ঘুম থেকে উঠতে আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে। সাড়ে-সাতটায় অ্যালার্ম দেওয়া ছিল মোবাইলে। কখন যে বেজে বেজে থেমে গেছে বুঝতেই পারেনি ও। মুন্নুও তাই। শনিবার, তাই অফিসের তাড়া নেই। কিন্তু একগাদা কাজ ডায়রির পাতায় ‘টু-ডু লিস্ট’-এ জ্বলজ্বল করছে। সপ্তাহের বাজার করা, দোকানে যাওয়া, ব্যাংকের কাজ, বিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং, ইনকাম-ট্যাক্স ফাইল করা— এসব মাথায় রেখেই সায়ন্তন বেসিনের দিকে এগোলো। গিয়ে দেখে বেসিনের কল খোলা; হুড় হুড় করে জল পড়ছে। মা ঘটিতে জল ভরে বারান্দার গাছে দিচ্ছে। এখান থেকে উঁকি মেরে যা বুঝল তাতে সবে তুলসী গাছে জল দেওয়া হচ্ছে। ওই-ই প্রথম জল পায় রোজ, তার সঙ্গে মায়ের গলায় ইষ্টনাম। এরপর দুটো জবা গাছের পালা। এদের তিনজনকে দিয়ে আবার ঘটি ভরা হবে। তার মানে মিনিট দুয়েক। মায়ের পায়ের যা অবস্থা, বারান্দায় যেতে আসতে কম করেও অন্তত দুমিনিট। এর মাঝে রাস্তায় লোকেদের কাজকম্মো নজর করতে হয়ত আরও মিনিটখানেক। গার্ডেনরিচ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থেকে ফিল্টার করে আসা জল বিনা কাজে লেগে, ভবানীপুরের কোনও এক ফ্ল্যাটবাড়ির ড্রেনপাইপ বেয়ে ভরপুর অবহেলায় ফিরে যাচ্ছে মাটির তলায়, এটা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। মা’কে অনেকবার বলেও কোনও লাভ হয়নি। হওয়ার আশাও নেই। তাই সায়ন্তন নিজের টুথব্রাশটা একটু ভিজিয়ে নিয়ে কলটা বন্ধ করে দিল। টুথপেস্ট লাগিয়ে সোজা বারান্দায়। অনেকদিন বাদে ভ্যাপসা গরমটা আজ একটু কম। বোধহয় কাছে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে।

শোবার ঘর পেরোবার সময় ওর ডান চোখের কোণে ধরা পড়ল মুন্নু উঠে পড়েছে ঘুম থেকে; আড়মোড়া ভাঙছে শুয়ে শুয়ে। ওর মা অনেকক্ষণ আগেই অফিসে চলে গেছে। যদিও আজ শনিবার হাফ ডে ওদের, অফিস শুরুর সময়টা রোজকার মতই। তাই ছোট্ট বয়স থেকেই মুন্নু এই দিনটাকে বেছে নিয়েছে একটু বেশি ঘুমোনোর জন্যে। অন্যদিন সকাল সাড়ে-ছটায় স্কুলবাস ধরতে হয়। রবিবারও বেচারির নিস্তার নেই ওর মায়ের ডিসিপ্লিনের চোটে। উঠেই ক্যারাটের ক্লাসের জন্যে তৈরি হওয়া, তারপর নাচ।
বারান্দাতে একটা বাংলা আর একটা ইংরিজি খবরের কাগজ গা এলিয়ে পড়ে আছে। রোজই কাগজওয়ালার থ্রো একদম ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়। মা যথারীতি গাছে জল দেওয়া শেষ করে পাশে চায়ের দোকানে কারা ভিড় করছে তা দেখায় মত্ত। খবরের কাগজে চোখ না বুলিয়েই মা এই চায়ের দোকানের আড্ডাতে কান পাতে রোজ আর তাতেই হেডলাইনগুলো জেনে যায়। বাবা বা সায়ন্তন ডাইনিং টেবিলে কাগজ ছড়িয়ে ব্রেকফাস্ট করতে বসলে টুকটাক প্রশ্ন করে যাচাই করে নেয় সেই খবরগুলো।
“জলখাবার খেয়ে বাজার যাবি তো?”
“হুঁ।” মুখভর্তি পেস্ট বলে ঘাড়টাও সাথে নাড়ল সায়ন্তন।
“পারলে একটু কাঁকরোল নিয়ে আসিস তো। মুন্নু ওটা ভাজা খেতে ভালোবাসে।”
আবারও ঘাড় নেড়ে ও বেসিনের দিকে এগোল মুখ ধুতে।

বাবা আর ও মোটমুটি একই সময়ে ওঠে। বেসিন এখন বাবার দখলে। এবারেও কলটা পুরো খোলা, বাবা ব্রাশ মুখে নিয়ে এদিক সেদিক করছে। মুখের ভেতর থেকে টুথপেস্টের ফেনা উপচে পড়ব পড়ব করলেও সায়ন্তন ঠিক জানে বাবার মুখ ধুতে অন্তত মিনিট পাঁচেক। ততক্ষণ কলটা খোলাই থাকবে, জলও পড়ে যাবে। বাবাকে এই অহেতুক জল খরচের কথা সায়ন্তন অনেকবার বলেছে। তাতেও কোনও সুরাহা হয়নি। পুরনো অভ্যেসটাই বজায় থেকেছে। অথচ বাবা আর মা নাকি জীবনের অনেকটাই কাটিয়েছে করপোরেশনের দেওয়া সকাল বিকেলের টাইম কলের জল ব্যবহার করে। সেসব অবশ্য ওর জন্মেরও আগের কথা।
ও নিজের মুখের ফেনাটা বেসিনে ফেলতেই জলের তোড়ে সেটা ধুয়ে গেল। কলটা বন্ধ করে জিভছোলা হাতে নিতেই “ড্যাড, ড্যাডি…” মুন্নুর চিৎকার শোনা গেল। মেয়ের এখন দশ বছর বয়স হলেও আবদার কমেনি। ওর টুথব্রাশে এখন পেস্ট লাগিয়ে দিতে হবে। জিভ পরিষ্কার করার পরে মুখ ধোয়া শেষ করেই সায়ন্তন ছুটল ঘরের দিকে। এখনও শুয়ে আছেন তিনি, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। এখনও ঘুমের ঘোর কাটেনি।

“গুড মর্নিং ড্যাড, তোমার ফোনটা কোথায়?”
“সকালে উঠেই ফোন দেখতে হবে না! মা বলে গেছে তোমাকে আজ থেকে নিউজ পেপার পড়া অভ্যেস করতে।” বলতে বলতে সায়ন্তন বিছানায় উঠে মুন্নুর কপালে আদর করে পরপর দুটো হামি দিল। মুখ তুলতেই একটা দুষ্টু মিষ্টি হাসি জেগে উঠল মেয়ের মুখে
“কাল থেকে ড্যাডি।”
সায়ন্তনও হেসে ফেলল, “জো হুকুম! এবার উঠে ব্রাশ করা হোক, ব্রেকফাস্ট করা হোক।”
মুন্নু নাক উঁচু করে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা লুচির গন্ধ নিতে নিতে বলল, “তরকারি কী হচ্ছে?”
“মাখা মাখা আলুরদম।”
“গুড! ঠাম্মা কাঁকরোল আনতে বলেছে, ভুলে যেও না কিন্তু।” বলেই ও বাবার হাত থেকে ব্রাশটা নিয়ে মুখে দিল।
সায়ন্তন একটু হাসল। তাহলে ঘুমটা আগেই ভেঙেছে, বারান্দায় বাবা আর ঠাম্মার কথা ঠিকই কানে গেছে ওর।
“সে নাহয় আনব। তোমারও কিন্তু ব্রাশ মুখে দিয়ে বসে থাকা চলবে না।”

বেসিনে ফিরে এসে সায়ন্তন গালটা একটু ভিজিয়ে নিয়ে, শেভিং ফোম লাগানো শুরু করল। মিনিটখানেক বাদে মুন্নুও হাজির। ওকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে পুচুৎ করে ফেলল ওর ছোট্ট মুখভর্তি ফেনা। তারপর দুহাত কোমরে রেখে ওর দিকে ফিরে বলল,
“ওয়েস্টেজ এর বাংলাটা কী হবে ড্যাডি?”
“খুব সোজা, অপচয়।”
“তুমি জল অপচয় কর।”- যেন একটা উপসংহার টানল ও!
সায়ন্তন খেয়াল করল যে ও নিজে অল্প হলেও কলটা খুলে রেখেছিল। কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করেই মেয়ে পেছন ফিরল। মুখ ধুতে থাকল ওর বাঁ হাত দিয়ে কলের মাথাটা ধরে। বারবার ঠিক যখন হাত পেতে জল নেবে, তখনই কলটা অল্প খুলল; হাত ভর্তি হয়ে গেলেই কলটা বন্ধ করে দিতে থাকল। কল খোলা-বন্ধ’র পালা মুখধোয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতেই থাকল।
সায়ন্তন ভাবল, সত্যিই তো, কল ব্যবহার করার সময় দুটো হাতকে কাজে লাগানোর কথা কেন মাথায় আসেনি; এতদিন?
প্রান্তিক বিশ্বাসের জন্ম কলকাতায়। স্কুলে থাকতে লেখা শুরু। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ পর্যন্ত কালান্তর সংবাদপত্র, সময় ও গ্রন্থন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্প, কবিতা ও রম্যরচনা। তারপর ২০০০ সাল থেকে দীর্ঘ পনেরো বছরের বিরতি লেখায়। ফিরে আসা ছোটগল্প, অণুগল্প, নিবন্ধ ও উপন্যাসে। তথ্যপ্রযুক্তির কর্মী, বর্তমানে কর্মরত কলকাতায়। লেখা ছাড়া ঘুরতে, ছবি তুলতে আর আঁকতে ভালোবাসেন।
3 Responses
অপচয় লেখাটি ভাল লাগলো। উপসংহার প্যারাগ্রাফটি খুব সুন্দর হ’য়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত, সাবলীল লেখা। যাঁরা একটু মন দিয়ে প’ড়বেন তাঁদের সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে, আমার ধারণা। লেখককে শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন।
আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ 🙏
আনন্দ পেলাম, উৎসাহিত হলাম
ছোটদের থেকে কত শিখি। ভালো লেখা।