ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি (Rainy season) আর খিচুড়ি (Khichdi) হলো বাঙালির বর্ষার একদম মাখো মাখো ইমোশন। আর খিচুড়ির সাথে ভাজা যদি পাতে থাকে! কিম্বা খিচুড়ি আর কষা মাংস, ওহহো! খিচুড়ি আর ইলিশ (Hilsha and Khichdi) ভুললে হবে! বর্ষার সঙ্গে এসব একদম এক সুরে মাখামাখি যেন।

বৃষ্টির জন্যে চাতক পাখির মতো বসে থেকে যখন আকাশ আঁধার করে মেঘ আসে, হৃদযন্ত্র আর পাকযন্ত্রের যুগলবন্দীতে তখন অন্তরে বেজে ওঠে, “আজ তবে খিচুড়ি হয়ে যাক!” এক মুঠো চাল আর ডাল, সে তো গরিবের ঘরের ধন আবার সাত রাজারও। কেউ সঙ্গে নেয় ইলিশ ভাজা, বা কষা মাংস, কেউ বা সামান্য একটু বড়া বা ভাজা, ব্যাস!
খিচুড়ির সঙ্গে এই যে বন্ধন, সে কি আজকের! মহাভারতেও এই খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চপাণ্ডবদের জন্য দ্রৌপদীর স্বহস্তে রান্না করা খিচুড়ি, কিম্বা বিভিন্ন সময়ে ভারতে আসা পরিব্রাজকদের নথিতে উঠে আসে খিচুড়ির উল্লেখ, ইবন বতুতা হোক বা রাশিয়ার আফানাসি নিকিতিন।

তবে বর্ষা মানে যেমন খিচুড়ি, তেমন রুপোলি ইলিশও। তাই ভাবলাম বর্ষা মুখর মাসে, সঙ্গী রাখি খিচুড়ি আর ইলিশ, ইলিশ এর কিছু পদ গরম ভাতের, আর খিচুড়ি রকমফের ও আনুষাঙ্গিক কিছু অলঙ্কার।
কখনও কোনো বর্ষণ মন্দ্রিত দিনে, হালকা করে যদি একটু কাজের ছুটি পাওয়া যায় সপ্তাহের মাঝে, বাচ্চারা ‘রেইনি ডে’ বলে যদি স্কুলছুট দেয়, ফেরার পথে বৃষ্টির জমা জলে পা ভিজিয়ে বাড়ি ফেরে, খাওয়ার জায়গায় একসাথে হয় প্রিয়জনরা, ওদিকে জানলা দিয়ে দেখা যায় “উজ্জয়িনী প্রাসাদশিখরে কী না জানি ঘনঘটা, বিদ্যুৎ-উৎসব…”, আর পাতে এসে পরে সোনালী রঙের ভুরভুরে সুবাস ছড়িয়ে দেওয়া খিচুড়ি আর রুপোলি ইলিশ ভাজা, মনে হয়,এই শান্তি টুকুর জন্যেই তো বেঁচে থাকা যায়, ভালবাসায় জড়িয়ে।
খিচুড়ির সঙ্গে এই যে বন্ধন, সে কি আজকের! মহাভারতেও এই খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চপাণ্ডবদের জন্য দ্রৌপদীর স্বহস্তে রান্না করা খিচুড়ি, কিম্বা বিভিন্ন সময়ে ভারতে আসা পরিব্রাজকদের নথিতে উঠে আসে খিচুড়ির উল্লেখ, ইবন বতুতা হোক বা রাশিয়ার আফানাসি নিকিতিন।
মা আজও বলে, চালে ডালে। এই চালে ডালের সঙ্গে বাঙালির সখ্যতা ছোট থেকে একটু একটু করে গড়ে ওঠে, যত দিন যায় আর বয়স বাড়ে, পেট যেন শান্তি খুঁজে পায় এই “কমফর্ট ফুড”-এ। সেই শান্তি আর ভালবাসার ডালি সাজিয়ে আজ কিছু রান্না করি, বর্ষা স্পেশাল।
মালাই খাড়াখিচুড়ি
উপকরণ – চাল ৩০০ গ্রাম, ডাল ১২৫ গ্রাম, মটরশুঁটি ১০০ গ্রাম, আস্ত পেঁয়াজ দুটি, কাঁচালঙ্কা ৪/৫টা, একটা পেঁয়াজ কুচি, দারচিনি ১”, লবঙ্গ কয়েকটা, আর তেজপাতা, আদা এক চামচ বাটা, একটা গোটা নারকেলের দুধ, এক লিটার মতো, ঘি ১০০ গ্রাম, লঙ্কাবাটা স্বাদ মতো, হলুদ গুঁড়ো।

প্রণালী: চাল ডাল মটরশুঁটি ধুয়ে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে। একটা হাঁড়িতে ঘি গরম করে, তাতে আস্ত পেঁয়াজ আস্ত লঙ্কা দিয়ে ভালো করে নাড়তে হবে। এগুলো বেশ লাল লাল হলে তুলে নিয়ে, ওই ঘিতেই দারচিনি, তেজপাতা, পেঁয়াজ কুচি, লবঙ্গ দিয়ে ভালো গন্ধ বেরোলে, আদাবাটা, লঙ্কাবাটা, হলুদগুঁড়ো দিয়ে নেড়েচেড়ে চাল ডাল মটরশুঁটি দিয়ে আবারও খুব ভালো করে নাড়তে হবে। নারকেল দুধ দিতে হবে। হাঁড়িতে ঢাকনা লাগিয়ে ফুটতে দিতে হবে। জল ফুটলে, ভাজা গোটা পেয়াঁজ আর লঙ্কাগুলো দিয়ে সেদ্ধ হতে দিতে হবে। ডাল সেদ্ধ হলে স্বাদ মতো নুন মিষ্টি দিয়ে নেড়ে, অল্প ঢেকে রেখে নামিয়ে ফেলতে হবে। অনন্য সাধারণ স্বাদ এই মালাই খিচুড়ির।
খিচুড়ি শাহজাহানি
উপকরণ – মাংসের জন্য: ৪০০ গ্রাম মটন কিমা (পা অথবা গর্দান থেকে), ১০০ গ্রাম ঘি, লঙ্কাগুঁড়ো ১ চামচ, পেঁয়াজ বাটা তিন বড় চামচ, আদা রসুন বাটা দেড় বড় চামচ, দই ১০০ গ্রাম, ধনেগুঁড়ো এক চা চামচ, গরম মশলা গুঁড়ো এক ছোট চামচ, ফ্রেশ পুদিনা পাতা কুচি এক চামচ, বড় আর ছোট এলাচ গুঁড়ো আধ চামচ।
চাল ডালের জন্য: ৫০০ গ্রাম বাসমতি চাল, ২৫০ গ্রাম মুগ ডাল, নুন স্বাদ মতো, দুধ এক কাপ, ৫০ গ্রাম ঘি, দুটো পেঁয়াজ মিহি কুচি, দুই চামচ পেঁয়াজ বাটা, এক চামচ আদা রসুন বাটা।

প্রণালী: কড়াইতে ঘি গরম করে তাতে কিমা এবং নুন, লঙ্কা গুঁড়ো, পেঁয়াজ আদা রসুন বাটা, দই দিয়ে খুব ভালো করে কষতে হবে। প্রয়োজনে অল্প অল্প জল দিতে হবে। তারপর জল দিয়ে ফুটলে ঢাকা দিয়ে সেদ্ধ করতে হবে। নরম হয়ে এলে, আর খুব অল্প জল থাকতে থাকতে ধনে গুঁড়ো, এলাচ গুঁড়ো, গরম মশলা আর পুদিনা পাতা দিয়ে দমে বসাতে হবে যাতে একদম জল শুকিয়ে যায়।
ওদিকে অন্য প্যানে ঘি গরম করে পেঁয়াজ কুচি ভেজে নিতে হবে বাদামি করে, তাতেই দিতে হবে পেঁয়াজ রসুন আদা বাটা আর ভালো করে নাড়তে থাকতে হবে ক্রমাগত। তারপর তাতে ধুয়ে রাখা চাল ও ডাল দিয়ে হালকা ভেজে নুন এবং জল দিয়ে দিতে হবে। ৩/৪ ভাগ সেদ্ধ হলে, কিমা আর দুধ দিতে হবে। তারপর দমে রান্না হবে বেশ কিছুক্ষণ। সার্ভ করার সময় হালকা হাতে সবটা মিশিয়ে পরিবেশন করতে হবে এই রাজসিক খিচুড়ি।
বাদাম কালিয়া
উপকরণ – ৫০০ গ্রাম মটন (পা থেকে টুকরো), ১২০ গ্রাম দই, ১০০ গ্রাম ঘি, ৬০ গ্রাম নারকেল দুধ, বড় এলাচ ২, দারচিনি ২”, লবঙ্গ ৪, চারটে পেঁয়াজ সরু কুচি করা, ১০ গ্রাম লঙ্কা গুঁড়ো, জিরা ১ চামচ, এক বড় চামচ আদাবাটা, ৬০ গ্রাম আমন্ড ভিজিয়ে বাটা।

প্রণালী: মাংসে দই দিয়ে মেখে রাখতে হবে প্রায় এক ঘন্টা। ঘি গরম করে তাতে এলাচ, লবঙ্গ দারচিনি দিয়ে গন্ধ বেরোলে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে ভাজতে হবে হালকা বাদামি করে। তাতে মাংস, নুন, লঙ্কাগুঁড়ো, জিরে, আদা দিয়ে কষতে হবে, অল্প জল দিতে হবে, যাতে জল শুকোতে শুকোতে মাংসও সেদ্ধ হয়ে। প্রায় সেদ্ধ হলে নারকেল দুধ দিয়ে ফুটলে আমন্ড বাটা দিতে হবে। অল্প আঁচে থাকবে যতক্ষণ না গ্রেভি একদম গাঢ় হয় আর ঘি ভেসে ওঠে। এই বাদামি কালিয়া একদম গরম শাহজাহানি খিচুড়ির সাথে জমে যাবে।
ইলিশ আনারসি
উপকরণ – ইলিশ ৪ পিস, মৌরি গোটা এক চামচ, তেজ পাতা একটা, কাঁচালঙ্কা ৩/৪ টে, হলুদগুঁড়ো ১ চা চামচ, মৌরি বাটা এক চামচ, লঙ্কাগুঁড়ো ১/২ চা চামচ, ছেঁকে রাখা অর্দ্ধেক আনারসেরর পাল্প, সর্ষের তেল চার বড় চামচ।

প্রণালী: তেল গরম করে তাতে মাছগুলো কয়েক সেকেন্ড দিয়ে এপিঠ ওপিঠ করে তুলে রাখতে হবে, ওই তেলেই গোটা মৌরি, কাঁচালঙ্কা আর তেজপাতা দিয়ে গন্ধ বেরোলে হলুদ, লঙ্কাগুঁড়ো আর মৌরিবাটা জলে গুলে দিয়ে কষে নিতে হবে। তারপর আনারসের রস আর পাল্প দিয়ে ফুটলে, আস্তে করে মাছ ছেড়ে দিতে হবে। নুন আর প্রয়োজনে অল্প চিনি দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে।
নারকেল দুধে ইলিশ
উপকরণ – ইলিশ ৪ পিস, নারকেল দুধ এক কাপ, এক চামচ সর্ষে বাটা (ছেঁকে রাখতে হবে খোসা), কালোজিরে ছোট আধ চামচ, কাঁচা লঙ্কা ৩/৪ টে, সর্ষের তেল ৪ চামচ, হলুদগুঁড়ো এক চামচ, নুন স্বাদ মতো।

প্রণালী: তেল গরম করে হালকা হাতে মাছ ভেজে রাখতে হবে। কাঁচা মাছেও করা যায়। ইলিশ মাছ বেশি করে জলের নিচে ধোয়া যাবে না। ওই মাছ ভাজার তেলে, কালোজিরে লঙ্কা ফোড়ন আর হলুদগুঁড়ো দিয়ে, কয়েক সেকেন্ড ভেজে, তাতে সর্ষে ছাঁকা আর নারকেল দুধ দিতে হবে। ফুটলে ইলিশ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এক মিনিট পর হালকা হাতে উল্টে দিতে হবে। সেদ্ধ হলেই নামিয়ে নাও, নারকেল মালাই-এর ইলিশ তৈরি। খেয়াল করতে হবে, ইলিশ সেদ্ধ হতে কিন্তু খুব কম সময় লাগে।
পুর ভরে কাঁকরোল ভাজা
উপকরণ – কাঁকরোল দুটো, নুন চিনি দিয়ে বেসন গোলা, তেল ভাজার জন্য।
পুরের জন্যে: পোস্ত বাটা দুই চামচ, সরষে বাটা এক চামচ, নারকেল বাটা এক চামচ, স্বাদ মতো নুন মিষ্টি আর লঙ্কাবাটা দিতে হবে।

প্রণালী: কাঁকরোল লম্বায় অর্দ্ধেক করে কেটে সেদ্ধ করে নিয়ে, ভিতরের দানা বাদ দিয়ে, তাতে এক চামচ পুর ভরে, চারদিকটা বেশ ভালো করে বেসনে ডুবিয়ে, ডুবো তেলে, মিডিয়াম আঁচে ভাজতে হবে বাদামি করে।
গরম খিচুড়ির সাথে, বেগুন ভাজা, ইলিশ ভাজা, কুমড়ো ভাজার সাথে এটিও নাহয় জায়গা করে নিক। জমে উঠুক বর্ষাকাল সবার পাতে।
ছবি সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।