কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই প্রকল্পগুলো বড়ই বিশ্রীভাবে ব্যর্থ হল। বুনো জন্তুদের পোষ মানানোর চেষ্টাটাই বলতে গেলে সবার আগে গেল ভেস্তে। তাদের আচার-ব্যবহার আগের মতোই রইল, কোনও হেরফের নেই। বরং তাদের সঙ্গে ভালোমানুষি করলে তারা আরও পেয়ে বসে। বিড়ালটা এই ‘বনের বন্ধু আবার শেখো’ সমিতিতে যোগ দিয়ে ক’দিন খুব কাজ-টাজ করল। একদিন দেখা গেল সে তার নাগালের বাইরে থাকা ক’টা চড়ুইয়ের সঙ্গে ছাদে বসে গল্প করছে। সে চড়ুইদের বলছে,
– আরে ভায়া সব পশুরাই তো এখন বন্ধু। চাইলে তোমাদের মধ্যে যে-কেউ এসে আমার থাবায় বসতে পারো।
তবুও চড়ুইরা কিন্তু যেমন দূরত্বে ছিল তেমনই রইল।
কেবলমাত্র পড়া আর লেখার ক্লাসগুলোই তুমুল সাফল্য পেল। দেখা গেল শরৎকালের মধ্যে ফার্মের প্রায় সব জানোয়ারই কিছুটা শিক্ষিত হয়ে উঠেছে। শুয়োররা যেমন ইতোমধ্যেই নিখুঁতভাবে পড়তে-লিখতে পারে। কুকুরগুলোও বেশ ভালোই পড়তে পারছে, তবে ওদের আবার সাত বিধান ছাড়া আর কিছুই পড়তে ইচ্ছে করে না। ছাগল মুরিয়েল কুকুরদের চেয়ে কিছুটা ভালো পড়তে শিখেছে। কোনও-কোনওদিন সন্ধের দিকে সে আবর্জনার স্তুপ থেকে তুলে আনা ছেঁড়াখোঁড়া খবরের কাগজের টুকরো থেকে বাকিদের পড়ে-পড়ে শোনায়। বেঞ্জামিন আবার লেখাপড়ায় শুয়োরদের মতোই পটু। তবে এ-কাজে কখনও সে নিজের শক্তি খরচ করতে চায় না। বলে, এতদিন পর্যন্ত যতটুকু জেনেছি তাতে মনে হয়েছে পড়াশুনো করার কোনও মূল্যই নেই।
ক্লোভার পুরো বর্ণমালাই শিখে ফেলেছে, কিন্তু শব্দ গঠন করতে পারে না। আর বক্সার তো বর্ণমালার ‘ডি’ অক্ষর টপকে ও-ধারেই যেতে পারেনি। সে ধুলোর ওপর তার বিশাল খুর দিয়ে এ, বি, সি, ডি লিখে ফেলে। তারপর কান দুটোকে পেছনে টানটান করে, কপালের সামনের চুলগুলো ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকিয়ে অনেক চেষ্টা করে পরে বর্ণগুলো মনে করার— কিন্তু বেচারা আর কখনওই সেগুলোর হদিস পায় না। সে যে পরের অক্ষরগুলো শেখার চেষ্টা করেনি, তা নয়। সে বেশ কয়েকবারই ই, এফ, জি, এইচ অবধি শিখে ফেলেছিল। কিন্তু যেই না সে পরের চারটে বর্ণ শেখে অমনি দেখা যায় সে আগের চারটে বেমালুম ভুলে গেছে। সে এক কাণ্ড!
আরও পড়ুন: মন্দার মুখোপাধ্যায়ের কলমে: খলিল জিব্রানের ‘দ্য প্রফেট’
অতঃপর বক্সার ঠিক করেছে সে শুধু প্রথম চারটে অক্ষরই মনে রাখবে। তার জন্য বক্সার প্রতিদিন দু-একবার সেই অক্ষরগুলো লেখে। মলি নিজের নামের ছ’টা অক্ষর বাদে আর কিছু শিখতেই চাইল না। সে গাছের ছোট-ছোট ডাল সাজিয়ে খুব পরিচ্ছন্নভাবে নিজের নামটা লেখে। তারপর একটা-দুটো ফুল নিয়ে তার আশেপাশে রেখে নামটার শোভা বাড়ায়। তারপর নিজের শিল্পকর্মে নিজেই মুগ্ধ হয়ে লেখাটাকে ঘিরে কয়েক-পাক ঘুরে নেয়। খামারের বাকি জানোয়ারদের মধ্যে আর কেউই ‘এ’-র বেশি এগোতে পারল না। ভেড়া, মুরগি বা হাঁসেদের মতো বোকা জন্তুরা তো আবার সাতটা বিধানও মুখস্ত করতে পারল না। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে স্নোবল ঘোষণা করল এখন থেকে ‘সাত বিধান’-কে কাটছাঁট করে একটিমাত্র বাণীর আকার দেয়া হবে। সেটা হল— ‘চারপেয়েরা ভালো, দু’পেয়েরা খারাপ।’ এই একটি বাক্যের মধ্যেই নাকি পশুবাদের মূলমন্ত্র ধরা রয়েছে। যে এই কথাটাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারবে, তার ওপর মানুষ আর কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না।
পাখিরা প্রথমে আপত্তি জানিয়েছিল। তাদেরও তো দুটোই পা। তখন স্নোবল তাদের বোঝাল যে, ব্যাপারটা তেমন নয়। স্নোবল বলল, “কমরেডস, পাখির ডানা কেবলমাত্র ওড়ার কাজেই লাগে, আর কোনওরকম কুকীর্তি করতে এই ডানা ব্যবহার করা যায় না। তাই ডানাগুলোকেও এক একটা পা হিসেবেই ধরা যেতে পারে। মানুষের হাতের ব্যাপার আলাদা— সেগুলো আসলে বিভিন্ন রকমের বদমায়েশি করার যন্ত্রবিশেষ।” পাখিরা এই লম্বা-চওড়া ভাষণের কিছুই বুঝল না বটে, তবে তারা স্নোবল-এর ব্যাখ্যাটা মেনে নিল। স্বল্পবুদ্ধি প্রাণীরা সেই মূলমন্ত্র মুখস্থ করতে লেগে পড়ল। গোলাবাড়ির পেছনের দেয়ালে সাত বিধানের মাথার ওপর বড়-বড়-হরফে লিখে দেয়া হল ‘চারপেয়েরা ভালো, দু’পেয়েরা খারাপ’।
ব্যাস। মুখস্ত হতে যতক্ষণ। ভেড়াদের যেন দুরন্ত ভালোবাসা জন্মে গেল কথাগুলোর ওপর। মাঝে-মাঝেই মাঠে শুয়ে থাকতে থাকতে তারা সবাই মিলে ভ্যা ভ্যা করে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘চারপেয়েরা ভালো, দু’পেয়েরা খারাপ’। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা এভাবেই তারা চ্যাঁচাতে থাকে, ক্লান্ত হয় না। স্নোবল-এর এসব সভাসমিতির ব্যাপারে নেপোলিয়নের খুব একটা আগ্রহ নেই। তার কথা হল, যারা বড়ো হয়ে গেছে তাদের বদলে যারা ছোট, তাদের পড়াশুনো শেখানোর ওপরেই বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। খড় কাটার পরে পরেই জেসি আর ব্লুবেল দু’জনে ন’টা সুস্থ-সবল কুকুরছানার জন্ম দিল। বাচ্চাগুলো মায়ের দুধ ছাড়তে না ছাড়তেই নেপোলিয়ন এসে তাদের নিয়ে চলে গেল। বলল, এখন থেকে এই বাচ্চাদের পড়াশুনোর সমস্ত দায়িত্ব সে নিজেই নিচ্ছে।
কুকুরগুলোও বেশ ভালোই পড়তে পারছে, তবে ওদের আবার সাত বিধান ছাড়া আর কিছুই পড়তে ইচ্ছে করে না। ছাগল মুরিয়েল কুকুরদের চেয়ে কিছুটা ভালো পড়তে শিখেছে। কোনও-কোনওদিন সন্ধের দিকে সে আবর্জনার স্তুপ থেকে তুলে আনা ছেঁড়াখোঁড়া খবরের কাগজের টুকরো থেকে বাকিদের পড়ে-পড়ে শোনায়। বেঞ্জামিন আবার লেখাপড়ায় শুয়োরদের মতোই পটু। তবে এ-কাজে কখনও সে নিজের শক্তি খরচ করতে চায় না। বলে, এতদিন পর্যন্ত যতটুকু জেনেছি তাতে মনে হয়েছে পড়াশুনো করার কোনও মূল্যই নেই।
নেপোলিয়ান সেই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে গিয়ে আস্তাবলের চিলেকোঠায় রেখে এল। ঘোড়ার সাজঘরের ভেতরে রাখা মইয়ে চড়ে তবেই সেখানে পৌঁছনো যায়। সে বাচ্চাগুলোকে এমন আলাদা করে রাখল, যে বাকিরা কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের কথা বেমালুম ভুলে গেল। গোরুর দুধ রোজ রোজ কোথায় হাপিস হয় সেটাও জানা গেল খুব শিগগিরই। প্রত্যেকদিন তা মেশানো হয় শুয়োরদের খাবারের সঙ্গে। মরসুমের প্রথম আপেলগুলো সব পাকতে শুরু করেছে। হাওয়া দিলেই সেগুলো টুপটাপ খসে পড়ে, ফুলবাগানের ঘাসজমিতে ছড়িয়ে থাকে। সবাই ভেবেছিল আপেলগুলো বোধহয় সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ হবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। একদিন হুকুম জারি হল যে, সেই ছড়িয়ে থাকা আপেল সংগ্রহ করে আস্তাবলের সাজঘরে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। সেগুলো কেবলমাত্র শুয়োররাই খাবে। এ-নিয়ে কিছু জানোয়ার একটু গজগজ করল বটে, তবে তাতে লাভের লাভ কিছু হল না। দেখা গেল সব শুয়োরই এ-বিষয়ে এককাট্টা। এমনকি স্নোবল আর নেপোলিয়নের মধ্যেও কোনও মতবিরোধ ঘটল না।
পুরো ব্যাপারটা সবাইকে ভালো করে বুঝিয়ে বলার জন্য স্কুইলারকে পাঠানো হল। স্কুইলার বলতে শুরু করল,
“কমরেডস, আশা করি তোমরা আমাদের স্বার্থপর বা সুবিধেবাদী ভাবছ না। আমাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু দুধ বা আপেল খেতে পছন্দ করে না। আমি নিজেও অপছন্দ করি। তবুও যে আমরা এই দুধ বা আপেল খাচ্ছি তার মূল উদ্দেশ্য একটাই— নিজেদের স্বাস্থ্য ধরে রাখা। কমরেডস, বিজ্ঞান প্রমাণ করে দিয়েছে যে দুধ আর আপেলে এমন কিছু পদার্থ আছে যা আমাদের শরীর মজবুত রাখার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমাদের তো সবসময় মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হয়, এই খামারের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা বা সংগঠনের কাজ আমাদের উপরেই নির্ভর করছে। দিন-রাত এক করে আমরা কেবলই তোমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর রেখে চলেছি। বলতে গেলে তোমাদের স্বার্থেই আমাদের এই দুধ আর আপেল খেতে হচ্ছে। কখনও কি ভেবে দেখেছ যদি আমরা নিজেদের কাজ ঠিকমতো করতে না-পারি তাহলে কী হবে? জোন্স আবার ফিরে আসবে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। জোন্স ফিরে আসবেই আসবে, কমরেডস।”
নিজের শরীরটাকে এপাশ-ওপাশ দুলিয়ে লেজ নাড়তে-নাড়তে রীতিমতো ওকালতি করার ভঙ্গিতে স্কুইলার বলল, “তোমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কেউ নেই যে চায় জোন্স ফিরে আসুক।” এখন ঘটনা হচ্ছে, জোন্স ফিরে আসুক সেটা কেউই চায় না। এ ব্যাপারে কারও কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং স্কুইলার যখন ঘটনাটাকে এদিকে ঘুরিয়ে দিল তখন তাদের আর কিছুই বলার রইল না। শুয়োরদের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখাটাই এখন সবচেয়ে জরুরি, এ নিয়ে আর তর্ক-বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই। সবাই একমত হল যে, এখন থেকে দুধ আর বাতাসে ঝরে পড়া আপেল এবং পরবর্তীকালে গাছপাকা সমস্ত আপেল কেবলমাত্র শুয়োরদের জন্যই বরাদ্দ থাকবে।
অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।