হবে না-ই বা কেন! স্বাদে-বর্ণে-গন্ধে তিনি যে অনন্য! ফলের রাজা আমের মিষ্টি আয়োজনে
বাংলাদেশের বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী আফরোজ়া নাজ়নিন সুমি।
যেমন নামের বাহার, তেমন রঙের বাহার! গরমকালে অমৃতফলের কি আর তুলনা চলে অন্য কোনও ফলের সঙ্গে? গোলাপখাস দিয়ে শুরু হয়ে হিমসাগর, সিঁদুরে মেঘ, ল্যাংড়া, বেগমফুলি, আলফানসো, পিয়া পসন্দ, বাদশাভোগ… রকম কি একটা? আমের গন্ধে-রসে মন মজে না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া বিরল। বৈশাখের কাঠফাটা গরমও বাঙালি হাসিমুখে সয়ে নেয় আমের মুখের দিকে চেয়ে। জামাইষষ্ঠীতে মেয়ে-জামাইয়ের পাত ভরে আম না দিলে শাশুড়ির মন ওঠে না! নবনীতা দেবসেন-এর লেখায় (দেওয়ান-ই-আম> ভালো-বাসার বারান্দা>মে ২০০৮) পাই, তাঁর শ্বশুরমশাই আশুতোষ সেন শান্তিনিকেতনের প্রতীচী বাড়ি থেকে গরমকালে বেছে বেছে আম পাঠাতেন বন্ধুবর তথা বেয়াই নরেন্দ্র দেবকে। তাছাড়া নরেনবাবুর সঙ্গে বন্ধুতার সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন লালগোলার জমিদার, মহারাজ ধীরেন্দ্র নারায়ণ রায়। তাই ফি বছরেই লালগোলা থেকে উপহারস্বরূপ আসত ঝুড়িভর্তি আম। মুর্শিদাবাদের খাস নবাবি আম! যে সে কথা তো নয়! স্বাদ-গন্ধে তার জুড়ি মেলা ভার।
কাজেই আম-বাঙালির আম-ফান যুগে যুগে ষোলো কলায় বিকশিত হয়েছে। এ বছর অবশ্য ঝড়ের দৌলতে বড়ো বড়ো আমের গাছ কাঁচা আম-সহ উপড়ে যাওয়ায় আমের ফলন খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই শ্রাবণ মাস পড়ে গেলেও বাজারে এখনও আমের দাম আগুন। বিহার থেকে চৌসা, উত্তরপ্রদেশ থেকে দসেরি বা কর্ণাটক থেকে তোতাপুরীও এ বার বাজারে অমিল, লকডাউনের জেরে। তবু বাঙালি তো! গরমে আম নিয়ে একটু মাতামাতি না করলে যেন ভাত হজম হয় না। তাই বাঙালি রেস্তোঁরার মেনুতে আমের ছোঁয়া। গেরস্থালির হেঁশেল টক ডালের সৌরভে মাতোয়ারা। তাই বাংলালাইভও শেষপাত সাজিয়ে তুলেছে আমের মিঠাইতে। এ সব অবশ্য যে সে মিঠাই নয়, যাকে বলে রীতিমতো “এক্সপেরিমেন্টাল।” তাই মিঠাই বললেই যে চিরাচরিত সন্দেশ-রসগোল্লার কথা মনে পড়ে, এ তালিকায় সে সব নেই। রয়েছে আমের চিজ কেক, আম দিয়ে রাবড়ি, আমের ড্যানিশ এহেন নানা রকমের ‘ডেসার্ট।’ ঘরোয়া থেকে কেতাবি, সব ভোজের শেষপাতই জমকালো করে তুলবে আমের এইসব রেসিপি।
রেসিপি ১

ম্যাঙ্গো ক্রিম চিজ কেক উইথ ম্যাঙ্গো জেলি
উপকরণ
ক্রিম চিজ ৩০০ গ্রাম
দুধ ৫০ এমএল
গুঁড়ো চিনি দেড়কাপ
ফ্রেশ ক্রিম ১৫০ এমএল
আমের ক্কাথ ১ কাপ (দু’কাপ আমের ক্কাথে চিনি মিশিয়ে ফুটিয়ে নিতে হবে )
জেলেটিন সাড়ে তিন চা চামচ
বাদাম কুকি ১০-১২টা
মাখন ৫০ গ্রাম
ম্যাঙ্গো জেলি ১ প্যাকেট
প্রণালী: কুকিজ়গুলো গুঁড়ো করে গলানো মাখন দিয়ে ভালো ভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর ক্লিপ ওপেন ছোট ছোট কাপকেক ডিশে বাটারকাগজ লাগিয়ে তার উপর গুঁড়োটা বিছিয়ে দিয়ে রেফ্রিজারেটরে আধঘণ্টা রাখতে হবে। ক্রিম চিজ়ে দুধ মিশিয়ে বিটার দিয়ে বিট করে নিন। আস্তে আস্তে চিনি মিশিয়ে আবারও বিট করতে থাকুন। ফ্রেশ ক্রিম ফেটিয়ে নিতে হবে। এই ফেটানো ক্রিমটা ক্রিম চিজ়ের মিশ্রণে ভালো করে মিশিয়ে নিন। তারপর এতে আমের ক্কাথ মেশাতে হবে। গরম জলে জেলেটিন স্টিক দিয়ে ভালো করে গুলে নিতে হবে। এবার গোলাটা ক্রিম চিজ়ের মিশ্রণে মেশাতে হবে। এরপর এই সমস্তটা জমে যাওয়া কুকিজ়ের গুঁড়োর উপর ঢেলে দিয়ে আবারও রেফ্রিজারেটর রাখতে হবে ৫-৬ঘণ্টা। ম্যাঙ্গো জেলি বানিয়ে নিতে হবে প্যাকেটের নিয়ম অনুযায়ী। ম্যাঙ্গো জেলি ঠান্ডা হয়ে এলে জমে যাওয়া ক্রিমচিজ কাপ কেকগুলোর ওপরে ঢেলে দিতে হবে। আবার দু’তিন ঘণ্টা রেফ্রিজারেট করতে হবে। জমে গেলে ক্লিপ খুলে পাশের রিং সরিয়ে দিতে হবে। এ বার পছন্দমতো সাজিয়ে ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশন করুন!
রেসিপি ২

আমের শ্রীখণ্ড
উপকরণ
২৫০ গ্রাম দই
গুঁড়ো চিনি পরিমান মতো
১ কাপ ম্যাংগো পিউরি
২ টি এলাচ (গুঁড়ো করা)
পেস্তা ও আমন্ড কুচি
প্রণালী: প্রথমে দইটা একটা কাপড়ে বেঁধে ঘণ্টা দুয়েক ঝুলিয়ে রাখতে হবে, যাতে সব জলটা ঝরে যায়। এবার আমের খোসা ছাড়িয়ে পিউরি করে নিতে হবে। একটা বাটিতে আমের পিউরি, গুঁড়ো চিনি, জল ঝরানো দই খুব ভালো ভাবে মেশাতে হবে, যাতে কোনও দানা না থাকে। এর মধ্যে এলাচগুঁড়ো, পেস্তা, আমন্ডকুচি মেশাতে হবে। এবার ছোটো ছোটো বাটিতে ঢেলে দিয়ে উপরে পেস্তা ও আমন্ড কুচি ছড়িয়ে ফ্রিজে রেখে দিতে হবে ১ -২ ঘণ্টা। তারপর ফ্রিজ থেকে বের করে ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশন করুন!
রেসিপি ৩

আমের রাবড়ি
উপকরণ
দুধ ১ লিটার
কনডেন্সড মিল্ক ১/২ কাপ
খোয়া ১/২ কাপ
পাকা আমের পাল্প ১/২ কাপ
আমের টুকরো ১ কাপ
চিনি ১/২ কাপ
কাজু কুচি ৩ টে চামচ
প্রণালী: কড়াইতে দুধ দিয়ে ক্রমাগত নাড়তে হবে। সর পড়লে একপাশে সরিয়ে দিতে হবে ও ক্রমাগত নাড়তে থাকতে হবে। দুধ যখন অর্ধেক হয়ে আসবে, তখন খোয়া চিনি , কাজু কুচি দিয়ে আবারও নাড়তে হবে। তারপর কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে নেড়ে ফুটে উঠলে নামিয়ে আমের পিউরিটা দিয়ে নাড়তে হবে। ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে ওপরে আমের টুকরো দিয়ে পরিবেশন করুন।
রেসিপি ৪

ম্যাঙ্গো ব্লুবেরি ড্যানিশ
উপকরণ
পাফ তৈরি করার জন্য
- ময়দা ৭০০ গ্রাম
- মাখন ১০০ গ্রাম
- লবন ২ চা চামচ
- পানি ৫০০ মিলিলিটার
- মার্জারিন সাড়ে ৪০০ গ্রাম
- ব্লুবেরি জ্যাম বানানোর জন্য
- ব্লুবেরি ১৫০ গ্রাম
- চেরি ও ম্যাঙ্গো এক কাপ
- চিনি ১ কাপ
- গুড়া চিনি সাজানোর জন্য
- ডিম একটা
প্রণালী: পাফ তৈরি করার জন্য ময়দায় মাখন নুন এবং জল দিয়ে চার থেকে পাঁচ মিনিট ধরে মেখে নিতে হবে। মেখে রাখা ডো-টা ক্লিন রাপ করে ফ্রিজে রেখে দিতে হবে ১৫ -২০ মিনিট। ২০ মিনিট পর বের করে নিতে হবে। ডো-টাকে লম্বা করে চৌকো আকারে বেলতে হবে। এইবার মাঝখানে মার্জারিন দিয়ে দু’পাশ থেকে ভাঁজ করতে হবে। ভাঁজটা দেখতে অনেকটা বইয়ের মতো হবে। তারপরে বেলে নিতে হবে। এইভাবে পদ্ধতিটা পাঁচ থেকে ছ’বার করতে হবে। তারপর পরিষ্কার ফিল্ম দিয়ে মুড়ে ফ্রিজারে রেখে দিতে হবে। এইভাবে পাফ পেস্ট্রি শিট তৈরি করে ক্লিন ফিল্ম মুড়িয়ে তিন মাস পর্যন্ত ডিপ ফ্রিজে রেখে দেওয়া যায়।
ব্লুবেরি জ্যাম তৈরি করার জন্য ব্লুবেরিগুলোকে ছোট ছোট করে কেটে নিতে হবে। গ্যাসে প্যান বসিয়ে তার মধ্যে ব্লুবেরিগুলো দিয়ে দিতে হবে। এরপর এর মধ্যে চিনি দিতে হবে। যখন চিনি গলে ব্লুবেরির সঙ্গে ভালোভাবে মিশে যাবে, তখন নামিয়ে নিতে হবে।
এ বার পাফ পেস্ট্রি শিটগুলোকে ছোট ছোট চৌকো করে কেটে নিতে হবে। চারপাশটাও কেটে নিতে হবে। ভাঁজ করে পিনহুইল-এর আকার দিতে হবে। মাঝে ব্লুবেরি জ্যাম দিয়ে এবং তার উপর চেরি বসিয়ে দিতে হবে। তৈরি করে রাখার ড্যানিশ গুলোর উপর ডিম ব্রাশ করে ২০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় প্রি-হিট ওভেনে ১৫-২০ মিনিট বেক করতে হবে। বেক হলে ফ্রেশ ম্যাঙ্গো দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করুন।
ঢাকার ধানমন্ডির মেয়ে আফরোজা নাজনীন সুমি একজন সফল রন্ধণশিল্পী। তিনি একাধারে শেফ, জনপ্রিয় রন্ধণশিল্পী ও উপস্থাপক, রেসিপি ডেভেলপার, ফুড স্টাইলিস্ট, ট্রেইনার, খন্ডকালীন শিক্ষক,মহিলা সম্পাদক,ফ্রীল্যান্স ফটোগ্রাফার,অ্যামেচার মডেল এবং শৌখিন অভিনয়শিল্পী। সবকটি ভূমিকাতেই তিনি সমান স্বচ্ছন্দ।