আজ জানলার ধারে সিট পেয়ে গেছিল মেঘনা কপালজোরে। ক্লান্তিতে চোখ বুজে গেছিল ঠান্ডা হাওয়ায়। কিন্তু অভ্যেস কথা বলে। ঠিক সময়মতো চোখ খুলে গেছিল শ্রীরামপুর স্টেশনের আগেই। বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে পা চলছিল না আর ক্লান্তিতে। একটু আনমনা ছিল, তাই প্রথমে খেয়াল করেনি। তারপরে বুঝল, ছেলেটা ওর পিছন পিছন পা চালিয়ে আসছে। আর একটু পরেই ওর গায়ের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলে উঠল, ‘আজ এত দেরি হল আপনার?’ তেতো খাওয়ার মতো মুখভঙ্গি করে কোনওমতে উত্তর দিল মেঘনা, ‘এই তো…।’
ছেলেটা ওর প্রায় গায়ে গায়ে চলছে। এবার ও নিজের মোবাইল বের করে হিন্দিতে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে থাকবে। মেঘনা সেই ফাঁকে পিছিয়ে বা এগিয়ে গেলেই ও-ও এগিয়ে বা পিছিয়ে যাবে। কী যে বিরক্তিকর… এই তো কদিন আগেই খুব রেগে যা তা বলে দিয়েছিল ছেলেটাকে। ‘এই তুই আমার গায়ে গায়ে যাচ্ছিস কেন? এগিয়ে যা!’ সেদিন ও চলে গেছিল ঠিকই। মেঘনাও ভেবেছিল আপদ বিদায় নিয়েছে। প্রায় সাতদিন বাদে আবার উদয় হল। সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ির কাছাকাছি চলে এল মেঘনা। আর তখনই ছেলেটা বলে উঠল, ‘কাকিমা, বাইই।’ কোনও উত্তর না দিয়েই বাড়ির বেল বাজাল মেঘনা।
স্নান সারতে সারতে মেঘনা ভাবছিল ছেলেটার কথা। কতই বা বয়স ওর। এই তো সেদিন বাবুর সঙ্গে ঘরে খেলত, দু’জনে ছিল একেবারে হরিহর আত্মা। বাবুর থেকে মাস ছয়েকের বড় ও। উল্টোদিকের বাড়ি হলেও ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে মেঘনাদের তেমন ভাব ভালবাসা ছিল না। আসলে ওরা দু’জনেই ছিল একটু অসামাজিক ধরনের। বাবা মিলিটারিতে ছিল, রিটায়ার করার পরে বিয়ে। এক্স আর্মিম্যান হওয়ার সুবাদে কাস্টমসে চাকরি পেয়ে গেছিল। আর মা সিনিয়র স্কুল টিচার। ওদেরই বেশি বয়সের সন্তান অরুণাভ।
দুটো বাচ্চা মুখোমুখি হলে খুব স্বাভাবিকভাবেই যেমন মেলামেশা করে, বাবু আর অরুণাভর বন্ধুত্বও তেমনভাবেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু অরুণাভর মায়ের অতিরিক্ত শাসনের চাপে ছেলেটা ছোট থেকেই একটু কুঁকড়ে থাকত। মেঘনাদের বাড়িতেই ওদের যত খেলাধুলো, কার্টুন দেখা, একসঙ্গে আঁকা শেখা, এইসব চলত। ওদের বাড়িতে একমাত্র অরুণাভর জন্মদিনে বাবুর বা অন্য বাচ্চাদের এন্ট্রি ছিল।
প্রায় প্রত্যকে সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে অরুণাভর মা ছেলেকে রীতিমতো বকাঝকা, মারধর করত। এমনকী লাঠি দিয়েও! কারণ হয়তো, স্কুলের উইকলি টেস্টে খারাপ নম্বর, বা টিফিন খায়নি, এইরকম তুচ্ছ আপাত-স্বাভাবিক ঘটনা। একজন শিক্ষিত মহিলা, তায় আবার স্কুল টিচার, কী করে যে ওইটুকু ছেলেকে এমন নির্দয়ভাবে মারতে পারেন, মেঘনা ভেবে পেত না। এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল মেঘনারা এবং অন্য প্রতিবেশীরাও। এমনকি অরুণাভও যেন জানত, এ-ই তার প্রাপ্য। মা ডাকলে সে কেঁপে উঠত ভয়ে। ছেলেকে সারাদিন বই মুখে বসিয়ে রাখত ছুটির দিন। পরীক্ষার আগে তো কথাই নেই। বাবা, মা পালা করে ছুটি নিয়ে ছেলের সঙ্গে বসে থাকত। ক্লাস টু-থ্রি-র ছেলেকে এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়তে বা বসে থাকতে কেউ কোনওদিন দেখেছে?
কী যে বিরক্তিকর… এই তো কদিন আগেই খুব রেগে যা তা বলে দিয়েছিল ছেলেটাকে। ‘এই তুই আমার গায়ে গায়ে যাচ্ছিস কেন? এগিয়ে যা!’ সেদিন ও চলে গেছিল ঠিকই। মেঘনাও ভেবেছিল আপদ বিদায় নিয়েছে। প্রায় সাতদিন বাদে আবার উদয় হল।
অরুণাভ একমাত্র মেঘনাদের বাড়িতেই তা-ও যা একটু ফ্রি হতে পারত। কাকিমা কাকিমা বলে বালকসুলভ আবদারও সে করেছে অনেকবার। এমনও দিন গেছে, পরীক্ষার পরে মেঘনাদের বাড়িতেই সারাদিন কাটিয়েছে বাবুর সঙ্গে। ফলে অরুণাভর বড় হওয়া মেঘনা দেখেছে খুব কাছ থেকে। ছেলের বয়ঃসন্ধি এসেছে স্বাভাবিকভাবে, অরুণাভরও। এই সময়ে যা কিছু শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয় ছেলেদের, দুজনেরই একইভাবে হয়েছে। বরং অরুণাভকে মেঘনা কয়েকবার বকাবকিও করেছে ছেলের মতো করে। তাতে যে অরুণাভ কিছু মনে করেছে, তাও না। কিন্তু ওর আচরণে একটু বদল এসেছিল সেই সময় থেকেই।
মেঘনা সচেতন হয়ে উঠত অরুণাভকে দেখলেই। ছাদে, বারান্দায় বা রাস্তায় চোখাচোখি হলে মেঘনা বুঝত, অরুণাভ ওর শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে হাঁ করে। খুব অস্বস্তি হত, রাগ হত, কিন্তু কিছু করারও ছিল না। ভেবেছিল আর একটু বড় হলে বুঝি এসব কেটে যাবে। মানসিক দিক বিচার করলে কিশোরদের এই আচরণ অস্বাভাবিক নয়। ফলে মেঘনা ব্যাপারটা মন থেকে সরিয়ে দেওয়ারই চেষ্টা করেছে বরাবর।
আর সত্যি বলতে কী, ছেলেদের আজকাল যা পড়াশুনোর চাপ, একটু বড় হতে না হতেই, আইসিএসসি, আইএসসি— আর অন্যদিকে মন দেওয়ার কথা মনেও আসেনি মেঘনার। এই সময়ে অরুণাভ একেবারে ঘরবন্দি হয়েই থাকত। স্কুল, টিউশন ছাড়া ওকে আর কোথাও যেতে দেখেনি মেঘনা। বাবুর সঙ্গেও বন্ধুত্ব প্রায় চুকেই গেছিল সে সময় থেকে। ছেলে, সংসার আর অফিসের চাপে কখন যে মেঘনা বুড়িয়ে গেল, সে বোধহয় নিজেও বোঝেনি। আগে হাজার চাপ থাকা সত্ত্বেও নিজের দিকে কিছুটা খেয়াল রাখত মেঘনা। পরিপাটি সাজগোজ, হালকা ব্যায়াম, নিয়মমতো পার্লার, স্পা। মেঘনাকে সুন্দরী বলা না গেলেও ওর মধ্যে একটা চটক আছে। একটা গনগনে আগুনের সঙ্গে একটা মাধুর্য মিশে থাকত ওর রূপে। আর সবথেকে আকর্ষণীয় ছিল ওর চোখ। ওর চোখের দিকে তাকালে অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলত। মেঘনা নিজেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিল।
আর এখন? বেশ কয়েক গুছি চুলে পাক ধরেছে। নিয়মিত কালার করার কথাও আর খেয়াল থাকে না। সাজগোজেও ঢিলেঢালা ভাব। যা হোক কিছু হলেই চলে যায়। আর এই প্রি-মেনোপজ স্টেজে এসে যাবতীয় অতৃপ্তি, বঞ্চনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে ওকে আরও নির্লিপ্ত করে দিয়েছে আজকাল। কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে অনেক। প্রয়োজন ছাড়া আর কথা হয় না কারুর সঙ্গে। বন্ধু বলতে যে দু’ একজন ছিল, তারাও ওরই মতো গা ছেড়ে দিয়ে নিজের বৃত্তে বাস করছে। এ এমন এক সময় যে, মনে হয় এই পৃথিবীতে ওর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ছেলেও ভাল কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। পাশ করলেই চাকরি বাঁধা। ওকে নিয়ে আলাদা করে আর দুর্ভাবনা বা চাপ নিতে হয় না এখন মেঘনার। সপ্তাহান্তে বাড়ি আসে, তখনই যা হইচই হয় বাড়িতে, বাড়িটার প্রাণ ফেরে।
এর মধ্যে মাস চারেক আগে থেকে শুরু হয়েছে এই কাণ্ড। প্রথম দু’চারদিন তত গুরুত্ব দেয়নি মেঘনা। ভেবেছিল অরুণাভ হয়তো এমনিই কোনও জায়গা থেকে ফিরছিল, দেখা হয়েছে, তাই কথা বলছে। কিন্তু একদিন খেয়াল করল, মোড়ের মাথায় একটা পোস্টের আড়ালে ওরই ফেরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে অরুণাভ। না-দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে গেছিল মেঘনা। কিন্তু ও হনহন করে এগিয়ে এসে মেঘনাকে পাকড়াও করেছিল গত তিন-চারদিনের মতোই। বিরক্তি দেখিয়েছিল, রাগও।
হাজার হোক, একটা সদ্য যুবা, নিজের ছেলের মতো হলেও তাকে তো আর চড় চাপাটি মারা যায় না বা চিৎকার করে বকাঝকাও যায় না। তাও আবার রাস্তায়। আর কী দোষে? সাদা চোখে দেখলে মনে হবে মায়ের মতো কাকিমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলেছে একটা ছেলে। এতে দোষের কী আছে এমন? কিন্তু মেঘনা বুঝতে পারত নিজের সহজাত নারী প্রবৃত্তির প্রভাবে। অরুণাভর গা ঘেঁষে আসা, ওর উষ্ণ, ঘনঘন শ্বাস ফেলা… গা ঘিনঘিন করে উঠত মেঘনার। স্নান করতে একটু বেশিই সময় নিয়েছে এই কদিন।
মেঘনা ভাবছিল— ও কি সিনিক হয়ে যাচ্ছে অকারণ? হয়তো এমনিই ছেলেটা কথা বলে, এমনিতেই ওর বুদ্ধিশুদ্ধি কম বরাবর। বোকাবোকা হাবভাবে এখন স্মার্টনেসের প্রলেপ চাপাতে চায়, ফলে ওকে যেন একটা বকচ্ছপের মতো লাগে। মোটাসোটা, থপথপে চেহারা, ডাল্ ব্রেন— এ সবই হয়তো বাপমায়ের বয়সকালের সন্তান হওয়ার ফল। হয়তো সে-ই ভুল বুঝছে! একটু বেশিই রুড হয়ে যাচ্ছে। পুরুষমানুষ তো কম দেখল না জীবনে, নারী শরীরের প্রতি ওদের লোভ অনন্ত। তাইই হয়তো অরুণাভকেও একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে।
আগে হাজার চাপ থাকা সত্ত্বেও নিজের দিকে কিছুটা খেয়াল রাখত মেঘনা। পরিপাটি সাজগোজ, হালকা ব্যায়াম, নিয়মমতো পার্লার, স্পা। মেঘনাকে সুন্দরী বলা না গেলেও ওর মধ্যে একটা চটক আছে। একটা গনগনে আগুনের সঙ্গে একটা মাধুর্য মিশে থাকত ওর রূপে। আর সবথেকে আকর্ষণীয় ছিল ওর চোখ।
কিন্তু সেদিন মাঝরাতে মেসেঞ্জারে কেন মেসেজ পাঠাল ওকে? কেনই বা সেদিন নিজের মোবাইল আনেনি বলে ওর মোবাইল চেয়ে ফোন করল কাকে… ওটা যে বাহানা ছিল কথা বলার, সেদিন মেঘনা বুঝেছিল ঠিকই। একটু দূরত্বেই তো দু’জনের বাড়ি, বাড়ি গিয়েই ফোন করা যেত। আসলে মেঘনার মোবাইল নম্বর চাইতে সাহসে কুলোয়নি, তাই ওই ফন্দি এঁটেছিল বোকা ছেলেটা। দু’একদিন অবান্তর ফোনও করেছিল, কিন্তু ওর ঠান্ডা গলা শুনে ভয়ে আর করেনি। একবার তো গলা বিকৃত করেও ফোন করেছিল হিন্দিতে… যেন সে চিনতে পারবে না! এইসব বোকাবোকা হাস্যকর কাজগুলো দেখলেই ওকে আর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয়, নেহাতই ছেলেমানুষ, ইমম্যাচিওর।
সেদিনের মতো অরুণাভকে ক্ষমা, ঘেন্না করে দিল মেঘনা। ব্যাপারটা এখানেই শেষ করে দিতে চাইছিল। ফলে এরপর ওর সঙ্গে দেখা হলে মেঘনা ছোটবেলার মতো ব্যবহার শুরু করল। কী খাচ্ছিস, কী করছিস, কী পড়ছিস এখন… এইসব নিয়ে হাল্কা কথাবার্তা। তাতে কিন্তু কাজ হয়েছিল সাময়িকভাবে। ছেলেটাকে কিছুদিন একেবারে স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। মেঘনার মাথা থেকেও ভূত নেমে গেছিল তখন। হ্যাঁ, সাময়িকভাবেই। কারণ আর কিছুই না, ছেলেটার মাথায় আবার অ্যাডোলেসেন্স পিরিয়ডের পোকা ফিরে এসেছিল। ঠিক আগের মতোই, রাস্তায় মেঘনার পিছু নেওয়া, গায়ে পড়া, অহেতুক ফোন করা…
বাবুকে জানাবে সব, ঠিক করেছে মেঘনা। ও যদি কোনওভাবে অরুণাভর সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক করে দিতে পারে। কিন্তু কী জানাবে? কী বলবে বাবুকে? বলবে— দ্যাখ, তোর বন্ধু আমার গায়ে পড়ছে রোজ রাতে? এও কি মা হয়ে মুখ ফুটে বলা যায়? বলবে, মাঝরাতে মেসেজ করছে আমাকে? ফোন করছে অকারণ? কিছুটা অন্তত বলতে হবেই। বাবুর সঙ্গে মায়ের মেলামেশা বন্ধুর মতোই। মা যতটা না সে, বন্ধু বেশি। এমনকী আজকাল তো ওকে রীতিমত ভরসা করে মেঘনা। ওর বিচারবুদ্ধির ওপর মেঘনার যথেষ্ট আস্থা আছে।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক। যে ছেলের বুদ্ধির ওপর এত ভরসা ছিল মেঘনার, সেই ছেলে সব শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। পারলে তক্ষুনি ওদের বাড়ি গিয়ে অরুণাভকে মেরেধরে আসে, এমন শুরু করল। কোনওমতে সেদিনের মতো বুঝিয়ে সুঝিয়ে থামাল ছেলেকে। কিন্তু ছেলের রাগের নমুনা জানে ও ভালভাবেই। তাই ওর ভেতরে ফুঁসতে থাকা আগ্নেয়গিরিটার উত্তাপ টের পাচ্ছিল। পরদিন ফেরার সময়ে স্টেশনে নেমেই দেখল বাবু দাঁড়িয়ে আছে। কী একটা কারণে কলেজ ছুটি চলছিল ওদের। ছেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে ফিরতে ভালই লাগছিল মেঘনার। মাঝে একটা রোলের দোকান দেখে ছোটবেলার মতো বায়না করে রোল কেনাল বাবু। আর রোলের মুখে বাড়তি সস দিয়ে নিল ওর পুরনো স্বভাব অনুযায়ী।
কিন্তু সেদিন মাঝরাতে মেসেঞ্জারে কেন মেসেজ পাঠাল ওকে? কেনই বা সেদিন নিজের মোবাইল আনেনি বলে ওর মোবাইল চেয়ে ফোন করল কাকে… ওটা যে বাহানা ছিল কথা বলার, সেদিন মেঘনা বুঝেছিল ঠিকই। একটু দূরত্বেই তো দু’জনের বাড়ি, বাড়ি গিয়েই ফোন করা যেত।
দু’ কামড় খেতে খেতে এগিয়েছে কি এগোয়নি, সামনে অরুণাভ। অরুণাভ বোধহয় বাবুকে আশা করেনি এই সময়ে। হকচকিয়ে গেছে প্রথমটা। তারপর বোকা বোকা হেসে বাবুর সঙ্গে কথা বলতে গেছে। ‘কী রে কেমন আছিস? তুই বাড়িতে এখন? আমি ভাবলাম হস্টেলে ফিরে গেছিস।’ মেঘনা সেই আগ্নেয়গিরির ফুঁসে ওঠা টের পেল হঠাৎই। হিসহিস করে বলে উঠল ছেলে, ‘কেন আমি হস্টেলে গেলে তোর সুবিধে হয় নাকি?’ ওর মুখচোখ দেখে অরুণাভ ঘাবড়ে গেছে। আমতা আমতা করছে… আর সেই মুহূর্তেই বাবু, যে হাতে সস ভর্তি রোলটা ধরেছিল, সেই হাত দিয়েই ভরা রাস্তায় অরুণাভর মুখের সামনে রোলটা চিপে ওর মুখে একগাদা সস ছিটিয়ে দিল ঠিক হিন্দি সিনেমার কায়দায়।
চোখের সামনে যেন একটা ফ্রিজ় শট। আশেপাশের লোকজন হাঁ করে দেখছে, বাবু হনহন করে এগিয়ে গেল, আর অরুণাভ রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে… ওই তো যাচ্ছে তার আগে আগে। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব। লজ্জায় মুখ নিচু করে কোনওমতে বাড়ির দিকে এগচ্ছে মেঘনা, কিন্তু পা যেন আর চলছে না। অরুণাভকে এভাবে অপমান করা একেবারেই উচিত হয়নি বাবুর। এই বয়সের ছেলে, কী জানি কী করে বসে…! দুশ্চিন্তায় উৎকণ্ঠায় রাতে ভাল ঘুম হল না তার। বাবুর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি ও সে রাতে। এমন অসভ্যের মতো আচরণ করবে বাবু ভাবতেই পারেনি মেঘনা। ওকে বলাই মস্ত ভুল হয়েছে তার। ওর ওপর ভরসা করা যাবে না আর কিছুতেই।

সকালে অরুণাভদের বাড়ির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ওকে খুঁজেছিল মেঘনা। দেখতে পায়নি। আহা রে! খুব আঘাত পেয়েছে নিশ্চই। দু’তিনদিন পরে ওকে দেখল এক ঝলক। মেঘনাকে দেখেই ঘরে ঢুকে পড়ল বারান্দা ছেড়ে। যাক্! কিছুদিন বাদে সব ঠিক হয়ে যাবে। সময় সব ক্ষোভ, আঘাত, দুঃখ, শোক মুছে দিতে পারে। এ তো সামান্য ঘটনা। যদিও কচি মনে এই অপমানের কষাঘাত কতটা প্রভাব ফেলে, সে মেঘনা জানে।
জীবন তার বৈচিত্র নিয়ে চলতেই থাকে। থমকে গেলেও একেবারে থেমে যাওয়ার নয়। বাবু হস্টেলে চলে গেছে। তার মা, বাবাও নিয়মিত কাজে লেগে পড়েছে। অরুণাভর সঙ্গে মেঘনার রাস্তায় আর দেখাসাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। ওদের বাড়ির ভেতর থেকে মাঝেসাঝে ওর আভাস পাওয়া যায়, এটুকুই। শীত পড়ছে ধীরে ধীরে। ফেরার সময়ে প্রায় সকলেরই মাফলার, চাদর বেরিয়ে পড়ে ব্যাগ থেকে। মেঘনার অত শীত করে না। তবে বয়স জানান দিচ্ছে এখন। কাশি হচ্ছে ঠান্ডা লাগালেই। তাই বাধ্য হয়ে একটা স্কার্ফ জড়িয়েছে ও ফেরার পথে। আজ যেন রাস্তাঘাট একটু বেশিই ফাঁকা। গাঢ় কুয়াশায় ল্যাম্পপোস্টের জোরাল আলোগুলো পর্যন্ত চাপা পড়ে গেছে মনে হচ্ছে। এই সময়ে এত কুয়াশা হয় না সাধারণত। মাথা ঢেকে নিল মেঘনা।
বাতাসে ভিজে ভাব, আর হিম স্পর্শ। কী ভেবে পিছন ফিরে তাকাল মেঘনা। যত দূর চোখ যায়, একটা জনপ্রাণিও নেই। সামনেও তাই। একটা দমকা হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিল মেঘনাকে। আর ঠিক তখনই হুহু করে উঠল ওর মন। মনে হল, কেউ কোত্থাও নেই আর। ভয়ানক এক একাকীত্ব ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর গায়ে। অসহায় লাগছিল মেঘনার। দু’ চোখ ছাপিয়ে জল এল আচমকা। তবু তো ওই ছেলেটা ছিল… তার এই অপ্রয়োজনীয় জীবনটা অন্তত ওর কাছে গুরুত্ব পেত কিছুক্ষণের জন্য হলেও। একজন, অন্তত একজন ওর দিকে তাকাত, ওকে দেখত খুঁটিয়ে। আজকাল আয়নায় নিজের মুখ দেখাও ছেড়ে দিয়েছে মেঘনা। কতদিন ভাল করে দেখেনি নিজেকে?
আরও পড়ুন: বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প: প্রতিবিম্ব পর্ব ২
বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিল অভ্যস্ত পায়ে। কার বাড়ি ওটা? ওর নিজের? নাকি বাবুর, বাবুর বাবার? সে যদি আজ বাড়ি না ফেরে, খুব কিছু অসুবিধে হবে না কারও। দু’ চারদিন একটু অসুবিধে হবে, হাতের কাছে সব বাগিয়ে, গুছিয়ে দেওয়ার লোক না থাকলে যেমন অসুবিধে হয় মানুষের, তেমনটাই। বাকি আর কী? অরুণাভর বাড়ির সামনে চলে এসেছে মেঘনা।
আচমকা ওর ঘর লাগোয়া বারান্দায় তাকাল। আলো জ্বলছে না ওখানে। কিন্তু রাস্তার আলোয় দেখা যাচ্ছে, একটা জ্যাকেট পরা আবছায়া স্থির দাঁড়িয়ে। মোবাইলের বাক্যালাপ শোনা যাচ্ছে। ‘হ্যাঁ আন্টি, কেমন আছেন? আপনাদের বাড়ি যাব একদিন।’ ও প্রান্তের উত্তরের পরে ছায়ামূর্তি আবার তড়িঘড়ি বলে উঠল, ‘কী যে বলেন, আপনি এখনও খুব গ্ল্যামারাস।’ মেঘনা বেল বাজাল নিজের বাড়ির। রাস্তার আলোয় অদ্ভুত উজ্জ্বল দেখাচ্ছে এখন ওকে।
তুষ্টি হুগলি জেলার শেওড়াফুলির বাসিন্দা এবং বোটানিতে স্নাতক। গদ্য ও কবিতা লেখায় সমান আগ্রহ। প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তিন - ভিজে যাওয়া গাছ, ব্ল্যাক ফরেস্ট ও এরিসেডের আয়না। গদ্যের বইয়ের নাম পদাবলি।
5 Responses
Ek odbhut sexual tension …… oedipus complex
হ্যাঁ অনেকটা তাই।
besh onnorokom shwad pawa gelo …… lekha chaliye jan
মনের চলন বড় বিচিত্র ভুলভুলাইয়া। তার শুরুও নেই, শেষও নেই। আহা বেশ লিখেছ তুষ্টি! খুব ভালো লাগলো।
ভুলভুলাইয়াই বটে।