স্কুইলার! জন্তুরা থ মেরে গেল একেবারে৷ হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই স্কুইলার হাঁটছে৷ তার ওই বিশাল বপুর ভার বহন করতে পা–দুটোর যে সমস্যা হচ্ছে না, তা নয়৷ তবুও মোটামুটি একটা ভারসাম্য বজায় রেখেই সে খামারের উঠোনে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই খামারবাড়ির দরজা খুলে সারি দিয়ে শুয়োরের দল বেরিয়ে এল বাইরে৷ প্রত্যেকেই পেছনের দু–পায়ে ভর দিয়ে হাঁটছে৷ কেউ একটু ভালো, কেউ একটু খারাপ, কেউ কেউ আবার এমন টলমল করছে যেন মনে হচ্ছে হাতে একটা লাঠি ধরিয়ে দিলে তার খানিক সুবিধে হত। তবে প্রত্যেকেই কিন্তু বেশ সফলভাবে উঠোনে এক চক্কর মেরে এল৷
অবশেষে কুকুরের ভীষণ গর্জন শোনা গেল, সঙ্গে কালো মোরগছানার তীক্ষ্ম চিৎকার৷ এবার স্বয়ং নেপোলিয়ন বেরিয়ে এল বাইরে। রাজকীয় ঋজু ভঙ্গিতে হাঁটছে সে, উদ্ধত চাহনি ফেরাচ্ছে এপাশে–ওপাশে৷ তাকে ঘিরে কুকুরগুলো বেজায় লম্ফঝম্ফ জুড়েছে।
নেপোলিয়নের হাতে ধরা একটা চাবুক৷
চারিদিকে যেন শ্মশানের নীরবতা নেমে এল৷ আতঙ্কিত জন্তুরা গা–ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখতে লাগল, শুয়োরের দল সারি বেঁধে উঠোন ঘিরে চক্কর দিচ্ছে৷ জন্তুদের মনে হল, পৃথিবীটা যেন উল্টে গেছে৷ প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে উঠেই জন্তুদের মনে হল এর একটা প্রতিবাদ করা দরকার। এ–ক্ষেত্রে কুকুরের ভয় আছে। তা ছাড়াও বহু বছর ধরে কোনওরকম অভিযোগ বা সমালোচনা না–করে–করে কেমন একটা জড়তাও যেন এসে গিয়েছে তাদের স্বভাবে৷ তবুও ওরা হয়তো প্রতিবাদ করত, কিন্তু সেই মুহূর্তেই কোনও একটা সংকেত পেয়ে ভেড়ার দল তুমুল হল্লা জুড়ে দিল, “চারপেয়েরা ভালো, দুপেয়েরা আরও ভালো! চারপেয়েরা ভালো, দুপেয়েরা আরও ভালো!”
এক–নাগাড়ে পাঁচ মিনিট ধরে চলল সেই চিৎকার৷ যখন ভেড়ার দল থামল, ততক্ষণে প্রতিবাদ করার সুযোগটুকু চলে গেছে৷ শুয়োরের দল ঢুকে পড়েছে খামারবাড়ির ভেতরে৷

হঠাৎ বেঞ্জামিনের মনে হল কেউ যেন নাক ঘসছে তার কাঁধে৷ সে ফিরে তাকিয়ে দেখল, ক্লোভার৷ তার বৃদ্ধ চোখ–দুটো এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি ম্লান৷ ক্লোভার একটা কথাও উচ্চারণ করল না, কেবল বেঞ্জামিনের কেশর ধরে আলতো করে টেনে তাকে নিয়ে গেল বড় গোলাঘরটার একদম শেষ প্রান্তে, যেখানে সাত–বিধান লেখা ছিল৷ তারপর ওরা দু‘জনেই আলকাতরা–মাখা দেওয়ালের ওপর সাদা রঙে লেখা হরফগুলোর দিকে বেশ কয়েক–মিনিট একদৃষ্টে চেয়ে রইল৷
অবশেষে ক্লোভার বলল, “আমি খুব ভালো দেখতে পাচ্ছি না৷ অল্প বয়সেও যে লেখাগুলো পড়তে পারতাম, তা নয়৷ কিন্তু, কেন জানি না মনে হচ্ছে, লেখাগুলো যেন বদলে গিয়েছে৷ একবার দ্যাখো তো বেঞ্জামিন, সাতটা বিধান কি আগের মতোই রয়েছে?
এই প্রথমবার নিজের নিয়ম ভেঙে বেঞ্জামিন দেওয়ালের লেখাগুলো পড়তে শুরু করল৷ বিশেষ কিছুই সেখানে লেখা নেই অবশ্য। সাতটার বদলে এখন কেবলমাত্র একটাই বিধান রয়েছে৷ সেটা হল–
সব জন্তুই সমান
কিন্তু কোনও কোনও জন্তু বাকিদের চেয়ে বেশি সমান

এই ঘটনার পরদিন যখন শুয়োরেরা চাবুক হাতে নিয়ে খামারের কাজকম্ম তদারক করতে লাগল তখন আর কেউই অবাক হল না৷ ইতোমধ্যে শুয়োরেরা নিজেদের জন্য একটা ওয়্যারলেস সেট কিনেছে৷ টেলিফোন বসানোর তোড়জোড় করছে এবং জন বুল, টিট–বিটস ও ডেইলি মিররের গ্রাহকও হয়েছে৷ এ–সব জেনেও জন্তুদের মোটেও আর অস্বাভাবিক লাগল না৷ নেপোলিয়নকে পাইপ মুখে দিয়ে বাগানে ঘুরে বেড়াতে দেখেও কেউ আঁতকে উঠল না৷ এমনকি শুয়োরেরা যখন ওয়ার্ডরোব থেকে জামা–কাপড় বের করে পরতে শুরু করল, তখনও না। নেপোলিয়ান নিজে বেছে নিল একখানি কালো কোট, র্যাটক্যাচার পাজামা আর চামড়ার লেগিংস এবং তার প্রিয়তমা শুয়োরি পরতে শুরু করল জলের মতো স্বচ্ছ এক রেশমি পোশাক, যেটা এককালে মিসেস জোন্স প্রতি রবিবারে গায়ে দিতেন৷
এক সপ্তাহ পরে এক বিকেলবেলা বেশ কয়েকটি ঘোড়ার গাড়ি এসে ঢুকল অ্যানিম্যাল ফার্মে৷ আশেপাশের অন্যান্য খামারের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে, তাঁরা অ্যানিম্যাল ফার্ম পরিদর্শন করবেন৷ তাঁদের সমস্ত খামার ঘুরিয়ে দেখানো হল৷ প্রতিনিধিরা বিস্ময়–বিমুগ্ধ চোখে সব–কিছু দেখলেন৷ বিশেষ করে হাওয়া–কল দেখে তো তাঁদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল৷ জন্তুরা শালগম খেতে আগাছা সাফ করছিল৷ সবাই এক মনে খেটে চলেছে৷ মুখ তুলে তাকাচ্ছে না বললেই চলে৷ ওরা ভয় পাচ্ছে, তবে কাকে বেশি ভয় পাওয়া উচিত— শুয়োরকে, না মানুষকে— সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না৷
সেই সন্ধেবেলা খামারবাড়ির ভেতর থেকে অট্টহাসির দমক ভেসে এল, সঙ্গে উঁচু গলায় গান৷ হঠাৎ শুয়োর ও মানুষের মিলিত গলার আওয়াজ পেয়ে জন্তুরা কৌতূহলী হয়ে উঠল৷ আজ এই প্রথমবারের জন্য জন্তুরা মানুষের সঙ্গে সমান সমান মর্যাদায় বসে বৈঠক করছে৷ ওখানে চলছেটা কী? অ্যাঁ?
বাকি জন্তুরা বাগানের মধ্যে দিয়ে গুঁড়ি মেরে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে এগোতে লাগল খামারবাড়ির দিকে৷

সদর দরজার কাছে গিয়ে ওরা খানিক থমকাল৷ আর এগোবে কি না বুঝতে পারছে না, কেমন যেন ভয় করছে৷ কিন্তু ক্লোভার সবার আগে ঢুকে পড়ল ভেতরে। ওর পিছু পিছু অন্য জন্তুরাও পা–টিপে–টিপে পৌঁছে গেল বাড়ির একেবারে গোড়া অবধি৷ ওদের মধ্যে যারা একটু লম্বা, তারা খাবার ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মারল ভেতরে। লম্বা টেবিলটাকে ঘিরে ছ’জন চাষি আর ছ’টা বিশিষ্ট শুয়োর বসে আছে। নেপোলিয়ন বসেছে টেবিলের একদম মাথায়, সব চেয়ে সম্মানজনক চেয়ারটাতে। শুয়োরদের দেখে মনে হচ্ছে না যে, চেয়ারে বসতে তাদের কোনও সমস্যা হচ্ছে। বেশ আরাম করেই বসে রয়েছে ওরা। মহানন্দে তাস পেটাচ্ছে সবাই। মাঝে একবার খানিকক্ষণের বিরতি নেওয়া হল। অতিথিদের সম্মানার্থে মদ খাওয়া হবে৷ সবার হাতে হাতে ফিরতে লাগল একটা বিশাল জগ৷ গেলাস খালি হয়ে গেলেই আবার বিয়ার ঢেলে ভর্তি করে নেওয়া হচ্ছে৷ জানলার বাইরে দাঁড়ানো জন্তুদের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখগুলো কেউ খেয়ালই করল না৷
এমন সময়, ফক্সউডের মিস্টার পিলকিংটন বিয়ারের মগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ তিনি সকলের শুভ কামনায় মদ্যপানের অনুরোধ করতে চান৷ তবে তার আগে কয়েকটা কথা বলা তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বলে তিনি মনে করেন৷
তিনি বললেন, দীর্ঘদিন ধরে অ্যানিম্যাল ফার্মের সঙ্গে একটা অবিশ্বাস আর ভুল বোঝাবুঝির পরিবেশ তৈরি হয়েছিল৷ খুবই আনন্দের ব্যাপার যে, সেই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল আজ। একটা সময় ছিল যখন কেবল তিনিই নন, এই ঘরে উপস্থিত অন্যান্য মানুষেরা প্রত্যেকেই এই খামারের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব রাখতেন৷ কোনওরকম শত্রুতার কারণে যে অ্যানিম্যাল ফার্মের সম্মাননীয় মালিকদের প্রতি এমন আচরণ করা হত, তা নয়৷ প্রতিবেশী খামারগুলি এক অমূলক আশঙ্কা থেকেই এমন আচরণ করত৷ দুর্ভাগ্যজনক কিছু ঘটনাও ঘটেছে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে৷ তখন মনে করা হত, শুয়োরদের মালিকানা ও তত্ত্বাবধানে একটা খামার পরিচালিত হচ্ছে— এই ব্যাপারটাই খুব অস্বাভাবিক৷ এর ফলে আশেপাশের খামারে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে৷ বেশিরভাগ চাষিরা কোনওরকম খোঁজ-খবর না-নিয়েই ধরে নিয়েছিলেন যে, এ-রকম একটা খামারে স্রেফ যথেচ্ছাচার ও অরাজকতাই চলতে পারে৷ তাঁদের নিজেদের খামারের জন্তু-জানোয়ার, এমনকি কর্মচারী মানুষদের উপরে এর কী প্রভাব পড়তে পারে— সেই ভেবে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা৷ কিন্তু আজ সমস্ত সন্দেহের অবসান ঘটেছে৷ আজ তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে অ্যানিম্যাল ফার্ম পরিদর্শন করলেন৷ এখানকার প্রতিটি ইঞ্চি খুঁটিয়ে পরখ করে দেখলেন৷ কী পেলেন তাঁরা? অত্যন্ত আধুনিক সব পদ্ধতি মেনে চলছে এই খামার৷ শুধু তা-ই নয়, এই খামারের সুশৃঙ্খলতা ও সুব্যবস্থা অন্যান্য খামারের কাছে উদাহরণস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে৷ তাঁর বিশ্বাস অ্যানিম্যাল ফার্মের নিচু শ্রেণীর জন্তু-জানোয়ারেরা দেশের বাকি জন্তুদের চেয়ে অনেক কম খাবার খেয়েও অনেক বেশি পরিশ্রম করে৷ সত্যি বলতে কি, আজ তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা এমন অনেক কিছুই এখানে দেখেছেন যেগুলি তাঁরা খুব শিগগিরই নিজেদের খামারে চালু করতে চান৷
অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।