অনেকক্ষণ ধরেই কানে আসছিল একটা হইহই রইরই। দূর থেকে। যেমন শোনা যায় পার্ক সার্কাসের দাঙ্গা বা সল্টলেকে চলমান বাসের নাকের ডগা দিয়ে ‘আমার কিছু হবে না’ ভেবে পার হতে গিয়ে ষোলো বছরের ছেলে চাপা পড়ার পর জনতার রোষের আওয়াজ! এতক্ষণ বৃতি কান দেয়নি। এমন তো শহরে সারাক্ষণই হচ্ছে। শব্দটা এগিয়ে আসাতে আর উপেক্ষা করতে পারল না। হাতে ঝোলানো ব্যাকপ্যাক পিঠে তুলে ঘুরে তাকাল।
বড় রাস্তার পাশে গা-এলানো সার্ভিস রোডে দুপুরবেলা লোকজন নেই। কলেজ কেটে বাড়ি ফিরছে বৃতি। পথ ছেড়ে একটা চায়ের দোকানের পাশে সরে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল পিছন দিকে। দোকানটার ঝাঁপ বন্ধ। রাস্তা দিয়ে দৌড়ে আসছে একটা ছেলে, পিছনে ধাওয়া করছে বেশ কিছু লোক। দুপুরের রোদ্দুর লোকগুলোর হাতের চেম্বার, রড, চপারে ঝিলিক তুলেছে। ছেলেটার বয়স বেশি না। কী করেছে কে জানে! এতগুলো লোক লাগে একটা বাচ্চা ছেলেকে ধরতে?
দু’সেকেন্ডের মধ্যে বৃতির পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। দারুণ দৌড়য় তো! লোকগুলো এসে পড়ার আগে দোকানের পেছনে প্রায় বুজে যাওয়া নালা থেকে একটা নাকা তুলে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিল বৃতি। তারপর দে ছুট, দে ছুট।
নাকায় আটকে পড়ে গালাগালের তোড় আসছে পেছন থেকে, হোঁচট খেয়ে কয়েকজন চিৎ পটাংও হয়েছে মনে হল। সামান্য হাসল বৃতি। বেশ হয়েছে! একটু যে সময় বেশি পেল, তাতে ছেলেটা পালাতে পারবে মনে হয়। আর ও নিজে? আর মাত্র কয়েকটা মোড়, তারপরই বাড়ি। চিন্তা নেই। ছেলেটা হাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু গলি অবধি পৌঁছবার সময় পেল না বৃতি। পেছনে দ্রুত পায়ের শব্দ– হাঁপানির ফোঁসফোঁস, গালির ফোয়ারা।
“সা—লি… খান—কি… ছা–ড়—বি… না! তিনো… আয় এ—দিকে… আ—মার… স—ঙ্গে…, বাকি–রা ওই হা–রামির বাচ্চাকে পা—কড়া…। কি—সে… আঙলি ঢুকিয়েছে জা—নে… না!”
গতি বাড়াল বৃতি। জন্তুগুলো পেছনে ধাওয়া করেছে! মা’র বকুনি মনে পড়ল। “যে কোনও পরিস্থিতিতে চিন্তাভাবনা না করে ঝাঁপিয়ে পড়েই একদিন বিপদ ডেকে আনবি। নিজের ওপর আস্থা থাকা ভালো, কিন্তু সেটা যেন ক্ষমতার বাইরে না হয়।” ক্ষমতা? নাঃ, অত সহজে বৃতিকে ধরা যাবে না। বাবা বলত, ‘মেয়ে আমার অলিম্পিকে যাবে।’
কলেজ কেটে বাড়ি ফিরছে বৃতি। পথ ছেড়ে একটা চায়ের দোকানের পাশে সরে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল পিছন দিকে। দোকানটার ঝাঁপ বন্ধ। রাস্তা দিয়ে দৌড়ে আসছে একটা ছেলে, পিছনে ধাওয়া করছে বেশ কিছু লোক। দুপুরের রোদ্দুর লোকগুলোর হাতের চেম্বার, রড, চপারে ঝিলিক তুলেছে। ছেলেটার বয়স বেশি না। কী করেছে কে জানে!
প্রাণপণে ছুটছে বৃতি। কী আশ্চর্য, এতক্ষণে ধাবমান লোকগুলোর অনেক পেছনে পড়ে থাকার কথা। কিন্তু পায়ের শব্দ তো পেছিয়ে যাচ্ছে না, বরং কাছে এগিয়ে আসছে! সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে বৃতি যাচাই করার চেষ্টা করল কী অবস্থা।
স্কুলে রানিং কোচ বলতেন, ‘দৌড়বার সময় কক্ষনও ঘুরে তাকাবি না।’ তেমনি করেই নাকি দৌড়বীর মিলখা সিং অলিম্পিক গেমস-এ দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ স্থানে ধপাস হয়েছিলেন। ব্যাস, মেডেল ফস্কা! কোচের ট্রেনিং ভুলে তাকাল বৃতি। তারপর বুঝল… গুরুজনে যা বলে, মঙ্গলের জন্যেই। তিনটে ছেলের দাঁতে সিগারেট আর পান-পরাগের ছোপ দেখতে পেল ও।
আরও গতি চাই, আরও! বৃতি কি ছোটবেলার সেই দুর্দান্ত বেগ হারিয়ে ফেলেছে? এখনও তো বন্ধুবান্ধবরা ওর সঙ্গে রেসে নামতে ভয় পায়। তবে এখন একটা হ্যান্ডিক্যাপ আছে। পিঠের ওপর। একবার ভাবল ছুঁড়ে ফেলে দেয় ওটা। তারপরই সজাগ হল, ব্যাগে ওর বাড়ির ঠিকানা টিকানা, আরও কত কী আছে। ওই শিকারিদের হাতে সেগুলো তুলে দিলে শুধু ওর নিজের নয়, বাড়ির সকলে নিরাপত্তা হারাবে। একটু গর্বও হল, এত টেনশনের মধ্যেও যুক্তিতে ঘাটতি হয়নি।
একটা সিমেন্টের হাত বৃতির হৃদপিণ্ড জোরে চেপে ধরেছে – বুকে হাওয়া ঢুকছে না। জঙ্ঘায় একটা ব্যাথা ক্রমাগত বাড়ছে। বৃতি জানে, পেশির অক্সিজেন ফুরিয়ে অ্যান-অ্যারোবিক পর্যায়ে চলে গেছে ওর শরীর। এই পথটা… আর কত… ল… ম… বা…? ডানহাতি গলিটাতে বাঁক নিল বৃতি। ঢুকেই বুঝল ভুল গলিতে ঢুকেছে। আরও দুটো মোড় পরে ওর বাড়ির গলি– ওর পাড়া। দুটোর মধ্যে ভেতর দিয়ে কোনওভাবে সংযোগ আছে কি? নাহলে… গলির শেষে পৌঁছে গেল ও।
একটা পাঁচিল। ডাইনে, বাঁয়ে– দু’হাত দিয়ে দ্রুত পরীক্ষা করল। নিরেট ইট দিয়ে তৈরি, গলি বন্ধ করা পাঁচিল। বেরবার রাস্তা নেই। দু’দিকে উঁচু উঁচু বাড়ির ছায়া পড়ে গলি আবছা অন্ধকারে। সব বাড়ির দরজা বন্ধ। একটা কলে পড়া ইঁদুরের মত আটকে গেছে বৃতি। তিনটে ছেলে গলির মুখে। ওদের হাপরের মতো নিঃশ্বাস টানার শব্দ পাঁচিলের প্রতিটি ইটে ধাক্কা খেয়ে ঘিরে ফেলছে বৃতিকে। ছেলেগুলো বুঝেছে আর দৌড়বার দরকার নেই– ধীর পায়ে এক জোটে এগিয়ে আসছে ওরা।
“ছ্যা – র্যা – র্যা – ছি…প…লি…ই-ই-ই-!”
“আরে মেরে সপনো কা বিমলি…ই-ই-ই-!”

সামনের ছেলেটার হাতে চপার নাচছে… ছেলেটা এগোচ্ছে। বাঁদিকের ছেলেটার হাতে পেঁচানো সাইকেলের চেন। তিনটে মুখ কেটে আঠালো হাসি লাফিয়ে পড়ল গলির পাথরে-– ঠন, ঠন, ঠন-ন-ন-ন-ন…! কাছের দরজাটায় বৃতি ধাক্কা দিল কয়েকবার। কেউ যদি দরজা খুলে ওকে ভেতরে ডেকে নেয়!
“নো-ও-ও বাডি হো-ও-ম… তেরি-ই-ই বাডি ইজ মো-ও-ও-ম…!”
দরজা খুলল না। দৃষ্টির তেলতেলে ফিতেগুলো সাপের মতো বুকে হেঁটে পেঁচিয়ে ধরছে বৃতিকে, ছোবল হানছে থেকে থেকে। হিস-স-স-স… দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাথার মধ্যে পাগলা ঘণ্টি বেজে চলেছে ঢং ঢং ঢং! শরীরের প্রতিটি পেশী কাঁপছে থির থির করে!
“হ্যাই, আমি সবসে আগে। তোরা পিছ্নে লাইন দে…”
“সে তুই হরবকৎ আগেই আছিস, গুরু! আমরা আছি… তুর পরে…”
আলো কি হঠাৎ কমে গেল? ছায়াগুলো লম্বা হতে হতে ছড়িয়ে গেল গলির পাথরে, বাড়ির দেয়ালে, ইটের পাঁচিলে। গলির মুখে দাঁড়িয়ে কিছু ছায়ামূর্তি, একের পর এক, জোড়ায়-জোড়ায়, তিনজনে, দশজনে…
খাদ্য সামনে, লোভাতুর ছেলেগুলো খেয়াল করল না। পেছনের ছেলেটা গেল সবচেয়ে আগে। স্যুট করে উঠে গেল দ্বিতীয়টা। গলা থেকে শব্দ বের করার সময় পেল না। প্রথমটা টেরই পেল না স্যাঙাতদের অনুপস্থিতি। ওর ঠোঁট থেকে বিষের শিশ বেরোল বৃতিকে লক্ষ্য করে – সুঁ…ই… সুঁ…ই… সট্…! প্রথমের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছায়া– একের পর এক, জোড়ায়-জোড়ায়, তিনজনে, দশজনে…। সঙ্ঘবদ্ধভাবে একশো শরীর এক বিশাল ডানামেলা শকুনের মতো বিছিয়ে গেল ওপর থেকে।
বিস্ফারিত চোখে দেখল বৃতি– ছিঁড়ে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল হাত-পা, বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। টুকরো টুকরো হয়ে ঠিকরে পড়ল চতুর্দিকে। যেমন হুস করে এসেছিল, তেমনি ভুস করে উঠে দাঁড়াল ছায়া ছায়া একশো নারী। শরীর থেকে মুছে গেল সংঘাতের চিহ্ন। এ ওর কপালে হাত দিয়ে সোজা করে দিল টিপ, আঙুল দিয়ে গুছিয়ে দিল অবিন্যস্ত চুল। গোলাপি শাড়ি সামলে, লম্বা আঁচল দুলিয়ে, হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে গেল গলি থেকে– একের পর এক, জোড়ায়-জোড়ায়, তিনজনে, দশজনে…।
গলির মুখে পৌঁছে শেষজন পিছন ফিরে একটা গরম চুমু উড়িয়ে দিল তখনও ইটের দেয়ালে সেঁটে থাকা, ভীত-ত্রস্ত বৃতির দিকে।
*ছবি সৌজন্য: istockphoto, homegrown.co.in
শমীতা দাশ দাশগুপ্ত অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, লেখক, এবং নারীকল্যাণ কর্মী। পাঁচ দশকেরও বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশীয় পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী সংস্থা, ‘মানবী’র (১৯৮৫) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ইংরেজিতে লেখা বইয়ের সংখ্যা পাঁচ। বাংলায় একটি রহস্যোপন্যাস (‘দ্বন্দ্ব,’ আনন্দ পাবলিশার্স), দু’টি রহস্য গল্প-সংকলন (‘মৃত্যুর মুখ চেনা’ ও ‘ছায়া জগতের গল্প,’ দ্য কাফে টেবিল প্রকাশনী), ও দু’টি কবিতার বই (আবর্ত প্রকাশনী) রয়েছে। এছাড়া তিনটি বই ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন। বেশ কিছু পত্র-পত্রিকায় গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা লেখেন।
One Response
Shamita di darun laglo. Onyo rokom. Taan taan lekha.