আগের পর্বের লিংক:
[১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩]
কিছুদিন পরের কথা। সেই বিভীষিকাময় হত্যাকাণ্ডের ত্রাস ফিকে হয়ে এসেছে। এমন সময় কয়েকটা জন্তুর মনে হল, তারা যেন আবছা আবছা স্মরণ করতে পারছে যে ছ’নম্বর বিধানে লেখা ছিল– ‘কোনও পশু কখনও অন্য কোনও পশুকে হত্যা করবে না৷’ তারা শুয়োর বা কুকুরদের সামনে এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করল না বটে, কিন্তু কারও আর বুঝতে বাকি রইল না যে ছ’নম্বর বিধানের সঙ্গে এই হত্যালীলা কিছুতেই মেলে না৷ ক্লোভার বেঞ্জামিনকে গিয়ে বলল, ছ’নম্বর বিধানটা তাকে পড়ে শোনানোর জন্য৷ বেঞ্জামিন স্বভাবমতোই ক্লোভারের অনুরোধ সাফ নাকচ করে দিয়ে জানাল, সে এ সবের মধ্যে জড়াতে চায় না৷ ক্লোভার তখন ধরে আনল মুরিয়েলকে৷ মুরিয়েল পড়ে শোনাল, ছ’নম্বর বিধানে লেখা আছে– ‘কোনও পশু কখনও অন্য কোনও পশুকে হত্যা করবে না বিনা কারণে’৷ আশ্চর্য ব্যাপার! কীভাবে যেন শেষের শব্দ দুটো জন্তুদের মগজ থেকে বেমালুম হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, তারা এখন দেখতেই পাচ্ছে যে ছ’নম্বর বিধান ভাঙা হয়নি৷ যাদের মেরে ফেলা হয়েছে তারা তো ছিল বিশ্বাসঘাতক, স্নোবলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল৷ অতএব এটা পরিষ্কার যে তাদের হত্যা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷
এ বছর ওরা যেন গতবছরের থেকেও বেশি পরিশ্রম করল, তা-ও আবার বছরের পুরো সময়টা জুড়েই৷ হাওয়াকলের দেয়াল আগের চেয়ে দ্বিগুণ মোটা করে গেঁথে সময়মতো কাজ শেষ করা– বোঝাই যাচ্ছে জন্তুদের কী প্রচণ্ড খাটতে হয়েছে৷ এর সঙ্গে ফার্মের নিত্যদিনের কাজকম্ম তো ছিলই৷ কখনও কখনও জন্তুদের মনে হয় তারা যেন জোন্সের আমলের চেয়েও এখন বেশি সময় কাজ করে৷ খাবারও যে জোন্সের আমলের চেয়ে কিছুমাত্র বেশি পাওয়া যাচ্ছে তা-ও নয়৷

প্রতি রবিবার রবিবার স্কুইলার আসে৷ তার সামনের পায়ে একটা লম্বা মতো কাগজ ধরা থাকে— তার থেকে সে পড়ে পড়ে শোনায় বিভিন্ন ফসলের কত বেশি ফলন হল৷ সেই তালিকা অনুযায়ী কোনও ফসলের একশো শতাংশ, কোনও ফসলের তিনশো শতাংশ আবার কোনও ফসলের পাঁচশো শতাংশ ফলন বেড়েছে৷ বিপ্লবের আগে অবস্থাটা ঠিক কেমন ছিল, তা জন্তুরা এখন ঠিকমতো মনেও করতে পারে না৷ তাই তারা স্কুইলারকে অবিশ্বাস করারও কোনও কারণ খুঁজে পায় না৷ অবশ্য একই সঙ্গে তারা এটাও অনুভব করে যে, এই সংখ্যার গুরুভার কমে গিয়ে যদি শীঘ্রই খাবারের পরিমাণ বাড়ে তা হলে বড্ড ভালো হয়৷ হয় স্কুইলার নয়তো অন্য কোনও শুয়োরের মাধ্যমে আজকাল সবরকম হুকুম জারি করা হয়৷ পনেরো দিনে একবারের বেশি নেপোলিয়নকে জনসমক্ষে দেখাই যায় না৷ আর যখন সে বেরোয় তখন যে শুধু তার কুকুরগুলো তাকে ঘিরে থাকে তা নয়, আজকাল আবার একটা কালো রঙের বাচ্চা মোরগও জুটেছে সঙ্গে৷ মোরগটা নেপোলিয়নের সামনে সামনে কুচকাওয়াজ করে চলে আর নেপোলিয়ন বক্তৃতা শুরু করার আগে শিঙা ফোঁকার মতো উচ্চৈঃস্বরে ‘কোঁক্কর কোঁ’ বলে ওঠে। শোনা যাচ্ছে আজকাল নাকি খামারবাড়িতেও নেপোলিয়নের জন্য আলাদা ঘর বরাদ্দ হয়েছে৷ সে এখন আর বাকিদের সঙ্গে থাকে না৷ তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও আলাদা৷ সে খায় একা, পরিচারক হিসেবে থাকে দুটো কুকুর৷ তারাই খাবার পরিবেশন করে৷ বসার ঘরের কাচের আলমারিতে যে দামি ক্রাউন ডার্বি বাসনপত্র ছিল, নেপোলিয়ন সবসময় এখন সেগুলোতেই খায়৷ ঘোষণা করা হয়েছে এবার থেকে নাকি নেপোলিয়নের জন্মদিনেও বন্দুকধ্বনি করা হবে, ঠিক যেমনটা বাকি দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিনে করা হয়ে থাকে৷
নেপোলিয়নকে আজকাল আর শুধু নেপোলিয়ন বলে ডাকার রেওয়াজ নেই৷ খুবই আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চারিত হয় ‘আমাদের নেতা কমরেড নেপোলিয়ন’৷ শুয়োরেরা আবার তাকে ‘পশুপিতা’, ‘মানবকুলের ত্রাস’, ‘মেষরক্ষক’, ‘হংসবান্ধব’— এ রকম ভিন্ন ভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করতে খুব ভালোবাসে। নেপোলিয়নের জ্ঞান, তার হৃদয়ের মহত্ব এবং সমগ্র পশুকুলের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার কথা বাকি পশুদের কাছে বলার সময় ভক্তি ও শ্রদ্ধায় স্কুইলারের চোখের জল বাঁধ মানে না, গাল বেয়ে গড়াতে থাকে৷ এ-ও জানা যায়, যে-সব অসুখী পশুরা অন্যান্য খামারে নিদারুণ অবহেলা ও দাসত্বের শৃঙ্খলে দিন গুজরান করছে, তাদের প্রতিও নেপোলিয়নের হৃদয় উপচোনো ভালোবাসা রয়েছে৷ আজকাল আবার যে কোনও সাফল্য, যে কোনও সৌভাগ্যের জন্য নেপোলিয়নকে কৃতিত্ব দেয়ার একটা চল হয়েছে৷ হয়তো শোনা গেল এক মুরগি আর এক মুরগিকে বলছে, ‘আমাদের নেতা কমরেড নেপোলিয়নের কৃপায় আমি ছ’দিনে পাঁচটা ডিম পেড়েছি৷’ বা দুটো গরু হয়তো পুকুরে জল খাচ্ছে, একটা হঠাৎ বলে উঠল, ‘কী মিষ্টি জল, আহা! কমরেড নেপোলিয়নের নেতৃত্বকে অসংখ্য ধন্যবাদ৷’ খামারের জন্তুদের এই মনোভাব খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে কবি শুয়োর মিনিমাসের লেখা ‘কমরেড নেপোলিয়ন’ কবিতায়—
পিতৃহীনের বন্ধু তুমি!
খুশির ঝর্ণাধারা
ওঁচলা-পাত্র-ঈশ্বর তুমি
আমরা আত্মহারা।
বুকে আগুন জ্বালে
তোমার শান্ত দৃপ্ত চোখ
যেন আকাশ-মাঝে সূর্য
কমরেড নেপোলিয়নের জয় হোক!
ত্রাতারূপে এসেছ মোদের
বিলিয়েছ ভালোবাসা,
দুইবেলা পাই ভরপেট খাই
বিছানাটিও খাসা।
ছোট-বড়ো পশু আমরা সবাই
নিজের খোঁয়াড়ে শান্তিতে ভাই
পরমানন্দে নিদ্রাটি যাই
তুমি জেগে আছ তাই৷
আমার যদি থাকত কভু
একটি শুয়োরছানা।
হয়তো বড়ো হয়তো ছোট
বোতল-বেলনাপানা৷
ভক্ত সে যে হতই তোমার
জানে আমার মন।
ফুটলে বুলি বলত জোরে—
‘কমরেড নেপোলিয়ন!’
কবিতাটা নেপোলিয়নের অনুমোদন পেলে পরে সেটাকে বড় গোলাবাড়ির দেয়ালে, সাত বিধানের ঠিক উল্টোদিকে খোদাই করা হল৷ স্কুইলার সেই কবিতাটার উপরে সাদা রং দিয়ে নেপোলিয়নের একটি পার্শ্ব-প্রতিকৃতি এঁকে দিল৷

হুইম্পারের দালালিতে ফ্রেডরিক আর পিলকিংটনের সঙ্গে নেপোলিয়নের যে ব্যবসায়িক দরাদরি চলছিল, সেটা এর মধ্যে বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সেই কাঠের স্তূপটা এখনও বিক্রি করা যায়নি৷ ওই দু’জনের মধ্যে ফ্রেডরিকই কাঠটা কিনতে বেশি আগ্রহী, কিন্তু এত কম দাম দিতে চাইছে যে কহতব্য নয়৷ এরই মধ্যে হঠাৎ করে গুজব ছড়িয়ে পড়ল ফ্রেডরিক নাকি অ্যানিম্যাল ফার্ম আক্রমণ করে হাওয়াকল গুঁড়িয়ে দেবার ছক কষছে৷ হাওয়াকল তৈরি হওয়ার সময় থেকেই সে নাকি হিংসেয় একেবারে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে৷ শোনা যায় স্নোবলও নাকি পিঞ্চফিল্ড খামারেই ঘাপটি মেরে রয়েছে৷ গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি সময়ে একটা ঘটনার কথা শুনে জন্তুরা একেবারে চমকে উঠল৷ তিনটে মুরগি নাকি নিজেরাই এগিয়ে এসে স্বীকার করেছে যে, স্নোবলের উসকানিতে তারা নেপোলিয়নকে খুন করার পরিকল্পনায় শামিল হয়েছিল৷ মুরগিগুলোকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা হয়েছে৷
তারই সঙ্গে নেপোলিয়নের সুরক্ষার জন্য নেয়া হয়েছে বেশ কিছু নতুন ব্যবস্থা৷ রাত্তিরবেলা নেপোলিয়ন যখন ঘুমোতে যাবে তখন চারটে কুকুর তার খাটের চার কোনায় পাহারা দেবে৷ এ ছাড়াও পিংকে নামের এক জোয়ান শুয়োরকে নিয়োগ করা হল৷ নেপোলিয়ন কোনও খাবার মুখে তোলার আগে সে চেখে দেখবে৷ খাবারে যদি বিষ থাকে! একদিন খবর হল যে, নেপোলিয়ন নাকি মিস্টার পিলকিংটনের কাছে সেই কাঠের স্তূপ বিক্রি করার ব্যাপারে সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে৷ এ ছাড়াও নাকি অ্যানিম্যাল ফার্ম আর ফক্সউডের মধ্যে বিশেষ বিশেষ কিছু পণ্যের আদান প্রদানের ব্যাপারে একটা চুক্তি হয়েছে। হুইম্পার মাঝখানে রয়েছে বটে, তবু নেপোলিয়ন আর পিলকিংটনের সম্পর্কটা এখন মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণই বলা চলে৷ পিলকিংটন একজন মানুষ, তাই জন্তুরা তাকে বিশ্বাস করে না৷ তবে ফ্রেডরিকের তুলনায় যে তাকে অনেক বেশি পছন্দ করে, তা বলাই বাহুল্য৷ ফ্রেডরিককে তারা একই সঙ্গে ভয়ও পায় আবার ঘৃণাও করে।
গ্রীষ্মকাল ফুরোতে চলল, হাওয়াকলের কাজও প্রায় শেষ, এমন সময় একটা জোরালো গুজব ছড়িয়ে পড়ল– খামারে হামলার নাকি একটা চক্রান্ত চলছে। আক্রমণটা করবে ফ্রেডরিক। সে জন্য কুড়িজন বন্দুকধারী মানুষকে প্রস্তুত রেখেছে৷ এমনকী ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশকেও ঘুষ খাইয়ে হাত করে ফেলেছে৷ যদি সে কোনওভাবে একবার অ্যানিম্যাল ফার্মের দলিলটা হাতিয়ে নিতে পারে, তা হলে বিপদের একশেষ হবে৷ পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রেটের তরফ থেকে কোনও ব্যবস্থাই নেয়া হবে না৷ এ ছাড়াও পিঞ্চফিল্ড খামারের পশুদের উপর ফ্রেডরিক কী ভয়ানক সব অত্যাচার চালায় সে খবরও সকলের কানে আসে৷ সে নাকি একটা বুড়ো ঘোড়াকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, গোরুদের উপোস করিয়ে রাখে, একবার নাকি একটা কুকুরকে সে চুল্লিতে ফেলে ঝলসে মেরেছে৷ এটাও জানা গেছে যে, পায়ে ক্ষুর বেঁধে মোরগদের মধ্যে লড়াই করায় সে৷ এটাই নাকি তার সন্ধেবেলার বিনোদন। তাদের কমরেডদের এ হেন দুরবস্থার কথা শুনে রাগে জন্তুদের রক্ত টগবগিয়ে ফুটতে থাকে৷ তারা দলবেঁধে পিঞ্চফিল্ড আক্রমণ করে মানুষদের তাড়িয়ে পশুদের মুক্ত করার দাবি তোলে৷ স্কুইলার তখন তাদের বোঝায়, তড়িঘড়ি কোনও পদক্ষেপ করতে বারণ করে৷ বলে, নেপোলিয়নের কৌশলের উপর ভরসা রাখতে৷ (চলবে)
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১২ অক্টোবর ২০২২
ছবি সৌজন্য: Ralph Steadman
অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।