দুপুরবেলার নুয়ে পড়া নিরুপদ্রব আলো যখন শান্ত ভাপ ছড়িয়ে দেয় টুনুর জ্বরের ওপর, তখন দারুণ ইচ্ছে করে সবকিছুকে ভালবাসতে, যেটুকু যা বেঁচে আছে, অবসন্ন বুড়ো দাদু, শুকিয়ে যাওয়া দিদা অথবা অনেক দূরে চলে গেছে যে রীণামামিমা, টুনুর ইচ্ছে করে সবাইকে ছুঁয়ে দেখতে, যদিও ঘরে সে একলা বন্দি। জ্বরের কথা জেনে গেছে সবাই। মা আসবে, নিয়ে যাবে তাকে, শহরে, চিকিৎসার জন্য, যদিও মা আসবে না, নিয়ে যাবে না, শহরে, অন্য কোথাও, চিকিৎসার জন্য। গুবলুকে খুঁজে পাবার পাঁচদিন পরেও মা আসতে পারেনি, কত দূর থেকে যেন হাঁটা লাগাচ্ছে তো লাগাচ্ছেই, যে অন্তহীন রাস্তা তার অপেক্ষায় শরীর মেলে দিয়েছে তার খাঁজে খোঁজে কন্দরে অন্দরে জটিলতা অথবা গুপ্ত আততায়ী বারে বারে পথরোধ করে দাঁড়ায় কাঙ্ক্ষিত সুদিনের সামনে। তবুও টুনুর ইচ্ছে করে, শীতার্ত কুকুরের মতো ভালবেসে গুটিয়ে ঢুকে যায় কোনও উষ্ণ আশ্বাসের ভেতর, যেখানে গুবলু অথবা দূর জঙ্গলে আগুনের স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়াবে না।
আগুন জ্বলেছিল পরদিন, যখন পুলিশ চলে যাবার পর কিছু লোক এসেছিল আশপাশের গ্রাম থেকে। অন্ধকারে তাদের চোখ জ্বলছিল, নাকের জায়গায় টুনু দেখেছিল অন্ধকার গর্ত, চোয়াল চাপা, তাতে বিজকুড়ি ঘাম, আর তারা আঙুল উঁচিয়ে দাদুকে বলেছিল ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখতে। বিশ্বমামা মাথা নিচু করে এতক্ষণ বসেছিল কুয়োতলায়, বস্তুত গুবলুর বডি থানায় নিয়ে যাবার পর থেকেই স্থবির, এবার উঠে দাঁড়াল। তার মুখে জমা হয়েছিল ঘন মেঘ, কালচে জঙ্গল, ফাঁসুড়ে গম্বুজ। কাউকে দেখছিল না, শুধু দপদপ করছিল কপালের শিরা। সবাই মিলে দাদু দিদাকে বাড়ি ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল, আটকে দিল বাগানের গেট, আর টুনুর দিকে ফিরে কঠিন গলায় বলে গেল, ‘ঘরের জানালা খুলবে না।’
তবুও টুনু জানালা খুলেছিল, সাবধানে। পাশের ঘরের জানালা দিয়ে তখন দিদা উন্মাদ গলায় চিৎকার করে চলেছে, ‘ওকে ছেড়ে দে! আর বিপদ বাড়াসনি! সর্বনাশ হয়ে যাবে!’ অফলা বধিরতা তখন দিগন্তজুড়ে। টুনু দেখল পাগলটাকে টানতে টানতে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে চার পাঁচজন। পাগল চিৎকার করছে, গ্যাঁজলা বেরচ্ছে মুখ দিয়ে, চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে, বাগানের পাশের রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, পাছে কেউ দেখে ফেলে তাই তাড়াতাড়ি একপাশে সরে গেল টুনু, তার আগে চোখে পড়ল, পাগলটার একটা কান নেই, সেই জায়গায় দলা দলা মাংসপিণ্ড। একটা লোক তখন হাতের জ্যারিকেন থেকে পাগলের গায়ে কিছু তরল ঢালল, সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিল অন্য একজন।
‘এখানে ঢালছিস কেন? সবটা নষ্ট করবি নাকি?’

ধাঁধা লাগল টুনুর। পাগল যদি একানড়ে হয় তাহলে তার কান কোথায় গেল? নাকি সেও আসলে একানড়ের শিকার? এদিকে পাগলের চিৎকার থামাবার জন্য একজন একটা বালতি দিয়ে সজোরে মারল তার মাথায়, ঢ্যাপ করে শব্দ হল, আর গ্যাঁ গ্যাঁ আওয়াজ করে পাগলটা একপাশে কাত হয়ে গেল, রক্ত চুইয়ে পড়ল মাথা দিয়ে। একজন মাঠ থেকে আধলা ইট কুড়িয়ে এনে বসিয়ে দিল তার মুখে। পা দুটো একবার ছটফট করে উঠল, কিন্তু মুখ চেপে ধরেছে বলে চিৎকার বেরোল না। কেউ একটা বলে উঠল, ‘এখানে নয়, এখন কিছু করিস না। নিয়ে চল আগে।’ নেতিয়ে পড়া শরীরটাকে হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে মাঠের ওপর দিয়ে নিয়ে গেল সবাই।
বাকিটুকু আর দেখতে পায়নি কারণ জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল তারা। একটু পর আগুনের শিখা দেখা গিয়েছিল অন্ধকার ভেদ করে, সঙ্গে জান্তব আর্তনাদ। মার মার করে হুঙ্কার উঠেছিল। টুনু ঠকঠক করে কাঁপছিল, তবুও জানালা থেকে সরে আসতে পারেনি। সমবেত গর্জন আর পশুর মত আর্তনাদ মিলে মিশে অন্ধকার মাঠ, তালগাছ ও জঙ্গল ঘিরে ধরে পাক খেয়ে খেয়ে ওপরে উঠছিল, ধেয়ে আসছিল তীরবেগে তাদের বাড়ির দিকে। পাশের ঘর থেকে দিদার চিৎকার তখন আছাড়ি পিছাড়ি, ‘ফিরে আয়! ছেড়ে দে ওকে!’ দাদু দুই হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে, লালচে হয়ে উঠছিল আকাশ। সেই রং কিছুটা ছিটকে আসছিল তালগাছের মাথায়, যদি ওখানে কেউ লুকিয়ে থাকে তাহলে যেন ধরা পড়ে যেতেও পারে। সেই মত্তহাহা যখন রাত্রিকে জ্যান্ত জবাই করছিল, ভাঙা চাঁদের চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল রক্ত, আর বাতাস পিঠে করে ধুঁকতে ধুঁকতে পোড়া মাংসের গন্ধ বয়ে নিয়ে এসে যখন সেই লালাচ কুয়াশার দলাকে স্বেদাক্ত করে তুলল, টুনুর মনে হল রাত্রির এই উৎকট গন্ধ তার চামড়ার নিচে সেঁধিয়ে বসে থাকবে সারাজীবন।
তবুও টুনুর ইচ্ছে করে, শীতার্ত কুকুরের মতো ভালবেসে গুটিয়ে ঢুকে যায় কোনও উষ্ণ আশ্বাসের ভেতর, যেখানে গুবলু অথবা দূর জঙ্গলে আগুনের স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়াবে না।
ছিটকে যাওয়া আগুনের ফুলকি জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিল কি না সে দেখেনি, সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসা বুড়ো হাওয়া সে আগুনকে কতদূর পৌঁছে দিল, গম্বুজ অবধি কি না, বোঝেনি, শুধু লোকগুলো যখন বেরিয়ে আসছিল ছুটতে ছুটতে, সে দেখেছিল দাউদাউ করে জঙ্গল জ্বলছে, আগুন লাফিয়ে লাফিয়ে কাবাডি খেলার মতো করে পেরিয়ে যাচ্ছে এক বৃক্ষচূড়া থেকে পরের অসম্ভবে, আকাশের জামবাটি উপুড় করে কেউ ঢেলে দিচ্ছে গলন্ত হাঁসের ডিমের কুসুম, সোজা চলে যাবে মাইলের পর মাইল, বহুদূর সমুদ্রের বুকে, দাউদাউ আকাশ অরণ্য ও ভূভাগ, তখন শরীর কাঁপিয়ে গলা শুকিয়ে ও পায়ের পাতা ঠাণ্ডা করে গুঁড়ি মেরে উঠে এল জ্বরাসুর, কারণ টুনুর শরীর জুড়ে মহামারী আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।
তারপর হয়ত এক বরফযুগই কেটে গিয়েছে, যখন পুলিশ এসে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল বিশ্বমামাকে, আরও কাকে কাকে–গণপিটুনি, খুন, জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস, আরও কত কী বলে গেল, যখন রিনামামিমার দেশ থেকে তার ভাইরা এসে দিদিকে নিয়ে গেল তাদের কাছে, যখন দিদা আছাড়িপিছাড়ি–‘তোরা ওর বরকে ছাড়িয়ে নিয়ে আয়, নাহলে মেয়েটা বাঁচবে না’, পুলিশ কিছুতেই রিনামামিমাকে যেতে দিতে চাইছিল না কারণ সে নাকি সাক্ষী, তবুও ওপরতলা থেকে ধরাধরি করে চিঠি বার করে আনল তার ভাইরা, সঙ্গে মেডিকাল সার্টিফিকেট, যখন কড়া পুলিশি প্রহরা বসল জঙ্গল ঘিরে এবং দু’দিন বাদে উঠেও গেল, আবার শান্ততার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল পোড়া জঙ্গল, শুধু এক প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘অতদিনের পুরনো গম্বুজ, জেলেরা ওর উঠোনে মাছ শুকুতে দিত, সেটুকুও থাকল না, দেখে আসো গে, কেমন মরা কাঠের মতো হয়ে গিয়েছে শুকিয়ে।’
কিন্তু তার আগেই বিশ্বমামাকে কোমরে দড়ি পরিয়ে ভ্যানে তোলা হয়েছে, আর সে মুখ ফিরিয়ে ঠান্ডা পাথুরে গলায় দিদাকে বলে গেল, ‘আমাদের সবার পাপ জ্যাঠাইমা! আজ শেষ হল। রিনাকে দেখে রেখো’, দোতলার জানালা থেকে জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে টুনু দেখল বিশ্বমামা মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে একটা ফ্যাকাসে হাসির চেষ্টা করল যাকে উত্তুরে হাওয়ায় ফুটিফাটা ঠোঁটের আখরে করুণ লাগছিল, আর এই সমস্তই বহু বহু বছর ধরে চলে আসছে আর বহুদিন আগে হয়ে গেছে, তারপর থেকে মড়ার মাথার মতো হিম স্তব্ধতা বাড়ি ঘিরে। আবার বন্ধ ঘর, যা কখনও আর খুলবে না, শুকনো হাওয়া, একলা তালগাছের হিম চোখ।
টুনু উঠল বিছানা থেকে। হিসি পেয়েছে। আজ জ্বরটা একটু বেড়েছে, আর আসছেও ঘন ঘন। খাটের নীচ থেকে উঠে আসছে পিঁপড়ের দল, সুযোগ পেলেই ছেঁকে ধরবে তাকে, যেন চিনে গেছে তার ঘা। ডাক্তার দেখে কাল ওষুধ দিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু গলার কাছে ব্যথা, আর মুখে দুর্গন্ধ সে স্পষ্ট বুঝতে পারে। কবে শেষ দাঁত মেজেছিল কে জানে! পায়ের ব্যথা অসহ্য, ঘুমোতে দেয় না রাত্রে, দেওয়াল ধরে এক পায়ে লাফাতে লাফাতে বাথরুমে যায় টুনু, ফিরেও আসে। ডাক্তারবাবু টেস্ট দিয়েছে অনেক।
বিশ্বমামা মাথা নিচু করে এতক্ষণ বসেছিল কুয়োতলায়, বস্তুত গুবলুর বডি থানায় নিয়ে যাবার পর থেকেই স্থবির, এবার উঠে দাঁড়াল। তার মুখে জমা হয়েছিল ঘন মেঘ, কালচে জঙ্গল, ফাঁসুড়ে গম্বুজ। কাউকে দেখছিল না, শুধু দপদপ করছিল কপালের শিরা।
দেওয়ালের গায়ে হাত দিয়ে নিজেকে ঘষটাতে ঘষটাতে দরজার দিকে এগোচ্ছিল, যখন সামান্য টলে উঠল মাথাটা। টাল সামলাতে না পেরে টেবিলের কোণা ধরে ফেলল, আর ঠং করে কিছু একটা তার প্যান্টের পকেট থেকে মাটিতে পড়ল।
একটা চাবি। জং ধরা, লোহার। মাঝারি সাইজ।
হাঁ করে চাবিটার দিকে তাকিয়ে থাকল টুনু। কোথা থেকে আসল? তার তো মনে পড়ছে না!
নাকি, পড়ছে?
টুনু বুঝতে পারল তার হাত কাঁপছে। খালি লাগছে পেটের কাছে। সে প্যান্টের পকেট হাতড়াল। খড়মড় করে আওয়াজ হল, কিছু কাগজ।
চিঠি। তার নিজের হাতে লেখা। একানড়েকে পাঠানো। একটা চিঠির নিচে গম্বুজের ছবি, যেটা ছোটমামার খাতায় থাকার কথা। তার কাছে আসল কী করে? সে তো রেখে আসত তালগাছের নীচে!
ছেঁড়া ছবির মতো কিছু কিছু মনে আসছে কি? সেগুলো কি এতই সাঙ্ঘাতিক যাতে শিরদাঁড়া বেয়ে গুবরে পোকা হেঁটে যেতে পারে? টুনু দেওয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল। বোধশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল চিঠি ও চাবির দিকে। অল্প মাথা ঘুরছিল, হিম লাগছিল বুকের ভেতর। মেঝেতে সারি বেঁধে পিঁপড়ের ঝাঁক তার দিকেই এগিয়ে আসছে, খেয়ালই করল না।
কতক্ষণ বসে ছিল জানে না, কিন্তু অনেক গভীর জলের নীচ থেকে আস্তে আস্তে ভেসেও উঠল একসময়, যখন তার কানে বার বার নিজের নাম ভেসে আসছিল। বোবা চোখ মেলে তাকাল দরজার দিকে। ওখানে দাঁড়িয়ে কেউ একজন তাকে ডাকছে।
ছবি সৌজন্য Pinterest
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৩০ মার্চ ২০২১
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।