সেই কোন ছোট্টবেলায়… সকালে উঠে যদি একটু ল্যাদ খেয়েছি কি অমনি একদম কমল মিত্র স্টাইলে, “থাক থাক ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাক… ব্রাশ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে হবে!” সেই প্রথম পরিচয় জগন্নাথদেবের সঙ্গে।
ঠুঁটো জগন্নাথ কে? ফার্স্ট ইনফরমেশন, জগন্নাথ হল কৃষ্ণ ঠাকুর, আর তার হাত নেই! মায়ের কাছে বসে শুনলাম, কৃষ্ণ মারা যাবার পর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আমাদের ইঞ্জিনিয়ার ঠাকুর বিশ্বকর্মাকে বলেন মূর্তি গড়তে। বিশ্বকর্মা রাজিও হন। কিন্তু এক শর্তে! কেউ তাকে মূর্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিরক্ত করতে পারবে না! ওদিকে মাস যেতে না যেতেই রাজা আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। বিশ্বকর্মার ঘরের দরজা খুললেন! অমনি সব ফেলে উনি গায়েব! রাজার আফসোস, মূর্তি তবে অসম্পূর্ণ? গম্ভীর নির্ঘোষ হল আকাশ থেকে— উনি জগতের নাথ, কান ছাড়াও সমস্ত শুনতে পান, পা ছাড়াও সারা জগতে বিরাজমান… সমস্ত কিছু দিয়েই উনি সম্পূর্ণ!
এসব ম্যাজিক দেবতারাই পারেন! আমার কপালে স্রেফ বকুনিই!
তারপর, কোনও একদিন বাবার হাত ধরে গেলাম দুর্গাপুরের চিত্রালয় মেলা ময়দানে। শুনলাম: “এটা হল রথ, আর এই তিনজন জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা…।” প্রথম চাক্ষুষ পরিচয়। ওকে! দ্বিতীয় ইনফরমেশন, দুই ভাইবোন এই ঠাকুরের। একসঙ্গে মাসির বাড়ি যাচ্ছে, কী যে মজা ঠাকুরদের! নন্দীঘোষ নামের ইয়াব্বড় রথে চড়ে চললেন। ভাইবোনের আলাদা রথ আবার! বাবা কিন্তু বলল, আসলে উনি কংসের কুটিল ডাকে মথুরা যাচ্ছিলেন, সেই গল্প।
কুটিল জটিল গল্প থাক। তিন ভাইবোন মাসির বাড়ি যাচ্ছে, সেটাই মনে দাগ কেটে গেল। ওদিকে নাগরদোলা তখন হাত ছানি দিচ্ছে! রথের মেলা, মানেই নাগরদোলা, খাজার দোকান, হার চুড়ি মালা, হরেক মাল দু’টাকা তখন। পাঁপড় ভাজা আর অনেক মানুষ একসঙ্গে।

বেশ। আস্তে আস্তে ভাব হতে থাকল জগন্নাথদেবের সঙ্গে। নিজেরও রথ হল একদিন। সঙ্গে একটি ছবি, তিন ভাইবোনের…। সোজা রথ উল্টোরথ, পাড়ায় একটু রথ ঘুরিয়ে প্রণামী তোলা। কিন্তু সবাই বলে প্রসাদ কই? সেই তো! প্রসাদ ছাড়া হয় নাকি? মা বানাল, খাজা! আর পোড়া পিঠা! মার আদরের জগন্নাথ নাকি খুব পেটুক, বড্ড ভালবাসে নানান খাবার। খিচুড়ি, ডালমা হোক, বা হরেক মিষ্টি, লাড্ডু, পিঠা, গজা, খাজা, ছেনা পোড়া। বায়াসড হয়ে বলছি না, তবে ওই কথায় কথায় রেগে যাওয়া, শাপ দেওয়া দেবতাদের থেকে অনেকবেশি ভাল্লাগত জগন্নাথকে, সেই তখন থেকেই…
ময়দাতে প্রথমে এক চামচ ঘি আর তিন চামচ তেল ময়ান হিসেবে মিশিয়ে নিতে হবে, এমনভাবে যে হতে মুঠো করলে ড্যালা পাকে। অল্প জল দিয়ে দিয়ে মেখে নিতে হবে, রুটি পরোটার চেয়ে একটু শক্ত করে।
তারপর তার থেকে ছ’টা লেচি কেটে নিতে হবে। বেলতে হবে পাতলা আর বড় করে… রুটির মতো গোল করে। তারপর একটা রুটি নিয়ে তারওপর একটু ঘি ব্রাশ করে আর গুঁড়ো ময়দা ছড়িয়ে আর একটা রুটি চাপা দেওয়া হল। এরকম করে ছ‘ টা রুটি পরপর চাপিয়ে, হালকা হাতে ওপর থেকে একটু চেপে দিতে হবে। যেকোনো একটা ধার থেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে রোল করে নিয়ে, একদম শেষটা একটু জল লাগিয়ে সিল করে দিতে হবে। আর তারপর, ছুরি দিয়ে পৌনে এক ইঞ্চি মত গ্যাপে কেটে নিতে হবে, ছবিতে দেখানো যেরকম।

সেটা একটু হালকা চাপে বেলে নিলে রেডি, ভাজার জন্য। ওদিকে চিনি আর জল দিয়ে, এক শিরা চিনির রস রেডি করে রাখা, ঠান্ডা করে। এবারে একদম সিমারে ডুবো তেলে প্রায় মিনিট পনেরো ধরে খাজা ভাজতে হবে। বাদামি হলে, তুলে নিয়ে একটু ঠান্ডা হলে তবে চিনির রসে এ এপিঠ ওপিঠ করে ১৫-২০ সেকেন্ড রেখে তুলে নাও। ব্যাস, পুরো ঠান্ডা করে এয়ার টাইট কৌটোতে রাখো।
পোড়া পিঠা
কী কী লাগবে:
চাল গুঁড়ো/ চাল ভিজিয়ে বাটা – ২ কাপ
গুড়- ১ ১/২ কাপ
হাফ ছোট চামচ নুন
হাফ কাপ করে কাজু, কিসমিস, নারকেল কুচি
নারকেল কোরা হাফ কাপ
এলাচ, মৌরি গুঁড়ো এক চা চামচ করে
ঘি হাফ কাপ
জল প্রায় ৪-৫ কাপ
কীভাবে করব:
কড়ায় জল গরম করে গুড় মিশিয়ে গলিয়ে নিতে হবে। তারপর কাজু কিসমিস নারকেলটাও দিয়ে তাতে অল্প করে চালবাটা মেশাতে হবে, যাতে ড্যালা পেকে না যায়। অল্প অল্প করে সমস্ত চালবাটা আর বাকি সবকিছু মিশিয়ে নাড়তে থাকতে হবে মিডিয়াম আঁচে। ব্যাপারটা না শক্ত, না একদম কাদা কাদা হবে যখন, তখন নামিয়ে নিতে হবে আঁচ থেকে। কুকারের নীচে কলাপাতা গরম করে পেতে নিতে হবে, আর তারপর বেশ খানিকটা ঘি চারপাশে ভাল করে মাখিয়ে দিয়ে, ওই চালবাটার মিশ্রণটা ঢেলে দিতে হবে, বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে।

কুকারের ঢাকনার ওয়েটটা তুলে, একদম লো আঁচে বসিয়ে রাখতে হবে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক। তারপর একটা ছুরি দিয়ে চেক করে নিতে হবে রেডি কিনা, যেমন করে কেক চেক করি। ব্যাস, তারপর রেডি, জগন্নাথ দেবের প্রিয় পোড়া পিঠা। মন্দিরে অবশ্য এটা অতি কম আঁচে ১০-১২ ঘণ্টা ধরে করে, তারপর টুকরো করে ভেজে নেয়। আমরা বাড়িতে এটা ওভেনেও করতে পারি। সেক্ষেত্রে লোয়েস্ট টেম্পারেচারে ঘণ্টাখানেক।
জিলিপি, পাঁপড়ভাজা, খাজা, পোড়া পিঠা… সব নিয়ে দেখ তো এবারের রথ দারুন জমে ওঠে কিনা!
*সব ছবি ও রন্ধন সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।
One Response
Jai Jagannath..🙏🏻💝
Pora pitha khaja dekhe lov lagche..😍😋