১
স্বাতীকে দেখলাম কাদাজমিটা পেরিয়ে তিরতির করে বয়ে যাওয়া নদীটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর ওপারে আবার কিছুটা ঘাসে ঢাকা জমি। তারপর জংগলের সীমানা। কোনও কোনও বাঁকে পানা, শ্যাওলায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে নদীটা। জলের শব্দ খুব মন্থর। খুব কাছে গিয়ে কান পাতলে হয়তো-বা শোনা যায়।
রিসর্টের গেস্টরুমগুলো দূরে দূরে। অতিথিদের বসার জন্য টিনের ছাউনি বা পলতা বাঁশের ছাউনি দেওয়া জায়গা আছে। তারই একটায় বসে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম আমি। নিছক সময় কাটানো। আমার কাগজ পড়ার নেশা নেই। খুন-রেপ-রাজনীতিতে আমার একেবারেই আগ্রহ নেই। বাড়িতে টিভি দেখলে আমি সায়েন্স চ্যানেল বা স্পোর্টস চ্যানেল দেখি বা ল্যাপটপে সিনেমা।
রিসর্টের পেছন দিকটায়, যেখানে মাটি অনেকটা উঁচু পাড়ের মতো, সেখানে সার সার কতকগুলো গাছ। এদের মধ্যে অনেকগুলো ছাতিম গাছ। একটা ছাতিম গাছ চেহারায় বেশ পুরনো। ওই গাছগুলোর মধ্যে এই গাছটাই বোধহয় অবিভাবক। শুভ্রাংশু ওই মাটির পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় নদী, জংগলের ছবি তুলছে। রতন, মানে এই রিসর্টের কেয়ারটেকার কাম ম্যানেজার আমাদের জানিয়েছে, জংগল থেকে মাঝে মাঝে হরিণ বেরিয়ে জল খেতে আসে। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। এটা শোনার পর শুভ্রাংশুর বউ তিথি ভীষণ উত্তেজিত। আমি যেখানে বসে আছি, তারই কাছাকাছি আরেকটি ছাউনিতে বসে আছে ও। মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে শুভ্রাংশুকে বলছে ‘দেখতে পেলেই কিন্তু আমাকে ডাকবে। ভুলে যেও না।’
তিথির মোটা বেপথু চেহারা। থাইরয়েডের সমস্যায় পড়ে খুব মুটিয়ে গেছে। মুখশ্রী অবশ্য বেশ সুন্দর। কিন্তু অস্বাভাবিকরকম স্থূলতার কারণে ওর মুখটাকে একটা আঁচিলের মতো লাগে। সাদা ঘেরের একটা পোশাক পরেছে ও। অনেকটা ফ্রিল দেওয়া লম্বা স্কার্টের মতো। ওর চওড়া বাহুমূলে বিকেলের নিস্তেজ রোদ কোথা থেকে যেন এসে পড়েছে। তাতে বাহুতে মাংসের আধিক্য বোঝা যাচ্ছে। ওর সামনে যে টেবিল, তাতে পকোড়াগোছের কিছু। কী কারণে এদিকে তাকাতেই আমার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হল। ও হাসল। বলল ‘এই জয়ন্তদা, দূরে একা একা বসে আছেন কেন? এখানে আসুন না।’
আমি সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার দেখালাম। ও বলল ‘ও আচ্ছা। শুনেছেন তো, ওই জংগল থেকে নাকি হরিণ বেরিয়ে জল খেতে আসে। কী থ্রিলিং না? ইস, আজ যদি দেখতে পারি।’
‘তোমার স্বামী তো কড়া নজর রেখেছে। বেরোলে নিশ্চয়ই দেখতে পাবে।’ আমি বললাম।
‘আপনি জানেন না জয়ন্তদা, আমার লাক খুব খারাপ। সবাই দেখতে পায়, আমি পাই না। একবার লাটাগুড়িতে গেছি। সবাই ঘুরতে গিয়ে নদীর ধারে হাতি দেখতে পেল। পায়ে ব্যথা হওয়ায় আমি সেদিন ঘরেই থেকে গিয়েছিলাম।’
‘কোনো জ্যোতিষীর পরামর্শ নাও। হাতে পাথরটাথর পরো।’
বাচ্চা মেয়ের মতো খিলখিলিয়ে হেসে উঠল তিথি।
‘যা বলেছেন, এবার আপনার বন্ধুকে বলব কোনো ভাল জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে যেতে। স্বাতীদি ওখানে কী করছে?’
‘নেচারের সঙ্গে কথা বলছে।’
‘আপনার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পায় না বুঝি?’
‘বিয়ের তেইশ বছর পরে মানুষের টেস্ট বদলে যায় তো।’
‘সাঙ্ঘাতিক কথা। আপনার যায়নি তো?’
‘ভেবে দেখিনি। গেলে তো যেতেই পারে।’
‘না না, ওরকম বলবেন না। আমার দিদিবন্ধুটি কষ্ট পাবে।’
‘আমি কষ্ট পেলে সেটা কী বিচার্য নয়?’
‘আপনারা পুরুষমানুষ। আপনাদের কথা আলাদা।’
আরও পড়ুন: নন্দিনী সেনগুপ্তের গল্প: সোনাতরঙ্গ নদীর ধারে
কথার ফাঁকে স্বাতীকে লক্ষ্য করলাম। ও নদীর কাছাকাছি গিয়ে জংগলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। জংগলের রং এখন ধোঁয়া ধোঁয়া। আর একটু পরেই অন্ধকার ঘনাতে থাকবে। সবচেয়ে বয়স্ক ছাতিম গাছটা থেকে কী একটা পাখি ডাকছিল বুক বুক করে। ম্যানেজার রতন এসে বলল ‘রাতের খাবারের জন্য সব বাজার হয়ে গেছে স্যার। ছ’টার দিকে আপনাদের চিকেন পকোড়া আর কফি দেব। এখন একটু চা খাবেন স্যার?’
‘হ্যাঁ, দিতে পার।’
রতন তিথিকে দেখে নিয়ে গলা নিচু করে বলল ‘রাতে কি একটু ড্রিঙ্কস নেবেন স্যার?’
‘ব্যবস্থা করা যাবে?’
‘হয়ে যাবে। আপনারা ক’জন স্যার?’
‘শুভ্রাংশু খায় না। আমি আর…’- কথাটা শেষ না করেই বললাম ‘দু’জন। দু’জনের মতো ব্যবস্থা করলেই হবে। সস্তা জিনিস এনো না।’
‘না না, ভাল জিনিসই আসবে স্যার।’
রতনকে দু’জন বললাম এই কারণেই যে, শুভ্রাংশু না খেলেও তিথি ড্রিঙ্কস নেয়। এখানে আসার যখন পরিকল্পনা চলছে, তখন ও-ই ফোনে আমাকে জানিয়েছিল ওর ইচ্ছেটা। শুভ্রাংশুর এ ব্যাপারে কোনো অবজেকশন নেই। তিথি কখনো বেসামাল হয়ে পড়লে শুভ্রাংশুই সেটা হ্যান্ডেল করে।
রতন, মানে এই রিসর্টের কেয়ারটেকার কাম ম্যানেজার আমাদের জানিয়েছে, জংগল থেকে মাঝে মাঝে হরিণ বেরিয়ে জল খেতে আসে। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। এটা শোনার পর শুভ্রাংশুর বউ তিথি ভীষণ উত্তেজিত। আমি যেখানে বসে আছি, তারই কাছাকাছি আরেকটি ছাউনিতে বসে আছে ও। মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে শুভ্রাংশুকে বলছে ‘দেখতে পেলেই কিন্তু আমাকে ডাকবে। ভুলে যেও না।’
আমি ও আমার অন্য দু’জন বন্ধু মিলে তিন বছর আগে এই রিসর্টটা কিনেছি। যখন কিনেছি, তখন এসব কিছুই ছিল না। তারপর পয়সা লাগিয়ে এইসব গেস্টরুম, লাঞ্চ স্পেস, সীমানার বাউন্ডারি, লন, গোটা জায়গা জুড়ে বাতির ব্যবস্থা- সবই করা হয়েছে ধীরে ধীরে। রান্নাঘর, আধুনিক কিচেন রেঞ্জ- এসবও। ব্যবসা করার জন্য এখন রিসর্ট প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। গতবছর থেকে কয়েকটা পার্টিও এসে গিয়েছে। সমস্তটাই রতন খুব ভালোভাবে সামলে নিয়েছে। আমি এর আগে এখানে এসেছি কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য। এভাবে এসে থাকিনি। আমার অন্য দুই বন্ধু অবশ্য এসে থেকে গিয়েছে পরিবার, আত্মীয়স্বজন নিয়ে। আমার হয়নি। কারণ তখন স্বাতী এখানে নেই। মেয়ের সঙ্গে কলকাতায়। মেয়ে সবে হোটেল ম্যানেজমেন্টে জয়েন করেছে। কলকাতায় নতুন। স্বাতী তখন মাঝে মাঝেই মেয়ের সঙ্গে গিয়ে থাকত।
এই প্রথম আমার এখানে এসে রাত্রিযাপন। শুভ্রাংশু আর তিথিরও প্রথম।
এখানে যখন গেস্ট আসে, রতন তখন কয়েকটি অল্পবয়েসি ছেলে আর মহিলাকে যোগাড় করে আনে রান্নাবান্না, ফাইফরমায়েশি সামাল দেবার জন্য। ওদেরই কেউ, রোগা পাতলা চেহারার একটি ছেলে এসে আমাকে চা দিয়ে গেল। সুন্দর পোর্সিলিনের কাপ-প্লেট। রতনই বোধহয় কিনেছে। একটু দামি গেস্টদের খুশি করতে। রতন নিজে বুদ্ধি করেই এইসব করে। চা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। তাতে ভাল একটা চা পাতার ফ্লেভার। এখানে কাছাকছি অনেক চা বাগান আছে। মনে হয় সেখান থেকেই রতন যোগাড় করেছে।
সন্ধে নামছে। জংগলটা এখন আবছা। নভেম্বরের শুরুতে হাওয়ায় খানিকটা শীত। দেখলাম শুভ্রাংশু চেঁচিয়ে বলছে ‘স্বাতী বউদি, আর না। এবার চলে এস।’ আমার সঙ্গে স্বাতীর কথাবার্তা খুব কম। এভাবেই আমরা আছি। যখন যা করার, সেটা আমরা কথা বিনিময় ছাড়াই দিব্যি বুঝে যাই। দীর্ঘদিনের অনুশীলনে সেটা আরও নিখুঁত হয়েছে। দেখলাম স্বাতী ফিরে আসছে। অন্ধকার ঘনিয়েছে বলে ওর ফিকে রঙের পোশাক পরা আদলটাই দেখা যাচ্ছে শুধু। আমি রতনের ছেলেগুলোকে ডেকে তিথি যে টেবিলে বসে আছে, সেখানে দু’কাপ চা দিতে বললাম। আমি জানি স্বাতী এসে ওখানেই বসবে এবং চায়ের খোঁজ করবে। তিথিকে একটু আগে দেখেছিলাম চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথার চুলে আঙুল চালাচ্ছে। এখন দেখলাম ওই অবস্থাতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। চেয়ারের ব্যাকরেস্টে উল্টে আছে ওর মাথা। বুকের ওড়না খসে পড়েছে। মুখ অল্প হাঁ করে ও ঘুমোচ্ছে।
কথার ফাঁকে স্বাতীকে লক্ষ্য করলাম। ও নদীর কাছাকাছি গিয়ে জংগলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। জংগলের রং এখন ধোঁয়া ধোঁয়া। আর একটু পরেই অন্ধকার ঘনাতে থাকবে। সবচেয়ে বয়স্ক ছাতিম গাছটা থেকে কী একটা পাখি ডাকছিল বুক বুক করে। ম্যানেজার রতন এসে বলল ‘রাতের খাবারের জন্য সব বাজার হয়ে গেছে স্যার। ছ’টার দিকে আপনাদের চিকেন পকোড়া আর কফি দেব। এখন একটু চা খাবেন স্যার?’
আমার এভাবে বসে না থেকে আশেপাশেই কোথাও একটু ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছিল। কাছাকাছি কয়েকটি লোকবসত আছে। হাইওয়ে আছে। আমার গাড়িতেই সবাই এসেছি। গাড়িটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়াই যায়। শুকনো ঘাসপাতার ওপরে জুতোর শব্দ তুলে মাটির পাড়টা থেকে শুভ্রাংশু নেমে এল। আমার টেবিলে এসে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বলল ‘হরিণ দেখতে না পেলেও দুর্দান্ত কয়েকটি স্ন্যাপ নিলাম জানেন তো?’
‘ওই নদী আর জংগলের?’
‘জয়ন্তদা, ক্যামেরার লেন্স এমন একটি জিনিস, যেখানে চেনা দৃশ্যকেও অচেনা আর ভীষণ সুন্দর লাগে। ভাবছি কাল দিনে জংগলের কাছাকাছি যাব।’
‘আপাতত চোখে ক্যামেরার লেন্স ফিট করে দ্যাখো নিজের বউকে চিনতে পার কিনা।’
‘কেন? কী হয়েছে’ বলতে বলতে মুখ ঘুরিয়ে দেখেই শুভ্রাংশু চিৎকার করে উঠল ‘অ্যাই তিথি, অ্যাই! আরে পড়ে যাবে তো! এভাবে কেউ ঘুমোয় নাকি?’
শুভ্রাংশুর চিৎকারে রান্নাঘর থেকেও ছেলেগুলো বেরিয়ে এসেছিল। তিথি চট করে জীবনে ফিরল। তড়িৎগতিতে চেয়ার টেনে গুছিয়ে বসে নিয়ে বলল ‘দেখেছ, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
স্বাতী ততক্ষণে ওর টেবিলে এসে বসেছে। ও একটু হেসে বলল ‘এমন শান্ত, নিরিবিলি জায়গায় ঘুম পাবেই। চোখেমুখে একটু জল দাও।’ স্বাতী এসে বসতেই ছেলেগুলো চা দিয়ে গেল। তখন স্বাতী একপলক দেখল আমাকে। আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে খবরের কাগজে রাখলাম। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ছাপা হয়েছে একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্টে দুই ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা। আমি চাই না স্বাতী ওভাবে আমার দিকে তাকাক। ওই চাউনির, ওই দৃষ্টির এখন আর কোনও অর্থই হয় না। ছেলেগুলোকে আমি বলে দিয়েছিলাম দেখে ওরা চা দিয়ে গেছে। বলেছি যে, এতেও আমার কোনো চমৎকারিত্ব নেই। দীর্ঘদিনের সহাবস্থানে বুঝি, এই সময়টা স্বাতী চা চাইবে।

তিথি বলল ‘জয়ন্তদা, চায়ের ফ্লেভারটা কিন্তু দারুণ। আমার এক মামা ডামডিম চা বাগানে চাকরি করে। ওর ওখানে গিয়ে এমন চা খেয়েছিলাম। শুভও গিয়েছিল। সেবার শুভ চা বাগানে ইয়াব্বড় একটা প্যাঁচার ছবি তুলেছিল। তাই না শুভ?’
‘হুঁ। প্যাঁচাটার ডানায় বোধহয় চোট ছিল, উড়তে পারছিল না। চা গাছের ওপরেই বসেছিল। আমি ক্যামেরা নিয়ে যতই এগিয়ে যাচ্ছি, আর ও ঘষটে ঘষটে পিছিয়ে যাচ্ছে। উড়ে যায়নি।’
দেখলাম স্বাতী মুখ নামিয়ে চা খাচ্ছে। শুভ্রাংশু ক্যামেরা গুটিয়ে ব্যাগে পুরছে। রান্নাঘরে যে ছেলেগুলো কাজ করছে, ওদেরই কারও মোবাইলে গান বাজছে। পুরনো একটা হিন্দি গান। এই গানটা আমি বহু জায়গায়, বহুবার শুনেছি। গেস্টরুম, লন, গেটের কাছে সাদা বাতিগুলো তখন জ্বলে উঠেছে।
স্বাতী কী করবে জানি না, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি গাড়িটা নিয়ে কোথাও একটু ঘুরে আসব। রতনকে ফোন করে দেখব, ও যদি জিনিসটা যোগাড় করতে না পারে, আমিই নিউ হাসিমারা থেকে নিয়ে আসব। ওখানে একটা লিকার শপ আছে। গাড়ি নিয়ে গেলে বেশি দূর হবে না। এখানে আসার সময় স্বাতী যখন প্যাকিং করছিল, আমি ওকে কয়েকটা বই ঢোকাতে দেখেছি। হয়তো খানিকটা গল্পগুজব করে ঘরে গিয়ে বইয়ে ডুবে থাকবে। বাড়িতেও ও ওর ঘরে ডিনারের আগে সময় পেলে বইয়ে ডুবে থাকে। আমি আমার ঘরে হয় পেন্ডিং কোনও কাজকর্ম করি বা সিনেমা-টিনেমা দেখি। চা খাবার ইচ্ছে হলে নিজেই করে আনি, কখনো নিঃশব্দে এসে স্বাতী টেবিলে রেখে যায়। এমনই নিঃশব্দ, বরফে ঢাকা কোনো পার্বত্য প্রদেশের মতো আমাদের সংসার। রোদ-জ্যোৎস্না সবই পড়ে কিন্তু প্রাণের আধিক্য কম।
আমার সঙ্গে স্বাতীর কথাবার্তা খুব কম। এভাবেই আমরা আছি। যখন যা করার, সেটা আমরা কথা বিনিময় ছাড়াই দিব্যি বুঝে যাই। দীর্ঘদিনের অনুশীলনে সেটা আরও নিখুঁত হয়েছে। দেখলাম স্বাতী ফিরে আসছে। অন্ধকার ঘনিয়েছে বলে ওর ফিকে রঙের পোশাক পরা আদলটাই দেখা যাচ্ছে শুধু। আমি রতনের ছেলেগুলোকে ডেকে তিথি যে টেবিলে বসে আছে, সেখানে দু’কাপ চা দিতে বললাম। আমি জানি স্বাতী এসে ওখানেই বসবে এবং চায়ের খোঁজ করবে।
শুভ্রাংশুকে বললাম ‘এখুনি তোমাদের কফি দেওয়া হবে। তোমরা কফি খাও, আমি একটু ঘুরে আসি।’
‘সে কী, আপনি কফি খাবেন না?’
‘এসে খাব। তোমরা খাও না।’
দেখলাম তিথি আমার দিকে চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে ঘুরে তাকিয়েছে। আমি জানি কেন। চোখের পলক ফেলে ওকে আশ্বস্ত করলাম। দেখলাম স্বাতী পায়ে পায়ে রান্নাঘরে ঢুকে ছেলেগুলোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কী যেন দেখছে। গাড়িটা ব্যাকে এনে গেটের সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম লোহার গেটটার একধারে কী একটা লতায় ফিকে লাল ধরনের ফুল এসেছে। একটা বাতি জ্বলে আছে ওদের ওপরে। ফুলের ভারে নুইয়ে পড়েছে লতার ঝাড়টা। অতিথিরা দেখলে নিশ্চয়ই আনন্দ পাবেন। গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে উঠলাম। দু’দিক থেকেই বড় বড় লরি, প্রাইভেট কার যাওয়া-আসা করছে। আমি ফোন বের করে রতনকে ধরলাম।
‘স্যার?’
‘জিনিসটা কি যোগাড় করতে পেরেছ?’
‘দোমহনির দিকে দেখলাম স্যার। তেমন ভাল কিছু নেই।’
‘ছেড়ে দাও। আমি নিউ হাসিমারার দিকে যাচ্ছি। আমিই নিয়ে আসব।’
‘না, মানে স্যার’ আমতা আমতা করল রতন। আমি বললাম ‘তুমি রিসর্টে গিয়ে দ্যাখো ওদের কিছু দরকার কিনা।’
‘ঠিক আছে স্যার।’
২
স্বাতীর সঙ্গে ডিভোর্সটা কেন যে হয়নি, সেটা ভাবলে আমার বিস্ময় হয়। কীভাবে দুটো একেবারে বিপরীত ধারার মানুষ এখনও একইসঙ্গে পাশাপাশি রয়ে গেলাম- সেও আশ্চর্যের। আমার আর স্বাতীর ডিভোর্সের সব কাগজপত্র তৈরি, কোর্টে ডেটও পাওয়া গেছে, তারপরেও যে কেন হল না! স্বাতীর বাড়ির লোক স্বাতীকে নিয়ে কোর্টে উপস্থিত, আমার সঙ্গে গেছে সেজবউদি আর অরুণ। সেটাও এমন নভেম্বরেরই কোনও একটা দিন ছিল। তার মাসখানেক আগে থেকেই স্বাতী বাপের বাড়ি। আমরা এখন যে বাড়িটায় থাকি, সেটা তখনও হয়নি। আমি থাকি আমাদের পুরনো বাড়িতে। দাদা-বউদিদের সঙ্গে। পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। একতলায় আমাদের ঘর। সেসময় গার্গী প্রায়ই আসত আমাদের বাড়ি। একদিন ও চলে যাবার পরেই স্বাতী উঠে গেল দোতলায় সেজবউদিদের ঘরে। সারা রাত নামলই না। পরদিন সকালে সেজবউদি চা নিয়ে এসে বলল ‘ছিঃ ভাই, মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছ!’
‘কী কষ্ট দিলাম?’
‘তোমার স্বাতীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে ভাই। ও এখন তোমার বউ। গার্গীর সঙ্গে তোমার কিন্তু সত্যিই বিয়ে হয়নি। এখন তুমি ওকে বাড়িতে আসতে দিচ্ছ কী করে?’
‘কী আশ্চর্য, ও তো আমার বন্ধুও!’
‘বিয়ের আগে জীবনটা একরকম থাকে ভাই, বিয়ের পর আর একরকম। গার্গীর সঙ্গে তোমার বিয়ে হবার কথা ছিল। সেজন্য ও আর যাই হোক, আর পাঁচটা বন্ধুর মতো হতে পারে না। ও দিনের পর দিন আসছে, তোমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে রাত করে ফিরছে- এটা কি কোনো স্ত্রীই মেনে নেবে?’
‘এতে এত আপত্তিরই বা কী আছে?’
‘অবশ্যই আপত্তির কারণ আছে। তাছাড়া গার্গী স্বাতীকে কী বলেছে জানো? বলেছে, স্বাতীর জন্যেই নাকি তোমার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়নি। যে বন্ধু বিবাহিত, তার বউকে এসব বলা কি বন্ধুর কাজ? তোমার বিয়ে হয়েছে। তুমি তো সেই অফিস আর বন্ধুবান্ধব নিয়েই আছ। কতটুকু সময় দাও নিজের বউকে?’
এরকম আরো, আরো অজস্র সব ঘটনা। এর মধ্যে আমরা কে সত্যি ছিলাম, কেই-বা মিথ্যে ছিলাম- তা অমীমাংসিতই থেকে গেছে। হয়তো এর মীমাংসা হয়-ও না। হয়তো দু’জনেই সত্যি ছিলাম বা দু’জনেই মিথ্যা ছিলাম। তখনও টুকাই আসেনি। ভেতরে ভেতরে এতটাই বিষিয়ে গিয়েছিলাম যে, ভেবেছিলাম আমাদের মধ্যে কোনওদিন সন্তান আসবে না। এমন বৈপরীত্য আর কাটাকুটিতে ভরা একটি সম্পর্কের মধ্যে একটি নিষ্পাপ প্রাণকে এনে যন্ত্রণা দেবার কোনও অর্থই হয় না। তথাপি টুকাই এল। এরপরেও টুকাই এল। এও কী আশ্চর্য নয়?
অফিস থেকে একবার ট্যুর প্রোগ্রাম হল। আমরা চারজন কলিগ আর আমাদের ফ্যামিলি। সিমলাতে হোটেলও বুক করা হল। ট্রেনের রিজার্ভেশানও পাওয়া গেল। একদিন অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় খুলতে খুলতে সে-কথা স্বাতীকে বললাম। ও তখন বিছানায় বসে কিছু একটা সেলাই করছে। আমার কথা শুনে ও বলল ‘আমি যাব না। তুমি যাও। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘুরে এস।’ কথাটার যে তীর্যক শ্লেষ, তা আমাকে ফুঁড়ে না দিয়ে ছাড়ল না। আমি বলেছিলাম ‘কেন? কেন যাবে না? তোমার অসুবিধেটা কোথায়?’ ও কোনও উত্তর না দিয়ে সোজা কিচেনে ঢুকে গেল।
আমার ভেতরে কোথাও দপ করে আগুন জ্বলে উঠল যেন। আমি কোমরের বেল্টটাকে মরা সাপের মতো একটা কৌচে ছুড়ে দিয়ে চিৎকার করে বললাম ‘যাবে না এই কারণেই তো যে, তোমাকে আমি ঘটনাচক্রে বিয়ে করে ফেলেছি। তোমার কেরিয়ার নষ্ট করে দিয়েছি। আমি বিয়ে না করলে বড় চাকরি করতে। আরো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারতে। তাই তো? কেন, আমি কি তোমার বাড়ির লোকের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়েছিলাম? কেন ওরা বিয়ে দিলেন তোমার? কেন?’ আমার চিৎকারে বউদিরা ছুটে এসেছিল। স্বাতী তখন কিচেনে হাউহাউ করে কাঁদছে। ওভেনে চায়ের জল শুকিয়ে বাসন থেকে পোড়া ধোঁয়া উঠছে। আমি না যাওয়ায় সেবার পুরো ট্যুরটাই ক্যানসেল হয়েছিল।
আরও পড়ুন: অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে: একটা ল্যান্ডস্কেপের অক্ষরমালা
হাইওয়ের দু’পাশে হালকা গাছপালা। আমার গাড়ির হেডলাইটে ওদের শুকনো, রুক্ষ বাকল আলোকিত হয়ে উঠছে। পাশ দিয়ে হুসহাস বেরিয়ে যাচ্ছে অন্য সব যানবাহন। ওদের নিশ্চয়ই কফি, পকোড়া খাওয়া এতক্ষণে শেষ হয়েছে।
কোর্টে স্বাতী খুব সুন্দর একটা সুতোর কাজ করা চুড়িদার পরে এসেছিল। চারপাশে তখন দিনের আনন্দিত রোদ। রাস্তায় নানা উদ্দেশ্যে আসা বহু মানুজন। রাস্তার দু’পাশে মাদুরে সাজিয়ে প্লাস্টিকের ঘটিবাটি, চাইনিজ জিনিসপাতি, জামাকাপড় বিক্রি নিয়ে অনেকে বসেছে। কাঠের শোকেসে আংটি নিয়ে জ্যোতিষীও আছে। স্বাতীকে দেখে আমার ভেতরটা কেমন যেন হূ হূ করে উঠল। মনে হল যেন ও আর আমি মহাকাশের মতো একটা কালো শূন্যতার এপারে ওপারে দাঁড়িয়ে আছি। সেজবউদি দেখলাম স্বাতীর দিকে ছুটে গেল।
দিনের শেষে ডিভোর্সটা হল না। আমাদের সঙ্গে স্বাতী ফিরে এল। রাতে যখন আলো নিভিয়ে গায়ে চাদর টেনে বিছানার একপ্রান্তে কাৎ হয়ে শুয়ে আছি, বুঝলাম আরেকটি মানুষও আমারই মতন বিছানার অন্য প্রান্তে গায়ে চাদর টেনে চুপ করে শুয়ে আছে। দুটি মানুষের দু’জোড়া অপলক চোখ-ই জ্বলছে। ঘটনাটা আজও আমার কাছে রহস্যময়। কেন ফিরে এল স্বাতী? লোকলজ্জার ভয়ে? নাকি অন্য কোনো অবিনাশী টানে? ফিল্মে অনেকসময় দেখা যায়, কেউ গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে ঢুকে গেল- সেইরকম? কর্তৃত্বের কোনও ইশারা আসলে ও কি সেদিন রেখে গিয়েছিল আমার জন্য? উত্তর নেই আমার কাছে। এ সবই হয়তো সম্ভব। পরোক্ষে গার্গীও হয়তো সম্ভব।
৩
লিকার শপে গিয়ে দেখেশুনে ভাল হুইস্কি নিলাম একটা। তিথি হুইস্কি-টুইস্কি সবই খায়। এতটা হয়তো দু’জনে খেতেও পারব না। থাক, বাকিটা রতনকে দিয়ে দেব। ভাল মদ ও নিশ্চয়ই সবসময় খেতে পায় না। অবশ্য ও মদ খায় কিনা, তাও আমি জানি না। ওর গলায় আমি কণ্ঠী দেখেছি। সে না খেলে অন্য কাউকে দিয়ে দেবে। ওর ছেলেছোকরাগুলো নিশ্চয়ই খায়।
বিয়ের আগে আগে একবার শালবনে পিকনিক করতে গিয়েছি। আমার ব্যাচেলর জীবনের শেষ পিকনিক। সবাই মিলে এইসব নিয়ে আমাকে খোঁচা দিচ্ছিল। বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যা হয়। শালবনে নদীর ধারে বসে আমরা ড্রিঙ্ক করছিলাম। চতুর্দিকে শুকনো শণের ভুসভুসে জংগল। সুচরিতা, গার্গী ওরা বিয়ার না খেয়ে হুইস্কিই খাচ্ছিল। জংগল থেকে কুড়োনো কাঠ মাথায় নিয়ে আদিবাসী মেয়েরা আমাদের দলটাকে দেখতে দেখতে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ গার্গী প্রায় আমার গায়ে ঢলে পড়ে বলল ‘বাথরুমে যাব। নিয়ে যাবি?’
বেলা তিনটের সূর্য দিগন্তের দিকে এগিয়ে বড় হয়ে উঠেছে তখন। শালবনের মাটি শুকনো, ওল্টানো পাতায় ঢাকা। কোথাও কোথাও কাশের ঘন জংগল আছে। কাঁটাগাছের জংগল আছে। আর আছে ঝিঁঝিঁর ডাকে সাজানো তীব্র নির্জনতা। আমি আর গার্গী স্থলিত পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। গার্গী হঠাৎ আবিল গলায় বাকি বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল ‘অ্যাই, তোরা কিছু মনে করবি না। আমি আমার মিস-হয়ে-যাওয়া বরকে নিয়ে বাথরুম করতে যাচ্ছি। বর হলে তো ও তাই-ই করত। আমাকে বাথরুমে নিয়ে যেত। কী রে যেতিস না?’ বন্ধুরা সবাই হেসে উঠেছিল। সুচরিতা বলেছিল ‘মিস-হয়ে-যাওয়া বরকে আবার ফাঁদে ফেলে দিস না। অন্য একটি টুকটুকে বউ কিন্তু ওর পথ চেয়ে বসে আছে।’
ঘটনাটা আজও আমার কাছে রহস্যময়। কেন ফিরে এল স্বাতী? লোকলজ্জার ভয়ে? নাকি অন্য কোনো অবিনাশী টানে? ফিল্মে অনেকসময় দেখা যায়, কেউ গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে ঢুকে গেল- সেইরকম? কর্তৃত্বের কোনও ইশারা আসলে ও কি সেদিন রেখে গিয়েছিল আমার জন্য? উত্তর নেই আমার কাছে। এ সবই হয়তো সম্ভব। পরোক্ষে গার্গীও হয়তো সম্ভব।
‘শাট আপ! আমি কি তেমন নাকি? আমি কি জানি না ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে? স্কাউন্ড্রেল!’ বলে গার্গী আমার হাত আঁকড়ে ধরে ধস নামা পা ফেলে ফেলে শালবনের মাটি দিয়ে হেঁটে আসছিল। ওর চুল ভেঙে গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল পিঠে। তাতে শ্যাম্পুর গন্ধ ছিল। আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে একটা কাশের জংগলে ঢুকে বাথরুম করল গার্গী। ফিরে এসে গার্গী একটা ঢেউ তুলে মাটিতে উল্টে থাকা পাতার বিছানার ওপরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল ‘তুই একটা স্কাউন্ড্রেল জয়ন্ত। বিশ্বাসঘাতক।’ বলেই আমার হাতে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে আমাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল ‘বিয়ে যখন আমাকে করবিই না, তখন আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করছিস কেন? বাচ্ছাগুলোর সঙ্গে শাটল খেলছিস। একদিন দেখলাম মায়ের হাত থেকে জলের ঝাড়ি নিয়ে ফুলগাছে জল দিচ্ছিস! হোয়াই জয়ন্ত? তুই কী বুঝিস না এতে করে মানুষের মনে প্রত্যাশা বেড়ে ওঠে? তুই জানিস, তোর বিয়ে ঠিক হবার কথা শুনে মা কীরকমভাবে কেঁদেছিল? বাচ্ছাগুলোও সারাদিন শব্দ করেনি। শ্মশানের মতো হয়েছিল সারাদিন বাড়িটা। তুই জানিস, বল তুই জানিস?’
হিংস্র জন্তুর মতো ফ্যাস-ফ্যাস করে কথাগুলো বলছিল গার্গী। ওর পা থেকে স্যান্ডেল খুলে গেছে। সারা চুলে, গায়ে কী গাছের যেন ছোট ছোট মরা পাতা আটকে আছে। অনেকটা তেঁতুলপাতার মতো। আমারও মাথায় গায়ে তেমনই ছোট ছোট সব মরে যাওয়া পাতা লেগে আছে। মস্তিষ্ক আলগা হয়ে ভাসছে কোথাও। চশমার কাচের ওপরে কী বিমুক্ত নীল আকাশ! ‘আসলে আমাকে তুই ভালো বা ওইধরনের কিছু একটা বাসতিস। কিন্তু ওভাবে হয় না রে। একজনকে বিয়ে করবি, আর একজনকে ভালোবাসবি- তা হয় না। সমস্ত কিছুরই একটা জবাব লাগে। আমাকে ভালোবাসতে গেলে আমাকেই বিয়ে করতে হত। আমি কেন আনঅ্যানসার্ড একটা রিলেশন মিছিমিছি বয়ে বেড়াব? বাড়ির মতের বিরুদ্ধে যখন যেতে পারবি না, আমার সঙ্গে প্যারালালি সম্পর্ক রেখে যাচ্ছিলি কেন? বাড়ির মতের বিরুদ্ধে কেন আমার হয়ে সওয়াল করলি না? কী চাইতিস আমার কাছে? বোনাস সুখ? ইউ ব্রুট! ইউ ডিড অল দিজ থিংগস টু পুট মি ইন হেল। আর আমি সেটা হতে দেব না।’
বলতে বলতে সেই অজস্র মরা পাতাসুদ্ধ আমার ওপরে কালো মেঘের মতো ঘনিয়ে এসেছিল গার্গী। ওর চুল থেকে, মাথা থেকে অজস্র মরা পাতা ঝরে ঝরে পড়ছিল আমার গায়ে, মুখে। ও ক্ষিপ্র আঙুল চালিয়ে আমার শার্টের বোতাম খুলে ফেলছিল। আমার বুকের রোম সরিয়ে ওর আঙুলগুলো সরীসৃপের মতো চলে আসছিল আমার গলার দিকে। গার্গী আবার ফ্যাসফ্যাস করে বলল ‘তুই বিশ্বাসঘাতকতা করলি আমার সঙ্গে, আমার মায়ের সঙ্গে, আমার গোটা ফ্যামিলিটার সঙ্গে। তুই একটা বেইমান। ব্রুট একটা। তোকে এর মূল্য দিতে হবে।’

আমার চোখের ওপর তখন নিঃসীম অন্ধকার। দেখলাম গার্গী আমার চোখ থেকে চশমা খুলে নিচ্ছে। আঙুল চালিয়ে দ্রুত এলোমেলো করে দিচ্ছে আমার চুল। ওর বুক শক্ত করে ঠেসে ধরেছে আমার বুকে। যেন দুটো অবোধ্য হাতিয়ার দিয়ে আমাকে বিঁধে ফেলছে। আমি চেষ্টা করেছিলাম গার্গীকে সরাতে, কিন্তু পারিনি। বাড়ি ফিরেছিলাম টলোমলো পায়ে। আমার সারা গায়ে তখন গার্গীর দাঁত আর লালসার দাগ। যেন একটা জন্তু কী এক আক্রোশে মরা গাছের দেহ থাবায় আঁচড়ে গেছে। শুধু সবকিছু হয়ে যাবার পরে আমারই নিথর শরীরের ওপর শুয়ে আলুথালু চুলে আকাশ ফাটিয়ে গার্গীর হো হো করে হেসে ওঠাটা চোখে ভাসছিল।
সাউন্ড সিস্টেমে একটা গান ডিম ভল্যুয়মে চালিয়ে ফিরে আসছিলাম। এখন বাকি যতটুকু জীবন, তা নিয়ে ভাবি না। মেয়েটা আছে। ওর জন্য যা, যতটুকু করেছি- খুব দুর্ঘটনায় না পড়লে ওর ভবিষ্যতে অসুবিধে হবার কথা নয়। এই বছরই ও একটা কোম্পানিতে জয়েন করেছে। আমি চাই ও ওর মতো করে জীবনটা কাটাক। আমাদের প্রাণহীন, বরফে ঢাকা পার্বত্য প্রদেশের মতো জীবনে ও-ই একটা সবুজ সতেজ ঝাউগাছ। আমাদের বয়েস হয়ে গেলে ও-ই ঝাউগাছে আমাদের জন্য আলো, স্ট্রবেরি এইসব সাজাবে। বালিশের নীচে মোজায় ভরে উপহার রাখবে। ও বড় হয়েছে। বুঝতে শিখেছে। হয়তো বুঝেছে মা বাবার চেহারায় দুটো আলাদা আলাদা জাহাজের ভাঙা তক্তা শুধু পাশাপাশি সমান্তরাল হয়ে ভেসে আছে। প্রত্যেকটি তক্তার দৈর্ঘ্য, ছ্যাঁদার অবস্থান আলাদা আলাদা। একসঙ্গে মেলানো যাবে না কিছুতেই।
আরও পড়ুন: দোলনচাঁপা দাশগুপ্তের গল্প: বসন্তদিন
রতনের ফোন এল।
‘স্যার, আপনি কোথায়?’
‘এই তো ফিরে আসছি। কেন?’
‘ছোট ম্যাডাম আপনার খোঁজ করছেন। আমাকে ফোন করতে বললেন।’
‘ম্যাডামরা এখন কোথায়?’
‘বড় ম্যাডাম স্যার ঘরে আছেন। ছোট ম্যাডাম এই তো, আমার পাশেই।’
‘ওরা খেয়েছে?’
‘হ্যাঁ স্যার। কফি আর চিকেন পকোড়া। যেমন আপনাকে বলেছিলাম।’
‘ছোট ম্যাডামকে ফোনটা একটু দাও তো।’
‘দিচ্ছি স্যার।’
ওপার থেকে হি হি করতে করতে তিথি বলল ‘জয়ন্তদা, এদিকটায় তো বেশ শীত। স্লিভলেস পরে এসেছি। ভালই ঠাণ্ডা লাগছে। আপনি কোথায়?’
‘তোমার টেম্পারেচার বাড়ানোর জিনিস নিয়ে ফিরছি।’
‘তাই? আসুন, আসুন। হি হি হি হি…’
মেয়েটা আছে। ওর জন্য যা, যতটুকু করেছি- খুব দুর্ঘটনায় না পড়লে ওর ভবিষ্যতে অসুবিধে হবার কথা নয়। এই বছরই ও একটা কোম্পানিতে জয়েন করেছে। আমি চাই ও ওর মতো করে জীবনটা কাটাক। আমাদের প্রাণহীন, বরফে ঢাকা পার্বত্য প্রদেশের মতো জীবনে ও-ই একটা সবুজ সতেজ ঝাউগাছ। আমাদের বয়েস হয়ে গেলে ও-ই ঝাউগাছে আমাদের জন্য আলো, স্ট্রবেরি এইসব সাজাবে। বালিশের নীচে মোজায় ভরে উপহার রাখবে।
ফোনটা কেটে দিয়ে ভাবলাম, কথাটা হয়তো একটু স্ল্যাং বলা হল। তিথি অবশ্য কিছুই ভাববে না। এই ভাবনাটুকু ভাবার মতো স্তরই নেই ওর মধ্যে। নিঃসন্তান ওরা, তবুও কীরকম প্রাণোচ্ছল হয়ে আছে। এইজন্য ওদের আমার বেশ লাগে। শুভ্রাংশু কিছু না পেলে বউয়েরই নানারকম অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলে। সেটা আবার সবাইকে দেখায়ও। রিসর্টে ফিরে গিয়ে ডানদিকের গেস্টরুমটার বারান্দায় বসে আমরা মদ খাব। রতনকে বলব কিছু ভাজাভুজির ব্যবস্থা করতে। স্বাতী এখন আর ঘর থেকে বেরোবেই না। হয়তো টের পাবে সবই। যেমন ও সবককিছু টের পেয়ে এসেছে। তিথি একটু বোকা আর সরল। মদ খেয়ে হয়তো আমার হাত ধরে ঢলেও পড়তে পারে। দূর থেকে হয়তো ওর বিশাল শরীর আর চওড়া, নগ্ন বাহুমূল দেখা যাবে। লোকচক্ষে হয়তো সেটা কিছুটা অশ্লীলও দেখাবে। তবে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। ভেতরে ভেতরে বহুদূর অবধি আমি প্রস্তরীভূত হয়ে গেছি। নতুন করে সেখানে প্রাণ সঞ্চারের আর কোনও সম্ভাবনাই নেই।
গাড়িতে যে গানটা বাজছিল, ভালো লাগছিল ওটার কথাগুলো শুনতে।
‘অল মাই টুমরোজ ডিপেন্ড অন ইয়োর লাভ, সো উইশ মি এ রেনবো অ্যাবাভ।’
রেনবো অ্যাবাভ! কী সুন্দর, প্রতীকী একটা কথা!
কী মনে করে যেন গাড়ির জানালা দিয়ে একবার বাইরে উপরে তাকালাম। দেখলাম ওপরে, অনেক ওপরে আকাশে একমুঠো তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে জ্বলছে।
*ভিতরের ছবি সৌজন্য: Goodfon, Facebook
জন্ম কোচবিহার জেলায়৷ বড় হয়ে ওঠা আলিপুরদুয়ার জেলার হ্যামিল্টনগঞ্জে৷ কলেজে পড়াকালীন লেখালেখির প্রতি আগ্রহ জন্মায় এবং লেখার হাতেখড়ি৷ স্থানীয় ছোট পত্রপত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশ৷ এরপর লেখায় দীর্ঘ সময়ের ছেদ পড়ে৷ আবার গত তিনবছর ধরে লেখায় ফেরা৷ কাব্যগ্রন্থ 'কিছুক্ষণ থাকা অথবা অনন্তকাল' ২০২০ কলকাতা বইমেলায় 'শুধু বিঘে দুই' থেকে প্রকাশিত৷ মূলত কবিতা লিখতে পছন্দ করেন৷ একটু আধটু গদ্যচর্চাও হয়৷
2 Responses
ভালো লাগলো এই সময়ের নারী পুরুষের নিজেকে না চেনার, নিজের চাওয়া পাওয়া না বুঝতে পারার যন্ত্রণার গল্প।
ধন্যবাদ