১
হোটেলের ঘরে ঢুকে ল্যাপটপের ব্যাগ আর ফাইলটা খাটের পাশের টেবিলটার ওপর নামিয়ে রাখল তিস্তা। সন্ধে হয়ে আসছে। তবে আকাশের রক্তিম আভা এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি। বাইরের আলোর আভা কাচের জানালার ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে।
সারাদিন ধরে ভূপাল শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে, বেশ ক্লান্ত তিস্তা। বম্বেতে একটা বাণিজ্যিক পত্রিকায় কাজ করে ও। মধ্যপ্রদেশের শিল্পের পরিস্থিতি ও বিনিয়োগ নিয়ে ওদের কাগজ একটা বিশেষ প্রতিবেদন বের করতে চলেছে। সেই কাজের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতেই ওর ভূপালে আসা। ভোরবেলা হোটেলে পৌঁছে, ব্যাগটা নামিয়ে রেখেই ও বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর সারাদিন বিভিন্ন সরকারি দফতরে ঘুরতে হয়েছে, কথা বলতে হয়েছে নানা লোকের সঙ্গে। কালকে সকালে আরও দু জায়গায় দেখা করে ওর বম্বে ফেরত যাওয়া।
তিস্তা খাটের ওপর আরাম করে বসে রুম সার্ভিসের মেনু কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। তবে ডিনারের দেরি আছে। এখন চা আর এক প্লেট পকোড়া নেওয়া যাক। তিস্তা ফোন করে রুম সার্ভিসে অর্ডার দিয়ে দিল।
চা আসতে বেশি সময় লাগল না। তিস্তা বিছানায় পা মুড়ে বসে চা আর পকোড়া খেতে খেতে টিভিটা চালিয়ে এদিক ওদিক চ্যানেল ঘোরাতে লাগল, কিন্তু ঠিক মন দিতে পারল না। সারাদিন ধকলের পর ওর চোখটা যেন জড়িয়ে আসছে। তিস্তা বাইরের জামাকাপড় নিয়েই বিছানায় পা টান টান করে শুয়ে, ফোনটা নাড়াচাড়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।

একটু উশখুশ করে চোখ খুলল তিস্তা। ঘর অন্ধকার। শুধু জানালা দিয়ে এক ফালি রাস্তার আলো এসে পড়েছে ঘরে। হাতড়ে হাতড়ে বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা তুলে সময় দেখে তিস্তার ঘুম ছুটে গেল। রাত সাড়ে বারোটা বাজে? এত ঘুমিয়েছে ও? তিস্তা খাটের পাশের সুইচটা টিপে আলো জ্বালালো। তারপরই অনুভব করল বেশ খিদে পেয়ে গেছে ওর। কিন্তু এত রাত্রে কি খাবার পাওয়া যাবে? ঘরে চা কফি করার ব্যবস্থা আছে অবশ্য। কিন্তু এত রাতে শুধু চা…
রুম সার্ভিসের নম্বর ডায়াল করল তিস্তা। ফোনটা রিং হল না। তিস্তা এবার রিসেপশনের নম্বরটা ডায়াল করতে চেষ্টা করল। নাহ, ফোনে রিং টোনই আসছে না ঠিকমত। কী ব্যাপার? এদের ফোন-টোন সব খারাপ হয়ে গেল নাকি? একবার নীচে রিসেপশনে নেমে দেখবে? হোটেল যখন, কিছু না কিছু খাবার তো পাওয়া যাবেই।
তিস্তা আর দেরি করল না। চুলে একবার চিরুনি চালিয়ে, হাতে মোবাইল ফোন আর ঘরের চাবি নিয়ে বেরিয়ে এল। তারপর করিডোর দিয়ে হেঁটে লিফটের কাছে পৌঁছে, লিফটের বোতাম টিপে অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ তিস্তার খেয়াল হল লিফটের ইন্ডিকেটরের বোতামটাই জ্বলছে না। আরও কয়েকবার বোতাম টেপাটেপি করেও কোন লাভ হল না। লিফটের কোনও সাড়াশব্দই নেই। এ কীরকম হোটেল? ফোন, লিফট কিছুই চলছে না? ওর ঘরটা অবশ্য বেশি ওপরে নয়, তিনতলায়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া যেতেই পারে।
বেশি খুঁজতে হল না। করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা দরজা ঠেলেই সিঁড়ি। কিন্তু সিঁড়িতে আলো নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার। তিস্তা একবার চিন্তা করল নামবে কিনা। কিন্তু একবার যখন মনস্থ করেছে… তিস্তা মোবাইল ফোনের টর্চটা জ্বেলে সিঁড়ি দিয়ে গুনে গুনে তিনতলা নামল। সিঁড়ি শেষ হয়ে যাবার পরে একটা দরজা। হ্যাঁ, এইবারে আলো। হোটেলের ভেতরে একটা প্যাসেজে ঢুকে পড়েছে ও। একটু ইতস্তত করল তিস্তা। রিসেপশনটা কোন দিকে হতে পারে? কিন্তু তিস্তাকে বেশি ভাবতে হল না। একটি ছেলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। পোশাক দেখে মনে হল হোটেলেরই লোক। তিস্তা কিছু বলার আগেই ছেলেটি ওকে দেখে অবাক হয়ে বলল— “ইয়েস ম্যাম? ইউ আর লুকিং ফর সামথিং?”

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তিস্তা। যাক এবার একটা ব্যবস্থা হবে আশা করা যায়। তিস্তার এই মাঝরাতে খাবার চাই আর ফোনে পায়নি শুনে ছেলেটি ভারী বিব্রত হয়ে পড়ল। মাথা চুলকে বলল আসলে ওদের ইলেকট্রিক লাইনের একটা ফেজে গণ্ডগোল হয়েছে। তাই ফোন, লিফট, কিছুই কাজ করছে না। সিঁড়ির আলোগুলোও জ্বলছে না। তবে ইলেক্ট্রিশিয়ানরা কাজ করছে, আর খানিকক্ষণের মধ্যেই হয়ত সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এখন খাবার? ও নিজে রিসেপশনে কাজ করে, খাবারের খোঁজ ঠিক রাখে না। তবে ও ওদের কিচেনের কাউকে ডেকে দিচ্ছে, কিছু খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।
ছেলেটি তিস্তাকে হোটেলের এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ওদের কিচেনে নিয়ে গিয়ে একটু অপেক্ষা করতে বলল। তিস্তা আগে কোনওদিন হোটেলের রান্নাঘর দেখেনি। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে দেখল, বেশ বড় একটা ঘর। এখন অনেক রাত বলেই বোধহয়, ঘরটা প্রায় অন্ধকার। মাথার ওপর একটা কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। একপাশে দেওয়াল জোড়া গ্যাস স্টোভ, কিচেন কাউন্টার। আরেকদিকে বিশাল আয়তনের দুটো ফ্রিজ। খানিক পরেই সেই ছেলেটির সঙ্গে একজন মোটাসোটা ভদ্রলোক কিচেনে ঢুকলেন। ভদ্রলোক যে এই মাঝরাতে ছুটে এসে একদম খুশি হননি, সেটা তাঁর মুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে। তিস্তাকে দেখে বললেন এখন বিশেষ কিছু জোগাড় করা যাবে না। ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ হতে পারে আর একটু ফল। তাতে হবে কি? তিস্তা সানন্দে ঘাড় নাড়ল।
ভদ্রলোক দ্রুত হাতে চিজ, টমেটো দিয়ে স্যান্ডউইচ বানিয়ে, আপেল কেটে, প্লেট, কাঁটা, চামচে, টিস্যু পেপার সমেত একটা ট্রেতে সাজিয়ে দিলেন। তিস্তা আপ্লুত হয়ে ‘থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ’ বলাতে, এতক্ষণে ভদ্রলোকের কাঁচাপাকা গোঁফের ফাঁকে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। নিজের থেকেই ট্রেতে একটা কোকের ক্যান বসিয়ে ভদ্রলোক বললেন
— “ওয়েলকাম! এনজয় ইয়োর ফুড।”
কমবয়েসী ছেলেটি বলল, “চলুন ম্যাম, আমি আপনার ঘরে খাবারটা পৌঁছে দিচ্ছি।”
তিস্তার এবার ভীষণ লজ্জা করল। একে তো এদের এত রাতে অসম্ভব বিরক্ত করা হয়েছে, তারপর এইটুকু খাবার ওর ঘর পর্যন্ত ও নিজেই নিয়ে যেতে পারবে। তিস্তা ঘাড় নেড়ে বলল,
“না না, আর পৌঁছতে হবে না। আমি নিয়ে যেতে পারব। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

অন্ধকারে এক হাতে ট্রে, আরেক হাতে মোবাইলের টর্চ ব্যাল্যান্স করতে করতে তিস্তা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। কাজটা যত সহজ ভেবেছিল, তত সহজ নয়। একটু বেসামাল হলেই সব যাবে। দোতলার ল্যান্ডিং-এ এসে একটু দাঁড়াল তিস্তা। যাক, এ তো প্রায় হয়েই এসেছে। আর কটা ধাপ উঠলেই, তিনতলা।
তিস্তা টর্চটা বন্ধ করে মোবাইলটা ট্রের ওপরেই রাখল। টর্চ আর লাগবে না। আর কটা সিঁড়ি ও টর্চ ছাড়াই উঠে যেতে পারবে। দুটো সিঁড়ি তিস্তা নির্বিঘ্নে উঠে পড়ল। তারপরই ঠিক কি যে হল, ও ভাল করে বুঝে উঠতে পারল না। সামনের দিক থেকে একটা প্রবল ধাক্কা লাগল। মুহূর্তের মধ্যে তিস্তার হাত থেকে খাবারের ট্রে সশব্দে ছিটকে পড়ল। তিস্তা শুনল কেউ একজন “ও মাই গড!” বলতে বলতে ওকে জাপটে ধরেছে। তিস্তাও হাত বাড়িয়ে প্রাণপণে কিছু একটা খামচে ধরে কোনওরকমে পড়াটা আটকাতে চাইল। তারপর কারও সঙ্গে ঝটাপটি করতে করতে ধুপ করে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এর শক্ত মাটিতে বসে পড়ল।
অন্ধকারে অভাবনীয় পরিস্থিতি। তিস্তা চেঁচিয়ে উঠল— “হু ইস ইট? লিভ মি, লিভ মি।”
তিস্তাকে ধরে থাকা হাত দুটো সঙ্গে সঙ্গে আলগা হয়ে একটি পুরুষ কণ্ঠ প্রচণ্ড বিব্রত স্বরে বলে উঠল— “সরি সরি। এক্সট্রিমলি সরি। কান্ট মেক আউট আ থিং…। উফ!”
— “ছাড়ুন আমাকে!”
— “আমি তো আপনাকে ছেড়েই দিয়েছি। ইউ আর হোল্ডিং অন টু মাই শার্ট।”
সে কি? ও কী করে…! অন্ধকারে যদিও কিছুই ভালো করে বোঝার উপায় নেই, তিস্তা খেয়াল করল ও এক হাত দিয়ে তখনও প্রাণপণে একটা কিছু খামচে ধরে আছে। ছি ছি, এটা শার্ট নাকি? শার্টটা ছেড়ে দিতেই তিস্তার মনে হল দুটো বোতাম আর খানিকটা কাপড়ও সঙ্গে সঙ্গে ওর হাতে উঠে এল। তিস্তা ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“সরি, ভেরি সরি। আপনার শার্টটা ছিঁড়েই গেছে বোধহয়।”
“সে যাক। আপনার লাগেনি তো?”
বলতে বলতে লোকটি উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই বলল— “এ হে হে। কীসের ওপর পা দিয়ে ফেললাম! নরম একটা কী চেপ্টে গেল!”
— “ইস, আমার স্যান্ডউইচ!”
বলতে বলতে তিস্তা হেসে ফেলল। কী অদ্ভুত পরিস্থিতি! এত করে রাতের খাবার জোগাড় করা, আর এখন বেমক্কা একটা লোকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে… এই লোক এত রাতে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নেমে কোথায় যাচ্ছে? ওরই মত খাবার খুঁজতে নাকি?
— “কী বললেন? আপনার কী?
— “স্যান্ডউইচ। আমার রাতের খাবার। এত কষ্ট করে নীচে গিয়ে নিয়ে এলাম। সব পড়ে গেল আপনার সঙ্গে ধাক্কা লেগে। আমার মোবাইলটাও পড়ে গেছে। আপনার মোবাইলের টর্চটা জ্বালাবেন? দেখি ফোনটা কোথায় পড়ল।”
লোকটা নিজের পকেট এদিক ওদিক দুবার চাপড়ে বলল,
“আমার ফোনটাও তো পড়ে গেছে দেখছি। দাঁড়ান, আমার কাছে লাইটার আছে, জ্বালাচ্ছি।”
ফস করে লাইটারের আলো জ্বলে উঠল…

অন্ধকার সরে গিয়ে লাইটারের ছোট্ট আলোর শিখায় জায়গাটা সামান্য আলোকিত হয়ে উঠল। আলোর আভায় তিস্তা দেখল, এ তো প্রায় ওরই সমবয়সী, কিংবা ওর থেকে হয়ত খানিকটা বড়, একটি ছেলে! লম্বা, গোলগাল ফর্সা মুখ, বেশ ভালমানুষ চেহারা। ছেলেটির শার্টের সামনেটা ছিঁড়ে গিয়ে গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে। ইস, ছি ছি! পায়ের কাছেই মোবাইলটা পড়ে ছিল। তিস্তা নীচু হয়ে ফোনটা তুলে নিল। তারপর ছেলেটিকে বলল,
“আপনি আপনার ফোনটা খুঁজুন। এইখানেই পড়েছে নিশ্চয়ই। বাই দ্য ওয়ে, আমি তিস্তা বসু। আপনি?”
— “অস্মিত গোয়েল। কিন্তু আপনার খাবার যে পড়ে গেল! কী হবে?”
তিস্তা বলল, “আর কী হবে! কপালে খাওয়া না থাকলে এই হয়। এবার সকালের ব্রেকফাস্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বাই!”
আরও পড়ুন- গল্প: দড়ি টানাটানি খেলা
তিস্তা ঘরে ফিরে এসে জামাকাপড় ছেড়ে খাটে বসে ঢকঢক করে বোতল থেকে অনেকটা জল খেল। উফ! আজকে রাতটা জলের ওপরেই থাকতে হবে। খাওয়া তো মাথায় উঠল। তার বদলে যা হুজ্জুতি! ছেলেটার মুখটা মনে পড়তেই তিস্তার হাসি পেল। শার্টটার কী অবস্থা! নিজের মনেই একটু হাসল তিস্তা। তারপর আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল।
***
ঘুম ভেঙে গেল তিস্তার। দরজায় বেল বাজছে না! এই সময় আবার কে? বিছানা থেকে উঠে চটিটা পায়ে গলিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে তিস্তা গলা তুলে বলল,
“কৌন?”
— “আমি অস্মিত। প্লিজ ওপেন দ্য ডোর। আমার ফোনটা আপনার কাছে।”
কী বলছে? কার ফোন? তিস্তা দরজাটা খুলতে গিয়ে নিজের দিকে একবার তাকিয়েই একপাশে সরে গিয়ে দরজাটা অল্প একটু খুলে মুখটা বাড়াল। এই নাইটি পরে কারও সামনে বেরোনো যায় না। সেই ছেলেটি, অস্মিত, দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো, বিধস্ত দেখাচ্ছে। সেই ছেঁড়া শার্টটাই পরে আছে। হাতে একটা ফোন ধরা। অস্মিতের পেছনে আর একজন হোটেলের লোক দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় সিকিউরিটি।
সিকিউরিটির লোকটি তিস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাম, ইনকো আপসে কুছ বোলনা হ্যায়।”
তিস্তার ভুরুটা একটু উঠে গেল। অস্মিত বলল,
“ভেরি সরি, আপনাকে এই সময় ওঠাতে হল। কিন্তু কী করব বলুন? আমার ফোনটা নিয়ে আপনি চলে এসেছেন। এত তাড়াতাড়ি করলেন তখন, একটু খেয়াল করলেন না?”
— “কী বলছেন আপনি?
— “ঠিকই বলছি। আপনি ফোনটা নিয়ে আসুন প্লিজ।”

সিকিউরিটির লোকটি দেখল এরা পরস্পরকে চেনে। সে তিস্তার দিকে মাথা নেড়ে চলে গেল। তিস্তা ভেতরে ঢুকে বিছানার পাশের সাইড টেবিল থেকে ফোনটা তুলল। একবার হোম স্ক্রিনটা অন করতে চেষ্টা করল। সত্যিই তো! এ তো অন্য হোম স্ক্রিন! এটা ওর ফোন নয় তাহলে! একদম এক রকম দেখতে, তাই চট করে ও তুলে নিয়েছিল। তারপর ঘরে ফিরে এসে আর ফোনটা চেক করেনি। ইস! কী যে হচ্ছে আজকে!
তিস্তা চেয়ারের ওপর রাখা স্কার্ফটা জড়িয়ে নিল। তারপর দরজা খুলে ফোনটা অস্মিতকে এগিয়ে দিয়ে লজ্জিত স্বরে বলল,
“রিয়্যালি সরি! আপনাকে আবার কষ্ট করে আসতে হল।”
অস্মিত একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল,
— “আর কষ্ট! সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেই রাত কেটে যাচ্ছে। এমন হোটেলের অবস্থা, লিফট চলছে না, সিঁড়িতে আলো নেই। আমার আবার ছ’তলায় রুম। বুঝুন একবার। আমি আজকেই রাত দশটায় চেক ইন করেছি। একটা সুটকেস আর একটা ব্যাগ সঙ্গে ছিল। এরা ঘরে সুটকেসটা পাঠিয়ে দিয়েছে, ব্যাগটা পাঠায়নি। আমারও সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হয়নি। তারপর একটা দরকারি কাগজ বের করতে গিয়ে দেখি ব্যাগ নেই। ওই ব্যাগের খোঁজ করতেই তো তখন নীচে যাচ্ছিলাম। নীচ থেকে ব্যাগ নিয়ে ঘরে চলে গিয়েছিলাম, জানেন? তারপর ফোনটা চেক করতে গিয়ে দেখি এই কাণ্ড। আপনার রুম নম্বর তো জানি না? আবার ওই অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলাম। ভাগ্যিস আপনি নামটা বলেছিলেন। রিসেপশনে আপনার নাম বলে, রুম নম্বর খুঁজে…”
তিস্তা স্বভাবতই কৌতুকপ্রিয়। ও অস্মিতের সঙ্গে একটু মজা করবার লোভ সামলাতে পারল না। বলল,
“এবার আর ধাক্কা খাননি তো?”
অস্মিত অবাক হয়ে বলল,
“মানে?”
— “মানে এবার সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আর কারও সঙ্গে ধাক্কা লাগল কিনা তাই জিজ্ঞেস করছি।”
তিস্তা হাসতে হাসতে মুখে হাত চাপা দিল।
অস্মিত বিস্মিত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“কী আশ্চর্য! আপনার হাসি পাচ্ছে? নিজের ফোনটা হারিয়ে গেলে কী করতেন?”
— “হারাল কোথায়? এই তো আপনি দিয়ে গেলেন!”
— “বাহ বাহ, বেশ! উফ, আপনি! এদিকে আমার টেনশনে…”
— “আর টেনশন করবেন না। ফোন পেয়ে গেলেন তো? এবার গিয়ে শুয়ে পড়ুন। না না, আই অ্যাম ভেরি সরি। সত্যি! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ! আই মিন ইট।”
তিস্তা হাত বাড়িয়ে দিল। অস্মিত আলতো করে ওর হাতটা ছুঁয়ে বলল,
“ইটস ওকে। গুড নাইট।”
তিস্তা হাসিমুখে বলল,
“গুড নাইট আর কোথায়? এ তো সকাল প্রায় হয়েই এল। বাই।”

২
তিস্তা ভূপালের রাজা ভোজ এয়ারপোর্টের লাউঞ্জের একটা চেয়ারে বসে ল্যাপটপ খুলে কাজ করছিল। বিকেল চারটের সময় ওর বম্বে ফেরত যাওয়ার ফ্লাইট ছিল। সেইমতো এয়ারপোর্টে পৌঁছে তিস্তা শুনল ফ্লাইট লেট, কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছে, ছাড়বার সঠিক সময় এক্ষুনি বলা যাচ্ছে না। অযথা সময় নষ্ট করার মানে হয় না। তিস্তা একধারে একটা চেয়ারের পাশে ব্যাগ নামিয়ে রেখে, নিজের কাজ শুরু করে দিল। আজকে সকালের মিটিংগুলো ভালোই হয়েছে। তিস্তা মিটিং-এর পয়েন্টগুলো সব পরপর গুছিয়ে টাইপ করতে লাগল।
— “হ্যালো!”
তিস্তা চমকে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলল। আরেহ, এ যে সেই ছেলেটা, অস্মিত। কালকে রাত্রের সেই বিধ্বস্ত চেহারা আর নেই। একটা নীল চেক চেক হাফ শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে দিব্যি ঝকঝকে দেখাচ্ছে। তিস্তা হেসে বলল,
“হাই! আপনি? কোথায় যাচ্ছেন?”
অস্মিতও হাসল, কিন্তু হাসি তেমন ভালো ফুটল না। অস্মিতের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ…
— “বম্বে ফিরব। ফ্লাইটটা লেট হয়ে গেল। কখন যে ছাড়বে! এরা তো কিছু বলতেই পারছে না! আমিও তো বম্বেই ফিরব। ওই ইন্ডিগোর ফ্লাইটটার জন্যই অপেক্ষা করছি।”
— “অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই। বসুন।”
তিস্তা নিজের পাশের খালি চেয়ারটা দেখিয়ে, ল্যাপটপের দিকে আবার চোখ ফেরাল। অস্মিত ব্যাগ, সুটকেস রেখে ধপ করে বসে পড়ল। তিস্তা কাজ থেকে চোখ না সরিয়েও বুঝতে পারল অস্মিত সুস্থির হয়ে বসতে পারছে না। সমানে উশখুশ করছে। চেয়ার থেকে উঠে সামনের জায়গাটাতে হেঁটে হেঁটে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটা ফোন করে নিয়েছে। হাত দিয়ে চুল সরাচ্ছে, রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে। লম্বা লম্বা পা দুটো নেড়েই চলেছে, ফলে একই স্টিলের পাতের ওপর বসানো তিস্তার চেয়ারটাও কেঁপে কেঁপে উঠছে।
আরেহ, এ তো মহা অস্থির! প্লেন না ছাড়লে ছটফট করে কোনও লাভ আছে? তিস্তা আর থাকতে না পেরে বলল, “এত ব্যস্ত হয়ে কী করবেন? প্লেন লেট হওয়া তো কারো হাতে নেই। রিলাক্স!”
অস্মিত উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “রিলাক্স কী করে করি বলুন তো? আমার বম্বে গিয়ে অফিসে একটা জরুরি মিটিং ছিল। দুবাই থেকে একটা পার্টি এসেছে আমাদের সঙ্গে একটা ডিলের ব্যাপারে। কী যে মুশকিলে পড়লাম! আমার সেক্রেটারিকে বলেছি ওদের জানিয়ে দিতে… কিন্তু তাহলেও… কী ঝামেলা! বাবা আর দাদাও বম্বেতে নেই…”
— “আপনাদের বিজনেস বুঝি?”
— “হ্যাঁ। ইলেকট্রিক্যাল ইকুইপমেন্টস তৈরির বিজনেস। মধ্যপ্রদেশের দেওয়াসে আমাদের একটা ফ্যাক্টরি আছে। সেখানেই এসেছিলাম। তারপর এই তো ভূপাল হয়ে ফেরা। কোথায় এক-দেড় ঘণ্টায় বম্বে পৌঁছে যেতাম, তা না…”
তিস্তা উৎসাহিত হয়ে উঠল। ভাল লোক পাওয়া গেছে তো! এদের মধ্যপ্রদেশে ফ্যাক্টরি, বিজনেস। ওর কাজটার জন্য কিছু পয়েন্ট তো এর কাছ থেকেও পাওয়া যেতে পারে?
তিস্তা বলল, “আপনাকে পেয়ে খুব ভালো হল। আমার কাজটায় একটু হেল্প করে দিন না?”

অস্মিত তিস্তার দিকে তাকিয়ে একটু বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, “আপনার কাজে হেল্প? বলুন? সম্ভব হলে নিশ্চয়ই করব।”
— “আমি ‘বিজনেস ডেলি’তে কাজ করি। মধ্যপ্রদেশের শিল্প পরিস্থিতি নিয়ে একটা প্রতিবেদন বের করবে আমাদের কাগজ। সেই কাজের জন্যই আমার এখানে আসা। অনেকের সঙ্গেই দেখা করেছি এই দুদিনে। আপনি এ ব্যাপারে কিছু বলুন না? এখানে শিল্পে বিনিয়োগ করবার সুবিধা-অসুবিধা, সরকারের কাছ থেকে আর কী পেতে ইচ্ছুক শিল্পমহল, এই সব আর কি…”
অস্মিত হেসে বলল, “এ তো ইন্টারভিউয়ের প্রশ্ন দেখছি! আমার রোজকার ব্যবসা সামলানোর কাজ। এত গুছিয়ে কী বলতে পারব? দেওয়াসে আমাদের ফ্যাক্টরিটা দাদুর আমলের। আপনি দেওয়াসের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। এখানকার সব থেকে পুরনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট। সেই সত্তর-আশির দশক থেকে ওখানে অনেক রকমের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে সেই রমরমা ধরে রাখা যায়নি। অনেক বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি আছে। প্রায় চার হাজার একর জুড়ে, ছোট বড় মিলিয়ে ধরুন প্রায় সাড়ে চারশোর ওপর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিট। তবে উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে প্রোডাকশন, এক্সপোর্ট সব কিছুরই ক্ষতি হচ্ছে। এদিকে সরকারের আরেকটু নজর দেওয়া দরকার।”
অস্মিত চুপ করল। তিস্তা একটা নোটবুক বের করে লিখতে আরম্ভ করেছিল। অস্মিত ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“না, না, লিখতে হবে না। এ সব আমি আপনাকে ইমেল করে পাঠিয়ে দেব। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি বডি থেকে অনেক লোকাল ইস্যু গভর্নমেন্টকে মাঝে মাঝেই পাঠানো হয়। সেগুলো দেখলে আপনার কাজের খানিকটা সুবিধে হবে হয়ত।”
অস্মিত তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কিন্তু এদিকে কী ব্যাপার বলুন তো? ফ্লাইট কখন ছাড়বে কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না। আপনি জিনিসগুলো খেয়াল রাখুন, আমি একবার একটু দেখে আসি।”
***
সন্ধে হয়ে গেছে। এয়ারপোর্টে ভিড় জমছে। লেট হওয়া ফ্লাইটের লোকজন, অন্য ফ্লাইটের লোক মিলিয়ে গিজগিজ করছে এয়ারপোর্ট। ইন্ডিগোর কাউন্টারের কাছে উপচে পড়ছে লোকজন। তিস্তা ওর জায়গা থেকেই দেখতে পেল বেশ কয়েকজন যাত্রী ইন্ডিগোর দুজন স্টাফকে ঘিরে ধরেছে। তিস্তা ওদের অবস্থাটা বেশ বুঝতে পারছে। বেচারা ছেলেগুলো! যাত্রীদের নানা রকম প্রশ্ন শুধু নয়, ফ্লাইট দেরি হবার জন্য রাগ, বিরক্তি, উদ্বেগও যথেষ্ট ধৈর্যের সঙ্গে হাসিমুখে সামলাতে হচ্ছে ওদের।

অস্মিত দুটো কফি আর সামোসা নিয়ে ফিরে এল। তিস্তা ল্যাপটপ বন্ধ করে ওর হাত থেকে কফিটা নিতে নিতে বলল, “থ্যাংক ইউ। কিন্তু আবার এসব কেন?”
— “কেন? খিদে পাচ্ছে না আপনার? আমার তো ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে।”
তিস্তা কফির কাপটা নিয়ে ব্যাগ থেকে পার্সটা বের করতে গেল। অস্মিত হাঁ হাঁ করে উঠল।
“প্লিজ! এটা করবেন না। আমার তো আপনাকে আরও ভালো করে খাওয়ানো উচিত ছিল। কালকে রাত্রে আমার জন্যে আপনার খাবারটা পড়ে গেল! কিন্তু সেরকম কিছু তো পেলামই না। আমরা কথা বলছি আর ওদিকে স্টলের সব খাবার প্রায় শেষ। তবে ইন্ডিগোর ওরা বলছে আর বেশিক্ষণ লাগবে না। এইবার চেক ইন শুরু হবে।”
৩
প্লেন অবশেষে টেক অফ করেছে। তিস্তা আর অস্মিত পাশাপাশি সিটে। অস্মিত কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করছে, তিস্তা সিটের পেছনে মাথা হেলিয়ে চোখটা বুজে আছে। অস্মিত একবার তিস্তার দিকে তাকাল। তিস্তা ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। সেই তো, কালকে রাত থেকে যা হুজ্জুতি যাচ্ছে। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ওর কথাবার্তায় সেসব মনে হওয়ার উপায় নেই। এত হাসিখুশি, সহজ, সপ্রতিভ মেয়ে অস্মিত এর আগে কোনওদিন দেখেনি। তিস্তার সঙ্গে গল্প করতে করতে এয়ারপোর্টে এতটা সময় কোথা দিয়ে কেটে গেল। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ও নিজের অফিসের চিন্তাও ভুলে গিয়েছিল।
তিস্তার দিকে তাকিয়ে অস্মিতের মনে হল, বেশ সুন্দর দেখতে তিস্তাকে। একটা সাদা কাজ করা টপ আর একটা কালো ট্রাউজার পরেছে তিস্তা। লাবণ্যমাখা সুডৌল মুখ। চিবুকের কাছে একটা ছোট্ট তিল। চুলগুলো একটু এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর এসে পড়েছে। অস্মিতের হঠাৎ তিস্তার কপাল থেকে চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। তারপর নিজের ভাবনায় নিজেই ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে ও মুখটা ঘুরিয়ে নিল।
“মে আই হ্যাভ ইয়োর অ্যাটেনশন প্লিজ…”
প্লেনের সাউন্ড সিস্টেম সরব হয়ে উঠেছে। তিস্তা চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল। অস্মিত কান থেকে ইয়ারফোনটা নামিয়ে রাখল। আশেপাশের সিটের লোকজন নড়েচড়ে উঠল। সাউন্ড সিস্টেমে ভেসে আসছে পুরুষ কণ্ঠ…
“ইয়োর ক্যাপ্টেন হিয়ার ফ্রম দ্য ফ্লাইট ডেক। আই অ্যাম ভেরি সরি টু সে, আমাদের প্লেনে একটা টেকনিকাল প্রবলেম হয়েছে। বম্বে অবধি এই ফ্লাইট যেতে পারবে না। আমরা বরোদাতে একটা এমারজেন্সি ল্যান্ডিং করছি। উই উইল অ্যারেঞ্জ অ্যানাদার ফ্লাইট টু বম্বে ফ্রম বরোদা। আই সিনসিয়ার্লি অ্যাপলোজাইস ফর দ্য ইনকনভিনিইয়েন্স। কেবিন ক্রু প্লিজ প্রিপেয়ার ফর ল্যান্ডিং।”

চারিদিকে একটা চাপা গুঞ্জন। তারপরেই লোকজন সরব হয়ে উঠল। সবাই উত্তেজিত হয়ে একসঙ্গে কথা বলছে। এত রাতে এ কী বিড়ম্বনা! এমনিতেই ফ্লাইট লেট, তারপরও কেন সব দেখে নিয়ে ভোপাল থেকে প্লেন ছাড়ল না? এদের কোনও দায়িত্বজ্ঞান নেই? যাত্রীদের নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে!
কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে এয়ার হোস্টেসদের ডেকে ডেকে প্রশ্ন করছে। এয়ার হোস্টেসরা এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। এইরকম হঠাৎ ঘোষণার ফলে তারাও ছোটাছুটি করে ল্যান্ডিং-এর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। অস্মিত সিট বেল্ট আটকাতে আটকাতে তিস্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হল তো! এইটাই বাকি ছিল। সুস্থভাবে একবারে বম্বে পৌঁছানো এবার কপালে নেই। আপনি সঙ্গে থাকলে লাইফে বৈচিত্রের অভাব হয় না দেখছি! কালকে রাত থেকে যা শুরু হয়েছে…”
— “এই দেখুন! আমি আবার কী করলাম? প্লেন খারাপ হয়ে গেছে, সেটা কি আমার দোষ?”
— “না না, তা বলছি না। আচ্ছা আপনার একটুও টেনশন হচ্ছে না? ভাবছেন না, কখন বাড়ি পৌঁছবেন?”
— “কী মুশকিল! ভেবে কী করব? আমার হাতে কিছু আছে নাকি? আচ্ছা, আপনি বরোদায় গেছেন আগে?”
— “না, সুযোগ হয়নি।”
তিস্তা খুব উৎসাহিত হয়ে বলল।
“শুনুন না, একটা কাজ করবেন? এরা কি এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে দেবে?”
— “জানি না। কেন? কোথায় যাবেন?”
— “বরোদাতে অনেক দেখার জায়গা আছে শুনেছি। চলুন না, এয়ারপোর্ট থেকে একটা ক্যাব নিয়ে বরোদাতে একটা নাইট ট্যুর করে নিই? খুব মজা হবে, দেখবেন। তারপর গুজরাতি ডিনার। কী!”
তিস্তার চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠল! অস্মিত প্রায় কথা হারিয়ে ফেলেছে। এসব কী বলছে তিস্তা? ওর কোনও চিন্তা-ভাবনা কিছুই নেই নাকি? এই যে এক প্লেন লোক বিরক্ত হয়ে, রাগ করে, অযথা হয়রানির জন্য প্লেনের ভেতর অস্থির হয়ে, এয়ারলাইন্সকে দোষারোপ করে যাচ্ছে, আর ও একদম নির্বিকার! বরং এরই মধ্যে বেড়ানোর প্ল্যান করে খুশি হয়ে উঠছে! অস্মিত আশ্চর্য হয়ে তিস্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি যে কী বলব ভেবে পাচ্ছি না! মাঝরাতে বরোদায় ঘুরবেন? এরই মধ্যে বেড়াবার প্ল্যানও করে ফেললেন?”

তিস্তা অস্মিতের মুখের দিকে তাকাল। আচ্ছা বেরসিক লোক তো? বয়েস কম হলে কী হবে, এর শুধু জ্যাঠামশাইদের মতো চিন্তা আর টেনশন করার স্বভাব! কোথায় এরকম একটা হঠাৎ সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে, খুশি হবে, তা না…!।
তিস্তা বলল, “কেন? আপনার বেড়াতে ভাল লাগে না? ঠিক আছে, আপনি না গেলে আমি একাই যাব। এয়ারপোর্টে গাড়ি থাকবে নিশ্চয়ই। ওদের বললেই হবে।”
— “ওদের বললেই হবে? আপনি একা এই রাত্রে একটা অচেনা শহরে ঘুরতে যাবেন? আর আমার সঙ্গে যে যাবেন বলছেন, আমাকে চেনেন না, জানেন না, আমার সঙ্গে রাত্রে ক্যাব নিয়ে বেরোবেন? ভয় করবে না?”
তিস্তা অবাক হয়ে বলল, “সে কি? আপনাকে চিনি না? কালকে মাঝরাত থেকে তো শুধু আপনাকেই দেখছি… মাঝে কয়েক ঘণ্টা বাদ দিয়ে, আর আপনি বলছেন আপনাকে চিনি না? আশ্চর্য লোক তো আপনি! আর ভয় করবে কেন? আপনি বাঘ না ভাল্লুক? অন্ধকারে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন না কি?”
অস্মিত অসম্ভব বিরক্ত হয়ে তিস্তাকে কোনওমতে থামিয়ে দিয়ে বলল “ছি ছি ছি! থামুন আপনি। কী যে বলছেন!”
— “বাহ, আপনিই তো অদ্ভুত কথা বলছেন। আচ্ছা, আপনি কি সিঙ্গল?”
তিস্তার এই খাপছাড়া প্রশ্নে অস্মিতের কান দুটো হঠাৎ ভীষণরকম লাল হয়ে উঠল। ও তিস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “মানে?”
— “মানে আবার কী? কখন বম্বে পৌঁছবেন কে জানে! বাড়িতে আপনার স্ত্রী অপেক্ষা করে আছেন কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছি।”
— “না না, আই অ্যাম নট ম্যারেড। বাড়িতে মা আর ভাবি আছেন। বাবা আর দাদা তো বাইরে। আর আপনি? আপনার বাড়িতে কেউ চিন্তা করবে না?”
— “আমি বম্বেতে একাই থাকি। পথ চেয়ে কেউ বসে নেই।”
তিস্তা আর অস্মিতের অবশ্য বরোদা এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনো হল না। এয়ারপোর্টে নেমেই ইন্ডিগোর তরফ থেকে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের হাতে ডিনারের প্যাকেট দিয়ে দেওয়া হল। রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ডিনার পেয়ে যাত্রীদের ক্ষোভ খানিকটা হলেও প্রশমিত হল, কিছুটা সময়ও কাটল। বরোদায় বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। এবার এক ঘণ্টার মধ্যেই আরেকটা প্লেন বম্বে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেছে। তিস্তার বরোদা ঘোরার ইচ্ছে আপাতত মুলতুবি রইল।
অন্ধকার আকাশে পথ কেটে প্লেন বম্বের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছে। কেবিনের আলোগুলো কমিয়ে দিয়ে প্লেনের ভেতরটা আধো আলো-অন্ধকার মাখা স্বপ্নিল পরিবেশ। সেই একইরকম পাশাপাশি বসে আছে অস্মিত আর তিস্তা। এবার আর তিস্তা ঘুমোয়নি, চুপ করে বসে আছে। অস্মিত তিস্তার দিকে তাকাল। কী ভাবছে ও? হঠাৎ অস্মিতের মনে হল আর একটু পরেই তো প্লেনটা বম্বেতে ল্যান্ড করবে। তারপর ওরা যে যার নিজের পথে। পথের পরিচয় কি পথেই শেষ হয়ে যাবে? তিস্তার সঙ্গে ওর কি আর দেখা হবে না? অস্মিতের ভেতরটা হঠাৎ কেমন করে উঠল। না, না অসম্ভব! তিস্তাকে যে ওর দারুণ ভালো লেগে গেছে! তিস্তার সঙ্গে আর দেখা না হলে…! নাহ, এই দোটানায় ও থাকতে পারবে না। এর একটা উত্তর পেতে হবে এক্ষুনি— সে যাই হোক না কেন।

অস্মিত গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে তিস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তিস্তা?”
তিস্তা ঘাড় ফেরাল।
— “আপনার সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে?”
তিস্তার ভুরু দুটো উঁচুতে উঠে গেল। অস্মিতের চোখের ভাষা পড়তে ওর একটুও অসুবিধে হল না। অল্পেতেই অপ্রস্তুত হয়ে ওঠা, লাজুক, টেনশনপ্রবণ অস্মিতের ভেতর থেকে যেন একটা অন্য গভীর অস্মিত বেরিয়ে এসেছে। তিস্তার মনটা দুলে উঠল। তবুও একটু রসিকতা করার লোভ তিস্তা সামলাতে পারল না। কপট বিস্ময়ের স্বরে বলল,
“সে কি? এখনও তো মোটে বাড়িই ফিরতে পারলাম না! আপনার সঙ্গেই সেই থেকে বসে আছি। এখনই দেখা করার কথা? আপনার আবার আমাকে ভালো টালো লেগে গেল না তো?”
তিস্তার চোখ কৌতুকে নেচে উঠল। হাসি গোপন করতে ও জানালার দিকে মুখ ফেরাল। অস্মিতের মুখটা এক ঝলকে কান পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল। ও তিস্তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আহত গলায় বলল, “আপনি কখনও একটুও সিরিয়াস হতে পারেন না, না? যাক, আপনার উত্তর পেয়ে গেলাম। আর বলব না। সরি। প্লিজ ফরগেট ইট।”
তিস্তা হঠাৎ একটা খুব অন্যরকম গলায় বলল, “এই, না না। মজা করছিলাম আমি। মাইন্ড করবেন না প্লিজ। আমি সিরিয়াস নই আপনি ভাবছেন, না? সত্যি, মজা করা স্বভাব হয়ে গেছে আমার। আসলে ভীষণরকম সিরিয়াস আর কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমার বড় হয়ে ওঠা, জানেন? ব্রোকেন ফ্যামিলি। খুব ডিস্টার্বড সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছি। আমার কাস্টডি নিয়ে খুব ঝামেলা হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই অশান্তি, কোর্টরুম, এসব দেখেছি। হস্টেলে বড় হয়ে ওঠার দিনগুলো মনে পড়ে। সবাই কত আনন্দ করে ছুটিতে বাড়ি যেত। আমার ছুটিতে একবার এখানে, একবার ওখানে। কিচ্ছু ভাল লাগত না। তারপরে তো মা বিদেশেই চলে গেল। আমার কথা কি সেরকম করে কেউ ভাবল? অ্যাডলেসেন্ট পিরিয়ডটা আমাকে খুব অ্যাফেক্ট করেছিল। টাকাপয়সার কোনও অসুবিধে ছিল না। কিন্তু টাকাপয়সাই কি সব, বলুন? সুস্থ পরিবার, আদর, যত্ন, ভালবাসা এগুলো না থাকলে…”
তিস্তার গলাটা ধরে আসছিল। একটু চুপ করে থেকে ও বলল, “থাক ও সব কথা। তারপর থেকে আমি ঠিক করেছি লাইফটা যতটা পারি হেসে, আনন্দ করে কাটাব। জাস্ট লিভ ইন দ্য মোমেন্ট। কোনওকিছুরই স্থায়িত্ব নেই জীবনে। দেখেছি তো! অত সিরিয়াস হয়ে, টেনশন করে কী লাভ বলুন? যা হওয়ার, সে তো হবেই।”

অস্মিত সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলতে পারল না। আপাতদৃষ্টিতে দারুণ প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি এই মেয়েটির হাসির আড়ালে যে একটা গভীর দুঃখ লুকিয়ে আছে, জেনে ওর মনটা কেমন ভারী হয়ে উঠল। ও আস্তে আস্তে বলল, “সরি। না বুঝে আমি…”
তিস্তা মাথা নাড়ল,
“না না, ইট’স ওকে। এসব কথা সচরাচর আমি কাউকে বলি না। আর সত্যি কথা, এসব ভাবিও না আর। এখন মোটামুটি ঠিকঠাক চলছে। কাজটা মন দিয়ে করি, ভালো লাগে। আর বললাম তো, একাই থাকি। অনেকদিন থেকেই একা একা সব সামলানোর অভ্যেস হয়ে গেছে।”
অস্মিত তিস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্যান উই নট বি ফ্রেন্ডস?”
তিস্তা ওর সহজ ভঙ্গিতে হাসল। সেই উষ্ণতায় ভরা হাসি ওর চোখ ছুঁয়ে গেল, সারা মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
“নিশ্চয়ই। বন্ধুই তো। এতক্ষণ গল্প করলাম, এতক্ষণের পথ চলা একসঙ্গে, আপনি বন্ধু নন? আমার ফোন নম্বরটা রাখুন। দেখা করব আমরা।”
তিস্তা ওর হাতটা বাড়িয়ে দিল। অস্মিত সাগ্রহে হাতটা নিজের দুটো হাতের মধ্যে নিয়ে তিস্তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আই কান্ট টেল ইউ হাউ হ্যাপি আই অ্যাম ! এরকমই থাকুন আপনি, তিস্তা। সব সময়। এরকমই সহজ, হাসিখুশি, স্পিরিটেড। কেউ কি চাইলেই আপনার মতো হতে পারে বলুন? কজন আপনার মতো যে কোনও বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেও আনন্দের রসদ খুঁজে পায়? রোজকার জীবনের মালিন্য যেন আপনাকে কোনওদিন স্পর্শ করতে না পারে।”
কেউ যেন অনেক অনেকদিন পর, তিস্তার মনের কোমল তন্ত্রীগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দিল। চোখে জল চলে এল তিস্তার। অসম্ভব স্বাবলম্বী, কৌতুকপ্রিয়, হাসিখুশি তিস্তা হঠাৎ একটা হাত চোখের ওপর চেপে কেঁদে ফেলল।
অস্মিত ওর দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, “এ কি, কী হল? তিস্তা…”
তিস্তা দুদিকে মাথা নাড়ল। অস্মিত খুব নরম স্বরে বলল, “প্লিজ, একদম না! প্রশংসা করলে কেউ কাঁদে নাকি?”
তারপর অস্মিত অল্প হেসে তিস্তার হাতে একটু চাপ দিয়ে বলল, “এবার আমি বলি? রিল্যাক্স!”
চোখের জলের মধ্যে দিয়ে অস্মিতের দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করল তিস্তা। অস্মিত তিস্তার হাতটা ধরে রইল। প্লেনটা ধীরে ধীরে আকাশে পথ কেটে বম্বে এয়ারপোর্টের দিকে নামতে লাগল।
ছবি সৌজন্য: শুভ্রনীল ঘোষ, Pexels, Istock, Free public Domain,
পেশায় অর্থনীতিবিদ। প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা। দুই দশকের ওপর ধরে ইকনমিক পলিসি রিসার্চ- জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত। কর্মজীবনের শুরু কলকাতায়, তারপর কর্মসূত্রে দিল্লি, গুরগাঁও এবং বর্তমানে মুম্বই।
সার্ক সদস্য দেশের মধ্যে আয়োজিত ‘দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় শীর্ষ স্থান অধিকার করে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন।
অবসরের সঙ্গী লেখালেখি এবং গান। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজি কবিতার বই ‘Thoughts to Words’ (২০২০) এবং বাংলা কবিতার বই ‘টুকরো কথা’ (২০২৩)। কবিতা ও ছড়া লেখার সঙ্গে সঙ্গে লিখছেন গল্প।
হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং অন্য ধারার বাংলা গানে দীর্ঘদিন শিক্ষা লাভ করেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের মিউজিক অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ২০১৫ তে।
2 Responses
Darun
খুব ভাল লাগল