বক্তৃতা শেষ করতে গিয়ে মিস্টার পিলকিংটন অ্যানিম্যাল ফার্ম ও তার প্রতিবেশী খামারগুলির মধ্যে সম্প্রীতির ভাব বজায় রাখার ওপরেই গুরুত্ব দিলেন সব–চেয়ে বেশি৷ বললেন, শুয়োর ও মানুষের মধ্যে কোনোরকম স্বার্থের সংঘাত আগেও ছিল না, ভবিষ্যতেও হওয়া উচিত নয়৷ তাদের লড়াইয়ের ক্ষেত্র ও বাধা–বিপত্তিগুলো তো প্রায় একই ধরনের৷ যেমন, শ্রমিকদের নিয়ে সমস্যা— সেটা তো সব খামারেই একই রকম, নয় কি?
এ–বার মনে হল মিস্টার পিলকিংটন বেশ গুছিয়ে একটা সরস মন্তব্য করতে চলেছেন৷ কিন্তু কিছু বলবেন কী, কথাগুলো ভেবেই তিনি হেসে আকূল৷ হাসির দমকে তাঁর দুটো গালই একেবারে লাল হয়ে গেল। অবশেষে খানিক হেঁচকি তুলে তিনি বললেন, “আপনাদের যেমন নিম্ন–শ্রেণীর জন্তুদের নিয়ে মাথাব্যথা, আমাদেরও তেমনি নিচু–জাতের মানুষদের নিয়ে যন্ত্রণা৷“
পিলকিংটনের এই রসিকতায় হাসির রোল উঠল টেবিলে৷ অ্যানিম্যাল ফার্মে জন্তুদের যে কম খেতে দিয়ে ভালো মতো খাটিয়ে নেওয়া হয়— এ–জন্য পিলকিংটন আরও এক–প্রস্থ অভিনন্দন জানালেন৷ বললেন, তিনি এটাও খেয়াল করেছেন যে, এই খামারে জন্তুদের বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেওয়া হয় না৷
বক্তৃতা এখানেই শেষ। মিস্টার পিলকিংটন সকলকে নিজেদের–নিজেদের গেলাস ভরে নিতে অনুরোধ করে বললেন, “ভদ্রমহোদয়গণ, আমরা সকলে অ্যানিম্যাল ফার্মের সমৃদ্ধি কামনায় পান করি, আসুন৷“

ঘরের মধ্যে মহা উৎসাহে হই–হুল্লোড় শুরু হল৷ সঙ্গে মেঝেতে তুমুল পা–ঠোকাঠুকি৷ নেপোলিয়ন তো খুশিতে ডগোমগো হয়ে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে গেল মিস্টার পিলকিংটনের কাছে, তাঁর গেলাসের সঙ্গে নিজের গেলাসটা একবার ঠেকিয়ে নিতে৷ তার পরেই চোঁ–চোঁ করে সব পানীয় সাবাড়৷
ধীরে–ধীরে উল্লাসের তোড় কমে এল৷ নেপোলিয়ান দাঁড়িয়েই ছিল, জানাল যে, সে–ও দু–চারটে কথা বলতে চায়। তার বাকি বক্তৃতার মতো এটাও বেশ সংক্ষিপ্ত ও যথাযথ। নেপোলিয়ন বলল, এই ভুল–বোঝাবুঝির পর্ব মিটে যাওয়ায় সে নিজেও খুশি৷ দীর্ঘদিন ধরে গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে, তার ও তার সহকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গি হল বিপ্লববাদী ও নাশকতামূলক৷ নেপোলিয়নের ধারণা কোনও অপকারী শত্রুই এই গুজব ছড়ানোর কুকীর্তি করেছে৷ শুধু তা–ই নয়, আশেপাশের ফার্মের জন্তুদেরও না কি বিপ্লবী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে তারা— এমনটাও রটানো হয়েছে৷ এর চেয়ে বড় মিথ্যে কথা আর কী–ই বা হতে পারে! সে আগেকার সময়ই হোক বা বর্তমান কাল— এই খামারের একমাত্র লক্ষ্য সর্বদা শান্তিতে থাকা এবং প্রতিবেশী খামারগুলির সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখা৷ তাদের খামার আসলে এক সমবায় উদ্যোগ, যার পরিচালকের সম্মানজনক পদটিতে রয়েছে নেপোলিয়ন নিজে৷ যদিও শুয়োরেরা সকলেই এই খামারের মালিক৷ তার জিম্মায় থাকা দলিল–দস্তাবেজে তেমনটাই লেখাপড়া করা রয়েছে৷

নেপোলিয়ান আরও বলল যে, তার মনে হয় না কেউই আর এখন নিজেদের মনে সেই পুরনো অবিশ্বাসের ভাব জিইয়ে রেখেছে। তবুও পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতার ভাব আরও পোক্ত করে তুলতে খামারের কার্য–পরম্পরায় এখন থেকে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে৷ এতদিন পর্যন্ত এই খামারের জন্তুরা একে–অপরকে ‘কমরেড‘ বলে ডাকত৷ বড্ড বোকা–বোকা ব্যাপার! এটা বহু আগেই বন্ধ করা উচিত ছিল৷ আরও একটা অদ্ভুতুড়ে প্রথা রয়েছে এই খামারে, কীভাবে শুরু হয়েছিল তা কে জানে! সেটা হচ্ছে, প্রতি রবিবার সকালে বাগানের খুঁটিতে আটকানো একটা শুয়োরের খুলির সামনে কুচকাওয়াজ করা! এটাও বন্ধ করতে হবে৷ খুলিটা অবশ্য ইতোমধ্যেই কবর দেয়া হয়েছে৷ নেপোলিয়ন বলে চলল, দণ্ডের মাথায় আমাদের পতাকাটা কি আজকের অতিথিদের নজরে এসেছে? একটু লক্ষ করলে বুঝতে পারবেন আগে পতাকার গায়ে সাদা রং দিয়ে যে শিং আর ঘোড়ার খুর আঁকা থাকত, সে–সব মুছে ফেলা হয়েছে৷ আজ থেকে আমাদের নিশান কেবলই সবুজ পতাকা৷
তবে, পড়শি হিসেবে মিস্টার পিলকিংটন যে দুর্দান্ত বক্তৃতাটি দিয়েছেন তার মধ্যে থেকে সে মাত্রই একটি বিষয় পেয়েছে যা নিয়ে কিঞ্চিৎ সমালোচনা করা যায়৷ মিস্টার পিলকিংটন তাঁর পুরো বক্তৃতা জুড়েই এই খামারকে ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম‘ বলে উল্লেখ করেছেন৷ অবশ্য এ–ব্যাপারে তাঁকে বড় একটা দোষ দেওয়া যায় না৷ আসল ঘটনাটি তো তাঁর জানা নেই! জানবেনই বা কেমন করে— নেপোলিয়ন তো এইমাত্রই ঘোষণা করছে যে এই খামারের নাম আর অ্যানিম্যাল ফার্ম থাকছে না৷ এখন থেকে এর নতুন নাম হল ‘ম্যানর ফার্ম‘— যেটা তার মতে সব–চেয়ে যুক্তিযুক্ত ও প্রকৃত নাম৷
নেপোলিয়ন যোগ করল, “ভদ্রমহোদয়গণ, আর–একবার গেলাসগুলি ভর্তি করে নিন৷ আসুন, এ–বার একটু অন্যভাবে শুভ কামনা করি— ম্যানার ফার্ম দীর্ঘজীবী হোক!”

আবার সেই আগের মতোই হুল্লোড়৷ গেলাসগুলো দেখতে–দেখতে খালি হয়ে গেল৷ বাইরে থেকে যে–সব জন্তুরা উঁকি দিচ্ছিল, তারা তো একেবারে থ! যেন ওরা আশ্চর্য কিছু দেখছে৷ এমনকি শুয়োরদের মুখগুলোও কেমন যেন বদলে গেছে বলে মনে হচ্ছে! কিন্তু বদলেছেটা কী? বুড়ি ক্লোভার তার ঝাপসা চোখের দৃষ্টি ফেরাতে লাগল এক–শুয়োরের মুখ থেকে অন্য–শুয়োরের মুখে৷ তাদের কারও থুতনিতে পাঁচটা ভাঁজ, কারও চারটে, কারও বা তিনটে৷ কিন্তু আসলে ঠিক কোন জিনিসটা বদলেছে?
সময়ের সঙ্গে হইচই কমল৷ ঠিক যেখানে তাস খেলা থামানো হয়েছিল সেখান থেকেই আবার শুরু করা হল৷ জন্তুরাও ফিরে চলল নিঃশব্দে৷
কুড়ি গজ যেতে–না–যেতেই থমকে দাঁড়াতে হল ওদের৷ খামারবাড়ি থেকে উন্মত্ত চিৎকার ভেসে আসছে৷ তারা আবার দৌড়ে গিয়ে জানালায় চোখ লাগাল৷ যা ভেবেছে তা–ই। ভয়ানক ঝগড়া বেধেছে ভেতরে। কেউ চেঁচাচ্ছে, কেউ টেবিল চাপড়াচ্ছে, কেউ সন্দেহের চোখে অপরের দিকে তাকাচ্ছে, কেউ বা তীব্রভাবে কোনও–কিছু অস্বীকার করছে৷ যা বোঝা যাচ্ছে, নেপোলিয়ন ও পিলকিংটন দু‘জনেই একই সঙ্গে ইস্কাপনের টেক্কা খেলে ফেলায় এই ঝামেলা শুরু হয়েছে৷
বারোটা গলা রাগে গর্জন করছে, একটাকে অন্যটার থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না৷ শুয়োরদের মুখে কী বদল এসেছে— সে প্রশ্ন এখন অবান্তর। বাইরে দাঁড়ানো জন্তুরা একবার শুয়োরদের মুখ ছেড়ে মানুষের দিকে তাকাচ্ছে, আবার মানুষের মুখ ছেড়ে শুয়োরদের দিকে তাকাচ্ছে৷ কোনটা যে শুয়োর আর কোনটা যে মানুষ— সেটা এখন বলা একেবারেই অসম্ভব৷
অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।