Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

উপন্যাস: আকাশপ্রদীপ: পর্ব ৬

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

সেপ্টেম্বর ৮, ২০২২

san diego city
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] []

১৫

জিনিয়া একটা কফি নিয়ে পথ হাঁটছে৷ রোদ ঝলমলে দিন৷ এখানে রোদ ঝলমলে আবহাওয়া ব্যতিক্রম নয়, বরং নিয়ম৷ জিনিয়ার অফিসটা খুব মজার, কারণ অফিসে কোনও ওয়ার্কিং আওয়ার্স নেই৷ পুরোটাই ফ্লেক্সিবল্‌৷ যে যেমন চায় সেইভাবে কাজ করে৷ জিনিয়া যেমন সপ্তাহে চারদিন বাড়ি থেকে কাজ করে৷ বিভিন্ন লেখার এডিটিংয়ের কাজ৷ পুরো মেটিরিয়ালটাই কম্পিউটারে৷ কাজের পরে শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া৷ কখনও ওর তলার লেভেলের এডিটরদের কাছে পরামর্শ এবং নির্দেশ সহকারে৷ কখনও লেখকের সঙ্গে কথা বলা, কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন করা প্রয়োজন, কোথায় আইডিয়াটা আরও বিস্তারিত করা দরকার, কোন অংশগুলো ছেঁটে ফেলতে হবে– সেগুলো নিয়ে লেখকদের সঙ্গে কথা বলতে হয় ওর৷ ওদের কোম্পানি শুধু ফিকশনই ছাপে৷ অন্য ধরনের কোনও লেখা ছাপা হাউস পলিসি নয়৷ অনুবাদও ওরা ছাপে না৷ তার জন্য অন্য পাবলিশার আছে৷ 

আজ জিনিয়ার মনটা খুব ফুরফুরে৷ একজন নতুন ভারতীয় লেখককে সে আবিষ্কার করেছে৷ আবিষ্কার করাটা অবশ্য তার কাজ নয়৷ তার জন্য কমিশনিং এডিটর রয়েছে৷ নীল বলে এই ছেলেটার লেখা যে ছাপা হবে ইতিমধ্যেই সেটা ডিসাইডেড৷ টেলিফোনে বেশ কিছুটা কথা হয়েছে ছেলেটার সঙ্গে৷ বড়জোর বছর পঁয়তিরিশ হবে৷ ইস্ট কোস্টে বস্টন হারবারের কাছে একটা নেবারহুডে বড় হয়ে উঠেছে ও৷ বাবা ভারতীয়৷ মা বোধহয় চাইনিজ-অ্যামেরিকান৷ ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে নানারকম বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সাবালক হয়ে ওঠার কাহিনি৷ বাবা-মায়ের ইমিগ্র্যান্ট এক্সপিরিয়েন্স,ছেলেটার নিজস্ব টেক, সবই রয়েছে কাহিনীতে৷ জিনিয়া নিশ্চিত, যে কতকগুলো অংশ ঠিকমতো সেল করতে পারলে খুব কাটতি হবে উপন্যাসটার৷ এত বছর পাবলিশিং ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে ও এখন এই জিনিসগুলো কিছু কিছু বুঝতে পারে৷ ইমিগ্র্যান্ট এক্সপিরিয়েন্স নিয়ে তো কতই লেখা হচ্ছে এখন৷ সবগুলোর মান সমান নয়৷

নীলের লেখাটা সত্যি অন্য রকমের৷ নীলের সঙ্গে যতটা না প্রয়োজন থেকে, তার চেয়েও বেশি একটা জেনুইন কৌতূহল থেকে ফোন করেছিল ওকে৷ লেখকদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে ও কথা বলে সত্যিই, কিন্তু এক্ষেত্রে তেমন কোনও দরকার ছিল না৷ প্রথমে ই-মেল করে তারপর ফোন করাটাই দস্তুর এখানে৷ কিন্তু উপন্যাসটা উল্টেপাল্টে বেশ ভালো লেগে যাওয়ায় অফিসের তথ্য থেকে ফোন নম্বরটা জোগাড় করেছিল জিনিয়া৷ প্রথমে ভয়েস মেলে গেছিল৷ বাড়ির ফোন নাম্বারই দেওয়ার নিয়ম অফিসে৷ একবার ফোন করে আলাপ পরিচয় হয়ে গেলে সেলফোন নম্বর বিনিময় হতে পারে৷ কিন্তু অচেনা ব্যক্তির সেলফোনে ফোন করা এই পাবলিশিং হাউসে নিয়মবিরুদ্ধ৷ ‘দিজ ইজ নীল হিয়ার, প্লিজ লিভ ইয়োর নাম্বার৷ আই উইল কল ইউ ব্যাক৷’ ফোন নম্বর রেখে জিনিয়া বলেছিল, ওর পাবলিশিং হাউসের নাম৷ তিন দিন বাদে এক সন্ধ্যেয় ফোন করল নীল৷ খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়েই৷ ওর লেখা তো কমিশনড্‌ হয়ে গেছে৷ তাহলে? কোনও সমস্যা? নতুন লেখকদের সবসময় একটা উদ্বেগ কাজ করে ভিতরে ভিতরে৷ না না সমস্যা কিছু নেই৷ এমনিই জিনিয়া আলাপ করতে ফোন করেছে৷ ওর নিজের অভিজ্ঞতাও কিছুটা এইরকম৷ সেজন্যই ফোন৷ একটু কৌতূহল হয়েছিল হয়তো জিনিয়া সম্পর্কে৷ 

তারপর থেকে জিনিয়ার সঙ্গে বারকয়েক কথা হয়েছে নীলের এই ক’দিনে৷ খুব অকপট, সরল সোজা মনে হয়েছে নীলকে৷ প্রথম আলাপেই বেশ ওপেন আপ করেছে নীল৷ ওর বাবা এখনও অ্যাটলান্টিক সিটিতেই থাকেন৷ মার সঙ্গে বহুদিন আগে ডিভোর্স হওয়ার পর বাবা আর বিয়ে করেননি৷ মা বিয়ে করে শিকাগোতে৷ খুব ভালো সম্পর্ক ওর মা আর বাবার সঙ্গে৷ মাঝে মাঝে ও যায় সৎবাবার বাড়ি৷ সৎ ভাইয়ের সঙ্গেও ভালো র‌্যাপো ওর৷ ‘হি ইজ ইনটু কার্পেনট্রি’ নীল বলেছে৷ ওর বাবা অ্যাটলান্টিক সিটিতে একটা ক্যাসিনোতে সিনিয়র ম্যানেজার৷ জিনিয়া শুনে উচ্ছ্বসিত৷ অ্যাটলান্টিক সিটি৷ ছোটোবেলায় দু’একবার মা-বাবার সঙ্গে ওরা দুই ভাইবোনও গেছে বেড়াতে৷ ক্যাসিনো ওর বাবার ধাতে সইত না৷ ওখানে বেশিরভাগ লোক যায় ক্যাসিনোর আকর্ষণে৷ জ্যোতির্ময় আর অরুণলেখা সমুদ্রের ধারে চাদর পেতে চুপ করে বসে থাকতেন৷ চারদিকের জীবন উপভোগ করতেন৷ বাবাই আর জিনি তখন নেহাতই বালক-বালিকা৷ ওরা সমুদ্রের ধারে হুটোপুটি করে খেলা করত৷ নীল হাসছিল৷ 
– পরে যদি কখনও আবার যাও, লুক ফর দ্যা বিগেস্ট ক্যাসিনো দেয়ার৷ ইট ইজ রান বাই ট্রাম্প৷ এবার এলে স্পেশাল ডিসকাউন্ট করে দিতে বলব তোমার জন্য৷
ট্রাম্প টাওয়ারের তলায় ওই ক্যাসিনোতেই নীলের বাবা ম্যানেজার৷ ট্রাম্পের সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ক্যাসিনোর একটা৷ অল দ্যা মোর রিজন নট টু গো দেয়ার ৷ মনে মনে জিনি বলেছিল, যদিও মুখে প্রকাশ করেনি৷ কে জানে নীল যদি আমেরিকায় বসবাসকারী অনেক অনেক ভারতীয়র মতো ট্রাম্পভক্ত হয়! না হওয়াটাই অবশ্য স্বাভাবিক৷ ইমিগ্র্যান্ট এক্সপেরিয়েন্সের মধ্যে দিয়ে যারা গেছে, তাদের মনে ট্রাম্পের কিছু মূল নীতির প্রতি বিরাগ থাকাই স্বাভাবিক৷ তবু নীলের লেখা পড়ে ট্রাম্প জমানার প্রতি তার মনোভাব খুব স্পষ্ট নয়৷ কী দরকার সহজ কথাবার্তার মধ্যে একটা তিতকুটে ভাব আমদানি করার? নীল কীভাবে কোন সেটিংয়ে থাকে, ওর কোনও বিশেষ বন্ধু বা পার্টনার আছে কিনা, এসব জিনি জানে না৷ তবে নীলের লেখার মাধ্যমে ওর জীবনটা অনেকটাই খোলা পাতার মতো৷ 

San diego
স্প্যানিশ আর্কিটেকচার কীভাবে প্রভাবিত করেছে সান দিয়েগোর স্থাপত্যশৈলী, তাই নিয়ে কথা বলতেন বাবা

জিনিয়া সহজভাবে নীলের সঙ্গে গল্প করেছে৷ ওর নিজের জীবনের কথা অনেকটাই বলেছে নীলকে৷ ফিলাডেলফিয়ার পাথরের তৈরি একটা কাসলের মতো বাড়িতে ওর বড়ো হওয়া, কলাম্বিয়ায় এডিটিং এ্যন্ড পাবলিশিং নিয়ে পড়াশুনো, অ্যালেক্স, রুণের কথা৷ ও যে এখন ডিভোর্সি এবং একজন পার্টনার আছে, তাও বলেছে৷ শুধু দুটো কথা বলেনি৷ লুকিয়ে রাখার জন্য না, বলার দরকার হয়নি বলে৷ রুণ যে একজন স্পেশাল নিডের বাচ্চা এবং রুণের সূত্রেই যে ওর সঙ্গে বিয়াট্রিসের দেখা, সেটা জিনিয়া বলেনি নীলকে৷ সব কথা সবাইকে বলার দরকার হয় না৷ কাকে জীবনের কতটুকু দেখাবে, কতখানি উন্মুক্ত করে দেবে, সে ব্যাপারে জিনিয়ার এখন মতামত খুব স্পষ্ট৷ নিজের বুদ্ধি, বিবেচনা এবং বিবেক যা বলে, সেটাই পথনির্দেশ বলে মেনে নেয় জিনিয়া৷ কফি শেষ করে কাপটাকে ট্র্যাশে ফেলে বালবোয়া পার্কের পুবকোণের এনট্রান্সটা দিয়ে ঢুকে পড়ল জিনিয়া৷ ওদের বাড়ির খুব কাছেই এই বিশাল পার্কটা৷ হাজার রকম অ্যামিউজমেন্ট এর ব্যবস্থা এখানে৷ কত রকমের মিউজিয়াম, চারদিকে বিশাল বিশাল থামওয়ালা আর্কেড, যাতে স্প্যানিশ স্থাপত্যের প্রভাব স্পষ্ট৷ ফোয়ারা, রেস্তঁরা, কফি শপ৷ একদিকে সান ডিয়েগো জু৷ রুণকে নিয়ে এখানে আসা আজ বহুবছর ধরে জিনিয়াদের প্রতি শনিবারের রুটিন৷ যদি কখনও জিনিয়া না থাকে তবে বিয়াট্রিসই রুণকে নিয়ে আসে৷ প্রতি শনিবার জিনিয়া একটা কফি বা অন্য কোনও ড্রিঙ্ক নিয়ে বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে এখানে৷ ওদের ফ্যামিলি পাস আছে. তাই সারা বছর শুধু পার্ক নয়, নানা ধরনের অনুষ্ঠান, সব মিউজিয়াম, জু, সবকিছু ফ্রি ওদের জন্য৷ রুণকে ওর সেশন থেকে তুলে বিয়াট্রিস আসে একটু পরে৷ প্রতি শনিবার সকালে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপির একটা ট্রেনিং সেশন থাকে রুণের৷ বিয়াট্রিস নিজেও যুক্ত ওই ট্রেনিং সেন্টারটার সঙ্গে৷ বিয়াট্রিস আর রুণ এসে যোগ দেয় জিনিয়ার সঙ্গে৷ ওরা না আসা অবধি জিনিয়ার মি-টাইম৷ জিনিয়া তখন নিজের সঙ্গে সময় কাটায়৷ পার্কে বসে এই একান্ত নিজের এই সময়টা ওর ভারি পছন্দের৷ 

বহুদিন আগে যখন রুণ হয়নি, তখন অ্যালেক্স আর ও এই পার্কে সুযোগ পেলেই চলে আসত৷ তখন হারবারের কাছে একটা টু-রুম অ্যাপার্টমেন্টে থাকত ওরা৷ রুণ হবার পর একবার জ্যোর্তিময় আর অরুণলেখা এসেছিলেন সেই বাড়িতে৷ বালবোয়া পার্কে গিয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন জ্যোর্তিময়৷ স্প্যানিশ আর্কিটেকচার কীভাবে প্রভাবিত করেছে সান দিয়েগোর স্থাপত্যশৈলী, এ নিয়ে বলতে শুরু করলে আর থামতেন না তিনি৷ সেবার রুণকে দেখতে এসে গোটা এক মাস ছিলেন মা-বাবা৷ সেই প্রথম বাবার রাগ পড়ল৷ তার আগে জিনিয়া যখন অ্যালেক্সকে বিয়ে করার কথা বাড়িতে বলল, তখন ছ’মাস জ্যোর্তিময় কথা বলেননি জিনিয়ার সঙ্গে৷ বাবা যে কতখানি জেদি, একগুঁয়ে এবং হৃদয়হীন হতে পারে সেই সময় বুঝেছিল ও৷ রুণ হবার পর আবার সেই আগের বাবাকে যেন ফিরে পেয়েছিল জিনিয়া৷

সে সব অনেক বছর আগের কথা৷ মনে হয় যেন গত জন্মে ঘটেছিল সেসব৷ তখন রুণের রোগটা ধরা পড়েনি৷ দু’বছর বয়সে যখন প্রথম ধরা পড়ল রুণ অটিস্টিক, তখন যেন গোটা জগৎটাই ধসে পড়েছিল জিনিয়ার সামনে৷ জিনিয়ার ভিতরের কেরিয়ারিস্ট সত্তাটা যেন হঠাৎ ভেঙেচুরে মাটিতে মিশে গিয়েছিল৷ যে চাকরিটা করত, সেটা ছেড়ে দিল৷ দিনরাত রুণকে নিয়ে বসে থাকত আর চোখ থেকে ঝরঝর করে জল পড়ত৷ অ্যালেক্স গোটা ব্যাপারটা অনেক স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল৷ স্বামী স্ত্রী মিলে অনেক পড়াশুনো করেছিল এই নিয়ে৷ অ্যালেক্স ওকে পরিসংখ্যান দেখিয়েছিল, আমেরিকার প্রতি উনষাট জন শিশুর মধ্যে একজন অটিজমে আক্রান্ত৷ কারোর মধ্যে বেশি, কারোর কম৷ কোনও কিছুতেই সান্ত্বনা পেত না জিনিয়া৷ স্পেশাল নিড বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি হল রুণ৷ সেই স্কুলেই বিয়াট্রিস চাকরি করত৷ এই ধরনের বাচ্চাদের জন্য স্পেশাল ট্রেনিং নেওয়া টিচার ও৷ সেখানেই আলাপ৷ বিয়াট্রিস অসামান্য যত্ন করত বাচ্চাদের৷ রুণের প্রতি যেন একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব ছিল বিয়াট্রিসের৷ সত্যিই কি তাই? নাকি পরে হাইন্ডসাইটে এসব মনে হয়, এখন আর ঠিক বুঝতে পারে না জিনিয়া৷ তবে রুণ তখন থেকেই চোখে হারাত বিয়াট্রিসকে৷ এখন পনেরো বছর পরেও রুণ আর বিয়াট্রিস দু’জন দু’জনকে তেমনি ভালবাসে৷

এসব ভাবতে ভাবতেই জিনিয়া দেখল বিয়াট্রিস আর রুণ হাসি হাসি মুখে ওর দিকে এগিয়ে আসছে৷ রুণ এসে জিনিয়ার পাশে বসে আগে অনেকক্ষণ ধরে হাসল৷ ও শব্দ করে হাসে৷ তীক্ষ্ণ একটা বাঁশি যেন হঠাৎ খুব একা হয়ে দমকে দমকে ভিতরের গুমরানো কান্নাকে উজাড় করে দিচ্ছে, এরকম একটা শব্দ ওর হাসির৷ বাইরে অনেক লোক চমকে ফিরে তাকায়৷ রণো আর রোহিণী বছর দুয়েক আগে খ্রিস্টমাসের ছুটিতে যখন বেড়াতে এসেছিল, তখন রোহিণী এই হাসিটা শুনে চমকে গেছিল, স্পষ্ট মনে আছে জিনিয়ার৷ রোহিণী তো জানতই যে রুণ অটিস্টিক৷ তবু খুব কাছ থেকে রুণকে দেখা, ওর হাবভাব ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করা ওর হাসি শোনা, এক ধরনের শকিং এক্সপিরিয়েন্স ছিল হয়তো রোহিণীর কাছে৷ তবে রোহিণী খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে৷ কোনওভাবেই ও জিনিয়াকে বুঝতে দিতে চায়নি যে ও একটু চমকে গেছে৷ রোহিণী, জিনিয়া আর বিয়াট্রিসের যৌথ জীবন নিয়ে কোনও আগ্রহ দেখায়নি, খুব সহজভাবে অ্যালেক্স আর মেরির বাড়িতে গেছে ডিনারের নিমন্ত্রণে৷ ওর সীমা লঙ্ঘন করে কোনও অযথা কৌতূহল দেখায়নি বা নিরসনের চেষ্টা করেনি৷

রুণ একচোট হেসে নিয়ে জিনিয়ার কাঁধে তিনবার ট্যাপ করল৷ এটা ওর নিজস্ব আর একটা ভঙ্গি৷ যেদিন ও বিশেষ খুশি হয়, সেদিন এরকম মায়ের কাঁধে ট্যাপ করে ওর ভিতরকার খুশি জানান দিতে চায় ওকে৷ বিয়াট্রিসও হাসছে৷ রুণের পাশে গিয়ে ও ষড়যন্ত্রের ভঙ্গীতে বলল
– শ্যাল উই নাউ টেল হার আওয়ার প্ল্যান?
– ইয়া! উই উইল!
রুণ ঘুরে একবার বিয়াট্রিসকে দেখে নিয়ে আবার ঘুরছে জিনিয়ার দিকে।
– মামা! রিমেমবার দ্য প্রমিস! নাউ ইউ হ্যাভ টু গিভ মি হোয়াট আই ওয়ান্ট৷
আঠেরো বছর বয়সের তুলনায় রুণের মনটা বাড়েনি৷ রুণের মনের বয়স এগারো-বারোর কিশোরের মতো৷ কিন্তু শরীরটা বেড়েছে হু হু করে৷ রুণের মাথায় সোনালি চুল৷ গড়নটাও অ্যালেক্সের মতো৷ রুণের সারল্যময় চোখদুটো আনন্দে চিক্‌চিক্‌ করছে৷ আঠেরো বসন্ত পার করা রুণকে দেখে জিনিয়ার ইদানিং বিভ্রম হয়৷ ঠিক যেন পঁচিশ বছর আগেকার অ্যালেক্স৷ শুধু চুলটা ছোট করে ছাঁটা৷ চুল বেশি বাড়লে রুণের অসুবিধে হয়৷ বিয়াট্রিস আর রুণ দুজনে মিলে পালা করে বলছে ওদের চাহিদার কথা৷ হ্যাঁ, জিনিয়া প্রমিস্‌ করেছিল রুণকে, ওর আঠেরো বছর বয়স হলে ও যা চায়, তাই দেবে৷ সাধ্যের মধ্যে হতে হবে অবশ্যই সাধটা৷ 

Runn special need child
আঠেরো বছর বয়সের তুলনায় রুণের মনটা বাড়েনি

জিনিয়া ভেবেছিল রুণ বাড়িতে একটা পেট আনার কথা বলবে৷ অনেকদিন ধরেই রুণের একটা হ্যামস্টার পোষার শখ৷ বিয়াট্রিসকে ও ইতিমধ্যেই বলেছে শখটার কথা৷ ‘উইন্টার হোয়াইট ডোয়ার্ফ হ্যামস্টার’ রাখতে চায় রুণ৷ নিশ্চিতভাবেই রুণ সেই শখটার কথাই বলবে বলে ধরে নিয়েছিল জিনিয়া৷ কিন্তু না, রুণ অন্য একটা শখের কথা বলছে৷ একটা ক্রুজে যেতে চায় ও৷ সবাই মিলে৷ যারা ওর জগতে ম্যাটার করে৷ বিয়াট্রিস, জিনিয়া, অ্যালেক্স, মেরি সবাই মিলে যেতে হবে৷
– বিয়াট্রিস, মি, ইউ অ্যান্ড ড্যাড অ্যান্ড মেরি।
রুণ দাবি জানায়৷ জিনিয়া একটু গম্ভীর হয়ে গেছে৷ রুণের হাসির মধ্যে দিয়ে যে অনাবিল আনন্দটা ওর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, তা আর বোধ করতে পারছে না জিনিয়া৷ রুণ একটা স্বপ্ন দেখছে৷ একটা সুখী পরিবারের একত্রে সমুদ্রভ্রমণে যাবার স্বপ্ন, যে ধরনের বেড়ানোটা জিনিয়ার পক্ষে অনেক স্বাভাবিক ছিল কিশোরী বয়সে৷ মামণি, ড্যাড ও আর ওর দশ বছরের বড়ো দাদা বাবাই মিলে এরকম কত জায়গায় বেড়াতে গেছে৷ রুণের জগতে যেমন বিয়াট্রিস আর জিনিয়ার পাশাপাশি অ্যালেক্স আর মেরিও একই ইউনিট৷ সত্যিই অ্যালেক্স আর জিনিয়া যখন সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিল, তখন রুণকে তার আঁচ বুঝতে দেয়নি ওরা৷ তার কিছু আগে থেকেই বালবোয়া পার্কের কাছে এই অ্যাপার্টমেন্টে চলে এসেছিল জিনিয়া৷ অ্যালেক্স থেকে গিয়েছিল পুরনো বাড়িতে৷ উঁচু জমিতে বাংলো ধরনের বাড়িটায় জিনিয়ারও দশ বছরের দাম্পত্য জীবনের স্মৃতি আছে৷ সেই বাড়িতে এখন মেরি থাকে৷ অ্যালেক্সর ছাত্রী৷ অ্যালেক্স কনসার্ট পিয়ানিস্ট৷ মেরির সঙ্গে কবে থেকে পরিচয় সঠিক জানে না জিনিয়া৷ যখন ও আর অ্যালেক্স স্বামী-স্ত্রী ছিল, তখন থেকেই কি? তখন থেকেই কি ওদের সম্পর্কের শুরু? এসব আর জানার কৌতূহলও এখন হারিয়ে ফেলেছে জিনিয়া৷ যে অ্যালেক্সের প্রতি এত পজেসিভ ছিল ও, সেই অ্যালেক্স এখন অন্য একটি নারীর৷ মেরি খুব চমৎকার মেয়ে৷ একটু যেন আপনভোলা৷ নিজের জগতেই থাকে৷ সেই জগতে পিয়ানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ বাজনাকে ঘিরেই এখন অ্যালেক্সের ঘর-সংসার৷ 

অ্যালেক্স আর মেরির আন্ডারস্ট্যাডিং নিশ্চয়ই বেশ গভীর৷ খুব সুন্দর দম্পতি ওরা৷ অন্ততঃ বাইরে থেকে দেখে তো সেই রকমই মনে হয়৷ বয়সের তফাৎ সত্ত্বেও৷ অ্যালেক্সের বয়স এখন ছেচল্লিশ বছর৷ জিনিয়ার চেয়ে দু’বছরের ছোটো ও৷ মেরির বড়জোর ত্রিশ হবে এখন৷ আট বছর হল একসঙ্গে আছে৷ অ্যালেক্সের সঙ্গে ওর চেনাশোনা হয়তো দশ বছর হল৷ যখন মেরি কুড়ি বছরের তখন ও পিয়ানো লেসন নিতে প্রথম আসে অ্যালেক্সের কাছে৷ অ্যালেক্স তখন পঁয়ত্রিশ কি ছত্রিশ৷ একজন অটিস্টিক বাচ্চার বাবা, যার ঘরভাঙা স্ত্রী ভারতীয়৷ জিনিয়া তো অস্বীকার করতে পারে না যে ঘরভাঙার প্রথম দায়িত্ব ছিল তার৷ তার জীবনে কোনটা যে বেশি বড় জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়া ঘটনা, রুণের রোগটা ধরা পড়া নাকি বিয়াট্রিসের সঙ্গে চেনাশোনা হওয়া– এতদিন পরেও বুঝতে পারে না জিনিয়া৷ রুণ যে অন্য পাঁচটা বাচ্চার থেকে আলাদা, ও যে কোনওদিনই তথাকথিত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে না, এটা জানার পর সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে গেছিল জিনিয়া৷ অ্যালেক্স হয়তো নিজের মতো করে যোঝার চেষ্টা করেছিল৷ সাধ্যমতো সান্ত্বনাও দিতে চেষ্টা করেছিল জিনিয়াকে৷ কিন্তু কোনও সান্ত্বনাই বোধহয় সেই সময় জিনিয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না তখন৷ বেঁচে থাকার কোনও মানে যখন হারিয়ে যাচ্ছে, কোনও কিছুর জন্যই যখন আর সামনে তাকাবার তাগিদ পাচ্ছে না জিনিয়া, তখন বিয়াট্রিসের সঙ্গে দেখা৷ বিয়াট্রিস রুণদের স্কুলের টিচার ছিল৷

জিনিয়া নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে গেছিল৷ ‘ওকে, উই উইল সি’ বলায় রুণ মাথা ঝাঁকাচ্ছিল৷ কোনও কিছুতে সন্তুষ্ট না হলে ও মাথা ঝাঁকায়৷ ওর যে মনমতো হয়নি কোনও কথা, সেটা শরীরী ভাষায় ব্যক্ত করতে থাকে৷ ওকে তখন, কোনও না কোনওভাবে শান্ত করতে হয়৷ ওকে শান্ত করার কাজটা বিয়াট্রিস অনেক ভালোভাবে পারে৷ ছোট থেকে দেখছে বলে রুণকে ও ভীষণ ভালো বোঝে৷ অনেক সময় জিনিয়ার থেকেও ভালো বোঝে৷ সেটা কিছুটা ওর ট্রেনিংয়ের জন্যও৷ স্পেশাল নিড বাচ্চাদের জন্য জিনিয়ার থেকে অনেক বেশি তৈরি ও৷ জিনিয়া এত বছরে যা কিছু শিখেছে, সবই রুণকে বড় করতে গিয়ে শিখতে হয়েছে৷ জীবন ওকে ঘাড়ে ধরে বুঝিয়েছে বাস্তব আর স্বপ্নের তফাৎ৷ রুণের মাথা ঝাঁকুনিতে ওর সম্বিৎ ফিরেছিল৷ বিয়াট্রিস ওকে শান্ত করার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে৷ – পারহ্যাপস্‌ শি ইজ থিংকিং অ্যাবাউট দ্যা টাইম৷ উড ক্রিসমাস হলিডেস বি বেটার ডিয়ার, অর দ্য নেক্সট সামার?
শেষ প্রশ্নটা জিনিয়ার প্রতি৷ কিন্তু প্রশ্নটা রুণকে কিছুটা অন্যমনস্ক করার জন্য৷

দু’বছর বয়সে যখন প্রথম ধরা পড়ল রুণ অটিস্টিক, তখন যেন গোটা জগৎটাই ধসে পড়েছিল জিনিয়ার সামনে৷ জিনিয়ার ভিতরের কেরিয়ারিস্ট সত্তাটা যেন হঠাৎ ভেঙেচুরে মাটিতে মিশে গিয়েছিল৷ যে চাকরিটা করত, সেটা ছেড়ে দিল৷ দিনরাত রুণকে নিয়ে বসে থাকত আর চোখ থেকে ঝরঝর করে জল পড়ত৷ অ্যালেক্স গোটা ব্যাপারটা অনেক স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল৷ স্বা

আসল কারণটা বিয়াট্রিস জানে৷ অ্যালেক্স আর মেরি সপ্তাহে একদিন করে রুণকে ওদের কাছে নিয়ে যায়৷ মেরির সঙ্গে রুণের এই ক’বছরে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে৷ বয়সেও মেরি রুণের থেকে খুব বেশি বড়ো নয়৷ রুণ প্রথম প্রথম মেরির কাছে খুব আড়ষ্ট থাকত৷ এখন আবার মেরির সঙ্গে ওর বেশ ভাব৷ প্রতি সপ্তাহে সাধারণতঃ রবিবার অ্যালেক্স রুণকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় সকালবেলা৷ সারাদিন পর রাতে আবার পৌঁছে দেয়৷ রুণের খরচ-খরচার একটা বড় অংশ এখনও দেয় অ্যালেক্স৷ স্বেচ্ছায় দেয়৷ না দিলেও এখন জিনিয়া যেমন চাকরি করে, তাতে রুণের খরচ সে সামলাতে পারবে৷ আপাতভাবে মেরিরও নিশ্চয়ই এই বন্দোবস্তে আপত্তি নেই৷ পার্টনারের আপত্তি থাকলে কি ইচ্ছে সত্ত্বেও অ্যালেক্স রুণের সঙ্গে সপ্তাহে একটা দিন করে কাটাতে পারত? অসুবিধেটা অন্য জায়গায়৷ অ্যালেক্স আর মেরি ওদের সঙ্গে ক্রুজে যাওয়ার ব্যাপারটা নাও চাইতে পারে৷

ক্রুজ এখানে অনেক রকম৷ অতি বিলাসবহুল থেকে মোটামুটি অ্যাফোর্ডেবল্‌ পর্যন্ত হরেক রকম প্রমোদতরণীর ব্যবস্থা আছে এই শহরে৷ কিন্তু যে ক্রুজ জিনিয়ারা পছন্দ করবে, সেই ক্রুজের অংশীদার হতে ও কি করে বলবে অ্যালেক্সদের? দশ বছর আগে হলেও হত৷ এখন জীবনে অনেক বদল ঘটেছে৷ অনেকভাবে বাঁক ফিরেছে জীবন৷ এখন জিনিয়া অনেক বেশি স্বাধীন৷ আবার এখন ওকে ভাবতেও হয় অনেক বেশি৷ দশবার ভালোমন্দ বিচার করতে হয় কোনও কিছু করার আগে৷ এত ভাবা কি বয়সের লক্ষণ? জিনিয়া কি আস্তে আস্তে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে? বিয়াট্রিস ওর মনের যাবতীয় তরঙ্গ খুব অল্পেই ধরতে পারে৷ ও ঠিক টের পায়, কী ধরনের চিন্তাস্রোত বইছে জিনিয়ার ভিতর৷ রাতে বিছানায় শুয়ে জিনিয়ার চুলগুলে একটু ঘেঁটে দিল ও৷ নিজেই উন্মুক্ত করল শরীর৷ আজকাল শরীরী খেলা আর খুব একটা হয় না ওদের মধ্যে৷ কয়েক বছর আগেও তীব্র কামনায় আকৃষ্ট হত ওরা৷ শরীরের প্রতিটি প্রত্যঙ্গকে ছুঁয়ে দেখত বারংবার৷ তীব্র শরীরী আবেগে ওর শরীরে মিশে যাওয়ার মুহূর্তেও জিনিয়ার ভিতর আরেকটা মন ভাবত, যা ঘটছে তা কি সত্যি? জয়ন্তী সেন, যার জন্ম ইংল্যান্ডে, শিশু বয়সে যে বাঙালি বাবা-মায়ের সঙ্গে ইউরোপ থেকে পাড়ি দিয়েছিল আমেরিকায় নতুন শুরুর সন্ধানে, যে একদা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল তার চেয়ে বয়সে ছোট এক গ্রিক আমেরিকান যুবককে, যার ঔরসে সে জন্ম দিয়েছে এক অটিস্টিক বাচ্চার, তার জীবনে এসব সত্যি ঘটছে? সে এখন  আকৃষ্ট বোধ করছে অন্য এক নারীতে, যে নারী শরীরে স্তব্ধ হয়ে আছে অন্য এক দেশের গোটা ইতিহাস?

বিয়াট্রিস হয়তো অত ভাবত না৷ বিয়াট্রিস বেশি ভাবতে শেখেনি কখনও৷ মেক্সিকো থেকে ওর পরিবার ক্যালিফোর্নিয়াতে পৌঁছেছিল ইললিগ্যাল ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে৷ বিয়াট্রিসের একটা নিজস্ব লড়াই ছিল৷ ক্যালিফোর্নিয়ার মাটিতে একটা শক্ত জমি খুঁজে পাওয়ার, যে জমি থেকে কেউ কখনও ওকে উৎখাত করতে পারবে না৷ সেজন্য হাইস্কুলের পর বিশেষভাবে সক্ষম বাচ্চাদের জন্য দরকারি প্রশিক্ষণ নিয়েছে ও, স্পেশাল নিড টিচার হিসেবে ডিপ্লোমা করেছে৷ সঙ্গে সঙ্গে অর্জন করেছে হাতে কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা৷  দূরসম্পর্কের এক তুতো দাদাকে বিয়ে করেছিল বিয়াট্রিস৷ সে বিয়ে সুখের হয়নি৷ ওর স্বামী সাবস্টেন্স অ্যাবিয়ুজের শিকার৷ বিয়াট্রিস যে সেন্টারে স্পেশাল নিড বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করত, সেই স্কুলের নামডাক ছিল৷ অনেক খুঁজে খুঁজে শহরের কোথায় কী আছে তা নিয়ে অনেক ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে স্কুলটার সন্ধান পায় অ্যালেক্স৷ রুণকে ওখানে ভর্তি করার পর তৃতীয় কি চতুর্থ দিন প্রথম দেখেছিল বিয়াট্রিসকে৷ 

Lesbian Couple
কয়েক বছর আগেও তীব্র কামনায় আকৃষ্ট হত জিনিয়া আর বিয়াট্রিস

সেদিন রুণকে তোলার জন্য আসতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল জিনিয়ার৷ সওয়া দুটো বেজে গিয়েছিল৷ দুটোয় স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল৷ জিনিয়া গাড়ি পার্ক করে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রায় ছুটে গিয়ে দেখে রুণকে নিয়ে একজন মেয়ে বসে আছে খিলান দেওয়া পোর্টিকোর চত্বরে পা ঝুলিয়ে৷ খুব নিচু সুরে গল্প নাকি গান শোনাচ্ছে মেয়েটা৷ দূর থেকে দেখলে হঠাৎ করে ভারতীয় বলে মনে হবে৷ একঢাল কালো চুল প্রায় মাটি অবধি লুটিয়ে৷ তখন চুল অনেক সময়ই খোলা রাখতো বিয়াট্রিস৷ কাছে যেতেই বুঝতে পারল কী অসামান্য সুন্দরী বিয়াট্রিস৷ চাবুকের মতো ফিগার, একটু তামাটে রঙ, মনে হয় চামড়াটা যেন মোম পালিশ করা৷ সবচেয়ে চমক লেগেছিল ওর চোখদুটো দেখে৷ কালো চোখের মণি, টানাটানা চোখদুটোতে কোথাও যেন বিষণ্ণতা ঘাপটি মেরে আছে৷ আদৌ প্রথমদিন অত কি লক্ষ্য করেছিল জিনিয়া? ও প্রায় ছুটে এসে রুণকে নিয়েছিল বিয়াট্রিসের কোল থেকে৷ দেরির জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছিল প্রচুর৷ 
– ডোন্ট ওয়ারি৷ ডোন্ট বি সো অ্যাপোলোজেটিক৷ আই উই উইল অলয়েজ বি দেয়ার ইফ ইউ আর লেট৷
পরে অনেকবার কথা হয়েছে ওদের এই বাক্যটা নিয়ে৷ 
– দ্যাট সেনটেন্স সাউন্ডেড লাইক এ প্রফেসি।
জিনিয়া পরে বলেছে বিয়াট্রিসের আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে৷ সত্যিই ও এখন জানে যে বিয়াট্রিস ওর জীবনে এসেছে স্থায়ী সত্যের মতো৷ জিনিয়াকে ইদানিং মাঝে মধ্যেই শহরের বাইরে যেতে হয়৷ অন্য শহরে পাবলিশিং হাউসের নিজস্ব মিটিং থাকে৷ লেখকদের সঙ্গে দেখা করা৷ যত দূরেই যাক জিনিয়া, ও ঠিক জানে এদেশের পশ্চিম প্রান্তের এক শহরে এক অ্যাপার্টমেন্টে ওর অপেক্ষায় রয়েছে বিয়াট্রিস৷ এর মধ্যে একধরনের ভবিতব্য আছে৷ একদা বলা বিয়াট্রিসের ওই বাক্যটা যেন ওদের যৌথ জীবনের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী৷

জিনিয়ার সঙ্গে কোনও মিল নেই বিয়াট্রিসের ব্যাকগ্রাউন্ডের৷ অ্যালেক্সের সঙ্গে বরং অনেক মিল ছিল৷ অ্যালেক্সের পরিবার তিন প্রজন্ম আগে গ্রিস থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে এদেশে আসে৷ যেমন জিনিয়ার বাবা-মা এসেছিলেন ভারত থেকে৷ দুজনেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান৷ জিনিয়া এবং অ্যালেক্স দু’জনেরই ভাবপ্রকাশের ভাষা ইংরেজি৷ সে ভাষায় কথা বলতে ওরা সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করে৷ দু’জনেই মার্কিন নাগরিক৷ দু’জনেই উচ্চশিক্ষায় গেছে৷ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে দু’জনের আলাপ। সেখানে জিনিয়া পড়ত এডিটিং অ্যান্ড পাবলিশিং আর অ্যালেক্স ছিল সঙ্গীত এবং ফাইন আর্টস-এর ছাত্র৷ বিয়াট্রিস এসবের থেকে অনেক দূরের৷ আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে বর্ডার পেরিয়ে মেক্সিকো থেকে আমেরিকায় চলে আসে ওরা৷ সীমান্ত পেরবার ছবি যে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সময়ে একইরকম বিপন্নতার জন্ম দেয়, তা বিয়াট্রিসের পরিবারের সঙ্গে নিজের বাবার অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে দেখে বুঝতে পারে জিনিয়া৷ তবে ওদের পরিবারের মধ্যে মিল বলতে ওইটুকুই৷ বিয়াট্রিসের পরিবারের কেউ কেউ সীমান্ত পেরতে পারেনি৷ ওর দশ বছরের বড় দাদা আর দু’জন কাকা পালাতে গিয়ে সীমান্ত পুলিশের গুলিতে মারা গেছিল৷ বিয়াট্রিসের পরিবারের অন্য একটি দল বর্ডার পেরিয়ে আশ্রয় নেয় টেক্সাসে৷ বিয়াট্রিসের পরিবার পরে টেক্সাস থেকে ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরের নানাপ্রান্তে৷ বিয়াট্রিস আর তার মা-বাবা এসেছিল ক্যালিফোর্নিয়ায়৷ বিয়াট্রিসের স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হবার পর থেকে পরিবারের অন্যদের সঙ্গেও ওর আর যোগাযোগ নেই৷

– যে বর্ডার পার হয়ে এদেশে এসেছিলাম সেই বর্ডারই আমাকে আবার দূরে সরিয়ে দিল৷ আমি বুঝতে শিখলাম মানুষের জীবনে কতরকম সীমানা পেরোতে হয়।
বলেছিল বিয়াট্রিস, যখন সবে ঘনিষ্ঠতার একধাপ পেরিয়েছে জিনিয়ার সঙ্গে৷ তখনও ও একা থাকে, ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলে৷ স্প্যানিশে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে এবং ওকে দেখলে ঠিক বোঝা যায় না, জীবনে কী কী কষ্ট ও পেরিয়ে এসেছে৷ জিনিয়া তখন একটু একটু করে পায়ের তলার মাটি আবার ফিরে পাচ্ছে৷ একটা পাবলিশিং কোম্পানিতে আবার নতুন করে কাজ শুরু করেছে ও৷ শুধু রুণের স্কুলের সময়টা৷ সপ্তাহে কুড়ি ঘণ্টার কাজ৷ বিয়াট্রিসের সঙ্গে ওর স্বামীর তখন ডিভোর্সের পর্ব সবে শেষ হয়েছে৷ অশান্তির দাম্পত্য বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে আর দুজন মেয়ের সঙ্গে একটা টাউন হাউস ভাড়া করে থাকত৷ স্কুলের পরে রুণকে নিয়ে পার্কে, রেস্টুরেন্টে, কফিশপে নিয়মিতভাবে বসে গল্প করত ওরা৷ যখন শনি-রবিবার বিয়াট্রিসের সঙ্গে দেখা হত না, তখন পাগল পাগল লাগত জিনিয়ার৷ ছেলের স্কুলের টিচারের সঙ্গে নিছক বন্ধুত্বে তেমন হওয়ার কথা নয়৷ অ্যালেক্স প্রথম লক্ষ করেছিল এই ব্যাপারটা৷ বেশিরভাগ সময়ই তখন শনি-রবিবার বাড়ি থাকত না অ্যালেক্স৷ জিনিয়া ফোন করে বিয়াট্রিসের সঙ্গে দেখা করত৷ পোর্টের পাশে যেখানে নেভির জাহাজগুলো নোঙর করা থাকে, তার পাশে দেখা হত দু’জনের৷ রুণকে নিয়ে বাগি ঠেলে আলো জ্বলা দোকানগুলোর ক্লাস্টারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বেড়াত৷ দু’জনে আলতো করে কোমর জড়িয়ে নিত দুজনের৷ ব্যাস! ওইটুকুই যা পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন৷

Lesbian
জিনিয়া সেই প্রথম বুঝল, ও শারীরিকভাবে আকর্ষণ বোধ করছে বিয়াট্রিসের প্রতি

বিয়াট্রিস কখনও কোনও কিছুর জন্য জোর করত না৷ শুধু দু’জনেই নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করত৷ সেরকমই কোনও মুহূর্তে বিয়াট্রিস বলেছিল, ওর ড্রাগ অ্যাডিক্ট স্বামী কীভাবে দু’বার শীতের রাতে ওকে বার করে দিয়েছিল বাড়ি থেকে৷ সারারাত ও বাড়ির সামনে পার্কে বসে রাত কাটাতে বাধ্য হয়৷ দ্বিতীয় রাতে মন ঠিক করে নেয় ও৷ ডিভোর্স ফাইল করে৷ কোর্টে নিষ্পত্তি হয় ব্যাপারটার৷ এসব যখন বলছিল, তখন ওর দীঘল চোখ থেকে মুক্তোর মতো জলকণারা গড়িয়ে পড়ছিল৷ জিনিয়া সেই প্রথম বুঝতে পারল, ও শারীরিকভাবে আকর্ষণ বোধ করছে বিয়াট্রিসের প্রতি৷ সেই প্রথম বিয়াট্রিসের অনুমতি নিয়ে ও চুমু খেয়েছিল বিয়াট্রিসের চোখের পাতায়, গালে৷ ওর মুক্তোর মত অশ্রুবিন্দু পান করেছিল তৃষ্ণার্তের মতো৷ সেইসময়ই অ্যালেক্স একদিন জিজ্ঞেস করে জিনিয়াকে,
– ইজ এভরিথিং অলরাইট জিনি? 
কিছুই যে ঠিক নেই সে কথা তখন নিজের কাছেই প্রাণপণ অস্বীকার করছে জিনিয়া৷ সে চমৎকার অভিনয় করেছিল অ্যালেক্সের কাছে।
– অ্যাবসুল্যুটলি৷ হোয়াট আর ইউ টকিং অ্যাবাউট? এভরিথিং ইজ জাস্ট পারফেক্ট৷ 
অ্যালেক্স কতটা কনভিন্সড হয়েছিল কে জানে! বরাবরই স্বল্পভাষী, আত্মমগ্ন মানুষ ও৷ দু-তিন মিনিট চুপ করে থেকে ও বলেছিল,
– ওকে৷ ইফ সামথিং ম্যাটার্স সামডে, ডোন্ট হেজিটেট টু টেল মি৷ আই উইল স্টিল বি ইয়োর ফ্রেন্ড৷

Third person
ইফ সামথিং ম্যাটার্স সামডে, ডোন্ট হেজিটেট টু টেল মি

অ্যালেক্স কি তখনই বুঝতে পেরেছিল সব? ওর সঙ্গেও আলাপ হয়েছে তখন বিয়াট্রিসের– রুণের টিচার হিসেবে৷ অ্যালেক্স কিছু বুঝেছিল কিনা শেষ পর্যন্ত জিনিয়া সব খুলে বলার আগে, তা অজানাই থেকে গেল জিনিয়ার৷ তবে কথা রেখেছিল অ্যালেক্স৷ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত জিনিয়া সব বলল অ্যালেক্সকে, ও সেদিন স্তব্ধ হয়ে বসেছিল বহুক্ষণ৷ তার দু’দিন পরে ওরা পারস্পরিক এগ্রিমেন্ট করে ঠিক করে নিয়েছিল মিউচুয়াল সম্মতিতে ডিভোর্স নেবে৷ তখনই এই অ্যাপার্টমেন্টটা কেনা হয় জিনিয়ার আর রুণের থাকার জন্য৷ অ্যালেক্স কি প্রেমহীন জীবন থেকে নিষ্কৃতি চেয়েছিল? রুণকে খুব ভালবাসে অ্যালেক্স৷ তবু মাঝে মাঝে কূট একটা সন্দেহ উঁকি মেরেছে জিনিয়ার মনে৷ রুণ অন্য পাঁচটা বাচ্চার মতো হলে কি এই বিচ্ছেদ এত সহজে হতে দিত অ্যালেক্স? ও কি তখন থেকেই মেরির সঙ্গে একটা ‘স্বাভাবিক’ পরিবারের স্বপ্ন দেখত? তাই কি কোনও প্রশ্ন না করে নিয়তি নির্দিষ্ট ভবিতব্যের মতো মেনে নেওয়া জিনিয়ার সব অপরাধ?

সত্যিই অপরাধ কি? জিনিয়া জীবনে আবার একবার নতুন করে প্রেমে পড়েছিল৷ সেই প্রেমের কেন্দ্র কোনও পুরুষ ছিল না– ছিল বিয়াট্রিস৷ একজন নারী৷ সে শুধু তার রূপ দিয়ে নয়, ভিতরের সৌন্দর্য্য দিয়ে অমোঘভাবে টেনেছিল জিনিয়াকে৷ জিনিয়া দিশাহারা হয়ে গেছিল সেই অচেনা আকর্ষণের চুম্বকে৷ প্রতি সপ্তাহে কাউন্সেলিং করা, সাইকোলজিস্টের সঙ্গে একান্তে কথা, গ্রুপ থেরাপি, কিছুই বাদ রাখেনি দু-তিন মাস৷ একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিল বিয়াট্রিসের সঙ্গে দেখা করা৷ তারপর একসময় আর পারল না৷ নিজেকে নিরুদ্ধ করে রাখতে রাখতে একসময় মনে হল নিজের যৌন প্রবৃত্তিকে চাপা দিয়ে রাখাটাই অস্বাভাবিকতা৷ কাউন্সেলিংয়ে মনের অনেক অব্যক্ত ইমোশনও বার হয়ে এসেছিল৷ ও বুঝতে পেরেছিল অ্যালেক্সের শরীর, দেবদূতের মতো ওই চেহারা, ওকে আর টানে না৷ বস্তুতঃ তখনই ও প্রথম বুঝতে পারে, অ্যালেক্স শুধু ছিল ওর মনের সঙ্গী৷ যৌনতা থেকে ইন্টেলেকচুয়াল কম্প্যানিয়নশিপকে প্রথম আলাদা করতে শেখে জিনিয়া৷ বহু অগ্নিস্নানের মধ্যে দিয়ে৷ বহু ভূকম্পন, জলোচ্ছ্বাস পেরিয়ে৷ তারপর একদিন অনেক মৃত্যুর অন্ধকার পার হয়ে শেষে উন্মুক্ত এক প্রান্তরে পৌঁছয় জিনিয়া৷ অ্যালেক্সকে সব কথা খুলে বলে৷

১৬

রোহিণীর এখন কলেজটা বেশ ভাল লেগে গেছে৷ একটু একটু করে মন বসে গেছে এই জায়গাটায়৷ শহরটা ভারি সুন্দর৷ ছোট্ট একমুঠো ডাউনটাউন৷ কিন্তু অনেকরকম রেস্তোঁরা। চাইলে ইটালিয়ান, মধ্য প্রাচ্য, কেজান কুইজিন, সোল ফুড, কী নেই৷ ছোট্ট ক্যাম্পাস৷ ক্যাম্পাসের ভিতরে থাকার বাড়িগুলোও দেখার মতো৷ এদেশের লিবারেল আর্টস কলেজগুলোর মধ্যে এই কলেজ বহুদিন ধরে দু’নম্বরে৷ দুশো বছরের কলেজের নামও এসেছে শহরের নাম থেকেই৷ রোহিণীর আজকাল এই কলেজটা, এই শহরটার জন্য মন কেমন করে৷ এখন ও সপ্তাহে বেশিরভাগ সময়টাই কাটায় লেক্সিংটনে, যেখানে সীমন্তিনী আর অরুণাভর বাড়ি৷ ওর নিজস্ব স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টটা ছেড়ে দিতে কষ্ট হয়েছিল বেশ৷ বাবাইরা এসে চমৎকার সব ফার্নিচার দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল ঘরখানা৷ কিন্তু তারপর ওর নিজস্ব একটা আইডেন্টিটি তৈরি হয়েছিল ঘরটাতে৷ কিন্তু ও যা মাইনে পায় তাতে আলাদা করে একটা ঘর ভাড়া করে রেখে দেবার কোনও মানে হয় না, তা সে যতই কম ভাড়া হোক না কেন৷ ওর মা-বাবা গতবার এসে ওর বাসস্থান, কলেজ, সব ঘুরে ঘুরে দেখে গেছেন৷ শিপ্রা আর অমিয়র জায়গাটা বেশ পছন্দই হয়েছে৷ তবু আড়ালে শিপ্রা অনেকবার বোঝাতে চেষ্টা করেছেন রোহিণীকে– শ্বশুরবাড়িতে না থেকে একা একটা ছোট্ট ঘরে পড়ে থাকার মানে কি? তাও যদি রণো আর রোহিণী এক জায়গায় থাকত, একটা মানে হত৷ তাও যখন নয়…  

NRI woman
স্বাধীন মেয়ে হিসেবে তার নিজস্ব সময়, নিজস্ব স্পেস, এসব জিনিস খুব মূল্যবান

রোহিণী তার মাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে, কেন সে এখানে একটা আলাদা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে পছন্দ করে৷ এই জায়গাটা শুধু তার কর্মস্থলই নয়, স্বাধীন মেয়ে হিসেবে তার নিজস্ব সময়, নিজস্ব স্পেস, এসব জিনিস খুব মূল্যবান৷ সে যখন দিল্লিতে ছিল, তখন তার এত নিজস্ব মতামত ছিল না৷ ব্যক্তিগত পরিসর, স্পেস, প্রাইভেসি এসব সম্পর্কে রোহিণীর সোচ্চার মতামতের স্ফূরণ হয়েছে মার্কিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেনিংয়ে৷ চিত্তরঞ্জন পার্কের বাড়িতে তাকে বাধা দেবার লোক ছিল না৷ অমিয় বা শিপ্রা দুজনেই কাজকর্ম, পরিবার-পরিজন নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকতেন, যে সে এবং তার দাদা মোটের উপর মা-বাবার সঙ্গে সংঘাত জিনিসটা বোঝারই সময় পায়নি৷ রোহিণী এখন ভাবে, মাত্র আঠেরো বছর বয়স পর্যন্ত সে দেশে থেকেছে৷ নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশ দূরে থাক, সে ছিল বেশ বাধ্য ভালো মেয়ে টাইপ৷ পান থেকে চুন খসলে শিপ্রা বলতেন– এ বাড়ির মেয়ে হয়ে তুমি এরকম শিক্ষা পেলে কোথা থেকে? শিপ্রার খুব একটা শাসন করার দরকার হত না৷ তাঁদের বাড়ি যে ভদ্র শিক্ষিত পরিবার, সেই কথাটুকু স্মরণ করিয়ে দেওয়াই তাঁর সর্বোচ্চ স্তরের শাসন করা ছিল৷ এদেশে পড়তে এসে রোহিণী প্রথম বুঝেছিল এখানে মানুষ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং পরিসর বিষয়ে কতটা সচেতন৷ রণো এবং অন্যান্য বন্ধুদের দেখে অবাক হত৷ 

ও নিজে তখন বাবা-মাকে প্রতিদিন স্কাইপ করত৷ ও কী খাচ্ছে, ওর বাসস্থান কীরকম, এমনকী কেমন ঘরে ও বসে ক্লাস করে, সবকিছু মা-বাবাকে না দেখালে ওর শান্তি ছিল না৷ উল্টোদিকে রণো এবং এদেশে বড় হওয়া সব বন্ধুরাই বাড়ির সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগই করত না৷ প্রিন্সটনে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পড়ার যেমন প্রচুর চাপ ছিল, তেমনই প্রথম এক নিজস্ব বন্ধুগোষ্ঠী তখন প্রথম শুরু হয়েছিল৷ রোহিণী প্রত্যেকদিন ফোন করে বাড়ির সঙ্গে কথা বলে শুনে রণো অবাক হয়ে গিয়েছিল৷ ‘দ্যাটস ক্রেজি শিট’ ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ পরে রোহিণীর মনে হয়েছে, রণো যে পরিবার, ওর বাবা-মা-দাদাই-দিদান কাউকে কম ভালবাসে তা তো নয়৷ কিন্তু সেই ভালবাসা একটু দূরায়ত, যেন একটু দূরত্ব থেকে অন্যের ভালোমন্দ, দোষগুণ, সব নির্লিপ্তভাবে বিচার বিবেচনা করে, তারপর ভালবাসা৷ এটা রণোকে বলায় রণো মুচকি হেসেছিল৷ 
– ইউ ক্যান সে দ্যাট৷ ডিপেন্ডস অন পারস্পেকটিভ৷ 
– পারস্পেকটিভ মানে কি?
– দ্যাখ্‌, একটা বয়স অবধি সন্তানরা তো বাপ-মাকেই আদর্শ রোল মডেল হিসেবে ভাবে৷ তারপর যখন তারা বড় হয়, তখন তারা বাবা-মার দোষগুলোকে, ফ্ল-গুলোকে বুঝতে পারে৷ দেন দে আউটগ্রো দেয়ার প্যারেন্টস ৷ তখন তাদের মা-বাবাদের ব্যক্তি হিসেবে যে অক্ষমতা, যে অপারগতা সেগুলো তারা বুঝতে পারে, ভাবতে পারে৷ তখন ভালোবাসার ধরনটা বদলে যায়৷

জিনিয়ার সঙ্গে কোনও মিল নেই বিয়াট্রিসের ব্যাকগ্রাউন্ডের৷ অ্যালেক্সের সঙ্গে বরং অনেক মিল ছিল৷ অ্যালেক্সের পরিবার তিন প্রজন্ম আগে গ্রিস থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে এদেশে আসে৷ যেমন জিনিয়ার বাবা-মা এসেছিলেন ভারত থেকে৷ দুজনেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান৷ জিনিয়া এবং অ্যালেক্স দু’জনেরই ভাবপ্রকাশের ভাষা ইংরেজি৷ সে ভাষায় কথা বলতে ওরা সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করে৷ দু’জনেই মার্কিন নাগরিক৷ দু’জনেই উচ্চশিক্ষায় গেছে৷

রোহিণী প্রবলভাবে অস্বীকার করতে চেয়েও বুঝতে পারে, রণোর কথার মধ্যে একধরনের সত্যতা আছে৷ শুধু মা-বাবা আর সন্তানের মধ্যে নয়, সব সম্পর্কেই ভালোবাসার ধরণ পাল্টায়৷ কিছু কিছু সময় ভালোবাসাই হারিয়ে যেতে পারে৷ ভালোবাসা না থাকলে তো কথাই নেই৷ সেখানে এদেশের লোক যখন বোঝে তাদের মধ্যে আর কোনও প্রেম অবশিষ্ট নেই, তখন তারা বিচ্ছেদই শ্রেয় মনে করে৷ যেমন পিসিমণি সরে গেছে অ্যালেক্সের থেকে৷ অ্যালেক্স আবার মেরির মধ্যে নতুন ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে৷ রণোর মা-বাবার মধ্যে রসায়নটা ঠিক বুঝতে পারে না রোহিণী৷

তিরিশ বছর কাটিয়ে ফেললে কি সম্পর্কের মধ্যে একরকম শৈত্য আসে? রোহিণীর নিজের বাবা-মায়ের সম্পর্ক যদি বা বুঝতে পারে ও, বাবাই আর মাম্মার সম্পর্ক আরও জটিল৷ বহুমাত্রিক৷ দাদাই আর দিদানের সম্পর্ক বরং অনেক বেশি বুঝতে পারে রোহিণী৷ কেন? দাদাই লিখে গেছে বলে? দিদানকে ইন্টারভিউ করতে পারছে বলে? প্রতি প্রজন্মে বোধহয় সরল, সোজা একমাত্রিক কাঠামো থেকে আরও আরও দূরে সরে যেতে চায় সম্পর্ক৷ পিসিমণির যেমন হয়েছে৷ বিয়াট্রিস আর পিসিমিণির যে অন্যরকম সম্পর্ক, তা বুঝতে একটু সময় নিয়েছিল রোহিণী৷ প্রিন্সটনে ওদের বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিল সমপ্রেমে বিশ্বাসী৷ ভারতবর্ষেও ইদানিং এলজিবিটি সম্প্রদায় আজকাল অনেক সরব হচ্ছে৷ ভারতীয় লেখকদের মধ্যে কয়েকজনের সমপ্রেমী সত্তা সর্বজনবিদিত৷ কিন্তু রণোর নিজের পিসি, যার গল্প অনেকদিন ধরেই রোহিণী শুনেছে, তার একজন অটিস্টিক ছেলে আছে, সেটাও তার অজানা নয়৷ ওদের বিয়েতে লেক্সিংটনে যে রিসেপশন হয়েছিল, তাতেও পিসিমণি এসেছিল রুণকে নিয়ে৷ অ্যালেক্সও তখন ইস্ট কোস্টের কোথাও ছিল৷ অ্যালেক্সও রণোদের রিসেপশনে চমৎকার একটা ভূমিকা পালন করেছিল৷ কিন্তু তখন ওটুকুই জানত ওরা৷ বিয়ের পর পিসিমণির বাড়িতে গিয়ে প্রথম বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিল রোহিণী৷ রাতে শোবার সময় ফিসফিস করে রণোকে বলেছিল,
– ডিড ইউ নো অ্যাবাউট পিসিমণি?
যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে রণো বলেছিল,
– হাউ দ্যা হেল উড আই নো? 
– মাম্মা-বাবাই ওরা জানে না?
– বাবাই মাস্ট হ্যাভ নোন ৷ মাম্মাকে বলেছে কিনা আই ডোন্ট নো৷ বাবাই ইজ স্টিল ভেরি ক্লোজ টু পিসিমণি৷
খুব আশ্চর্য লেগেছিল রোহিণীর৷ বাবাই যদি জেনে থাকে, পিসিমণি যদি বলেও থাকে বাবাইকে তার নিজের বিষয়ে, সেটা নিজের বউকে বলবে না বাবাই? এরকম কোনও স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের কথা ভাবতেই পারত না রোহিণী৷ ও আহত চোখে রণোর দিকে তাকিয়েছিল৷
– তুই যদি কোনও ইম্পর্ট্যান্ট জিনিসের কথা জানিস, তুই আমাকে জানাবি না?
– ইট ডিপেন্ডস৷ ইফ আই ফিল ইট ইজ ইম্পর্টেন্ট ফর ইউ টু নো, আই উইল লেট ইউ নো৷ ইফ ইট ইজ নট রেলিভ্যান্ট ফর ইউ, আই প্রোবাবলি ওন্‌ট্‌।
রণো একটু ভেবে বলেছিল৷

তখনও রোহিণী বুঝতে পেরেছিল ওদের ভাবনার ভঙ্গিতে অনেক তফাৎ আছে৷ রণো প্রখর বাস্তববাদী৷ হয়তো ওর স্কুলেরও শিক্ষা এটা৷ লেক্সিংটনে খুব বিখ্যাত স্কুলের ছাত্র রণো পড়াশোনায় চৌখসই তৈরি হয়নি, কথাগুলো ওজন করে দেখে, যুক্তিগ্রাহ্যতা বিচার করে পেশ করার ক্ষমতা ওর সহজাত৷ সায়েন্স অলিম্পিয়াডের টিমে ছিল রণো৷ ওর কাছে স্কুলের পর প্রিন্সটনের সুমা কাম লড হওয়া, গুগলে রিসার্চ অ্যানালিস্টের বিশাল মাইনের চাকরি পাওয়া, সবটাই কেকওয়াক। ওর মেধার জোরে৷ রোহিণী ইতিহাসের ছাত্রী৷ ওর মন সাহিত্যঘেঁষা৷ ও মনে করে শুধু পাথুরে প্রমাণ দিয়ে যুগের ইতিহাস লেখা যায় না৷ তার জন্য কল্পনাও চাই৷ যুক্তির চেয়ে হৃদয়াবেগ যেন ওর মধ্যে বেশি কাজ করে৷ ভালো ছবি, ভালো কবিতা, ভালো সিনেমা ওকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়৷ মাঝে মাঝে রণোকে অকৃত্রিমভাবে জিজ্ঞেসও করেছে রোহিণী৷
– আমাকে বিয়ে করলি কেন তুই? আমি তো তোর পোলার অপোজিট৷
রণো শুধু হেসেছে।
– দ্যাট’স হোয়াই৷ অপোজিটস অ্যাটট্রাক্ট৷
এর বেশি আর কোনও কথা বার করা যায় না রণোর মুখ থেকে৷ এতদিন বাদেও রণোকে কেমন যেন অচেনা ঠেকে রোহিণীর৷  (চলবে)

 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pixels, Saatchi Art, Pinterest
Aparajita Dasgupta

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Picture of অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।
Picture of অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com