banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বাবার গল্প (পর্ব ২)

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Hemango Biswas

বাবার গল্প বলতে গিয়ে অন্য কথাও এল। জীবনী লেখা অবশ্য আমার উদ্দেশ্য নয়। ওঁর শৈশব ও কর্মজীবনের কথা অনেকটা ধরা আছে ‘উজান গাঙ বাইয়া’ বইতে। প্রণব বিশ্বাস এবং আরও অনেকে নানা জায়গায় লিখেছেন। ২০১২-তে শতবর্ষ উদযাপনের সময় পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও বাংলাদেশে নতুন করে লেখালেখি হয়েছে। আমার বোন রঙিলী বাবার জীবন নিয়ে নানা কাজ করছে। আমি ভাবছিলাম, টুকরো কিছু স্মৃতি কোথাও একটা লিখে রাখব। এরপর যদি ভুলে যাই! এই পত্রিকার আমন্ত্রণে সাহস পেলাম। এলোমেলো কথাও এঁরা ছাপবেন বলেছেন।


*

পাশের পাড়ায় ভালো বাড়িতে উঠে গিয়েছিলাম, কিন্তু খেলার বন্ধু আর খেলার মাঠ, এই দুই পড়ে ছিল পুরনো রাস্তায়। সেই রাস্তার একমাথা গিয়ে ঠেকত একটা উঁচু পাঁচিলে, তার ওপারে ছিল গোবরা মানসিক হাসপাতাল। এপার থেকে দেখা যেত হাসপাতালের বাসিন্দাদের, কয়েদিদের মতো তারা ডোরাকাটা ইউনিফর্ম পরে গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। মাঝে মাঝে দু’একজন পাঁচিল ডিঙিয়ে পালিয়ে আসত, সহজে ধরাও পড়ে যেত। পাড়ার লোকেরা এসব কাজে উৎসাহের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। ছোটরা বোধহয় সব দেশেই পাগল আর মাতালদের ভয় পায়, অন্তত আমি বেশ ভয় পেতাম। তাই একদিন যখন বাবা-মা বলল, ওই হাসপাতালে গিয়ে একজনের খাবার পৌঁছে দিতে হবে, আমি যৎপরোনাস্তি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। সেটা ১৯৬৯ সাল। যাঁর জন্যে খাবার নিয়ে যেতে হবে তাঁর নাম বাড়িতে শুনেছিলাম, ঋত্বিক ঘটক।

বাবার লেখায় আছে, ঋত্বিকের সঙ্গে ওর পরিচয় ’৫১ সাল নাগাদ। পার্টি নিষিদ্ধ থাকাকালীন বাবা অসম থেকে লুকিয়ে সে সময় কলকাতায় এসে বছর তিনেক ছিল। ওয়েলেসলি অঞ্চলে বাবার ডেরায় ঋত্বিক আসতেন, বাবা যেত ওদের হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে। ভূপতি নন্দীর পার্ক সার্কাসের বাড়িতেও ওঁদের নিয়মিত দেখা হত। কখনও কখনও সলিল চৌধুরী এবং অন্যরা যোগ দিতেন সেইসব আড্ডায়। মাঝে ধরা পড়ে কিছুদিন বাবা বন্দি ছিল, সেই সময়টুকু বাদ দিলে এই মোলাকাতে ছেদ পড়েনি। এই সময় ভাটিয়ালি সুরে বাবা দু’টো গান বাঁধে, ‘পদ্মা কও কও আমারে’ আর ‘আমার মন কান্দে পদ্মার চরের লাইগ্যা’। দেশভাগের পটভূমিতে লেখা এই দুই গান ঋত্বিকের বিশেষ প্রিয় ছিল শুধু নয়, দ্বিতীয় গানের রচনায় উনি কিছুটা সাহায্যও করেছিলেন। ওই  সময়কার আরেকটা গান, ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের পরে পরে লেখা বাবার দীর্ঘ ব্যালাড ‘ঢাকার ডাক’ রচনার সাক্ষী ছিলেন ঋত্বিক। সেই গান তৈরি করা নিয়েও তিনি খুব উত্তেজিত ছিলেন। এই দিনগুলোতেই ‘নাগরিক’ তৈরির কাজ শুরু হয়। মূলত যাঁর সাহায্যে ওঁরা ছবি করতে নামলেন সেই ভূপতি নন্দীর বাড়িতে ছবির উদ্যোগ পর্বে বাবা যোগ দিয়েছিল। ওদের সখ্যের আর এক সূত্র ছিলেন সুরমা ঘটক, চল্লিশের দশকে যিনি বাবার সঙ্গে সিলেট, শিলং অঞ্চলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও পার্টির কাজে জড়িত ছিলেন, বাবা যাঁকে ডাকনামে লক্ষ্মী বলে ডাকত। ওঁরা দু’জনে সুরমা উপত্যকার মানুষ, সেই নদীর নামেই সুরমার নাম।



[ হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও রত্না সরকারের গলায় ‘পদ্মা কও কও আমারে’]


ওই পঞ্চাশের দশকের গোড়ার সময়টায় গণনাট্যের কাজকর্মে বাবার অনাস্থা জন্মাচ্ছিল। পার্টির তৎকালীন রাজনীতিগত সংকট থেকেই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দিশাহীনতার জন্ম – এমন ভাবনা ওর নানা লেখাপত্রে রয়েছে। ঋত্বিকের কাছে ওই সংকট আরও বড় ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছিল, এবং ওঁর রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। ১৯৫৪-তে পার্টির সাংস্কৃতিক লাইনের সমালোচনা করে ‘অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট’ নামে এক দলিল লিখে উনি পার্টি-নেতাদের পাঠান। সেই দলিল লেখার সময় বাবার সঙ্গে ওঁর আলোচনা হত। সুরমা ঘটকের লেখায় পাই, দলিলের শেষ কপিটা উনি বাবাকে পাঠিয়েছিলেন। এইসব নানা অভিজ্ঞতা দু’জনকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। এর এক বছর বাদে ঋত্বিক পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সে বছরেই সুরমা-ঋত্বিকের বিয়ে হয়। সেই গল্পের আভাস রয়েছে ‘কোমল গান্ধার’ ছবিতে।

‘নাগরিক’-এ বাবাকে দিয়ে গান গাওয়াতে চেয়েছিলেন ঋত্বিক। বাবার ভাষায়, “আমি তখন খুবই অসুস্থ, রোগাপটকা। তাই রাজি হলাম না” (‘স্মৃতির ছিন্নপত্রে ঋত্বিক’)। সঙ্গী মহানন্দ দাসকে দিয়ে বাবা গাওয়াতে বলেছিল। ঋত্বিক মহানন্দর গান শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন, তাঁকে শুটিংয়ে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং গান রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু ছবির যে-সংস্করণ আমরা আজ দেখতে পাই তাতে সেই গান নেই। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় আবার ঋত্বিক বাবাকে ক্যামেরার সামনে গান গাওয়াতে চাইলেন। বাবা “সেলুলয়েড ভীতির” দরুণ রাজি হয়নি। সেবারে পাঠিয়েছিল রণেন রায় চৌধুরীকে, যার গায়কী অনেকটাই ছিলো বাবার মতো। ‘কান্দিয়া আকুল হইলাম ভব নদীর পারে’ নামক গানের দৃশ্যে এই অসামান্য শিল্পীকে দেখা যায়। বাবার চিঠি হাতে করে ঋত্বিককে গান শোনাতে যাওয়ার গল্প উনি পরে লিখেছেন। ‘কোমল গান্ধার’-এ বাবা অবশ্য রেহাই পায়নি, নেপথ্যে একটা গান গাইতে হয়েছিল। ঋত্বিকের দাবি ছিল, গানে কোমল গান্ধার স্বরটা লাগাতে হবে। ছবির লালগোলা দৃশ্যে পদ্মার চরের উপর বসে যেখানে মন্টু ঘোষ দোতারা বাজাচ্ছেন আর বিজন ভট্টাচার্য গাইছেন, সেখানে ওই গান শোনা যায়: “এপার পদ্মা ওপার পদ্মা মধ্যে জাগনার চর, তারই মধ্যে বইস্যা আছেন শিব সদাগর।”

Hemanga Biswas
বাবা এবং ঋত্বিক ঘটক। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

’৬৯-এ একদিন ঋত্বিক আমাদের সেই উঁচু পাঁচিল-ঘেরা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ঠিক হল, আমাদের বাড়ি থেকে ওঁর খাবার যাবে। কর্তৃপক্ষ সে অনুমতি দিয়েছিলেন। সপ্তাহের দিনগুলো মা বাবার চাকরি, কাজেই প্রথম দিকে আমার উপর ভার পড়ল খাবার নিয়ে যাওয়ার। সে বয়েসেই আমি প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে বাড়ির বাজার করতাম। অনেক ছেলেপিলেই আট-দশ বছর বয়েস থেকে বাড়ির অমন নানা কাজ করত, এখন শুনলে যতই সেটা শিশুর প্রতি অবিচার মনে হোক না কেন। ওতে বেশ আনন্দও ছিল, কারণ বাজার করলে অন্তত পঁচিশ পয়সা সরিয়ে জিলিপি খাওয়া যেত। কাজেই এই মানসিক হাসপাতালের দুঃসাহসী কাজে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হল। প্রথমে খুব পেট গুড়গুড় করছিল মনে আছে। ইষ্টনাম জপ করতে করতে হাতে ‘টিফিন ক্যারি’ নিয়ে গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ওই ভয়ের এলাকায় প্রবেশ করেছি এবং কাজ শেষ করে বেরিয়ে এসেছি, এই ভেবে পরে বেশ গর্ব বোধ করেছিলাম। আরও পরে অবশ্য বুঝেছি, ব্যাপারটায় ওর থেকে গুরুত্বপূর্ণ অন্য জিনিস ছিল। আবছা মনে আছে, ভিতরে ঢুকে একে তাকে জিগ্যেস করে একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানে মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে একটা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন ঋত্বিক। বিড়ি খাচ্ছিলেন। আমি খাবারটা ওঁকে দিয়ে হাফপ্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়ালাম। উনি জিগ্যেস করলেন, তুমি কে? আমি বলেছিলাম, স্পষ্ট মনে আছে, আমি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ছেলে হই। এই শুনে উনি খ্যাকখ্যাক করে খানিকক্ষণ হাসলেন। লম্বা রোগা একজন লোক উঁচু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনে হাসছেন, যে আমি কিনা অত কষ্ট করে ওঁর খাবার পৌঁছে দিয়েছি!

পরের রবিবার মা-বাবা হাসপাতালে গিয়েছিল ওঁকে দেখতে। সুরমা ঘটকও সেদিন এসেছিলেন। বাড়ি ফেরার পর ওদের কথা শুনেই বোঝা গেল সেদিন আমাকে নিয়ে ওখানে খুব একচোট হাসাহাসি হয়েছে। কিছু বইতে তখনও লেখা হত, ‘ইহা হয় একটি বালক’, কিন্তু আমি যে নার্ভাস হয়ে অনুবাদ করে ফেলেছি তা কে বোঝাবে। এর পরে দু’একদিন হাসপাতাল অভিযানে আমার সঙ্গী ছিল আমার মাসতুতো দিদি। ছুটিতে বেড়াতে এসেছিল আমাদের বাড়িতে, ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। খুব বেশিদিন গিয়েছি বলে মনে পড়ে না, তবে একদিনের কথা বিশেষ করে মনে রয়ে গেছে। সেদিন বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না হয়েছে, মা সেই মাছ পাঠিয়েছিল। ঋত্বিক কৌটো খুলে দেখে আমাকে ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, এটা নিয়ে যা। বৌদিকে গিয়ে বলিস, আমি পদ্মা-পাড়ের লোক, এক টুকরো ইলিশ খাই না। মা শুনে খুব আফসোস করেছিল। বাবা অফিস থেকে ফিরে সব শুনে বলল, আই মাস্ট আসক হিম কী তার বইক্তব্য। কিন্তু শেষে কিছু বলেনি। ওরা দু’জনে, বিশেষ করে মা, বহুদিন এই  গল্পটা করত।

একদিন বাবা হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসে চাপা স্বরে মাকে জানাল, ঋত্বিক আজ বলল, এদের একটু বোঝান হেমাঙ্গদা, এই শুয়োরের বাচ্চাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে কোনও লাভ নেই। কথাটা শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। সিনেমায় ওসব দেখাত বটে, কিন্তু অত সিনেমা আমার দেখা ছিল না। কিছুদিন পরে নানা লোকের হস্তক্ষেপে ওই শক থেরাপি বন্ধ হয়, ঋত্বিকের মেয়ে সংহিতাও তেমন লিখেছেন। কিন্তু ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে ঋত্বিকের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। ওখানে বসে নিজের দেখা মানুষজন পরিবেশ নিয়ে ‘সেই মেয়ে’ নামে তিনি যে নাটক লেখেন তাতে তার আভাস পাওয়া যায়। একটা রহস্য আছে অবশ্য ওই নাটকে। শান্তি নামে প্রধান যে চরিত্রটি সেখানে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি তাকে ডাক্তারবাবু উপায়ান্তর না দেখে ইলেকট্রিক শক দেন। শান্তির প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নাট্যকার নিজের যন্ত্রণাভোগের কথা বলছেন বোঝা যায়। কিন্তু নাটকে ডাক্তার চরিত্রটি পরম হিতৈষী, তার চিকিৎসা-বিধিরও কোনও সমালোচনা নেই। শান্তি সেখানে শেষ অবধি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

হাসপাতালের রুগী এবং কর্মীদের নিয়ে ‘সেই মেয়ে’ অভিনয় করিয়েছিলেন ঋত্বিক। শুনেছি, বিনয় মজুমদার সে সময় ওখানে ভর্তি ছিলেন এবং নাটকে অংশ নিয়েছিলেন। বাবার লেখায় পাচ্ছি, ঋত্বিক ওকে দিয়ে গানের অনুষ্ঠান করানোর জন্যে চেষ্টা-চরিত্র শুরু করেন। হাসপাতালে সাংস্কৃতিক কাজকর্মের জন্যে সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল, সেটা জোগাড় করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। শেষে যে-অনুষ্ঠান হয়েছিল তাতে ‘সেই মেয়ে’র অভিনয় হয়েছিল কিনা মনে নেই। সম্ভবত ওখানে একাধিক নাটক করিয়েছিলেন ঋত্বিক। যেদিন বাবা গান গেয়েছিল, সেদিন রুগীরা কয়েকজন গান আর আবৃত্তি করেছিল, একজন ম্যাজিক দেখিয়েছিল, আর সেই সঙ্গে একটা নাটক হয়েছিল, মনে আছে। রীতিমত প্যান্ডেল বেঁধে, সামিয়ানা টাঙিয়ে, মঞ্চের উপর অনুষ্ঠান। আমাকে যেতে বলা হয়েছিল, না নিজে থেকেই গিয়েছিলাম কে জানে। ঘাসের উপর বিছানো শতরঞ্চির মত কিছু একটায় বসে শুনছিলাম। আশে পাশে যারা বসে তারা সবাই ডোরাকাটা ইউনিফর্ম পরা। তাদের দু’একজন স্নিগ্ধতর প্রতিনিধি মঞ্চে উঠছে, একজন গাইছে, ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে’, আমি ভয়ে কাঠ হয়ে বসে আছি। তখনকার দিনে ছেলেমেয়েদের ট্রমা হত না। একালে সন্ধ্যেবেলা ওই চত্বরে বসিয়ে ‘ফাংশান’ শোনালে ওরা বোধহয় ওখানেই ভর্তি হয়ে যেত।

সেই অনুষ্ঠানের ক্লাইম্যাক্সের কথা আমাদের বাড়ির গল্প হয়ে উঠেছিল। বাবার দল গান ধরেছে, “ভেদি অনশন মৃত্যু তুষার তুফান”, ‘রেড পার্টিজান সং’-এর বাবার করা অনুবাদ। সে-গানে যেই বলা হয়েছে, “কমরেড লেনিনের আহবান, চলে মুক্তি সেনাদল” অমনি ইনমেট শ্রোতারা সকলে একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল, তারপরে সার দিয়ে মার্চ করে প্যান্ডেলের বাইরে চলে গেল! পরে জেনেছিলাম, রাতের খাওয়ার ঘণ্টা বেজেছিল। যারা লেনিনের আহবান শুনবার চেষ্টা করছিল তারা শুনতে না পেলেও ওরা শুনেছিল। পরে জায়গাটার যথাযথ নাম হয় পাভলভ হাসপাতাল।

*

এই লেখা লিখতে গিয়ে ‘সুবর্ণরেখা’র কথা মনে পড়ছে। ওই ছবি উন্মাদনাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছিল। এখানে সেই আলোচনার সুযোগ নেই, কিন্তু মন দিয়ে কাহিনির পর্বান্তরগুলো অনুসরণ করলে দেখতে পাব, মাঝে মাঝে ছবির মধ্যে জড়ানো পটে বলা হচ্ছে কিছু কাল কেটে যাওয়ার কথা, আর কেউ একটা পাগল হয়ে যাচ্ছে, অথবা মহাশূন্যে চলে যাচ্ছে গাগারিনের মতো। বাবা লিখেছে, হাসপাতালে ঋত্বিকের সঙ্গে ‘সুবর্ণরেখা’ নিয়ে ওর কথা হত। বাবার মতে, ওই ছবির চূড়ান্ত ট্র্যাজেডিতে, যেখানে ঈশ্বর গিয়ে সীতার ঘরে পৌঁছয়, সেখানে হতাশা বা অপবাদ নেই, বরং “দস্তয়েভস্কির মতো, হি ইজ ক্রাইং ফর দেম” (‘স্মৃতির ছিন্নপত্রে ঋত্বিক’)। কিন্তু নকশালবাড়ির ওই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাবার মনে হয়েছিল, সুবর্ণরেখা নদীর এক পার দেখিয়েছেন ঋত্বিক, অন্য পারে রয়েছে গোপীবল্লভপুর। বাবার প্রশ্ন ছিল, গোপীবল্লভপুরের রিয়ালিটি তুমি ধরতে পারবে? ঋত্বিক উত্তর দিয়েছিলেন, আমি ভাবব এ নিয়ে। বাবা ওঁকে ফেলিক্স গ্রিনের চিনের উপর বই পড়তে দিয়েছিল। কয়েক বছর পরে একটা চিত্রনাট্য নিয়ে বাবার কাছে এসেছিলেন ঋত্বিক। সেটা ছিলো ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’র চিত্রনাট্য। ওঁর মুখে ছবির গল্পটা শুনে বাবার মনে হয়েছিল, হয়তো ওদের সেই আলোচনার কোনও ভূমিকা রয়েছে তাতে। বাবা ছবিটা দেখেছিল ঋত্বিকের মৃত্যুর বছর খানেক পরে, হাওড়ার ‘পারিজাত’ সিনেমা হলে এক অনুষ্ঠানে। আমিও সেদিন ছিলাম। ওটাই আমার দেখা ঋত্বিকের প্রথম ছবি।

‘সুবর্ণরেখা’র কথা ভাবলে ফেদেরিকো ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’ (১৯৬০) ছবির কথা মনে পড়ে। শুধু সেই ছবির সঙ্গীতের উদ্ধৃতি ছিল বলে নয়, আরও গভীর যোগাযোগ ছিল। ‘দোলচে ভিতা’ ঋত্বিককে  বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল, ভাবিয়ে তুলেছিল। ওই ছবি নিয়ে ওঁর অসামান্য প্রবন্ধে এক জায়গায় উনি লিখছেন “ফেলিনি ভদ্রলোকটি ‘ক্রতো স্মর’-ও বলেছেন, ‘কৃতং স্মর’-ও বলেছেন, আমাদের কঠোপনিষদের মন্ত্রদ্রষ্টা কবির মতোই।” ‘সুবর্ণরেখা’র শেষ দিকে ঈশ্বর আর হরপ্রসাদ ট্যাক্সি চড়ে রাত্রির শহরে যাত্রা করে। গাড়ির কাচ দিয়ে দেখি সরে যেতে থাকা আলোর মালা, আর নেপথ্যে শুনি দুই মাতালের কণ্ঠস্বর: “অ্যাটম বোমা দেখে নাই, যুদ্ধ দেখে নাই, মন্বন্তর দেখে নাই …।” একসময় হরপ্রসাদ ফিসফিস করে, “ক্রতো স্মর, কৃতং স্মর।” কঠোপনিষদের শ্লোক আসে তার আগে। ওই দৃশ্যের শুরুতে তার মুখ থেকে শুনি, “উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।”

এই দুই ছবির মধ্যে বছর দুই-এর ব্যবধান। ‘দোলচে ভিতা’ ঋত্বিক নিশ্চয়ই প্রথমবার দেখেন ’৬০- ৬১ সালে। একবার বাবা আমাকে জিগ্যেস করেছিল, তোরা ‘লা দোলচে ভিতা’ দেখেছিস? আমি তখন ক্যাম্পাসে ফিল্ম সোসাইটি করি। ভাবছিলাম কিছু জেনারেল নলেজ পরিবেশন করা যায় কিনা। বাবা বলেছিল, ঋত্বিক আমাকে ছবিটা দেখাতে চেয়েছিল, এসে বলেছিল, হেমাঙ্গদা, চলুন একটা কসমিক ছবি দেখে আসি।                            (চলবে)

বাবার গল্প ১ 

5 Responses

  1. কিছু বলার মতো ভাষা ক্ষমতা কিছুই নেই ! মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুধু পড়ছি আর জানছি দুই কিংবদন্তি মানুষেদের কথা ও তাদের সহধর্মিণীদের নীরব সক্রিয় ভূমিকা !!
    আপনাকে সহস্রকোটি প্রণাম জানাই মৈনাক !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com