১৯৮০ সাল। ইন্টারনেট ছিল না। এসটিডিও না। মোবাইল ভবিষ্যতের গর্ভে। কাগজে ছাপা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার রেজাল্ট কে এনে দিয়েছিল এখন মনে নেই। সেইটা হাতে নিয়ে দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ির নীচ থেকে কলকাতায় ট্রাংক কল বুক করেছিলাম। ঘন্টা খানেক পর কলকাতায় কথা বললাম। বাবা আর মায়ের সঙ্গে। তাঁরা এতদিন ধরে যা চেয়েছিলেন, তা হয়েছে। ফোনে অবশ্য চোখের জল দেখা যায়না। গলা শুনে বুঝতে পারছিলাম ওঁরা আবেগ বিহ্বল। আমার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর শেষ স্টেশনে পৌঁছে গেছি। এর পর কোথাও যাওয়ার নেই। তৃপ্তির বোধ নিজের জন্য নয়, আমার প্রতিটি জাগতিক ব্যর্থতা যাঁদের বিচলিত করে সেই মা ও তাঁর ছায়ানুসারী বাবার জন্য। ইয়ারোজ এর নিবিড় স্নেহমাখা কোলের মায়া ত্যাগ করে চলে এলাম মসূরি অ্যাকাডেমি। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ফিরে আসা।তাই মনে হয়েছিল, শিমলা ছিল এক মধুর স্বপন। আমি যেন মসূরিতেই ছিলাম, অন্য কোথাও যাইনি।

আবার ফাউন্ডেশন কোর্স। গতবারের লেকচার সমূহ এখনও মনে জ্বল জ্বল করছে, তার মধ্যেই আবার ফেরা। ইউ পি এস সির পরীক্ষা পাশের পর ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়া মানে দু’বছরের জন্য নানা বিধ ট্রেনিং এর জন্য তৈরি হওয়া। মসূরির জাতীয় অ্যাকাডেমি মূলত আইএএস ট্রেনিং-এর জন্য। তবে, ফাউন্ডেশন কোর্স করে সব সর্বভারতীয় আর কেন্দ্রীয় সার্ভিসের সদস্যরা মিলেমিশে। চারমাসের ফাউন্ডেশন কোর্স শেষ হলে যে যার নিজের অ্যাকাডেমি তে চলে যায়, আরও নিপুণ আর সূক্ষ্মভাবে প্রশিক্ষিত হতে। আইপিএস অফিসাররা যান হায়দরাবাদের পুলিশ অ্যাকাডেমি তে, অডিট অ্যাণ্ড অ্যাকাউন্টস, শিমলায়। ইনকাম ট্যাক্স নাগপুরে।আমাদের ফাউন্ডেশন কোর্স এর পর ফিল্ড ট্রেনিং। ফিল্ড ট্রেনিং এ যাওয়ার আগে ও পরে আছে পড়াশুনো, শারীরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও আরও নানা আকর্ষক ব্রেক। ট্রেকিং, ভিলেজ ভিজিট, আর্মি অ্যাটাচমেন্ট, ভারত দর্শন। প্রথম দুটি ফাউন্ডেশন কোর্সে সবার জন্য। গতবার বাড়ির হা -হুতাশ খচিত পত্রাঘাতের জেরে এগুলি ভালো করে উপভোগ করতে পারিনি। এবার করব ভেবে মন প্রফুল্ল।
এছাড়াও আছে নানা সোসাইটি ও তাদের প্রতিযোগিতা, পুরস্কার ইত্যাদি। ডিবেট আমি পারিনা। পারি কবিতা লিখতে। আর একটু আধটু রাইফেল চালাতে। আমার একটা কবিতা ইংরেজি অনুবাদ হয়ে সাহিত্য সোসাইটির প্রাইজ পেয়ে গেল।কবিতা বিচার নাকি আপেক্ষিক, কালই শুনছিলাম। এখানেও যে মারাঠি যুবক যুগ্ম ভাবে পুরস্কারের প্রস্তাবনা করেছিল, তার বিচার সম্পূর্ণ কবিতা নির্ভর ছিলনা, এই রকমই আমার সন্দেহ। কবিতা টা অবশ্য মন্দ হয়নি। পরে আমার প্রথম কবিতার বই ‘চন্দন গাছ’ এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। জানলাম ছেলেটি আইআইটি বম্বে থেকে ফিজিক্স-এ এমএসসি ও পরিবেশ বিজ্ঞানে এম টেক করছিল। বাড়ি, মহারাষ্ট্রের জলগাঁও জেলায়। বড় হয়েছে বিহারের দ্বারভাঙ্গায়। পিএচ ডির কাজ অসমাপ্ত রেখে আইএএস ইন্টারভিউতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে এসেছে।

সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়— এই প্রবাদ অনুসরণ করে আমি মেঘ বৃষ্টি কুয়াশা রঞ্জিত মসূরির পথে অই মারাঠি যুবকের সঙ্গে অপরাহ্ন ভ্রমণে, লাইব্রেরি পয়েন্টে পান্তুয়া খেতে এবং ব্যারেটোর স্যূপ তথা হ্যারি’স এর আলু পরাঠা শেয়ার করতে প্রবৃত্ত হলাম। এই ব্যাপারটা যে প্রেমের দিকে এগোচ্ছে তা বুঝতে বুঝতে এসে গেল ভারত দর্শন নামক মহা ভ্রমণ, যেখানে আস্ত আস্ত ট্রেনের বগি বুক করে তার ওপর কাগজ সেঁটে “আইএ এস প্রোবেশনারস অন ভারত দর্শন” লিখে হই হই করে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়ানো হয়। কোনও প্রাদেশিকতা পাছে প্রশ্রয় পায়, সেই জন্য অ্যাডমিন অফিসে লটারি করে ভারত দর্শনের নানা জোন ঠিক হয়। তাতে দেখা গেল আমাদের ভ্রমণ পথ বিরাট দেশের দুই প্রান্তে। মুখ চুণ করে ধর্ণা দিলাম অ্যাডমিন অফিসের বহুগুণাজীর অফিসে। সদাশয় বহুগুণা এমন গ্রুপ বদলের অনুরোধ নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে পান। আমাদের দেখে প্রসন্ন হেসে বললেন, হো জায়গা বেটা। মাস দুয়েক কাটল পথে। ট্রেনের কামরায়, সরকারি গেস্ট হাউস আর ডাক বাংলোয় রাত্রিবাস। মধ্যযামিনীর ঘুমন্ত স্টেশন, ধূ ধূ রোদে দীর্ণ প্রান্তর, পাহাড় আর অরণ্যের মাঝ দিয়ে নিরুদ্দেশে ছুটে যাওয়া— আহা সে কী আনন্দ। স্টেশনে নেমে পুরী তরকারি আর সিঙাড়া কচুরি খাওয়া। দিনের বেলা ট্রেনের বার্থে যখন তখন ঘুম। মারাঠি যুবক সতীশ অগ্নিহোত্রী আমাদের দলের লিডার। তার কড়া শাসনে প্রাণ সর্বদা অতিষ্ঠ। পুরীতে সূর্যোদয় ভোর সাড়ে পাঁচটায় এবং তা দেখতেই হবে। ফলে, সাড়ে চারটের সময় তুলে দেওয়া হবে পুরো দলকে। এছাড়া খাবার টেবিলে সময়ে পৌঁছানো, ট্রেনে নিজেদের জিনিস পত্র ঠিক সময়ে তোলার তাড়া তো আছেই।একটা জিনিস দেখে মুগ্ধ হতাম। নিজের ভারী জিনিসপত্র যারা তুলতে পারত না, সবাই কে সাহায্য করত সতীশ অগ্নিহোত্রী আর আমাদের ব্যাচের টপার ভি রমণী। মাঝে মাঝে এমন ঘটেছে, ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে , ওদের নিজেদের জিনিস পত্র তখনও প্লাটফর্মে পড়ে। বগি তে বার্থ থাকত ২২ টা। আমরা ছিলাম ২৪ জন। পুরো সফরেই এই দুই ত্যাগী বীর দুই বেঞ্চের মাঝে মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমোল, অথচ নেতাগিরি ফলিয়ে কাউকে নীচে শুতে বলল না। মনের কোণে দুরাশা ছিল, সতীশ কে বিয়ে করলে পরবর্তীকালে মহিলা দের প্রতি যাবতীয় শিভ্যালরির উত্তরাধিকার পাবো আমি এবং একা আমি। তা হয়নি। কেবল একাকিনী মহিলা নয়,সকল পরিচিত অপরিচিতর জন্যই সে আজও নিজের হাতটি ভালোবেসে বাড়িয়ে রেখেছে।

ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।
সমাপ্ত
কলকাতায় জন্ম, বড় হওয়া। অর্থনীতির পাঠ প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখক জীবন আরম্ভ। সূচনা শৈশবেই। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য লেখায় অনায়াস সঞ্চরণ। ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার সদস্য ছিলেন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়। মহুলডিহার দিন, মহানদী, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, ব্রেল, কবিতা সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ ইত্যাদি চল্লিশটি বই। ইংরাজি সহ নানা ভারতীয় ভাষায়, জার্মান ও সুইডিশে অনূদিত হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। শরৎ পুরস্কার, সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণপদকে সম্মানিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর সোমেন চন্দ পুরস্কার ফিরিয়েছেন নন্দীগ্রামে নিরস্ত্র মানুষের হত্যার প্রতিবাদে। ভারতের নানা প্রান্তের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর উন্মোচিত তাঁর লেখায়। ভালোবাসেন গান শুনতে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে, প্রকৃতির নানা রূপ একমনে দেখতে।
2 Responses
এ কি, শেষ কেন?
চলবে না, চলবে না।
আরও চাই। আরও চাই।
যে দুরের থৈ নেই তার আবার শেষ কি? অপূর্ব রসময় গদ্য এবং অনুপম উপমায় অলংকৃত এক স্মৃতিকথন।