১
সোহমের ফ্রেঞ্চ কাটটা খুব স্টাইলিশ। আবার একটা পনিটেল রেখেছে দেখলাম। ছবিটা সেভ করে জুম করে দেখেছিলাম যতটা ফোনে অ্যালাও করে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছি! ফ্রেঞ্চ কাটের মধ্যে বেশ কয়েকটা সাদা। বুড়োচ্ছিস তাহলে বল? মাথার কয়েকটা চুল আবার খয়েরি কেন রে? কালার করেছিস? এবার তুই আয়। কেমন আওয়াজ দেব দ্যাখ। বয়স কি এ ভাবে আর লুকিয়ে রাখা যায় বস্? ওই ফেসবুকের ছবিগুলোতে ব্যাকগ্রাউন্ড ঝিনচ্যাক ছিল আমি জানি। পিছনে একশো দেড়শোতলা বাড়ি। কিংবা ফ্রেমজোড়া জলপ্রপাত। আমি বাকি পাঁচশ বিরানব্বই জনের মতো ওয়াও টোয়াও লিখে কমেন্ট করিনি। ক্যাশের বান্ডিল গোনার মতো করে ফোনের স্ক্রিনটাও স্ক্রল করিনি। তোকেই দেখছিলাম। আসবি জানার পর থেকে আরও বেশি করে।
সতেরো বছর। হ্যাঁরে, বাংলাটা এখনও আসে তো ঠিকঠাক? নাকি পুরোপুরি সাহেব হয়ে গিয়েছিস? সতেরো বছরের কোলাকুলি কিন্তু এ বারে একসঙ্গে, একবারে হবে ভাই! তোর বাড়ি যাব। শুনলাম রাজারহাটে কি একটা হাইটস-এ ফ্ল্যাট কিনেছিস। কাকু-কাকিমাকেও দেখি না কত বছর।
আসছিস তো দেবমাল্য? স্কুল ছাড়ার পর মাঝখানে শুধু একবারই দেখা হয়েছিল। তোর হয়ত মনে নেই আর। একটা মাঝারি মাপের রাস্তায়, পিছন থেকে কি হর্নটাই না মারছিলি। কাচের ভিতর থেকে খিস্তিও দিচ্ছিলি হয়ত। ঘুরে দেখি, তুই। এয়ারপোর্ট যাচ্ছিলি বলে গাড়ি থেকে আর টেনে নামাইনি তোকে। অটোমেটিক কাচটা নামল। তুই বললি, ‘আরে, মৈনাক, তুই?’ আমার তো কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতলের ছিপি খোলার মতো কথা আসছিল মুখে, সারা শরীরে। তুই বললি, ‘ফ্লাইট আছে রে, অলরেডি লেট। আর এক দিন কেমন?’ আমি তোর কাঁধে হাত রাখার আগেই কাচটা উঠে গিয়েছিল ফের। কি কান্ড দ্যাখ! আর কথাও হল না। দেখাও হল না। এত বছরের গল্পগুলো জমে আছে রে। শুধু একবার আয়।
আমি তো রোজই স্কুলের পাশ দিয়ে যাই, জানিস। ভুল বললাম। রোজ না। মাঝেমধ্যে। ওই এরিয়ার দোকানের অর্ডার তুলতে যেতে হয়। এক এক দিন তো এক একটা এলাকা আমার। দোকানে যাই। অর্ডার তুলি। কার্ড সোয়াইপ করার মেশিনের মতো দেখতে একটা যন্ত্রে রিকুইজিশনগুলো পাঞ্চ করি। ডিস্ট্রিবিইউটারের কাছে সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় সেগুলো। কয়েকদিন পরে ডেলিভারি দেওয়ার সময় আবার ডিস্ট্রিবিউটারের ছোট ম্যাটাডরে। স্কুলের পাশ দিয়ে গেলে তাকাই। তিনতলায় বারান্দার পাশের জানালাটা দেখি। ওইখানেই তো আমাদের ক্লাস নাইন। ক বিভাগ। মানে এ সেকশন। দোতলার মাঝামাঝি ওই ঘরটা। আমাদের ক্লাস সেভেন। খ বিভাগ। মনে পড়ে। ঘাড় উঁচু করে তাকালে কয়েকটা মাথাও দেখতে পাই। আমাদের তখনকার মতো ওরাও হয়তো এখন ভাবছে বড় হব কবে। আর বড় হয়ে যাওয়ার পরে, প্রতি দিন ঘষটাতে ঘষটাতে আমি এখন ভাবি, ছোট হব কবে। ইস, আর একটা বারের জন্য যদি ছোট হয়ে যাওয়া যেত ফের। স্কুলে ঢুকতে ইচ্ছে করে। অমিতাভ স্যার, তপন স্যার, বিমান স্যার। লজ্জা লাগে। ঢুকতে পারি না। স্যারেরা যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘কি করছিস এখন?’ মাথাটা একেবারে হেঁট হয়ে যাবে রে। কী যে বলব। দোকানে দোকানে ঘুরি আর অর্ডার তুলি স্যার। ওঁরা জিজ্ঞেস করবেন, ‘ও তাহলে তো তুমি সেলস-এ আছ।’ হ্যাঁ, হ্যাঁ সেলসই তো। সব সত্যি জানতে নেই। আমার জামার কলারটা জানে। জুতোর সোলটা জানে। পে স্লিপটা জানে। সে তো স্যারেদের সামনের ব্যাপার। তোদের কাছে লজ্জা কি!
মাস দু’য়েক আগে হোয়্যাটসঅ্যাপে ডিস্ট্রিবিউটর, মানে মালিকের ‘কিতনা পাঞ্চ হুয়া? ঝুট মত বাতানা, নিকম্মা কহিঁকা’ মেসেজটার উত্তরে কী লিখব ভাবছিলাম যখন, তখনই ওই অ্যাপে একটা গ্রুপ ক্রিয়েট হয়ে আমাকে বলল, ইউ আর অ্যাডেড। দেখলাম, রিইউনিয়ন ২০২০ বলে একটা গ্রুপে ঢুকে পড়েছি আমি। মানে আমাকে ঢোকানো হল। দেখলাম অভীক তৈরি করেছে গ্রুপটা। ও সফটওয়্যারে আছে। সেক্টর ফাইভে ষোলোতলা অফিস। উল্টোডাঙার মোড়ে বছরখানেক আগে দেখা হয়েছিল যখন, নম্বরটা নিয়েছিল। তার পরে দেখি অনেকগুলো নম্বর অ্যাড হতে শুরু করল ওই গ্রুপে। প্লাস ওয়ান দিয়ে দু তিনটে নম্বর। এর মানে তো আমেরিকা। ষোলো টাকা প্রতি মিনিট।
শখ করে একটা ট্র্যাভেল অ্যাপ ডাউনলোড করে একবার কলকাতা টু নিউ ইয়র্ক সার্চ দিয়েছিলাম। যাতায়াত বলল একাশি হাজার টাকা। বাবারে বাবা। অত টাকা খরচা করেও কেউ ঘুরতে যায়! ওই প্লাস ওয়ান লেখা নম্বরটায় টাচ করে দেখলাম, লেখা আছে সোহম দ্য উইনার। ঠিকই তো, তুই তো উইনারই। স্যুট পরা একটা ছবি। ফ্রেঞ্চ কাট। ফেসবুকে দেখি তো তোকে। সোহম মুখার্জী ট্র্যাভেলিং টু মিউনিখ ফ্রম সান হোসে। কিংবা সোহম মুখার্জী ফিলিং ফেস্টিভ ইন দ্য ম্যাজিক পাব, মিলান। ডিস্ট্রিবিউটার লিখল, “শালা সো রহে হো ক্যায়া?” কুড়ি বাইশটা নম্বর ওই গ্রুপটাতে অ্যাড হয়ে যাওয়ার পরই শুরু হয়ে গেল, গাইজ, সারপ্রাইজ। সবাই কেমন আছিস, ডিউড? একটা একটা করে নম্বর ছুঁয়ে ওদের নামগুলো দেখতে থাকি। এত বছর এক সঙ্গে বসা কল্যাণ, দেবমাল্য, মনোজিৎ, অনীশ, শুভঙ্কর, শিলাদিত্য। ক্লাস ঘরগুলো হঠাৎ বমি করতে শুরু করে দিল কত স্মৃতি।
মনোজিতের বাবা মিউনিসিপ্যালিটির কনট্র্যাক্টর ছিলেন। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম, ফলস সিলিং। ফ্যান ঘোরার জায়গাটার পিছনে প্লাস্টারের এমব্রয়ডারি। সুখের কারুকাজ সারা বাড়ি জুড়ে। আমাদের ভাড়া বাড়ির ফ্যানের ব্লেডের সঙ্গে লেগে থাকত কিছু অভাবি ঝুল। আজও থাকে। ফ্যান ঘোরার ঘড়ঘড় আওয়াজটা যেন কোনও শেষ বয়সের লোকের বিনা চিকিৎসার বুক ধড়ফড়। তখনও যেমন, আজও তেমন। মনোজিতের পেনসিল বক্সে ভর্তি থাকত নানা রঙের জেল পেন। জেল পেন প্রথম বাজারে এসেছিল তখন। মনে আছে, পঁচিশ টাকা করে দাম ছিল প্রতি পিস। একটা পেন মানে আমার তিন-চার দিনের টিফিন খরচ। ওর পেনসিল বক্স থেকে একটা নতুন পেন নিয়ে যখন নিজের নাম লিখছিলাম আমার হোমটাস্কের খাতায়, মনোজিৎ বাথরুম থেকে ফিরে আমায় দেখতে পেয়ে নাকে ঘুষি চালিয়ে দিয়েছিল দুম করে। রক্ত পড়েছিল। মনোজিৎ বলেছিল, ‘তোর বাপকে বলিস হিম্মৎ থাকলে জেল পেন কিনে দিতে। শালা চোর।’ আমি চুপ করে ছিলাম। মনোজিৎ আজ একটা এফএমসিজি কোম্পানির সেলস হেড। মুম্বইতে থাকে। ভুলে গিয়েছি ভাই। কিচ্ছু মনে নেই আমার ওসব স্মৃতি। আমি গরিবের বাচ্চা, গরিবই রয়ে গেলাম। তোর ভাল মানে তো আমারও ভাল। অনেক গল্প জমে রয়েছে, অনেক। কল্যাণ, তোদের অবস্থা তো আমাদেরই মতো ছিল। মহাদেবদার দোকানে দুটো লুচি আর আলুর দম ভাগ করে খেয়েছি কত দিন, মনে আছে? শুধু তোর চোখদুটো আমার মতো ফ্যাকাশে ছিল না। তোর চোখের তারায় তুবড়ির আলো ছিল। উচ্চাশার। স্বপ্নের। কী যে ম্যাজিক করে দিলি মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যামিক, জয়েন্টে। এর পর বড় কলেজের ম্যানেজমেন্ট। আজ বেজিং, কাল সিঙ্গাপুর। হায়ার সেকেন্ডারিতে তোর ওয়ান থার্ড নম্বর পেয়ে ফাঁকা ক্লাসঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে কান্না চাপছিলাম যখন, তুই বুকে জড়িয়ে বলেছিলি, ‘আমরা বন্ধু না? কাঁদবি না একদম। ভাল হলে জীবনে সবার এক সঙ্গে ভাল হবে। খারাপ হলে খারাপ।’ জীবনের এগনো পিছনো নিয়ে অত বুঝতাম না তখন। ভাগ্যিস। আজ বুঝি। বোঝাটা নিজের বাঁচার জন্য জরুরি।
২
কী সুন্দর সাজিয়েছে স্কুলটা! আমাদেরটা তো আর হিন্দু-হেয়ার নয়। উত্তর শহরতলির একটা সাধারণ স্কুল। এরকম স্কুলে রিইউনিয়ন হয় না। মনে পড়ে গেল, এই কথাটার বাংলাটা খুব সুন্দর। পুনর্মিলন। যেন একটা মিষ্টি ফুলের উপরে অনেকগুলো বাহারি প্রজাপতি। স্কুলের মধ্যে থেকে ভেসে আসছে সানাইয়ের হাল্কা আওয়াজ। সতেরো বছর। সতেরো বছর মানে কতগুলো মাস? আজ মাসের ঊনতিরিশ তারিখ। রবিবার। এ মাসে ভাল অর্ডার তুলতে পারিনি বলে আমার ছুটি বাতিল হয়ে গিয়েছে আজ। এই অনুষ্ঠানের কথা শুনে ডিস্ট্রিবিউটর একটা চার অক্ষর দিয়ে বলল, “কুত্তা কহিঁকা।” দেবমাল্য, অনীশ, শুভ— তোদের জন্যই এসেছি। আমার ফেলে আসা ক্লাসরুম, ফেলে আসা বেঞ্চ, আরও একবার যদি নতুন করে শুরু করতে পারতাম..। সোহম, শিলা, আজ অনেক ছবি তুলব কেমন? অনেক। কালকে ডিস্ট্রিবিউটারকে দেখাব। বলব, “দেখুন স্যার, আমার এই বন্ধু ভিপি, এই যে আমার কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেলস হেড। আপনি আমায় ছোট করতে পারেন, আসলে আমি কিন্তু এত ছোট নই।” বলার সময় বুকের মধ্যে ট্রাম্পেট বাজবে আমার।
ওই তো সোহম!
আরে, ওই তো কল্যাণ!
ওরা ঘিরে রয়েছে হেডমাস্টারমশাইকে। শুভঙ্কর, অনীশ, দীপাঞ্জনরাও আছে। আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয়। বন্ধু, কি খবর বল? পল্, ইয়ে হ্যায় প্যার কা পল্। এত গানের লাইন আমার ভিতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে কেন? আমার এত সুর? ইয়ে দোস্তি, হাম নেহি তোড়েঙ্গে। সোহম আমায় দেখল। শুভঙ্করও। আমি ছুট্টে আসতে শুরু করতেই সোহম হাত দেখাল। সিগনাল ছাড়া রাস্তার মোড়ে যেমন দুম করে হাত দেখিয়ে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। সোহম হাত দেখাতেই একই রকম ভাবে হাত উঁচিয়ে দিল অনীশও। ঠিক আছে। হয়তো কোনও প্রাইভেট কথা বলছে হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। ওরা তো অনেকেই বাইরে থাকে। হেডমাস্টারমশাই দূর থেকে আমাকে দেখে মুচকি হাসলেন একবার। ঠিক হাসি নয়, হাসির রেখা যেন। ঠিক আছে। আমাকে নিশ্চয়ই উনি সময় দেবেন পরে। আমি সিওর, আমায় উনি চিনতে পেরেছেন।
তিন তলার করিডরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আমি অপেক্ষা করতে থাকি। আর দেখতে থাকি বন্ধুদের। দীপাঞ্জন আজ মুম্বইয়ের একটা মস্ত বড় হাসপাতালের ডাক্তার। হার্টের মনে হয়। স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ডক্টর লেখা চকচকে নীল গাড়িটা তা হলে নিশ্চয়ই ওর। এর মানে দীপাঞ্জনের দুটো গাড়ি, একটা বোম্বেতে, আর একটা এখানকার জন্য। বাবারে বাবা। ওর কাঁধে হাত রেখেও একটা ছবি তুলব আজ। ডিস্ট্রিবিউটারকে দেখাব। গ্রুপ ছবি তুলতে হবে বেশ কয়েকটা। আবার কবে ওদের দেখব কি জানি। আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখব। আবার গান। কী যে হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। বন্ধুদের সঙ্গে নিজের মনের ক্যামেরাতেই পর পর ছবি উঠতে থাকে আমার।
ওই তো ওরা আসছে। এক সঙ্গে। দল বেঁধে। হেডমাস্টারমশাই স্টাফ রুমে ঢুকে গেলেন। সোহম কি একটা বলতে বলতে আসছিল। আমার দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলে উঠল, “কি রে?” তারপরেই আবার পুরনো কথায় ফিরে গেল। ও বলছে, “গ্রুপ ডিনারটা কোথায় করি বল তো? নভোটেল আর হায়াতের মধ্যে কোনটা বেটার এনি আইডিয়া?”
ওরা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায়। তার মানে আজ নিশ্চয়ই আমাদের সবার ডিনার বাইরে। আমিও চলতে শুরু করি পিছন পিছন। শুভঙ্কর বলছে, “বাই পাসে আরও বেটার অপশন পাবি ব্রো।” আমি বলে উঠি, “রাতের কথা রাতে। এখন চল না মহাদেবদার দোকানে। লুচি আলুর দম খেতে ইচ্ছে করছে ভীষণ।” কল্যাণ বলে ওঠে, “রাবিশ।” আমার দিকে অবাক চোখে তাকায়। ও তাকালে সবাই তাকায়। মনোজিৎ বলল, “নিজের স্ট্যান্ডার্ডটা আর কবে বাড়াতে শিখবি তুই? জেল পেন কিনতে পেরেছিস চাকরি পাবার পরে?” এটা শুনে অভীক খ্যাক খ্যাক করে হাসতে শুরু করে। বলল, “ওরে আমার মিডল ক্লাস চাঁদু রে। একটু পায়ের ধুলো দিস। মহাদেব দা, হা হা হা।”
ওরা মজা করছে। বন্ধুরা তো মজা করবেই। বন্ধুদের কাছে লজ্জা কি। আমি বলে উঠি, “তোরা না, যাতা।” অনীশ বলল, “আর তুই?” বলে ওরা আবার নিজেদের মধ্যে হাসতে শুরু করল। সে হাসুক গে। বন্ধুরা হাসবে না তো কারা হাসবে? আমার ডিস্ট্রিবিউটর? আমি বললাম, “সোহম, অ্যাদ্দিন পরে দ্যাখা, গ্রুপ ফটো তুলব না?” সোহম বলল, “নিশ্চয়ই তুলব ব্রো।” সবাই হল্লা করল, “ইয়েস, তুলব, তুলব, তুলব।” কল্যাণ বলল, “টুয়েলভ-এর ঘরে যাই? আমাদের টার্নিং পয়েন্ট।” আমি বললাম, “এত বছর এক সঙ্গে থাকার পরে ওটাই তো আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘর।” দেবমাল্য আমার থুতনিটা ধরে বলল, “হাউ নস্ট্যালজিক।” বলে আবার হাসতে লাগল।
কেমন যেন তাল কেটে যাচ্ছে আজকে। একটার পর একটা না-জানা প্রশ্ন। পরীক্ষার হলে পেন কামড়ানোর মতো। এক বাটি তেলের মধ্যে যেন দু’ফোঁটা জল। হয়তো আমারই বোঝার ভুল। আর গান আসছে না কেন? সবাই হই হই করতে করতে টুয়েলভ-এর ঘরে যায়। আমিও যাই। সবার পিছনে। এই তো, এ বারে ছবি উঠবে। অনেক ছবি। সোহম বলল, “ডিউড, একটা ইউনিক কনসেপ্টে গ্রুপ ফটো নেব আজ। সিটিসি ফিফটি ল্যাকস অ্যান্ড অ্যাবাভ গ্রুপের একদম মাঝখানে থাকবে। টুয়েন্টি টু ফিফটি আমার চার পাশে।” বলে হাঃ হাঃ করে হাসতে হাসতে নিজেই সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। হাতটা দুদিকে ছড়িয়ে দেয় টাইটানিকের ডেকে জ্যাক-এর মতো। চুম্বকের টানে আলপিন যেমন আসে, তেমন ভাবে সবাই লেগে যায় সোহমের গায়ে। আমি ছাড়া, সবাই। দীপাঞ্জন বলে ওঠে, “নেক্সট ইয়ার গুরু আমি মাঝখানে থাকব।” মনোজিৎ বলে, “হাঃ হাঃ। আর আমি?” ওদের সবার হাসি কেমন যেন মহিষাসুরের মতো। বাজে। আমি কী করব? আমার দশ বছরের রোজগার যোগ করলে কুড়ি হয়। ওরা সবাই পোজ দিয়ে রেডি। স্কুলের দারোয়ানের হাতে সোহমের মোবাইল। পিছনে চারটে ক্যামেরা। এমন সময় অভীক বলে ওঠে, “তুইও আয়।”
কোথায় দাঁড়াব আমি?
অভীক বলল, “তুই বরং সোহমের সামনে নিল ডাউন হয়ে বসে যা।”
আমি বসি। মনোজিৎ, দেবমাল্য বলে ওঠে, “দ্যাটস দ্য স্পিরিট।”
এই কালো স্পিরিট নিয়ে আমার ডিস্ট্রিবিউটারের কাছে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আমি বলি, “চলি কেমন?” দীপাঞ্জন বলে, “গুরু, দাঁড়িয়ে যাও। এখনও তো আসল ফটো সেশনটা বাকি।”
শুনলাম, স্কুলের নিচে যে ট্যাটু শপটা হয়েছে নতুন, সেখানে নাকি সবাই নিজেদের হাতে একটা উল্কি করবে। প্রত্যেকে নিজের এখনকার সিটিসি-টা লেখাবে চামড়ার উপরে। ওদের ‘পরিচয়’। তার পর, সবকটা হাতের ছবি তোলা হবে একই ফ্রেমে। ওটাই নাকি হবে গ্রুপের প্রোফাইল পিকচার, এ বছরের মতো। আরও শুনলাম, এর বউনি নাকি হবে আমাকে দিয়ে। এমনটাই প্ল্যান।
আমি ছুটছি। কিন্তু এগোতে পারছি না।
অনেকগুলো অদৃশ্য হাত আমার জামার কলারটা চেপে ধরে আছে।
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
5 Responses
kon sahittik jeno bolechilen ek ekta akkshar ek akkshohini sena.kneel down kathata satti kore charlo;bulleter moto buke bindhe..chokhe jal….khuuuuuub bhalo legeche
খুব ভাল লেগেছে। দেখন সর্বস্ব সমাজের ছবি। তবে কেউ কেউ হয়তো সিটিসির বাইরেও বন্ধু থেকে যায়।
বড় সুন্দর লিখেছিস। এর থেকে বেশি বলার ভাষা নেই।
Mon chhuye gelo lekhata! Aro upohar dite theko!
বুক নিংড়ে নিলো।