শীতকে কথা দেওয়া ছিল, প্রতি বছর তার সঙ্গে দেখা হবে ভোরের কুয়াশা মোড়া রাস্তার বাঁকে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে…। কিম্বা হলুদ সর্ষে ক্ষেতের মেঠো আল পথে, নদীর ধারে, কোনও সুদূর থেকে আসা বাবুইবাটান আর চখাচখিদের সঙ্গে নিয়ে…। প্রতি শীতেই কথা রাখি। এই প্যাচপ্যাচে গরমের দেশে মাসখানেক ঠান্ডার জন্যে কতও প্রতীক্ষা…
শীত কি শুধু সর্ষেক্ষেত আর চখাচখির ডানা রঙিন করতে আসে? শীত আসে গাজর, বিট, ব্রোকলি, ক্যাপসিকামের রঙের সম্ভার নিয়েও… আর কড়াইশুঁটি? ওমা! বাঙালির শীতকাল কি কড়াইশুঁটি ছাড়া সম্পূর্ণ হয়? কোন বাঙালি বাড়ির শীতের ‘জলখাবারে’ একদিনও কড়াইশুঁটির কচুরি হয় না বলো দেখি? সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট নতুন আলু আর মটরশুঁটির আলুরদম, টুকুস করে শেষমুখে একখানা নলেন গুড়ের রসগোল্লা…
আমাদের বাড়ি থেকে কুয়াশামোড়া অন্ধকার থাকতে বেরোলেই মিনিট পনেরোর মধ্যে রায়পুর গ্রাম। ভোরে খেজুরের টাটকা রস আর ওখানেই তৈরি হয় টাটকা খেজুর গুড়। না গুড়ের রসগোল্লার রেসিপি বলছি না, বরং মার কাছে শেখা কচুরির কিছু টুকরো টিপস বলি…
- পুরটায় জিরেভাজার গুঁড়ো, অল্প নুনমিষ্টি আর লঙ্কাগুঁড়ো দিয়ে সর্ষের তেলে ভালো করে শুকনো শুকনো করে ভাজাটা খুব জরুরি। পারলে আগে থেকে করে ঠান্ডা করে রাখতে হবে।
- আর কচুরির ময়ানটা খুব ভালো হতে হবে। তেল গরম করে তবেই ভাজতে হবে, প্রয়োজনে একটু ময়দা দিয়ে দেখে নিতে হবে, ভেসে উঠছে কিনা গরম তেলে দিলে।
সকালে বেশ খানকতক কচুরি খেয়ে ফেললে, শীতের দুপুরে হালকা খাবার। আর তারপর রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে কমলালেবু, কিম্বা ওই সর্ষেক্ষেতের আলপথে মিষ্টি রোদ্দুরে বসে কাঁচা লঙ্কা, কাসুন্দি আর বিটনুন দিয়ে পেয়ারা মাখা… ওই যেখানে পথের ধারে অনন্তলতা ফুলের ভারে নুয়ে থাকে, সেই বাঁকের শেষে গরম গোটা বাদামভাজা আর গুড় লঙ্কা দিয়ে মাখা কয়েতবেলও চলতে পারে… আহহা, শীতের ভালোবাসা!

এই শীতের ছুটিতেই তো ছোটবেলায় শ্রেয়ার সঙ্গে যেতাম ওদের বাড়ি। বড়দিনে ওদের বাড়ি ঝলমল করে, আর কত কত কেক, কুকিজ, খাবার। মনে পড়ে গেল, দুই বন্ধুর একসঙ্গে কাটানো শীতের ছোটবেলা। শীত তখন যাই যাই… বহু অপেক্ষায় বছরে একবার শাড়ি পড়তে পারা, তাও ফ্রকের ওপরে! হ্যাঁ সরস্বতী পুজোর দিনের কথাই বলছি। কী যে আনন্দের দিন! বই থেকে মুক্তি, শাড়ি পরে একটু বড় বড় হাবভাব… আর ইস্কুলের খিচুড়ি ভোগ লাবড়া সহযোগে। আমাদের বাড়িতেও সেদিন নিরামিষ। কিন্তু পাশের বাড়ির চিত্রাকাকিমারা বরিশালের মানুষ, ওদের দেখতাম জোড়া ইলিশ বরণ করে ঘরে তুলত। সেইই পুজোর সময় ইলিশ খাওয়া শেষ করে, আবার এই সরস্বতী পুজোয় শুরু…মাঝের ক’মাস নাকি ঠান্ডায় ইলিশ ধরা হত না!
সে যাই হোক, বড়ো হতে হতে একটু একটু করে পুজোর উৎসহের কারণ বদলালো, নিজেদের পুজো! পাড়ার প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই সরস্বতী বানান বললে তবে চাঁদা… আর তাতেও যদি না পাই তো বাগান ভরা ফুলগুলো কিসের জন্যে শুনি? বিকেলে নাচ গান আর নাটক। মা সরস্বতীকে খুশি করতে হবে তো! সে অনেক কিছু বয়েসের সঙ্গে বদলালেও, কিছু ভালোবাসা তো একই থেকে যায়। যেমন পুজোর সকালে মার হাতের সাদা ফুলকো লুচি, ধবধবে সাদা কলাইয়ের ডালের বোঁদে আর সাদা ছানার মুড়কি। শ্বেতপদ্মাসনে অধিষ্ঠিত দেবীর জন্যে মার শুদ্ধ শুভ্র নৈবেদ্য! আমি কেবল পুজোয় বসে ভাবতাম সত্যিই যদি ঠাকুর খেয়ে নেয় তাহলে? এই তো শৈশব!
যাই হোক, ভাগ করে নিই তাহলে ছোটবেলার এক টুকরো স্বাদ। সকালে জলখাবারের ছানার মুড়কি, আর কলাইয়ের ডালের বোঁদে, আর দুপুরে খিচুড়ির সঙ্গে সজনে ফুলের বড়া আর তরকারির প্রণালি।
ছানার মুড়কি
২২৫ গ্রাম পনির
৩/৪ কাপ চিনি
১/৩ কাপ জল
এক চামচ গোলাপ জল
এক চামচ এলাচগুঁড়ো
ছানা ছোট কিউব করে কেটে রাখা থাকবে, ওদিকে ততক্ষণ চিনির রস তৈরি হবে। আঁচে জল আর চিনি দিয়ে ওই একটা তারের মতো সিরাপ তৈরি করে তাতে খুব কম আঁচে পনির কিউব মিশিয়ে নাড়তে থাকতে হবে। আস্তে আস্তে চিনি ঘন হয়ে গায়ে লেগে যাবে। ব্যাস রেডি ছানার মুড়কি। ওহ এটায় যত ফ্লেভার হবে, তত হবে সুস্বাদু…

সাদা বোঁদে
২৫০ গ্রাম বরবটি কলাইয়ের বেসন
২ বড়ো চামচ আতপচাল গুঁড়ো
১৫০ গ্রাম চিনি
নুন পরিমাণ মতো আর
জল ও তাই, চিনির রসের জন্যে
বরবটি কলাইয়ের বেসন না পেলে গোটা বরবটি কলাই কিনে খুব কম আঁচে তাওয়াতে রোস্ট করে মিক্সারে গুঁড়ো করা যায়, বলে রাখলাম বিকল্পটি। তারপর চালগুঁড়ি, বেসন আর নুন মিশিয়ে জল দিয়ে একটা ব্যটার বানাতে হবে, না ঘন, না পাতলা… যাতে ছানতা দিয়ে সঠিক ভাবে পড়ে। এই ব্যাপারটা একটু অভ্যেস করলেই আয়ত্তে আসবে। ওই ব্যাটারটা ঘণ্টা চারেক ঢেকে রেখে একটু মজতে সময় দিলে ভালো। তারপর তেল গরম করে নিয়ে আঁচ মাঝারি করে ছানতার ওপর দিয়ে তেলে ঢেলে ঢেলে ভেজে নিতে হবে, যাতে গোল গোল হয়ে পড়ে। তুলে নিয়ে পাশে তৈরি করে রাখা চিনির সিরাপে, যেটা কিনা এক তারের সিরাপ বলে, তার মধ্যে ঢেলে দেওয়া। ব্যাস…। এর সঙ্গে ধবধবে সাদা লুচি হলেই জমে ভালো।
এর পর আসি দুপুরের দুটো স্পেশাল খাবারে… পদ্ধতি বলার আগে মনে এল, এখন না হয় দাম দিয়ে কিনি, ছোটবেলায় কিন্তু ভোরে উঠে পাড়ার সজনে গাছগুলোর নীচে বিছিয়ে থাকা ফুল কুড়নো একটা বড় কাজ ছিল। বাবা বলত, এই সময় সজনেফুল মাস্ট, একদম অ্যান্টি পক্স! যাই হোক, যা লাগবে বলি,

সজনে ফুলের ঝাল
সজনে ফুল ৭০০ গ্রাম
১০০ গ্রাম মতো বেগুনকুচি
১০০ গ্রাম সিম কুচি
এক বাটি আলু কুচি, ছোট কিউব
টমেটো কুচি এক ছোট বাটি
মটরশুঁটি এক বাটি
বেগুনকুচি, সিমকুচি সব অল্প তেলে ভেজে রাখতে হবে, ঢিমে আঁচে। তারপর কড়াইতে সর্ষের তেল গরম করে কালোজিরে কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে টমেটোকুচি দিয়ে নেড়ে, মটরশুঁটি আর সজনে ফুল দিয়ে দিতে হবে। সঙ্গে নুন মিষ্টিও। জল দিতে হয় না একদমই। কম আঁচে ঢাকা দিয়ে সেদ্ধ করতে হবে। সবটা সেদ্ধ হলে, ওই বেগুন আর সিম ভাজাটা দিয়ে ভালো করে নেড়ে গরম গরম পরিবেশন। এতে অনেকে একটু সর্ষেবাটাও দেয়। ভালই লাগে। তবে এই হালকা ঝাল ঝাল সজনে ফুলের ঝালটিও দারুন কিন্তু।

আর এর সঙ্গে সজনে ফুলের বড়া।
সজনে ফুল একবাটি
বেসন আধবাটি
স্বাদমতো নুন
অল্প, খুব অল্প চিনি
একটু কালোজিরে হাফ চামচ মতো
আর গরম তেল দু’চামচ
হাফ চামচ খাবার সোডা
একটু সাদা তিলও
ফুলগুলো কুঁড়ি থেকে বেছে নিতে হবে, নইলে একটু তেতো লাগে। আর ফুল বেশি হবে বেসনের তুলনায়। সবটা ভালো করে মিশিয়ে একটু গাঢ় ব্যাটার তৈরি করে, ছোট ছোট করে বড়া ভেজে ঠিক গরম খিচুড়ির সঙ্গে খাও। সঙ্গে অবশ্যই তরকারি, লাবড়া আর চাটনি মাস্ট…
ওহ কাল আবার গোটা সেদ্ধর জোগাড় করতে হবে। স্কুলের সামনে চোখাচোখি হবার অপেক্ষা থেকে বাইকের পিছনে বসা হলুদ শাড়ি… বসন্ত পঞ্চমী থেকে বাঙালি ভ্যালেন্টাইন্স ডে, হৃদয়ের ভালোবাসার প্রকাশ বদলালেও কিছু ভালোবাসা আজও এক এবং অমলিন। ভোগ, প্রসাদ, গোটা সেদ্ধ আর দধি কর্মা। এই নিয়েই, শুভ হোক বসন্ত পঞ্চমী…
*মূল ছবি সৌজন্য: News18 Bangla
ভিতরের সব ছবি ও রান্না সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।
2 Responses
শ্রুতি দিদি, বড়ো বিপদে ফেললেন যে!! একেই তো CKD 4th. স্টেজে , হাজার টা নিয়ম কানুন ।এটা খাওয়া বারন, ওটা খেলেও সামান্য, এর মধ্যে এই সব খাবার প্রসঙ্গ মনটাকে দুঃখী করে দিল। কিন্তু হ্যা, বানিয়ে খাওয়াবো আমার ছেলে/ বৌমা/ নাতনি কে। স্ত্রী তো আছেই। অর্ডার করলেই হলো।
দারুণ লাগল । সজনে ফুলের ঝাল আর সাদা বোঁদে একেবারে নতুন item . খেতে-ই হবে ।