সত্তরের দশকে জন্মে, বড়দের মিছিল, মিটিং, বইমেলা আর রাদুগা প্রকাশনীর দৌলতে প্রথম যে দেশকে বিদেশ বলে চিনি, সে হল রাশিয়া, ওহ না, ইউনাইটেড সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক (USSR)। মস্কোর রেড স্কোয়্যারের ক্রেমলিন চাইমস-এর ঘণ্টার আওয়াজ, কিম্বা চুকটকার প্রখর ঠান্ডায় হরিণের চামড়ায় বানানো টেন্ট ‘ইয়ারাঙা’-তে আগুন জ্বালিয়ে বসে থাকা বয়স্ক মানুষ, বরফ সরিয়ে আবার টুন্ড্রা ফুলের আগমন, ইউরোপিয়ান রাশিয়ার ম্যাট্রিয়শকা ডল, লাল স্কার্ফ বেঁধে ছোট্ট মেয়েটির মাশরুম তোলা.. ইউক্রেইনের অস্ট্রিচ, জেব্রা, অ্যান্টিলোপ আর কৃষ্ণ সাগরের ধারে আর্টেক শহরে বাচ্চারা হাত মিলিয়ে গান করছে…
“Deep Blue the skies are here
The surf sings loud and clear…”
মসজিদ, মাদ্রাসা আর প্রাসাদের দেশ উজবেকিস্তান, ইউরি গাগারিন-এর দেশ কাজাখস্তান, রুস্টাভেলির দেশ জর্জিয়া… পুরো দেশটার প্রতি প্রান্ত যেন কত চেনা! নিউ ইয়ারে, মস্কোর গ্র্যান্ডফাদার ফ্রস্ট আর স্নো মেডেন-এর সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠা ছোটবেলা… আসলে প্রত্যন্ত প্রান্তরে বড় হবার সময় কুড়িয়ে বাড়িয়ে যতটুকু পৃথিবী চেনা যায় আর কি! এই তো বাঙালির ধর্ম! রাশিয়ান বইগুলোর মধ্যে একটা ছবি খুব মনে ধরত…

আজ়ারবাইজানের একটি পরিবার গোল হয়ে খাবার টেবিলের চারদিকে বসে খাচ্ছে আর সঙ্গে তাদের পোষা সিংহ! টেবিলে অনেকগুলো কেক এর টুকরো। সেই ছবির ছায়া বেয়ে বুড়ো বয়সে স্মৃতিচারণ… রাশিয়ান কেক, কী নাম পড়েছিলাম? মেডোভিক! বানালে তো হয়! পোষ্য সিংহ না থাক, পেটুক সঙ্গীদের দিয়েই কাজ চলে যাবে না হয়!
প্রত্যেক খাবার তৈরির পিছনেই কিছু না কিছু গল্প থাকে। মেডোভিক উদ্ভাবনের ইতিহাসটিও বেশ চমৎকার। উনিশ শতকে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞিকে ইমপ্রেস করতে ডাকা হল এক তরুণ রাঁধিয়েকে। তো সেই রানিমা এক্কেবারেই মধু খেতে ভালোবাসতেন না। (উচ্ছে পছন্দ ছিল কিনা সে সম্বন্ধে কোনও দলিল অবিশ্যি নেই, কিংবা মুখমিষ্টি সম্পর্কেও কিছুই জানা নেই) কিন্তু রাঁধিয়ে যুবক অজান্তে বানিয়ে ফেললেন মধু দেওয়া কেক, ভিতরে সাওয়ার ক্রিম। আর সেই কেক খেয়ে রানি তৎক্ষণাৎ কেকে প্রেমে… না না, শেফ নয়! কেকের প্রেমে পড়লেন!
এক্স্যাক্টলি সো! বাড়িতে যেই বানালাম মেডোভিক, বাড়ির সব্বাই পড়ল তার প্রেমে! হবে না-ই বা কেন, স্বাদ তো নয়, একদম সূর্যাস্তের আকাশের রঙের খেলার মতো… মধুর স্বাদে, মাখনের স্বাদে, ভ্যানিলার স্বাদে, ক্যারামেলের স্বাদে, ক্রিম আর সাওয়ার ক্রিমের স্বাদে এক্কেবারে একাকার। আচ্ছা, এবার একদম এক্স্যাক্ট পরিমাণগুলো বলে ফেলি তাহলে? স্বাদ ভাগ না করলে হয়?

চার টেবিল চামচ (১/৪ কাপ) মধু
সাড়ে তিন কাপ ময়দা
৭০ গ্রাম মাখন
৩/৪ কাপ চিনি
এক চা চামচ বেকিং পাউডার
তিনটে ডিম
আর ক্রিমের লেয়ারের জন্যে–
আরও হাফ কাপ সাওয়ার ক্রিম
এক কাপ হেভি ক্রিম
দু’কাপ পাউডার সুগার ( ক্রিমে চিনি মেশানো থাকলে বুঝে দিতে হবে)
এক চা চামচ ভ্যানিলা এক্সট্র্যাক্ট
এবারে পদ্ধতি বলি। ডিম হালকা ফেটিয়ে নিয়ে তাতে চিনি মেশাতে হবে। তারপর একে একে মাখন মধু আর বেকিং পাউডার মেশাতে হবে বড় বাটিতে। একটু মিশিয়ে নিয়ে পাশে কড়াই বা ডেকচিতে জল ফুটতে দিতে হবে, তার ওপরে ডিম মিক্সচারটা বসিয়ে নাড়তে হবে, প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট, যাতে চিনি গুলে যায় আর হালকা লালচে রঙ ধরে..
তারপর নামিয়ে বেশ খানিকটা ঠান্ডা করে নিতে হবে। তাতে খুব অল্প অল্প করে ময়দাটা মেশাতে থাকতে হবে। এসব করে টরে ব্যাপারটা খানিক কাদার মতো হয়ে যাবে। সেটা দেখলে মনে হবে এ দিয়ে না কেক হবে না রুটি! নাহ! ঘাবড়ানোর কিছু নেই, ওটাই পারফেক্ট। মার্বেল স্ল্যাবে বেললে, বেশি করে ময়দা দিয়ে হালকা হাতে মেখে নিতে হবে। দিয়ে নরম একটা ডো হবে, সেটা একদম লম্বা সিলিন্ডারের মতো করে রোল করে নিয়ে আটটা একদম সমান ভাগে কেটে গোল লেচি করে নিতে হবে।

এবারে মাখার সময় মনে হবে একদম বাজে নরম, বেলব কী করে!! ভয় নেই, আরও খানিক ময়দা দিয়ে বেলে নিতে হবে, সে ভারত বা রাশিয়া যার ম্যাপ হোক না কেন! তারপর ছয় বা সাত ইঞ্চি মাপের গোল থালা বসিয়ে কেটে নিতে হবে রুটির মতো। একটা করে রুটি করে সেটা ১৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পাঁচ মিনিট বেক হবে, ততক্ষণে অন্যটা বেলে নিলেই হবে। এবড়ো খেবড়ো ধারগুলো একদমই নষ্ট হবে না। সব শেষে ওগুলো একটু কড়া করে বেক করে ঠান্ডা করে মিক্সারে গুঁড়ো করে নিতে হবে। রুটিগুলো ঠান্ডা হতে দাও…
ব্যাস। নিজেও আরামসে ঠান্ডায় বসে, ক্রিম, সাওয়ার ক্রিম, চিনি, সব দিয়ে হ্যান্ড মিক্সারে ফেটিয়ে স্টিফ পিক করে নিতে হবে। সবটা নীচে বরফের বাটি রেখে! সাইবেরিয়া ফিল আনতে হবে তো নাকি!

আর শেষমেশ, অ্যাসেম্বল করা। রুটি নীচে, তারপর দু’হাতা ক্রিমের লেয়ার, আবার রুটি আর ক্রিম, এরকম করে সব শেষে ক্রিম দিয়ে প্লেন করে ওপরে সেই গুঁড়ো করা ধারগুলো দিয়ে সবটা ঢেকে দাও। তারপর সাজানো গোছানো তো নিজের দেখনদারির ওপর। খাবার সময় একটু বেশি মধু ঢেলে দিতেই হবে কিন্তু! মিষ্টি গুণগান শুনতে হবে তো নাকি!
ব্যাস, আমার বলার কাজ এইটুকুই। আপাতত এক টুকরো হানি কেক মুখে দিয়ে, ট্রান্স সাইবেরিয়ান ট্রেনে চেপে মেডোভিক আর ওই সেইই পুরনো আঙুরের রস খাবার স্বপ্ন দেখতে চলি…
*ছবি ও রান্না সৌজন্য: লেখক
*মূল ছবি: bakestreet
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।