জন্তুরা সবাই মিলে পরিত্রাহী চিৎকার করতে লাগল, “বেরিয়ে এসো, বক্সার! বেরিয়ে এসো!”
কিন্তু গাড়িটা ইতিমধ্যেই বেশ জোরে ছুটতে শুরু করে দিয়েছে৷ ধীরে ধীরে ওদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। ক্লোভারের কথাগুলো বক্সার ঠিকমতো বুঝতে পেরেছে কি না সেটাও তো মালুম হচ্ছে না৷ পরমুহূর্তেই বক্সারের মুখটা জানলা থেকে সরে গেল আর গাড়ির মধ্যে শুরু হল ভয়ানক দুড়ুম-দাড়ুম শব্দ। এটা বক্সারের খুরের আওয়াজ৷ সে খুরের বাড়ি মেরে গাড়ির দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে৷ একটা সময় ছিল যখন বক্সারের ওই বিশাল বিশাল খুরের গোটা-কয়েক লাথি পড়লে আর দেখতে হত না৷ গাড়িটা দেশলাইয়ের বাক্সের মতো গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে যেত৷ কিন্তু হায়! সে-শক্তি কি আর বক্সারের শরীরে আছে! কিছুক্ষণের মধ্যেই তার খুরের শব্দ ক্ষীণ হতে হতে এক্কেবারে থেমে গেল৷ মরিয়া হয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে জন্তুরা এবার গাড়ি-টানা ঘোড়া-দুটোর কাছে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল গাড়ি থামাবার জন্য। তারা চিৎকার করে বলতে লাগল, “কমরেড! ও কমরেড! তোমাদের পায়ে পড়ি! নিজেদের জাতভাইকে এ-ভাবে কোতল করতে নিয়ে যেয়ো না৷” কিন্তু সেই ঘোড়াগুলো এতই নির্বোধ, যে কী-ঘটছে-না-ঘটছে তারা কিছুই বুঝতে পারল না৷ স্রেফ কানগুলোকে পেছনদিকে টানটান করে ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল৷ একেবারে শেষ মুহূর্তে কোনও এক জন্তুর মনে পড়ল দৌড়ে গিয়ে খামারের পাঁচ-শিকওয়ালা দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ার কথা৷ কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ দেখতে দেখতে গাড়িটা সেই দরজা পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে নজরের বাইরে চলে গেল৷ ব্যাস! বক্সারকে এরপর আর কেউ কোনওদিন দেখতে পায়নি।

তিন দিন পরে ঘোষণা করা হল, বক্সার উইলিংডনের হাসপাতালে মারা গেছে। একটা ঘোড়ার পক্ষে যতটা সেবা ও যত্ন পাওয়া সম্ভব— সে-ও ঠিক ততটাই পেয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো যায়নি। বাকিদের খবরটা দিতে স্কুইলার নিজেই এল। তার কথা-মতো, বক্সারের শেষ সময়টাতে না কি সে তার পাশেই ছিল।
স্কুইলার সামনের পা তুলে এক ফোঁটা চোখের জল মুছে নিয়ে বলল, “এমন করুণ দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি গো! তার মৃত্যুশয্যায় আমি ঠিক তার পাশেই ছিলাম৷ শেষ মুহূর্তে সে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে, কথাও বলতে পারছিল না ঠিকমতো। কোনওমতে আমার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে বলল যে, তার একটাই দুঃখ রয়ে গেল— হাওয়া-কলের কাজ শেষ হওয়া অবধি দেখে যেতে পারল না৷ সে ফিসফিস করে আরও কী বলেছে জানো? বলেছে, ‘এগিয়ে চল কমরেড! বিপ্লবী আদর্শের নাম নিয়ে এগিয়ে চল। অ্যানিম্যাল ফার্ম অমর রহে! কমরেড নেপোলিয়ন অমর রহে! নেপোলিয়ান সর্বদাই সঠিক।’ —এই ছিল তার শেষ কথা কমরেডস!
এতদূর অবধি বলে আচমকাই স্কুইলারের হাবভাব কেমন যেন বদলে গেল৷ নতুন করে কিছু বলার আগে একটু থেমে নিয়ে সে তার কুতকুতে চোখগুলোকে খুব সন্দিগ্ধভাবে এপাশে-ওপাশে ঘোরাতে লাগল৷ তারপর বলল, সে না কি জানতে পেরেছে বক্সারকে নিয়ে যাওয়ার সময় একটা বোকা বোকা মাথা-মুন্ডুহীন গুজব রটেছিল৷ যে গাড়িটা বক্সারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিল তার গায়ে ‘ঘোড়ার কশাই’ লেখা দেখেছে কোনও কোনও জন্তু। অমনি তারা দুম করে ধরে নিয়েছে যে, বক্সারকে বোধহয় কোতল করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার! কোনও জন্তু এত গবেট হয় কী করে! তারা কি জানে না তাদের প্রিয় নেতা কমরেড নেপোলিয়ন কতটা ভালো?

স্কুইলার মহা খাপ্পা হয়ে এপাশ-ওপাশ দুলে লেজের ঝাপট মারতে মারতে এবার সেই ঘটনার একটা সহজ ব্যাখ্যা দিল। ব্যাপারটা তেমন কিছুই নয়, গাড়িটা সত্যি সত্যিই আগে এক ঘোড়ার কশাইয়ের ছিল৷ পরে এক পশু চিকিৎসক গাড়িটা কিনে নেন৷ কিন্তু তিনি এখনও গাড়ির গা থেকে সেই পুরনো লেখাগুলোকে মুছে দেননি— আর সেই জন্যই এই বিভ্রান্তি!
এ-কথা শুনে জন্তুদের বুক থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেল যেন৷ অন্যদিকে স্কুইলারও ছবির মতো করে বক্সারের মৃত্যুশয্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে যেতে লাগল৷ কী বিস্ময়কর সেবা-যত্নই না সে পেয়েছে! নেপোলিয়ন টাকা-পয়সার ব্যাপারে কোনও পরোয়াই করেনি৷ দরাজ হাতে দামি দামি সব ওষুধ কিনেছে বক্সারের জন্য। এত ভালো ভালো সব কথা শুনে জন্তুদের মন থেকে সন্দেহের শেষ মেঘটুকু পর্যন্ত উবে গেল৷ প্রিয় কমরেডের মৃত্যুর জন্য তাদের মনে যে দুঃখটুকু ছিল তাতে সান্ত্বনার একটা প্রলেপ পড়ল যেন। আহা! বক্সার অন্তত শান্তিতে মরেছে।
পরের রবিবার সকালের সভায় নেপোলিয়ন স্বয়ং উপস্থিত হয়ে বক্সারের সম্মানে একটা ছোট বক্তৃতা দিল। বলল, বক্সারের দেহ খামারে এনে গোর দেওয়া সম্ভব হল না বটে, তবে জলপাই পাতার একটা বড় মালা গেঁথে সেই মালা খামারের বাগানে বক্সারের সমাধিতে সাজিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছে সে, এবং কিছুদিনের মধ্যেই শুয়োরেরা বক্সারের সম্মানে একটা ভোজসভার আয়োজন করবে৷ ভাষণের শেষে ‘আমি আরও পরিশ্রম করব’ আর ‘নেপোলিয়ান সর্বদাই সঠিক’— বক্সারের এই দুটো আপ্তবাক্য জন্তুদের আর একবার স্মরণ করিয়ে দিল নেপোলিয়ান। তার মতে, এই কথা-দুটো সব জন্তুরই মেনে চলা উচিত। তাতে আখেরে তাদের ভালোই হবে।
ভোজসভার নির্দিষ্ট দিনে উইলিংডন থেকে মুদিখানার গাড়ি এসে একটা ঢাউস কাঠের বাক্স নামিয়ে দিয়ে গেল খামারবাড়িতে। সে-রাতে খামারবাড়ি থেকে উদ্দাম গান ভেসে এল, সঙ্গে ভয়ানক ঝগড়াঝাঁটির আওয়াজ। রাত এগারোটা নাগাদ কাচ ভাঙার তুমুল ঝনঝন আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে সব শোরগোল বন্ধ হয়ে গেল। পরদিন দুপুর পর্যন্ত খামারবাড়ি থেকে কারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। খবর ছড়িয়ে পড়ল কী-ভাবে যেন শুয়োরেরা এক বাক্স হুইস্কি কেনার টাকা জোগাড় করে ফেলেছে৷

***
বছরের-পর-বছর কাটে৷ ঋতুর-পর-ঋতু আসে-যায়৷ জন্তুদের স্বল্পায়ু জীবনের প্রদীপও নিভে যায় একে একে৷ একটা সময় এল যখন বিপ্লবের আগের দিনগুলোর কথা মনে করার মতো কেউই আর খামারে রইল না। ব্যতিক্রম খালি ক্লোভার, বেঞ্জামিন, দাঁড়কাক মোজেস আর কিছু শুয়োর৷
মুরিয়েল মারা গেছে৷ ব্লুবেল, জেসি, পিঞ্চার— কেউই বেঁচে নেই৷ বেঁচে নেই জোন্সও৷ দেশের অন্য প্রান্তে, কোনও এক শুঁড়িখানায় মারা গিয়েছে সে৷ স্নোবলের কথা সবাই ভুলেই গেছে৷ বক্সারের কথাও আর কারও মনে নেই, দু-একজন যারা তাকে চিনত তারা বাদে৷ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্লোভার বেশ মোটা হয়েছে, সে এখন গেঁটে বাতে ভোগে৷ তার চোখ-দুটো বেয়ে সব সময় জল গড়ায় আর পিঁচুটি জমে থাকে। দু’বছর আগে তার অবসর নেওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, কোনও জন্তুকেই আজ পর্যন্ত অবসর দেওয়া হয়নি৷ সেই বিশাল চারণভূমির এক পাশে অবসর নেওয়া বুড়ো জন্তুদের থাকার জায়গা তৈরি করার যে কথাবার্তা এক সময় হয়েছিল, সে-সব বহুকাল আগেই ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। নেপোলিয়ান এখন দেড়শো কেজি ওজনের এক পূর্ণ-বয়স্ক শুয়োর৷ আর স্কুইলার তো এতই মোটা হয়েছে যে চোখ খুলে তাকানোটাই এখন তার পক্ষে এক মহা সমস্যার ব্যাপার। কেবলমাত্র বুড়ো বেঞ্জামিনই সেই আগের মতো রয়েছে। বদল বলতে তার লম্বা মুখটা আর-একটু ধূসর হয়েছে। বক্সার মারা যাওয়ার পর থেকে সে খানিক মনমরা হয়ে থাকে৷ আগের চেয়ে আরও কম কথা বলে আজকাল৷
খামারে জন্তুর সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে৷ তবে শুরুতে যতটা বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল, ঠিক ততটাও বাড়েনি। পরবর্তীকালে যে-সব জন্তুরা জন্মেছে, তাদের কাছে বিপ্লব ব্যাপারটা কেবলই পুরনো আমলের একটা ফিকে সংস্কারের মতো— যা তারা মুখে মুখে গল্প-গাথার মতো প্রজন্মের-পর-প্রজন্ম ধরে শুনে আসছে৷ বেশ কিছু জন্তুকে বাইরে থেকে কিনে আনা হয়েছে, যারা অ্যানিম্যাল ফার্মে আসার আগে পর্যন্ত বিপ্লব নামক বস্তুটির নামও কোনও দিন শোনেনি
অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।