সন্ধ্যার কলকাতা। ক্যাফেতে বসে আছি, সামনে প্লেট সাজানো। পাশে বসা কিশোরটি বলে উঠল, “ইম্যাজিন, আমাদের সামনে কারোর মন আর চিন্তা প্লেটে সাজানো! সোল-ও (Soul) হতে পারে! আমরা সেটা খেতে চলেছি! সো উইয়ার্ড! তাই না?”
একশো বছর আগে, ১৯২০ সালে শ্রী সুশীল রায় যতীন্দ্রমোহন এভিনিউয়ে খোলেন ‘মিত্র ক্যাফে।’ সেই একশো বছরের পুরনো দোকানের অনন্য মেনু ‘ব্রেইন চপ!’ পাশে কিশোরটি উত্তরের আশা না করেই বলে চলে, “অবশ্যি মাছের মাথা আগেই খেয়েছি, আহা ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচু শাক, মুগ ডাল মাছের মাথা দিয়ে… কিন্তু রোজ রোজ বাড়ির সবার মাথা চিবনোর টেস্টই আলাদা.. চলো, এবার ছাগলের মাথাও ট্রাই করি!”
আমি যদিও ব্রেইন আগে খেয়েছি, দিল্লিতে ভেজা ফ্রাই, হায়দরাবাদেও..অসম্ভব সুস্বাদু। তবে কিশোরটির কাছে এই প্রথম! তাই অজস্র প্রশ্ন, ব্রেইন এডিবল? কোনও হেলথ রিস্ক হয়? নিউট্রিশনাল ভ্যালু আছে কোনও? এক এক সময় প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে মনে হয় উফফ মাথা ঠুকি! ওরেবাবা, না না থাক, ওদিকে বিজ্ঞান মাথায় ঘুরতে থাকে তো! এই যে এত ভালোবাসা ভালোলাগা রাগ দুঃখ দিয়ে তৈরি ব্রেইন, তার ইলাস্টিক মডিউলাস মোটে ০.৫-১ কিলো প্যাস্কেল, মানে ওই প্রায় জেলির মতো নরম সরম! ভাগ্যি স্কাল দিয়ে সেফগার্ড করা! তায় ওতে আবার দৈনিক প্রয়োজনের থেকে বেশি বেশি ভিটামিন বি ১২, নিয়াসিন, ভিটামিন সি, আইরন, কপার, ফসফরাস ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড আর কিঞ্চিৎ কোলেস্টেরলও, ওই খানিক ডিমের কুসুমের মতো খাদ্যগুণ… ধুর বাপু, অত ভেবেচিন্তে ব্রেইনস্টর্ম করে ব্রেইন স্টাডি না করে বরং এক কামড় খেয়ে ‘মগজাস্ত্রে‘ শান দেওয়া যাক…
প্রথম কামড় দিয়েই মনে হল, বার বার এ জিনিস খেতেই হবে। তার মানে, বাড়িতে বানানোর ব্যবস্থা করতে হবেই! নানান স্বাদের চপ খেয়েছি, কিন্তু এ স্বাদ একদম অন্য, মুখে লেগে থাকা! সবে দ্বিতীয় কামড় দিয়েছি জমিয়ে, পাশের কিশোরটির মগজে গিজগিজ করে ওঠে প্রশ্ন, “আচ্ছা এদেশ ছাড়া অন্য কোথাও ব্রেইন রেসিপি আছে? ট্রাই করা যেতে পারে?” বুঝলাম প্রথমে সন্দিগ্ধ হলেও দারুন লেগেছে টেস্ট।

জানিয়ে দিলাম, ফরাসি রান্নায় ‘cervelle de veau’ আর ‘tête de veau’ (উচ্চারণ করতে বোলো না প্লিজ)! পাকিস্তানি, বাংলাদেশি রান্নার পদ হিসেবে ‘মগজ‘, মেক্সিকান ‘ট্যাকো দে সেসো‘ এ ছাড়াও চাইনিজ সিচুয়ান কুইজিন, তুর্কি কুইজিন আর পৃথিবীর নানান দেশে খাওয়া হয় মগজ! শেফ মারিও বাটালি–র বিফ ব্রেইন রাভিওলি, বা ওই ছ’ঘণ্টা ঢিমে আঁচে সেদ্ধ করা মগজ ‘মেক্সিকান পসোলে’, আর ঈদ উল আধা-র সময় ‘ব্রেইন মসালা’ সেসব খুবই নাম করা ব্রেইন রেসিপি…। আর আফ্রিকা বাদ দেব লিস্ট থেকে, তা কি হয়? প্রায় দু’মিলিয়ন বছর আগে, ওই যে নীল নদের উৎস, লেক ভিক্টোরিয়া, তার চারপাশে তখন আমাদের পূর্বসূরিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, আদিম আর তথাকথিত বর্বর প্রজাতি, সেই সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বলছে, তখন থেকেই জীবজন্তুর মগজ খাওয়ার চল। শুয়োর, গরু, কাঠবেড়ালি, চিকেন, ভেড়া, ছাগল… এই সবকিছুই কিন্তু তালিকায় আছে। তবে ওই “ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড টেম্পল অফ ডুম”-এর দৃশ্যের ডেসার্টে কাঁচা চিলড হনুমান ব্রেইন খাওয়াটা বিলকুল বাড়াবাড়ি!
যাইহোক, বাড়ি ফিরে এ দোকান ও দোকান খুঁজতে গিয়ে বুঝলাম, চিকেনের পাগুলো যেমন গরিব মানুষের স্টেপল ফুড, সেরকম ছাগলের মগজও। সেরকম করে ভাগ্যিস খাওয়ার চল নেই, তাই দাম কমই। কিনে আনলাম খান তিনেক মগজ, ঠিক হাতের মুঠোর সাইজ এর! হাতের মুঠোয় যখন ধরলাম, মনে হচ্ছিল এই সেই হাজার হাজার নিউরনের বাড়ি, যেখানে রাগ দুঃখ ভালোবাসা আর কতও চিন্তা তৈরি হয়! খানিকটা ইমোশন? নাহ, ডারউইন সাহেব বলে গিয়েছেন, ” A scientific man ought to have no wishes, no affection….” বলতে বলতে পরিষ্কার করতে শুরু করলাম। ওপরে কালো শিরার মতো ব্যাপারগুলো পরিষ্কার করতে হবে। প্রিয়ন রিলেটেড রোগ থাকলে যদিও কিছু করার নেই। তবে সেটা মূলত বিফে বেশি হয়।

তারপর…
ব্রেইন পোচ করার জন্যে:
কড়ায় গরম জল ফুটন্ত
দুটো তেজপাতা
দুটো লেবু পাতা
নুন
আর পরিষ্কার মগজ তিনটে
দিয়ে ৪-৫ মিনিট ফুটিয়ে নিলাম। এটা কিন্তু কিনে এনে ফ্রিজে ভরে পরেরদিন করলে হবে না। টাটকা কিনে টাটকা করতে হবে।
চপের জন্যে
দুটো পেঁয়াজ মিহি কুচি
৪-৫ কোয়া রসুন মিহি কুচি
লঙ্কাকুচি তিন চারটে
আদাকুচি প্রায় এক চা চামচ
হলুদগুঁড়ো এক চা চামচ
লঙ্কাগুঁড়ো এক চা চামচ
নুন স্বাদ মতো
ইচ্ছে হলে ধনে জিরে গুঁড়ো দেওয়া যায় এক চা চামচ করে, তবে আমি দিইনি..। সিম্পল রেখেছি টেস্ট।

সেদ্ধ করা ব্রেইন কুচি করে কেটে নিয়ে তাতে ওপরে বলা সব মশলা মিশিয়ে নিয়েছি। কিন্তু হল কী, ব্রেইন একটু স্পঞ্জের মতো তো, বাইন্ড করতে এক মুঠোখানেক ব্রেড ক্রাম্ব দিতে হল। তারপর গোল গোল বল করে একটু চ্যাপ্টা করে ভাগ করে রাখলাম। ওদিকে কোটিংয়ের জন্যে, একটা ডিম নুন মরিচ দিয়ে ফেটিয়ে নিলাম, আমি আবার ডিম ফেটালেই একটু মিক্সড হার্ব দি।
গোল বলগুলো ডিমের গোলায় ডুবিয়ে আবার ব্রেড ক্রাম্ব ভালো করে প্রলেপ দিয়ে একদম ডুবো তেলে মিডিয়াম আঁচে ভেজে নিলাম। তারপর, আর কী…! গরম গরম হয় পুদিনা চাটনি নয় কাসুন্দি বা যে কোনও ডিপ আর সালাদ দিয়ে খাওয়া …
খেতে বসে, পাশ থেকে কিশোরটি যথারীতি ফোড়ন কাটে, “কুমির, উট, উটপাখি, মগজ, কিডনি, পাকস্থলি, কিছুই উদরস্থ করতে বাদ রইল না। আগন্তুকের মনমোহন দাদুর মতো, আমিও তাহলে ‘ সর্বভূক ও স্বল্পাহারী‘…আর একদিন যখন বড়ো হব, আমিও বেরিয়ে পড়ব একা একা পৃথিবী ভ্রমণে। মোটেই কূপমণ্ডুক হব না!”
ছবি ও রান্না সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।