সৌভাগ্য এমন আচমকাই এসে মুঠোয় ধরা দিয়েছে, যে পশুদের প্রথমে কিছুক্ষণ তা বিশ্বাসই হচ্ছিল না। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তারা প্রথমেই দল-বেঁধে খামারবাড়ির পুরো চৌহদ্দিটা একবার টহল দিয়ে নিল। কোথাও কোনও মানুষ লুকিয়ে নেই তো! নাহ্। সব ভোঁ-ভাঁ।
নিশ্চিন্ত হয়ে এবার ওরা ছুটল খামারবাড়ির দিকে। ঘৃণিত জোন্স-সাম্রাজ্যের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে ফেলতে হবে। আস্তাবলের শেষ প্রান্তে ঘোড়ার সাজঘর— তার দরজা ভেঙে ফেলা হল। লাগামের বিঁধ, নাকের আংটা, কুকুরের শেকল, সেই ভয়ংকর ছুরি— যেটা দিয়ে জোন্স শুয়োর আর ভেড়াদের মাংস কাট— এমন যা-যা পাওয়া গেল সবই ফেলে দেওয়া হল কুয়োর মধ্যে। উঠোনের এক কোণে জঞ্জালের স্তূপে আগুন জ্বলছিল। ঘোড়ার লাগাম, গলার ফাঁস, চোখের ঠুলি, নাকের জালি— এমন অসম্মানজনক যা-কিছু ছিল সব সেই আগুনে ছুড়ে দেয়া হল। একইসঙ্গে আগুনে ফেলা হল চাবুকগুলোকেও।
চাবুক পুড়তে দেখে জানোয়ারদের কী আনন্দ! আত্মহারা হয়ে তারা তুর্কি-নাচন শুরু করল। স্নোবল আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে ঘোড়ার ফিতেগুলোও ফেলে দিল আগুনে। এই সব ফিতে কেশরে আর লেজে বেঁধে গাড়ি-টানা ঘোড়াগুলোকে বাজার যাওয়ার দিনে সাজানো হত। স্নোবল বলল, “ফিতে… হ্যাঁ, এগুলোকেও জামাকাপড় হিসেবেই ধরতে হবে। আর জামাকাপড় মানেই একটা মানুষ-মানুষ-ব্যাপার। পশুরা সবসময় উলঙ্গ থাকবে।”
একথা শোনা-মাত্রই বক্সার কোত্থেকে একটা খড়ের টুপি নিয়ে এসে টুক করে ফেলে দিল আগুনে। ওই টুপিটা দিয়ে ও মাছির উৎপাত থেকে বাঁচতে গরমকালে কান ঢাকা দিয়ে রাখত। দেখতে-দেখতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জানোয়াররা অনেক কিছুই ধ্বংস করে ফেলল। জোন্সের চিহ্ন আর প্রায় কিছুই রইল না।
এরপর নেপোলিয়ন সবাইকে নিয়ে এল ভাঁড়ারঘরে। সেখানে প্রত্যেককে দ্বিগুণ পরিমান খাদ্যশস্য বিলি করা হল। কুকুরদের আবার অতিরিক্ত দুটো করে বিস্কুটও দেওয়া হল সঙ্গে। তারপর তারা পর-পর সাতবার ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’ গানটা প্রাণখুলে গেয়ে রাত্রিবেলা ঘুমোতে গেল। এমন নিশ্চিন্ত ঘুম ওরা আগে কখনও ঘুমোয়নি। কিন্তু প্রতিদিনের মতোই খুব ভোরে ওদের ঘুম ভেঙে গেল। আর ঘুম ভাঙতেই সকলের চট করে মনে পড়ে গেল, কী গৌরবময় ব্যাপারটাই না ঘটেছে গতকাল। অমনি সবাই ছুটল চারণভূমির দিকে।
আরও পড়ুন: তুষ্টি ভট্টাচার্যের কলমে: এনহেদুয়ানা
এই মাঠটা পেরিয়েই একটা ঢিবির মতো আছে। সেটায় চড়লে খামারের প্রায় সবটাই দিব্যি দেখা যায়। জানোয়াররা সকলে মিলে গুঁতোগুঁতি করে সেই ঢিবির উপর গিয়ে উঠল। তারপর ভোরের স্পষ্ট আলোয় দু’চোখ ভরে দেখতে লাগল। হ্যাঁ… এ সবই তাদের… শুধু তাদের। এই কথাটা ভাবতেই এত ভালো লাগছে, যে জন্তু-জানোয়াররা আনন্দে একেবারে হুটোপুটি করতে আরম্ভ করল। কেউ উত্তেজনার চোটে হাওয়ায় পালটি খাচ্ছে, তো কেউ শিশির-ভেজা ঘাসে গড়াগড়ি দিচ্ছে । কেউ একরাশ মিষ্টি ঘাস মুখে পুরে চিবুচ্ছে, তো কেউ আবার পা-ঠুকে-ঠুকে মাটির চলটা ছাড়িয়ে তাজা ঘ্রাণ নিচ্ছে।
এরপর তারা আবার একবার পুরো খামারটা টহল দিল। চাষের জমি, ঘাসজমি, ফলবাগান, পুকুর, গাছে-ঢাকা ছোট জঙ্গল— কত কী রয়েছে এই খামারে! এতদিন যেন এ সব কিছুই ওরা দেখেনি! সত্যি বলতে কী, এখনও ওদের বিশ্বাস হচ্ছে না যে এর সবটাই ওদের নিজস্ব।
ঘুরতে-ঘুরতে একসময় ওরা এসে থামল খামারের বসতবাড়ির দরজার সামনে। সবাই নিমেষে চুপচাপ। কারও মুখে রা নেই। এই বাড়িটাও এখন ওদেরই সম্পত্তি— তবুও কেউ ভেতরে যেতে ঠিক সাহস পাচ্ছে না। কয়েক মুহূর্ত এ-ভাবেই কাটার পর স্নোবল আর নেপোলিয়ন তাদের কাঁধের গুঁতোয় দরজাটা খুলে ফেলল। বাকি জানোয়াররা সারি বেঁধে ধীরে ধীরে সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল।
খুব সাবধানে হাঁটছে তারা। ধাক্কা লেগে যেন কোনও কিছু ভেঙে না যায়। পা টিপে টিপে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাচ্ছে, ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে কী অবিশ্বাস্য সব বিলাসবস্তু ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে! পালকের গদি-মোড়া খাট, আয়না, ঘোড়ার কেশরের সোফা, ব্রাসেলসের কার্পেট, বৈঠকখানায় চুল্লির উপরের তাকে রাখা মহারানি ভিক্টোরিয়ার লিথোগ্রাফ। সবকিছু দেখে-টেখে ওরা যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে, তখনই বোঝা গেল মলি বেপাত্তা।
একথা শোনা-মাত্রই বক্সার কোত্থেকে একটা খড়ের টুপি নিয়ে এসে টুক করে ফেলে দিল আগুনে। ওই টুপিটা দিয়ে ও মাছির উৎপাত থেকে বাঁচতে গরমকালে কান ঢাকা দিয়ে রাখত। দেখতে-দেখতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জানোয়াররা অনেক কিছুই ধ্বংস করে ফেলল। জোন্সের চিহ্ন আর প্রায় কিছুই রইল না।
ওরা আবার ফিরে গেল ভেতরে। সবচেয়ে সুন্দর শোবার ঘরটায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মলি। সামনে জোন্স গিন্নির ড্রেসিং টেবিল। ও সেখান থেকে একটা নীল ফিতে নিয়ে ঘাড়ের সঙ্গে আটকে রেখে মুগ্ধ চোখে নিজেকে দেখছে। বড়ই বোকা-বোকা ব্যাপার। সবাই ওকে খুব একচোট বকুনি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। রান্নাঘরে কিছু শুয়োরের মাংস ঝুলছিল। সেগুলো ওরা নিয়ে গেল কবর দেবে বলে। রসুইখানার পাশের ঘরে একটা বিয়ারের পিপে রাখা ছিল। বক্সারের এক চাঁটে সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এছাড়া অবশ্য আর কোনও কিছুতেই ওরা হাত দিল না। সেখানে দাঁড়িয়েই সর্বসম্মতিক্রমে ওরা ঠিক করল যে, খামারের এই বসতবাড়িতে ওরা কেউই কখনও বসবাস করবে না। বাড়িটাকে জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে।
এরপর পশুরা প্রাতরাশ সেরে নিতেই স্নোবল আর নেপোলিয়ান তাদের ফের একত্র করল। স্নোবল বলল,
– কমরেডস… সবে সকাল সাড়ে ছ’টা বাজে। সামনে এখনও সারাটা দিন পড়ে আছে। আজ আমরা ক্ষেত থেকে খড় কাটার কাজ করব। কিন্তু তার আগে একটা ছোট্ট কাজ বাকি আছে।
এইবার শুয়োররা সবাইকে জানাল যে, গত তিন মাস ধরে তারা লেখাপড়া শিখছে। জোন্স সাহেবের বাচ্চাদের একটা পুরনো বানান বই আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেইটাই তুলে নিয়ে তারা নিজেরা পড়াশুনো করতে শুরু করেছে। নেপোলিয়নের আদেশে সাদা আর কালো রংয়ের দুটো ডিবে জোগাড় করে আনা হল। তারপর ওরা এগিয়ে চলল বড় রাস্তার কাছের পাঁচ-শিকওয়ালা সদর দরজাটার দিকে। সবচেয়ে ওপরের শিকে বড়-বড় করে লেখা ‘ম্যানর ফার্ম’।
স্নোবল লেখালিখিতে সবচেয়ে দড়। তাই সে একটা তুলি নিজের পায়ের খাঁজে আটকে নিয়ে ম্যানর ফার্মের জায়গায় লিখে দিল ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’। এখন থেকে এটাই হবে এই ফার্মের নাম। এরপর আবার সবাই খামার বাড়িতে ফিরে এল। স্নোবল আর নেপোলিয়ন কাউকে পাঠাল মই আনতে। গোলাবাড়ির পেছনের দেয়ালে সেটাকে দাঁড় করানো হল। এবার শুয়োররা সবাইকে বুঝিয়ে বলল ব্যাপারখানা কী! গত তিনমাস ধরে তারা নাকি ‘পশুবাদ’ নিয়ে বিস্তর চর্চা করেছে। এবং পশুবাদের মতো বিশাল তত্ত্বকে খুব সাফল্যের সঙ্গে মাত্র সাতটি বিধানে রূপান্তরিত করেছে। ওই সাতটি বিধান এখন এই দেয়ালে লিখে ফেলা হবে। এই বিধানের কখনও কোনও পরিবর্তন করা যাবে না এবং আজ থেকে এই ফার্মের পশুরা এই সাত-বিধানকেই আইন হিসেবে মেনে চলবে।
শুয়োরদের পক্ষে মইয়ে চড়া বড় সহজ কাজ নয়। তবুও স্নোবল কষ্টেসৃষ্টে চড়ল। রঙের পাত্র হাতে স্কুইলারও তার পিছু-পিছু উঠল কয়েক ধাপ। তারপর কালো আলকাতরার উপর বড়-বড় সাদা হরফে লেখা শুরু হল, যা প্রায় তিরিশ গজ দূর থেকেও স্পষ্ট পড়া যাবে। লেখাটা এরকম—
সাত বিধান
১। দু’পেয়েরা সবাই শত্রু
২। চারপেয়ে বা যাদের ডানা আছে, তারা সবাই বন্ধু
৩। কোনও পশু কখনও জামা-কাপড় পরবে না
৪। কোনও পশু কখনও বিছানায় শুয়ে ঘুমোবে না
৫। কোনও পশু কখনও মদ্যপান করবে না
৬। কোনও পশু কখনও অন্য কোনও পশুকে হত্যা করবে না
৭। সকল পশুই সমান
দু’ একটা ছোটখাটো ভুলচুক বাদ দিলে মোটের ওপর বেশ পরিষ্কার লেখা হয়েছে। সকলের সুবিধের জন্য স্নোবল জোরে জোরে লেখাটা পড়তে শুরু করল। পড়া শেষ হলে সবাই বেশ খুশি মনেই একমত হল ওর সঙ্গে। যারা একটু চালাক-চতুর, তারা আবার তৎক্ষণাৎ বিধানগুলো আত্মস্থ করতে শুরু করে দিল।
– এবার কমরেডস…
রঙ মাখা তুলিটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে স্নোবল বলে উঠল,
– এবার খেতের দিকে চল। আমরা দেখিয়ে দেব যে জোন্স আর তার দলবলের চেয়েও দ্রুত আমরা ক্ষেতের কাজ করতে পারি। নইলে কিন্তু মান সম্মান থাকবে না।
ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনটে গরু হাম্বা হাম্বা করে হল্লা জুড়ে দিল। অনেকক্ষণ ধরেই তাদের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। আসলে গত চব্বিশ ঘণ্টায় তাদের দুধ দোওয়া হয়নি। ব্যথায় তাদের বাঁট একেবারে ফেটে পড়ছে। কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তা করার পর শুয়োরেরা বালতি নিয়ে গিয়ে গরুদের দুধ দোয়াতে শুরু করল। দেখা গেল, তাদের সামনের পা দিয়ে এ কাজ বেশ ভালই করা যাচ্ছে। দেখতে দেখতেই অন্যান্য পশুদের লোলুপ দৃষ্টির সামনে পাঁচ-পাঁচটা বালতি ঘন তাজা দুধে ভরে উঠল।
আবার সবাই খামার বাড়িতে ফিরে এল। স্নোবল আর নেপোলিয়ন কাউকে পাঠাল মই আনতে। গোলাবাড়ির পেছনের দেয়ালে সেটাকে দাঁড় করানো হল। এবার শুয়োররা সবাইকে বুঝিয়ে বলল ব্যাপারখানা কী! গত তিনমাস ধরে তারা নাকি ‘পশুবাদ’ নিয়ে বিস্তর চর্চা করেছে। এবং পশুবাদের মতো বিশাল তত্ত্বকে খুব সাফল্যের সঙ্গে মাত্র সাতটি বিধানে রূপান্তরিত করেছে।
একজন জিজ্ঞেস করল,
– আচ্ছা… এই দুধ নিয়ে আমরা কী করব?
একটা মুরগি বলে উঠল,
– জোন্স মাঝেমধ্যেই আমাদের খাবারে একটু করে দুধ মাখিয়ে দিত…
– দুধ নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না কমরেডস।
নেপোলিয়ন বালতিগুলোকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল,
– দুধের ব্যাপারটা দেখা যাবে’খন। খেতের কাজটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। কমরেড স্নোবল তোমাদের খেতে দিকে নিয়ে যাবে। আমিও কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসছি। এগিয়ে চল কমরেডস। ফসলের খেত তোমাদের অপেক্ষায় বসে রয়েছে।
অতএব জন্তু জানোয়াররা দলবেঁধে চলল ক্ষেতের কাজ করতে। সন্ধেবেলা ফিরে তারা দেখল সেই পাঁচ বালতি দুধ কোথায় যেন গায়েব হয়ে গিয়েছে।
অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।