এত গাছপালা তবু জায়গাটি শুষ্ক, ধুলো ওড়া। ছায়া থাকলেও গরম ভাপ সে ছায়াকেও তাতিয়ে দেয়। স্থল শেষের পাথুরে পাড়ের অনেক নিচে মা গঙ্গা। বর্ষা এলে জল খারাপ আর বরাবর উঠে আসে পালতোলা নৌকা গুলো যেন ডাঙার সমান্তরালে ভেসে ভেসে যায়। কুমার সেসব দেখে বটে কিন্তু তার নজর প্রকৃতিতে সীমাবদ্ধ নয়। মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন বলেন সে বড় মেজাজি।আর এই মেজাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার অপরূপ রূপ । ছোট থেকেই পাড়ার মেয়েরা, ঘরের মেয়েরা, বেপাড়ার মেয়েরা ছল ছুতোয় গাল টেপে। টোকা মারে। বয়স বাড়লে ছুঁতে চায়। আমল না দিলে বলে ভারি সুন্দর তো! মেয়েদের মত গাল! লাল টুকটুকে মুখ! গরুর মতো ড্যাবড্যাবে চোখ! ময়ূর বাহন একেবারে! থাকার মধ্যে পুরুষ পুরুষ তো ওই গোঁফ খানা!
কুমার সহর্ষে গোঁফ মুচড়ে ঘুরে বেড়ায়। ময়ূর বাহনই বটে! ময়ূরের তীব্র চেঁচানিতে এদিকের লোক ওদের দুই চোখে দেখতে পারেনা। অমন বাঁকানো নখ! ভোর থেকেই ছাতে, উঠোনে, পাথুরে রাস্তায়, গঙ্গার নির্জন পাড়ে, সবচেয়ে বড় কথা কচি সবজি ক্ষেত ঠুকরে মাড়িয়ে একাকার করে দেয়।
শুধু কুমারের ওদের প্রতি দুর্বলতা আছে। লাজুক ময়ূরের দৃপ্ত ভঙ্গিতে, চলার মধ্যে একটা যুদ্ধংদেহী ভাব আছে। যেভাবে ঝোপ জঙ্গল চাষের জমি থেকে বিষধর সাপ ধরে তীক্ষ্ণ ঠোঁটের আঘাতে তাকে ফালাফালা করে দেয় তা মুগ্ধ হয়ে দেখে কুমার। তার ভালো লাগে জংলি ময়ূরের নীলচে কালো রূপ। বোনের ময়ূরের পাশাপাশি এ দেশের প্রত্যন্ত পল্লীজীবী ময়ূর পালকদের প্রতি তার অদম্য আকর্ষণ আছে। ময়ূরকে এরা দেবতা মনে করে। বিশেষত্ব এই জাতের স্বাধীনচেতা আত্মগর্বী গাঢ় ত্বকের মেয়েদের প্রতি গোপন অনুরাগ আছে কুমারের। বনের ময়ূরের মতোই এরা সহজে বশ্য নয়। কিছু কিছু ময়ূরী ইদানিং মানুষের আশেপাশে থাকতে ভালোবাসে। এই প্রায় পোষ মানা সাদা আর ছাইরঙা ময়ূরীর নিরীহ ভঙ্গির ঘোরাঘুরি তার একেবারেই পছন্দ নয়। আজও ঘর থেকে বেরিয়ে ডানদিকের ঝুপসি গাছের নিচে পাতার স্তুপের মাঝে ডিমে তা-এ বসা ময়ূরীকে দেখলো। কুমারের ইচ্ছে করে তাকে একটা ঢিল ছুঁড়ে মারে। কুড়িয়েও নেয় মাপসই একটা। কদিন পর এক পাল বাচ্চায় ভরে যাবে উঠোন। ভোর থেকে নিকোনো দাওয়ায় তাণ্ডব শুরু করে দেবে। ঢিল ছুঁড়তে গিয়ে স্থানু হয়ে যায় কুমার। সেই নিশ্চিন্ত সমর্পিত ভঙ্গিতে ডিমের উপর বসে আছে পরম মমতায়। কুমার তাকে ছেড়ে আসার দিন এভাবেই গভীর বিশ্বাসে তাকিয়ে ছিল সে।
২
এই ভাঙাচোরা দুর্গ ছাড়ালেই বাইরে শহরটাও তার মত প্রাচীন। নগর জুড়ে ছোট-বড় সেজ মেজো দশাসই অর্বাচীন নানা মন্দিরে ছয়লাপ। ঘণ্টাধ্বনি, ঘোড়ার গাড়ি, হৃষ্টপুষ্ট অগুনতি ষাড়ে , গলি তস্য গলিতে ওই অটো আর হাওয়া গাড়িই কিছু বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে। কুমার বিশাখ অটোর পিছনে উঠে বসে। ফুল ও চটকানো বেল পাতার সুগন্ধ সবে মন্দির শহরে ছড়াতে শুরু করেছে। বিশাখের পাশে শক্ত-সমর্থ ময়ূরকণ্ঠী রঙা এক মেয়ে।বিশাখের কপালে ফুটে ওঠা মুক্তোর মতো স্বেদবিন্দু মেয়েটি লম্বা আঙ্গুল দিয়ে তুলে ঠোঁটে ঠেকায়।
বিশাখের চোখে যেন বিদ্যুৎ ঝলকায়। মেয়েটির স্তন বিভাজিকায় পুঁতি ও পাথর হাড়ের মালার লকেটে ময়ূরের ছবি খোঁদাই করা। বিশাখের দৃষ্টি সে দিক থেকে সরে না।
বিশাখ বলে, বল্লী, মা বোধহয় রাজি হবে না।
কালো মেয়েটির রূপের ছটায় কোথায় মুছে গেছে সুকেশিনী সুবেশিনী গৌর চম্পক বর্ণা দেবসেনা, কুমারের সম্বন্ধ করে বিয়ে হওয়া বউ।
বল্লীর ভ্রূ ময়ূরের বাঁকা ঠোঁটের মতো কুঁচকে যায়। বলে, আমি কি চেয়েছিলাম নাকি? তুমি তো ভয় দেখিয়ে জোর করে রাজি করালে। বয়স্ক কুমার তরুণী প্রেমিকার দিকে তাকিয়ে আবেগাপ্লুত গলায় বলে, তোমার জন্য কিই না করেছি বল্লী! এত দূর দেশে এসে থেকে গেছি- ওদিকে সবাই জানে সর্ব রমনী প্রিয় হয়েও আমি কুমার!
বল্লী তার মোটা ভারি ঠোঁট ও কুঞ্চিত কেশে ভরা মাথা দুলিয়ে বলে, আর প্রতারক বলে না? অমন সুন্দরী রানী বউ ছেড়ে কিনা আমার মত- তা মায়েদের আর দোষ কী? মায়েরা তোমার মতো অভিজাত ও সাদা পুরুষের জন্য সাদা দেবকন্যাই চান। যেমন আমার মা চান আমার যোগ্য কালো পুরুষ।
কুমার বিশাখ দৃঢ় মুষ্টিতে বল্লীর হাত ধরে, বলে, যাই হোক, যাই ঘটুক, তুমি আমার।
বল্লী গ্রীবা সোজা করে বলে, আর তুমি আমার।
অটো এগোয়। খানিকটা এগোবার পর খোয়া ওঠা রাস্তা এমন যে বসে থাকার আরাম পাওয়া যায় না। যানবাহন নিয়ম না মানা পাগলের মত যাতায়াত করে। কখনো মনে হয় অটো লাফিয়ে উঠে সোজা গিয়ে নোংরা ঢাল গড়িয়ে পড়বে মা গঙ্গায়।কখনো মনে হয় হাড়জিরজিরে ঘোড়ায় টানা ঝলমলে গাড়ি বেখেয়ালে অটোর ঘাড়ে উঠে পড়বে! বেশ খানিকটা টালমাটাল চলার পর দুর্গা মায়ের মন্দিরের সামনে নামে কুমার ও বল্লী।
ড্রাইভার গাড়ি লাগিয়ে চা খেতে দাঁড়ায়। মহিষের দুধের গাঢ় মালাই মারা চা ঢালতে ঢালতে গয়ারাম চা ওয়ালা মৈথিলীতে বলে, ব্রিজওয়া কিয়া আহাক অটো মে ভোর স কুনো সওয়ারি নেহি চড়হেল অছ?
ড্রাইভার মাথা নাড়ে। বলে, না কোনো যাত্রী সে এত সকালে পায়নি। ভোর ভোর ধম্ম করার লোক কমছে আজকাল।
কুমার বল্লীকে নিয়ে মন্দিরের চত্বর পেরোয়। ভাবে, মাকে সামলাবে কি করে? কি করে বোঝাবে? ভাই সেই কবে কায়দা করে মাকে প্রদক্ষিণ করে, মায়ের গায়ে গায়ে থেকে, মন জুগিয়ে কব্জা করে ফেলেছে। সে মায়ের শরীর জাত পুত্র তবুও জন্ম থেকে প্রথম যৌবন অবধি মা বাবার সঙ্গ পায়নি, পরিচয় পায়নি। দুই বোন বিদ্যা ও অর্থের উত্তরাধিকারী হয়েছে। একমাত্র সেই ভাগ্য তাড়িত দুর্ভাগা। মায়ের অদ্ভুত দর্শন মানস পুত্রই তাঁর ঘনিষ্ঠ। মা- ই শেখালেন মানুষের শরীরের চেয়ে মন এগিয়ে থাকে। মন সাড়া দিলে তবে তো শরীর জাগে! ইন্দ্রকন্যা দেবসেনা মায়ের পছন্দের ছিল। তার নয়।
হ্যাঁ সে সম্মত হয়েছিল। দেবসেনার বিরুদ্ধে কোন কথাই যে বলার ছিল না তা যে তাকে দেখেছে সেই বুঝতে পারবে। ভারী অনুগত আর শান্ত মেয়ে সে। আর অমন ডাকসাইটে মা-বাপের উপর কথা বলা যায় নাকি?
বল্লী স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে,তোমার মা যদি আশ্রয় না দেন, আমাকে গ্রহণ করা সহজ হবে না কিন্তু
বর্ষিয়ান কুমার শান্ত গলায় উত্তর দেয়, বর্ণের জন্য, বংশ কৌলিন্যের জন্য মা যদি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে মায়ের উত্তর দেশে আমি চিরকুমার- ই থেকে যাবো। তোমাকে না চিনলে কেউ দেবসেনার কথাও মনে রাখবে না।কোথাও আমার পাশে তাকে খুঁজে পাবে না। আর অনার্যপূজিত ময়ূর- ই হবে আমার প্রিয় সখা। দেখে নিও তুমি। লোকে ভুল করে বলবে আমি যোদ্ধা। দেবতাদের সেনাপতি। আসলে যে দেবসেনার পতি ছিলাম কেউ জানবে না।
বল্লীর সুঠাম কালো শরীর যেন সর্বাঙ্গ দিয়ে হাসে। শক্ত করে কুমারের হাত চেপে ধরে। দুজনে দৃঢ় ভঙ্গিতে সামনে এগিয়ে যায়।
অটোওয়ালার ঘরফিরতি সওয়ারির দলের দুই বাচ্চা তখন অটোর ভিতর এক গোছা ময়ূরের পালক পেয়ে বেদম হুটোপুটি শুরু করে দেয়।
সেবন্তী ঘোষের জন্ম শিলিগুড়িতে, উচ্চশিক্ষা বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কবি ও লেখকদের মধ্যে সেবন্তী নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরষ্কার ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেবন্তীর পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং পোর্টালে। ওঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'আমাদের কথা', 'যে থাকে অন্ধকারে', 'ফুর্তি ও বিষাদ কাব্য', 'ফুল ও সুগন্ধ', 'দিল-দরিয়া' উল্লেখযোগ্য।