‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে’ এই গানটা আমার ভীষণ প্রিয়৷ ছোটবেলায় যত্রতত্র বেসুরে গাইতাম– আকাশে উড়িছে বকপাখি৷ অনেক পরে জেনেছি বকপাঁতি৷ কাকু শিখিয়েছিল ‘collective noun for a group of geese on the ground is a gaggle. When in flight they are called skein, a team or a wedge. And when flying close together they are called a plump.’ ভুলেই গেছিলাম। আজ, শিক্ষক দিবসে কাকুর কথা মনে পড়ল আর গুগল খুঁজে দিল আরো একখানা ফেলে আসা দিন৷ রেডিওতে ফিরে আসা হেমন্তের গান, সকালের ‘বর্ণালী’ অনুষ্ঠান, মায়ের প্রিয়৷
স্কুলের ‘মিস’ পড়িয়েছিলেন ডাকঘর। অমল যে আমি কতবার সেজেছি মনে মনে৷ ছোটবেলায় একবার ডিপথেরিয়া হয়েছিল। তখন সারাদিন শুয়ে থাকতে হত৷ জানালার শিক ধরে কতবার সুধার সঙ্গে খেলেছি। আবার কখনও বা হয়েছি সুধা নিজেই। এখনও এক পলকে কিশলয় বইয়ে পড়া ‘অমল ও দইওলা’ অংশটুকু জীবন্ত হয়ে ওঠে, দূর থেকে দইওয়ালা আসছে বাঁক কাধে তুলে, দুলে দুলে একটা সহজাত নাচের ছন্দ তুলে। আর এই প্রবাসে ইউনিফর্ম পরা পোস্টম্যান, হাতে চিঠির ঝাঁপি দেখলেই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ‘আমার কি কোনও চিঠি এসেছে?’ না না, রাজার চিঠি চাই না মোটেই৷ কিছু প্রিয় মানুষের ট্যারাব্যাঁকা অক্ষরের ভালোবাসার ছোঁয়া৷ এখন সেই চিঠিও নেই আর তাদের সংখ্যা গুনতে এক হাতের কড়ও শেষ হয় না। ভাঁজ করা কাগজের মাঝে নীল অক্ষরে কিছু না শেখানোর মাঝে অনেক কিছু শিখিয়ে দেওয়ার পর্ব আজ ডোডো পাখির মতন বিলুপ্ত।
বাবার অফিসে গিয়ে বাবার সঙ্গে নিজামের রোল খাওয়া৷ বাবা শিখিয়েছিলেন, খাওয়া-দাওয়ার স্বাদটা আপরুচি। ধর্মটাও তাই। নিজের মনের একান্তে নিজের কাছে নিজের জবানবন্দি৷ সব ধর্মকে সমান সম্মান, আর ধর্ম না মানাটাও আসলে একরকম ধর্ম। নিজস্বতা। সংঘাত নেই অন্য ধর্মের সঙ্গে।
আমার বড়মানি, আমার মায়ের থেকেও যিনি বড়, বলেছিলেন মনে না নিয়েও অনেক সময় মানিয়ে নিতে হয়। তবেই সংসারে শান্তি থাকে৷ আমরা তো কথায় কথায় লোটাকম্বল নিয়ে হিমালয়বাসী হতে পারি না তাই৷ তবে মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেবার তফাতটা আলাদা করতে শিখতে হয়৷ সময় মতন প্রতিবাদের ভাষা যেন খুব জোরালো হয়৷
একবার সরস্বতী পুজোর সকালে ঠাকুমা শিখিয়েছিলেন, শরীরে শুচি অশুচি বলে কিছু নেই। আগেকার দিনে ছোট ছোট মেয়েদের সংসারে ভারী কাজ থেকে ছুটি দেওয়ার নিছক অজুহাত৷ আর ঘরের সেই কোণটা খুঁজে নিয়ে মাসের কটা দিন নিজের মতন করে নিজের ভালোলাগার কাজে মন দেওয়ার অবকাশ৷ সেলাই, আঁকা, লেখার অবসর খুঁজে নেওয়া৷
আমাদের বুজো শিখিয়েছে, ভালোবাসার জন্যই কীভাবে ভালোবাসা যায়৷ ল্যাজ নাড়তে নাড়তে, গায়ে গা ঘষে, হাজার বকুনির পরেও শুধু দুটো চোখ দিয়ে সব রাগ জল করে দেওয়া যায়৷ মাটির টবের গাছটা শিখিয়েছে একটু আদর আর একটু যত্ন দিলেই মরা ডালে আবার সবুজ কচি পাতা উঁকি মারে৷ রবি ঠাকুর শিখিয়েছেন,
নিতে যারা জানে তারাই জানে,
বোঝে তারা মূল্যটি কোন্খানে।
তারাই জানে বুকের রত্নহারে
সেই মণিটি কজন দিতে পারে
হৃদয় দিয়ে দেখিতে হয় যারে—
যে পায় তারে পায় সে অবহেলে।
পাওয়ার মতন পাওয়া যারে কহে
সহজ বলেই সহজ তাহা নহে,
দৈবে তারে মেলে।
‘খেয়েছিস তো’, ‘কিছু খাবি?’, ‘একটু খেয়ে নে’, মানে যে ‘ভালো আছিস তো’, এ কথা বুঝিয়েছেন মা৷ দিনরাতের হিসেবের খেয়াল রাখার খেলা ভুলে, আট হাজার মাইল দূর থেকে ভোরবেলা ফোন করলে আজকেও মা একই কথা বলেন, ‘খেয়েছিস তো?’
জানালার বাইরে বড় চ্যাপ্টা একটা চাঁদের পাশের ছোট তারা শিখিয়েছে, না সব যায় না৷ যে ছোট ভাই বা দাদা তারা হয়ে গেছে হঠাৎ করে একদিন, তারাও আছে দিনের আলোর গভীরে, কিশোরকুমার না রফি, ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা, অমিতাভ না নাসিরুদ্দিনের ঝগড়ার খুনসুটিতে।
মনখারাপের রাতেও জীবনের আনন্দগুলোকে খুঁটে খুঁটে খেতে শিখিয়েছে সুন্দরবনের সেই রাতজাগা পাখি, মাঝদরিয়ার সেই মাঝি, অন্ধকারে অবাক করে দেওয়া জ্বলন্ত দুটো চোখ আর পাড়ভাঙা সেই বয়ে যাওয়া গঙ্গা৷
জীবনটা সত্যি ভালোবাসার, জীবন এক রোমাঞ্চ— আমাদের গুরু, আমাদের শিক্ষক ৷
মৌসুমীর জন্ম কলকাতায় হলেও গত তিন দশক ধরে নিউ ইয়র্কই তাঁর বাসস্থান এবং কর্মস্থান। এক্কেবারে বিশুদ্ধ ক্যালইয়র্কার। শুঁটকি মাছ থেকে চন্ডীপাঠ, Grateful Deads থেকে সুপ্রীতি ঘোষ আর এই diasporic dichotomy-র জাগলিংয়ে হাত পাকাতে পাকাতেই দিন কাবার। ভালোবাসেন বই পড়তে, ছবি আঁকতে, রান্না করতে, আড্ডা মারতে আর ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে। তবে সবচেয়ে ভালোবাসেন সক্কলকে নিয়ে জমিয়ে বাঁচতে!
5 Responses
এতো ভালো লাগলো
মন ভরে গেলো
লিরিক্যাল
ভাল লাগলো।
মন ছঁুয়ে গেল। মনে পড়ে গেল নিজের ছেলেবেলার কথা। দেশ থেকে দূরে থেকেও যে মাটির কাছাকাছি থাকা যায় তার প্রমাণ পেলাম।
ডাল লাগল ।আরো লিখুন