banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

দেখা: গল্প: চৌকাঠে বুনোমোষ

বাংলালাইভ

এপ্রিল ৩, ২০২৩

new short story on buffalo painting
new short story on buffalo painting
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

সৌরভ ইয়াসিন আজকেই আসবে। 

মণিদীপা, সৌরভ ইয়াসিনের বছর আগের ক্লিক একজোড়া জংলি মহিষের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে ছিল। ছয় ফুট বাই চার ফুটের ব্রোমাইডের ওপরে মনোক্রম মানে সাদা কালো প্রিন্টের একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত স্থিরচিত্র। আফ্রিকার মসাইমারা ফরেস্টের একজোড়া ওয়াইল্ড বাফেলো। যারা এসে ছবিটি দেখেন, তাঁরা অনেকেই পার্থক্য করতে পারেন না, ওয়াইল্ড বাফেলো আর বাইসনের মধ্যে পার্থক্য ঠিক কতটা? ছবিটি যিনি দেখেন প্রতিবারই মণিদীপ তাঁর দেখার ভুলকে বারে বারে কারেকশন করে দিয়ে বলে, উঁহু, ওয়াইল্ড বাফেলো… Bison have large humps at their shoulders and bigger heads than buffalo…

ছবিটির দিকে স্থির তাকিয়ে থাকা ব্যক্তিটি বলবে, উটেরও কুঁজ হয়। মানুষেরও পিঠের ওপরে ঢিবি হয়। বাইসনেরও হয়। বুনো মোষেরও হয়। যদিও বিষয়টি কুঁজের নয়, বুনো মোষের ছবিটি কিন্তু অসামান্য। ইয়াসিনের ক্যামেরায় জাদু আছে।    

 আজ সকাল থেকেই মণিদীপা একজোড়া বুনো মোষের এই ছবিটির দিকে বারে বারে তাকিয়ে দেখছিল, আর স্মৃতির শরীরে মোলায়েম হাতিয়ে যাচ্ছিল। কত কথা মনে পড়ছিল। আর পাখির শরীর থেকে পালকগুলি খুলে খুলে পড়ছিল। কোমর পর্যন্ত হলুদ রঙের ঘাস ঢেউ তুলে যাচ্ছিল, পাল তুলছিল হরিণের জটলা। গাছের ডালে লেজ ঝুলিয়ে বসেছিল চিতা। 

সৌরভ ইয়াসিন ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে মগ্ন হয়েছিল। মণিদীপা যতটা পারছিল সৌরভ ইয়াসিনের শরীর থেকে গরম নেওয়ার চেষ্টা করছিল একেবারেই গা ঘেঁষে। ওদের বিয়ের মাত্র চারদিন পরে কেনিয়ার মাসাইমারার জঙ্গলে তারা দুজন। সাথে ওদের হলুদ ঘাসের জঙ্গলের ওপরে হু হু বাতাস, মাঝে মাঝে ঘাস পুড়ছে। সাফারি জিপের গতি নিজের রাস্তা নিজেই গড়িয়ে নিচ্ছে। জিপের ড্রাইভার মানোডি ওয়াঙ্গা অনেক কথা বলছিল ঘাসের জঙ্গলের বিষয়ে।   

Masai mara
ওদের বিয়ের মাত্র চারদিন পরে কেনিয়ার মাসাইমারার জঙ্গলে তারা দুজন।

রোটা খুব বড় গ্রাম। সেখানে অনেক শান্তি ও বিশ্রামনিবাস আছে। সৌরভ ইয়াসিন মানোডি ওয়াঙ্গাকে বলল, আমরা ঠিক কত কিলোমিটার জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করেছি

মানোডি ওয়াঙ্গা বলল, রোটা থেকে প্রায় চব্বিশ কিলোমিটার ফুরিয়ে এনেছি।  

তবুও লেন্সে তেমন কিছুই ধরা পড়ল না।  

আপনার কপাল। অথচ অনেক কিছুই আপনার ভাগ্যে ঘটল না। যেমন হাতির পাল দেখার ভাগ্য। বাইসনের ছোট বড় দল। বুনো মোষের অক্লান্ত দল। জেব্রার পাল জঙ্গলের ভিতরে সঠিক বিপদের সিগনালিংয়ের কাজ করে। আশ্চর্য ! যতই দূরে যাচ্ছি নদীটিও যেন পিছিয়ে যাচ্ছে।   

হঠাৎ মণিদীপা বলল, সৌরভ আমি কি তোমার সম্পর্কে কিছু বলতে পারি

এখন আমরা জঙ্গলের মধ্যে আছি।    

আমি নিশ্চিত আগামী বহুদূরের ভবিষ্যতে এই বিশেষ দিনটিকে নিয়ে আমি কিছু না কিছু লিখবই। মানে ধরে নাও, নোটস ফ্রম দ্য জঙ্গল জাতীয় কিছু। তাই বলছিলাম, আমি কি তোমার সম্পর্কে আরও কিছু জানতে পারি? মানে আমাদের বেশ কয়েক বছরের সম্পর্কের বাইরেও আমরা পরস্পর যা জানি না সেই বিষয়ে। অবশ্যই যদি তুমি আমার সম্পর্কেও অতিরিক্ত কিছু জানতে চাও, আমি বলতে প্রস্তুত।   

আমাদের বিবাহ হয়ে গেছে, এরপরে যা কিছু পরস্পরের সম্পর্কের বাইরে জানা পড়ে আছে, তার বাকিটুকু আর কিছুই পড়ে থাকবে না আশা করছি।  

থাকবে। মৃত্যু পর্যন্ত অনেক কিছুই বাকি থেকে যাবে। 

মানোডি ওয়াঙ্গা বলল, আইস ক্যানে ঠান্ডা আছে। চুমুক দিলেন না তো

সৌরভ ইয়াসিন বলল, খুব গরম। গুমোট।  

দিন ফুরিয়ে এলে রাতের দিকে এখানে বৃষ্টি হয়। তিন চারদিন পরে বৃষ্টি না হলে, ঘাসের জমিতে আগুন ধরে যায়। কেনিয়ার ঠান্ডা সম্পর্কে আফ্রিকানদের ধারণা অন্যরকম। একটু ঠান্ডা গলায় ঢেলে নিন। ভালো লাগবে। ম্যাঙ্গো জুসের স্বাদ আছে। 

মণিদীপা বলল, স্টোর ব্যাগে জল আছে। আমি তাই খাই।

বেশ তো। 

***

অনেকটা পথ অতিক্রম করে এল। একটাও দৃশ্য ছবির মতো উপভোগ্য হল না। অদ্ভুত তো। কিছু যে চোখে পড়েনি, এমন তো নয়। কিন্তু ক্লিক করে যে ছবি ধরে রাখবে, তেমন উল্লেখযোগ্য দৃশ্য কোথায়? তাহলে কি এ যাত্রা তাদের কপালটাই খারাপ

মানোডি ওয়াঙ্গা বলল, এরপরে আমরা এগিয়ে যাব বিপদসীমার মধ্যে। ভয় অন্য কোনো জানোয়ার সম্পর্কে নয়। ভয় হল, জঙ্গলের সবচাইতে শক্তিশালী জন্তুটিকে নিয়ে, হাতি। আফ্রিকান হাতির পাল হল সবচাইতে বিপজ্জনক। সাফারি জিপের চারদিক ব্যারিকেড করে রাখে। ভাগ্য খুব খারাপ থাকলে দশ থেকে বারো ঘণ্টা সেই ব্যারিকেডের মধ্যে থাকতে হয়। আমার জীবনে এইরকম অভিজ্ঞতা বেশ কয়েকবার হয়েছে। স্থির হয়ে থাকতে হবেগাড়ির ভিতরে চুপ করে বসে থাকতে হবে। ম্যাচ বক্সের দেশলাইয়ের কাঠি ঠুকলেই বিপদ। আমি মন থেকে চাইছি হাতির দল যেন আমরা দূর থেকেই দেখতে পাই। যাতে সময় সুযোগ বুঝে সরে পড়তে পারি।  

Masai mara Elephants
আফ্রিকান হাতির পাল হল সবচাইতে বিপজ্জনক

মানোডি ওয়াঙ্গার এই কথায় খুবই চটে গেছিল সৌরভ ইয়াসিন।

  লোকটি কি জানে না, সমস্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়েই আমি এখানে কাজ করতে এসেছি। হাতির দলই হোক, বা দাবানলের আগুনে ঘাস পুড়ে যাওয়ার মতো যে কোনও বিপজ্জনক ঘটনাই হোক, ছবি কিছু সংগ্রহ করতেই হবে। একটি স্মৃতি ধরে রাখা ছবি। ভবিষ্যতে এই সব ছবি আমাকে মুনাফা দেবে।  

ভাঙাচোরা নয়, এমন একটি নির্ভাজ ঘটনার দিকে এগিয়ে চলেছিল তারা। সমতল ঘাসের জমির মধ্যে দিয়ে, খুবই সচেতন হলুদ দাগ ধরে, যে দাগের গভীরে লুকিয়ে আছে অনেক পর্যটকের স্মৃতি। 

মানোডি ওয়াঙ্গা বারে বারে বলছিল, আমরা কিন্তু বিপদসীমার মধ্যে অনেকক্ষণ আগেই প্রবেশ করেছি। এরপরে যা কিছু ঘটবে সেটা আমাদের বাড়তি পাওনা। মাসাইমারা জঙ্গল হাতির জন্যই বিখ্যাত। বিশাল আকারের সব দানবীয় হাতি। আফ্রিকার মানচিত্রের মতো দুটো কান হাওয়াকলের মতো আশেপাশে বাতাস সৃষ্টি করে। আর তেমনিই হিংস্র। 

আফ্রিকার হাতির আকার ও হিংস্রতা নিয়ে আপনার ধারণাকে আমি বিশ্বাস করছি।    

অভিজ্ঞতায় দেখেছি  হাতি সম্পর্কে অনেক পর্যটকের ধারণা আমার থেকেও অনেক গুণ বেশি। 

***

বিপদ ঘটেছিল অনেক পরে, প্রায় বিকেল ফুরিয়ে আসার আগে আগে। ঠিক দুপুরের দিকে একটি ঝাঁকরা মাথাওয়ালা গাছের গুঁড়ির আড়ালে একজোড়া বুনো মোষের দেখা পেয়েছিল সৌরভ ইয়াসিন। সঙ্গমের পরে তাদের পরস্পরের লোমশ শরীর লেহন করে নেওয়ার যে বিরল দৃশ্য সৌরভ ইয়াসিন ক্যাপচার করে নিল, তার জন্য গোটা কৃতিত্বই মণিদীপার প্রাপ্য। 

বুনো মোষের সঙ্গমের পরে যে আন্তরিক দৃশ্য মণিদীপার চোখে ভেসে উঠেছিল, সে এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে সৌরভকে ফিস ফিস করে বলে উঠেছিল ক্লিক… ক্লিক…ক্লিক… 

মানোডি ওয়াঙ্গা ব্যাক গিয়ারে জিপটিকে ব্যাক ড্রাইভ করে, পিছিয়ে নিচ্ছিল একটি ভরসা মতো সমতল ফাঁকা ঘাসের জমিতে, যাতে করে একটানে ড্রাইভ করে, বুনোমোষের নাগালের অনেক দূরত্বে চলে যেতে পারে। সে বুঝতে পারছিল বুনোমোষ দুটোর রক্তচক্ষু নিস্পলক তাকিয়ে ছিল। এই তাকানোর মধ্যে, ভয়ানক আক্রমণের প্রস্তুতি থাকে। মানোডি ওয়াঙ্গা তার নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছিল, কী ভয়ানক বিপদ ঘটতে চলেছে। 

 ওদের নজর এড়িয়ে মণিদীপা জিপ থেকে কখন যে নেমে গেছিল সৌরভ ইয়াসিন ও মানোডি ওয়াঙ্গা বুঝতেই পারেনি। জিপের ধাক্কা এতই প্রবল ছিল, মণিদীপার মনে হচ্ছিল, বুনোমোষ তার হাঁটুতে চার অশ্বশক্তির ধাক্কা মেরেছে। সে ছিটকে পড়ে যেতেই একটি মহিষ গর্জন করে উঠল। 

তারপরে একজোড়া বুনো মহিষ আবার সঙ্গমে ডুবে গেল।  

African buffalo mating
তারপরে একজোড়া বুনো মহিষ আবার সঙ্গমে ডুবে গেল

২  

স্মৃতির শরীর বড়ই বেখেয়াল। যদিও ঘটে যাওয়া ঘটনাপুঞ্জের গভীরে স্মৃতির শরীরের আদল অনেকটাই নাজুক। মণিদীপা হাতিয়ে হাতিয়ে যা পাচ্ছিল, তার মধ্যে একেবারেই সেলিব্রেশন নেই। সে বুঝতে পারছিল, হাঁটুর নীচে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। হুইল চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে তার শরীর ও মনের ক্লান্তি ক্লেদ হয়ে বসে গেছে। প্রতিদিন সে বুনো মোষের ছবিটার দিকে তাকিয়ে মোষের শরীরের শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করে। কিন্তু হাঁটু তার বিচ্ছিরিভাবে ভেঙে গেছে।    

 বেশ কয়েক মাস পরে, সৌরভ ইয়াসিন আসছে মণিদীপার ফ্ল্যাটে। মণিদীপার হাঁটুর চিকিৎসার জন্যই। সৌরভ ইয়াসিন মণিদীপাকে নিয়ে যাবে, মুম্বাইয়ের টাটা হাসপাতালে। যদি তার স্ত্রী মণিদীপার জন্য একটা কৃত্তিম হাঁটুর ব্যবস্থা করা যায়। কারণ মণিদীপার হাঁটু বলতে কিছু নেই। যেটুকু সামান্য আছে, তার মধ্যে জংলা লতাপাতার নির্ভরতার শক্তি পর্যন্ত নেই।   

মণিদীপাই আফ্রো-এশিয়ান ফটোগ্রাফিক সোসাইটিতে মেল করে পাঠিয়ে দিয়েছিল মাসাইমারা জঙ্গলে বুনোমোষের ছবি। মণিদীপার নির্বাচিত তিনটি অসামান্য ক্লিক।
ইয়াসিনকে না জানিয়েই। সৌরভ ইয়াসিন নিজের বেশ কিছু নির্বাচিত ক্লিক গুগল ক্লাউডে রেখে দেয়। মণিদীপা সৌরভের ফাইলে ঢুকে সেই সব ছবি দেখতে থাকে। মণিদীপার ভিতরে অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে, সে বুঝতে পারে উৎকর্ষতার গভীর ভাষা। বুনো মোষের ছবির ভিতরে এক অদ্ভুদ দরদ লুকিয়েছিল। একজোড়া বুনোমোষের নির্ভার চোখের ভাষা। সেই চোখের ভাষা মাসাইমারার জঙ্গলের সীমানা অতিক্রম করে প্রবেশ করেছে বায়োলজিক্যাল বিবর্তনের মধ্যে। 

ছবিটি পুরস্কৃত হয়, অভিনব এক্সপ্রেশন ধরে রাখার জন্য। অ্যাওয়ার্ড অফ এক্সিলেন্স। বলা হয় বেস্ট এগজিবিট। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো অর্থমূল্য।   

মণিদীপা ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। আর ব্ল টিং পেপারের কালি শুষে নেওয়ার মতো সময়কে দ্রুত শুষে নিতে চাইছিল ঘড়ির কাঁটা। 

কিন্তু না, প্রতীক্ষা করতে করতে মণিদীপার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে।
কখন আসবে সৌরভ?
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে চলেছে।
প্রায় একবছর পরে তার সঙ্গে দেখা হবে। বছরের ঠিক এই সময়েই নাইরোবি থেকে তারা ফিরেছিল। ঋতু বদলের ঠিক আগের মুহূর্তে।   

৩ 

রাত্রি নটার পরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহর থেকে একটার পর একটা ফ্লাইট নামতে থাকে। মণিদীপা আগেই আর্জিনাকে বলে রেখেছে আমাকে ছাদে নিয়ে যাবি। একটার পরে একটা ফ্লাইট ল্যান্ড করবে আর প্রতিটি ফ্লাইটের ল্যান্ডিংয়ের সময় মণিদীপা কল্পনা করে নেবে, কোন কোন শহর থেকে ফ্লাইট এসে শহরের এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে। 

সাততলার ছাদে উঠলেই এয়ারপোর্টের আলো আকাশকে উৎসবমুখর করে রাখে। মণিদীপা জানে এয়ারপোর্ট থেকে খুব বেশি হলে, তার আবাসনে ক্যাব চলে আসে মাত্র পাঁচ থেকে আট মিনিটের মধ্যে। সারাদিন প্লে­নের গোঁ গোঁ শব্দ। গ্যাসোলিন মিশে থাকে শহরের আকাশে।

বুনো মোষের ছবির ভিতরে এক অদ্ভুদ দরদ লুকিয়েছিল

রাত্রি সাড়ে আটটার পরেই মণিদীপা আর্জিনাকে তাড়া দিতে থাকে। 

আর্জিনা বলে, ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। 

সবেমাত্র সন্ধে হল।
আজ কত তারিখ যেন? ভুলে গেলে?
মণিদীপা আর্জিনার দিকে তাকিয়ে তারিখ খুঁজে যেতে থাকে। 

মণিদীপা বারে বারে উতলা হয়ে ভাবছে, সৌরভ ইয়াসিনের ফ্লাইট কখন ল্যান্ড করবে। কারণ সৌরভ নিশ্চিত করে সঠিক সময় জানায়নি। আর সে কোন শহর থেকে আসছে কিছুই জানায়নি। শুধু বলেছে আমার ফ্লাইট রাতের দিকে ল্যান্ড করবে। 

আর্জিনা বলল, তাহলে বল আজ তোমার প্রতীক্ষিত সেই দিনটি এল? কতদিন পরে দাদাবাবু আসছে। অনেক মাস পরে। আচ্ছা কখন আসবে বলো তো?

আমার হাঁটুর চিকিৎসার জন্য আসছে। আমরা যাব বোম্বের টাটা হাসপাতালে।

যাক তোমার হাঁটু ভালো হয়ে যাবে। আমাকে আর হুইল চেয়ার ঠেলতে হবে না।

ঠিক কখন আসবে বলা যাচ্ছে না।

হ্যাঁ। আমার তো মনে হচ্ছে রাত বারোটাও হতে পারে।

ওয়াটস অ্যাপে বারে বারে মেসেজ করে জানতে চাইছি ঠিক কখন ফ্লাইট ল্যান্ড করবে? কিন্তু ও কোনও রিপ্লাই দিচ্ছে না।

আমি তো ভেবেছিলাম দাদাবাবু সন্ধের পরেই এসে পড়বে। তুমি যখন জানতে পারছ না কখন আসবে, তখন আমি কী করে জানব?

আমারও তাই ধারণা ছিল।

কিন্তু রাত বারোটার পরে এলে আজকের তারিখ তো আর থাকবে না। তারিখ পাল্টে যাবে। তখন তোমার জমিয়ে রাখা এত প্রতীক্ষিত ভালোবাসার মর্ম থাকবে না আজকের দিনটার জন্য।

আজকের তারিখ প্রতি মাসেই আসে। পাশাপাশি সংখ্যাকে রাখলে আজকের তারিখটাকে অনেকটা হুইল চেয়ার… হুইল চেয়ার মনে হয়। আজকের প্রতীক্ষিত তারিখ এল, আর গতকালের তারিখটাকে কালবৈশাখী ঝড় ছিঁড়ে খেল।

সে কী ঝড়! তোমার হুইলচেয়ার কাঁপছিল। ভাগ্যিস জানালা বন্ধ করতে পেরেছিলাম, না হলে তুমি হুইল চেয়ার থেকে পড়েই যেতে। এফ এম চালিয়ে দেব? স্বর্ণযুগের গানের আসর এই শুরু হল বলে।

না। আস্তে আস্তে আমাকে লিফটের কাছে নিয়ে চল। 
আজ কী বার?

বাঃ রে? বারে বারে বলছ আজকের তারিখ আর বার মনে নেই?

 কোনও কোনও দিন বার অতিক্রম করে শুধু একটি বিশেষ তারিখ হয়ে যায়। 

night Flight

আর্জিনা লিকার চায়ের ফ্লাক্স গুছিয়ে নিয়ে বলল, আর কিছু নিতে হবে? জলের বোতল? তুমি ছাদে গিয়ে কী দেখবে? আমরা কি এখনই ছাদে যাব?
আরেকটু অপেক্ষা করি? ফ্লাইটের ওঠা নামা দেখব।
এখন মাত্র রাত্রি সাড়ে আটটা বাজে।
ঠিক আছে। মিনিট চল্লি­শ পরেই যাই।   

মণিদীপার মনে হল, আচমকাই হুইলচেয়ার নড়ে উঠল। ঝাঁকুনি দিল তীব্র। আর্জিনার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে, কিন্তু কথা বলার দম যেন ভিতর থেকে ফুরিয়ে আসছে। ঠিক সেই দিনকার ঝাঁকুনির মতোশরীর থেকে শরীরকে বিছিন্ন করে দিয়েছিল আচমকাই সাফারি জিপের ধাক্কা, মাসাইমারার জঙ্গলের হু হু বাতাস বুকের ওপরে পোশাক ছুঁয়ে কামার্ত হয়ে পড়ছিল। আচমকাই জিপের পিছন দিকের চাকা, টায়ার জুড়ে চোরকাঁটার পিষে যাওয়া অবশিষ্ট, ঘাসফুল চোরকাঁটার ওপরে নির্বিকার লেহন করছে।  

৪   

গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে লিফট উঠে গেল, সোজা সাততলা অতিক্রম করে, ছাদে। হুইল চেয়ারের চাকা গড়িয়ে গেল ছাদের উত্তরদিকের কোণে। ছাদের দক্ষিণদিকের কোণে শহরের প্রাণকেন্দ্র। আলোকিত হাইরাইজ, দূরে কাছে পার্বত্য শহরের মতো। উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ি। বাতিস্তম্ভের আলোতে রাতের আকাশ আলো হয়রে আছে। কোথায় সেই নক্ষত্রখচিত আকাশ। আলো ঢেকে দিয়েছে অন্ধকার আকাশের সৌন্দর্য। 

রাতের আকাশের রহস্যময় অন্ধকারকে এঁটো করেছে শহরের আলো। এখন শহরের মানুষ আর ছায়াপথ, কালপুরুষ, শুকতারা, তারা পতনের দৃশ্য দেখতে পায় না। রাতের আকাশে বাদুড়, রাতজাগা পাখি, ঘন কালো আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকের দাগের ক্ষতের স্বাদ আর কোথায়? পূর্ণিমার চাঁদের ছনিও কেমন জানি বিস্বাদ। রাত্রি সাড়ে নটার ছাদ। গভীর কৃষ্ণপক্ষ। যদিও কৃষ্ণপক্ষ আর শুক্লপক্ষের ব্যবধান শহরের রাতের আকাশ মুছে দিয়েছে। 

মণিদীপা বলল, আমাকে ছাদের কোণের দিকে নিয়ে চল আর্জিনা। 

আর্জিনা বলল, ওই দেখ, একটা প্লে­ন রানওয়েতে নামছে। দূরে আরেকটা প্লে­নের আলোও টিপ টিপ করছে। 

তাহলে এক ঘণ্টায় কটা নামছে?  

আমি একদিন গুনেছিলাম, মোট বারোটা প্লে­ন একঘণ্টার মধ্যে ল্যান্ড করে। প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর। ভারতবর্ষের কত কত শহর থেকে আসছে। কত মানুষ নামছে। কত মানুষ আবার এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অনেকে ফিরে আসে, আবার অনেকেই আর আসে না। অনেকেই আবার এই শহরে প্রথম আসে। আবার অনেকেই বিবাহবিচ্ছেদের মামলার জন্য আদালতে হাজিরার জন্য আসে।

অনেকে আবার আব্বুজানের ইন্তেকালের খবর পেয়ে দুনিয়া জন্নতের প্রান্ত থেকে আসে। 

অনেকে আবার বিইয়ে করতে আসে। কোম্পানির কাজে আসে। আবার অনেকেই তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য আসে। যেমন আমার বর সৌরভ ইয়াসিন আসছে। 

আর্জিনা বলল, আমার মনে হচ্ছে দাদাবাবু প্লে­ন থেকে নেমে গেছে?

 না। ওই যে বহুদূরে টিপ টিপ করে আলো জ্বলছে, ওই আলোর পিছনে যে প্লে­ন আছে, তাতেই সৌরভ আসছে, ওই প্লে­নটিই সেই শহর থেকে ফিরছে। 

কোথা থেকে আসছে

তা কী করে বলব? ও তো আমাকে আর বলেনি কোথা থেকে আসছে? শুধু জানি আজকের তারিখে রাতে ও ফিরে আসছে। আর আমাকে নিয়ে ও মুম্বাইয়ের টাটা হাসপাতালে যাবে, হাঁটুর চিকিৎসার জন্য। এমনটাই স্থির হয়ে আছে। ওর কথামতোই আমি প্রস্তুত হয়ে আছি। একটু ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে দাও তো? মনে হচ্ছে, ওর আসতে আসতে রাত বারোটা হয়ে যেতে পারে। 

আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে, তুমি চিন্তা করো না। চা খাওয়া হলে, চল নেমে যাই। চল ঘরে যাই। এইভাবে আকাশের প্লে­ন দেখে কেউ অপেক্ষা করে, শুনিনি

যে প্লে­নটায় ও ফিরছে, সেই প্লে­নটাকে একবার নামতে দেখব না?

তুমি কী করে জানবে? কোন প্লে­নে দাদাবাবু আসছে? তুমি কি প্লে­নের ভিতরটা দেখতে পাচ্ছ নাকি? কোন প্লেনের কোথায় বসে আছে? সবকিছু? আর প্লে­নটাও অনেকদূরে না কতটা কাছে আছে জানলেই বা কী করে?  

হ্যাঁ। কল্পনায় দেখতে পারছি। এই দেখতে পারাটাই যদি না থাকত, তাহলে, হাঁটুভাঙা অবস্থায় এই হুইলচেয়ারে বসে বসে বেঁচে থাকার কোনও মানেই হত না। কল্পনা আর ভাবনাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।  তুমি কি কল্পনা কর?

আর্জিনা হাসল। বলল, আমার মতো আয়ার কাজ করা মহিলার আবার কল্পনা কীসের? শুধু ভাবি আমারও একদিন শাদি হবে। সেদিন বিছানায় অনেক ফুল ফুটে থাকবে। 

তবুও একটা ভাবনাকে আঁকড়ে ধরে তো বেঁচে আছো। আমরা আরও কিছুক্ষণ এখানে থাকি। আপনজনের ফিরে আসাও তো একটা উৎসবের মতোই। কোনো ছুতো ধরে তার প্রকাশ করতে হয়। এই আমি, আমরা যেমন করছি। প্লে­ন নামছে আলোর ছটা ছড়িয়ে…

 কিন্তু আমরা তো জানি না দাদাবাবু কোন প্লে­নে আসছে, এইভাবে বোকার মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। ওই দেখুন আরেকটা প্লে­ন নামছে, ওই প্লে­নেও তো দাদাবাবু থাকতে পারে?

না। পারে না। ওই প্লেনে সৌরভ আসছে না। 

 আমি বলছি আসছে। ওই প্লে­নেই দাদাবাবু আসছে। 

আসছে না। আসছেই না।

কেন আসছে না

কারণ ওই প্লে­নেই সৌরভ আসছে, তা এখনও পর্যন্ত আমি কল্পনা করিনি। এই জন্যই আসছে না। 

তুমি কল্পনা করছ না বলেই আসছে না? এ তোমার কেমন যুক্তি? আসছেই, চলে আসবে এমন কেন ভাবছ না? দাদাবাবু এই প্লেনেই আসছে। এই ভাবনাটা কত আনন্দের বলো তো? এমন কল্পনা কেন করছ না? এ ভারী অদ্ভুত তোমার কল্পনা। 

ভাবছি। যে প্লে­নে সৌরভ আসবে সেই প্লেনের উড়ান এখনও দেখিনি। 

কেন এমন ভাবছ?

কারণ, আমাদের ফ্ল্যাট এয়ারপোর্টের খুব কাছে। আমি জানি সৌরভ কোন ফ্লাইটে ফিরছে। 

night-flight-plane-airport

রাত গড়িয়ে যাচ্ছিল। রাত গভীর হলে সামান্য শব্দগুলিকে কাচ ভেঙে যাওয়ার মতো মনে হয়।  পাইপ বেয়ে উঁচুতলা থেকে যে জল নামে, তার মধ্যেও ঘুম জড়িয়ে থাকে। মধ্যরাত্রির সঙ্গে ঘড়ির কাঁটাও ছুটে যাচ্ছে। শহরতলির আকাশ থেকে ভেসে আসছে রাতজাগা পাখির হৈ টি টৈটি। মণিদীপা নিজের ফ্ল্যাটে সব আলো জ্বালিয়ে রেখেছে। চ্যাটচ্যাটে গরম। ঘামের সঙ্গে পাকা আমের গন্ধ আসছে। মণিদীপার এখন মনে হচ্ছে, আজকের তারিখ ক্যালেন্ডারের জুন মাসটাকে সাদা পাতা করে দিল। সাদা পাতার মধ্যে যতই দুঃখ থাক না কেন, একটি সম্ভাবনা সব সময়ই জেগে থাকে। 

আর্জিনা ঘরের মসৃণ সাদা পাথরের ওপরে গড়িয়ে ঘাম ও হাঁসফাঁস কমানোর চেষ্টা করছিল। ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা অতিক্রম করল, আজকের তারিখটাকে বদলে দিয়ে আরও একটা নতুন দিনের সূচনা করল। 

যখন তখন সৌরভ চলে আসতে পারে, তাই দরজা ভেজিয়ে রেখেছে মণিদীপা।   

ঘরের ভিতরে একটা শব্দ হচ্ছিল। তারিখ বদলে যাওয়া সময়টার দিকে তাকিয়ে মণিদীপা ভাবছিল, সত্যিই কি সৌরভ আসবে? হয়তো সে ভুল জানত, অন্য কোনো তারিখ বলেছিল না কি!  অন্য কোনো একদিন? মণিদীপার মনে পড়ে গেল, সেই মাসাইমারার জঙ্গলের বুনোঘাসের ওপরে বাতাস বয়ে যাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ। দলে দলে ছুটে চলেছে হরিণ, অ্যান্টিলোপ, জেব্রা। 

ঘরের দরজা বাতাসের ধাক্কায় সামান্য খুলে গেল। ঘরের চৌকাঠের ওপাশে একজোড়া বুনো মোষ তার দিকে স্থির তাকিয়ে আছে, এখনও।  

এই শেষরাতেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহর থেকে ফ্লাইট এসে নামছে এয়ারপোর্টে। 

 

 

ছবি সৌজন্য: Flickr, Alamy, Freepic , Pixabay,

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com