ঘরে বসে পড়ার ফলে গৃহকর্মে অরুচি জাগা খুব স্বাভাবিক। পাঁচফোড়নের সঙ্গে জিরের, পোস্তর সঙ্গে সুজির, অড়হর ডালের সঙ্গে মটর ডালের তফাৎ বার করার মনীষা আমার মধ্যে তখনও জাগেনি, আজও না।
খুলনার দৌলতপুর কলেজে ইংরাজি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন বাবা, তারপর কলকাতায় এসে এমএ পড়া শেষ করতে পারেননি। সংসারের চাপে চাকরি নিতে হয়েছিল। বাংলা মিডিয়ামে পড়া তিন ছেলেমেয়েকেই হাতে ধরে ইংরিজি ভাষা ও গ্রামার শিখিয়েছিলেন, হাতের লেখাও আমাদের তিনজনেরই বাবার মতো, অতটা সুন্দর নয় হয়তো। প্যারাফ্রেজ়িং, প্রেসি রাইটিং, ট্রান্সশ্লেসনে আমরা তিনজনই অতি পারঙ্গম হয়ে উঠেছিলাম। দিস্তে কাগজ কিনে আমাদের লেখার খাতা বানিয়ে দিতেন। সকালে অফিস যাবার আগে হোমওয়ার্ক দিয়ে যেতেন, সন্ধেবেলা এসে দেখতেন। ক্লাস সেভেন থেকে ইলেভেন এই ড্রিল।
বড়দা আর আমার মধ্যে ছ’বছরের তফাৎ হওয়ায় পুরো একটি দশক বাবাকে এই কাজটি করে যেতে হয়। এখন অভিভাবকরা ক্রমশ হয়ে উঠেছেন ব্যবস্থাপক। নিজের হাতে সন্তান মানুষ করা আর প্রাইভেট কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা যে এক নয়, তা বোঝার মতো সময়ও মা বাবার হাতে নেই। আমরাও যথাসম্ভব সন্তানদের শেখানোর চেষ্টা করেছি নিজেদের বিদ্যেবুদ্ধি দিয়ে, তবে বাবার নিষ্ঠার সমতুল্য কিছু পারিনি।
হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় হিউম্যানিটিজ়ে প্রথম হওয়ার গৌরবে আমাকে প্রথম ইন্টারভিউ করতে যে সাংবাদিক এসেছিলেন, তাঁকে মিষ্টি পরিবেশন করে মা আমাকে বললেন, ‘যাও তৈরি হয়ে এস।’ অর্থাৎ একমাত্র ভাল ভয়েলের শাড়িটি পরে এস। তখন টিভি ছিল না। সংবাদপত্রে ছবি আর সাক্ষাৎকার, এবং বেতারে আর এক প্রস্ত প্রশ্ন-উত্তর।
বাড়িতে ‘বেতার জগত’ আসত। আমি পড়তে পারতাম না। একদিন প্রচ্ছদের একটা পুরো পাতাজোড়া ছবি দেখিয়েছিলেন বাবা। আলাদা করে আমাকে ছোট ঘরে ডেকে। এক মা, তার সদ্যোজাত সন্তানের গালে গাল লাগিয়ে হাসছে।
তৈরি হতেই বাবা এসে বলে গেলেন, যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কী হতে চাও, বলবে, আই এ এস। আনাড়ির মতো সে কথা খবরের কাগজে বলে দেওয়ায় প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রগতিশীল বন্ধুদের হাতে কম নাস্তানাবুদ হতে হয়নি। কিন্তু বাবার অতীত ব্যর্থতার ইতিহাস আমি জানতাম। প্যাকিং বাক্সের উপর মোমবাতি জ্বেলে আই এ এস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া ও বিফল হওয়া। পরের বার ফিজ়ের টাকা জুটিয়ে উঠতে পারেননি। কাজেই বাবার মনের ইচ্ছে পূরণ করাই আমার একান্ত চেষ্টা ছিল, কেরিয়ার অপশন হিসেবে আইএএস-এর গুরুত্বের চেয়েও।
জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে মায়ের সঙ্গে একমত হয়ে আমার পাশে দাঁড়াননি বলে বাবার উপর দুর্দান্ত অভিমান হয়েছে, কিন্তু রাগ করতে পারিনি। সব বাবা মা -ই নিজের সন্তানের উপর অলীক গৌরব আরোপ করে থাকেন। বাবা আমাকে রবীন্দ্রনাথ ও ইয়েটস এর উত্তরসূরি মনে করে উৎফুল্ল হতেন। কাজেই আইএএস মরাঠী ব্যাচমেটকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত তাঁর হৃদয় ভেঙে দিয়েছিল। মায়ের রাগ ক্ষোভ তিরস্কারের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে, তিনি এই ক’টা কথাই বলতে পেরেছিলেন, “আমার মেয়ে— এমন যার লেখা— সে আর লিখতে পারবে না।” দুই গাল ভেসে গিয়েছিল চোখের জলে। সেই অদৃশ্য চোখের জল আজও আমার প্রতিটি বইয়ের মলাটে লেগে থাকে।

তবে বাবার সবচেয়ে মোক্ষম উপদেশটি ছিল সততা বিষয়ক। সাঁইত্রিশ বছরের কর্মজীবনে তা আমার নাকের সামনে বোর্ডের মত ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। তত্ত্বটির অবতারণা আমার অতি শৈশবে। বাবা নানা সংস্থার অডিট করতেন কিন্তু আমাদের বাড়িতে উপঢৌকন কখনও প্রবেশ করেনি। এক আত্মীয়া আমাকে হেসে বলেছিলেন, উপরি কীভাবে কামাতে হয় আমাদের অনিল (বাবার নাম) জানে না। আমি বিক্ষুব্ধ চিত্তে বাবাকে এসে নালিশ করেছিলাম। বাবা সংক্ষেপে বলেছিলেন, ওসব জানার কোনও দরকার নেই।
আমি আইএএস জয়েন করার পর কোনও পারিবারিক আলোচনায় নিজের সততা নিয়ে কিছু একটা বলেছিলাম, হয়তো ঈষৎ গর্বের সঙ্গে। বাবা বলেছিলেন, ‘সততা নিয়ে কখনও গর্ব অনুভব কোরও না। ওটা হল বেয়ার মিনিমাম। ন্যূনতম মান। তুমি ট্যাক্স পেয়ারের টাকায় মাইনে পাও। তোমার কাছে প্রত্যাশিত টোটাল ইনটেগ্রিটি। তা আর্থিক সততার চেয়ে অনেক বড়।’
কথাটা কখনও ভুলিনি। বাবা যখন চলে যান, আমার বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। এই পাঁচ দশকে বাবা হয়তো খান পনেরো কথাই আমাকে নিজে থেকে বলেছিলেন। কিন্তু সন্তানের জীবন গড়ে দেবার জন্য তা যথেষ্ট ছিল।
*ছবি সৌজন্য: Pixels, artranked.com
কলকাতায় জন্ম, বড় হওয়া। অর্থনীতির পাঠ প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখক জীবন আরম্ভ। সূচনা শৈশবেই। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য লেখায় অনায়াস সঞ্চরণ। ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার সদস্য ছিলেন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়। মহুলডিহার দিন, মহানদী, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, ব্রেল, কবিতা সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ ইত্যাদি চল্লিশটি বই। ইংরাজি সহ নানা ভারতীয় ভাষায়, জার্মান ও সুইডিশে অনূদিত হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। শরৎ পুরস্কার, সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণপদকে সম্মানিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর সোমেন চন্দ পুরস্কার ফিরিয়েছেন নন্দীগ্রামে নিরস্ত্র মানুষের হত্যার প্রতিবাদে। ভারতের নানা প্রান্তের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর উন্মোচিত তাঁর লেখায়। ভালোবাসেন গান শুনতে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে, প্রকৃতির নানা রূপ একমনে দেখতে।
2 Responses
পড়ছি l আপনার লেখা এমনই হয় l সততা নিয়ে আপনার বাবার মন্তব্য দাগ কেটে গেল l
ভালো লাগল । কর্মসূত্রে অনেক আইএএস অফিসারের সংগে পরিচয় ছিল কিন্তু আপনার মত সৎ এবং উঁচু মানের লেখক বেশি দেখিনি অফিস পাড়ায় ।