আগের পর্বের লিংক:
[১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫]
কিন্তু যখন সবুজ পতাকা উড়ল, গুনে গুনে সাতবার বন্দুক দাগা হল এবং নেপোলিয়ন তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বক্তৃতা দিল— তখন জন্তুদের মনে হল তারা সত্যি সত্যিই এক মহাযুদ্ধে জয়লাভ করেছে। যেসব জন্তুরা যুদ্ধে মারা গিয়েছে তাদের শেষকৃত্য সম্পন্ন হল গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে৷ তাদের শবদেহবাহী গাড়িটা টানল বক্সার আর ক্লোভার মিলে৷ নেপোলিয়ন স্বয়ং সেই শোভাযাত্রার সামনে সামনে হাঁটল৷ উদযাপন চলল টানা দু’দিন ধরে৷ গান গাওয়া হল, বক্তৃতা দেওয়া হল, বন্দুকও ছোড়া হল বেশ কয়েকবার। প্রতিটি জন্তুকে উপহার হিসেবে দেওয়া হল একটি করে আপেল, পাখিদের দু’আউন্স করে শস্য, আর কুকুরেরা পেল তিনটে করে বিস্কুট। ঘোষণা করা হল, এই যুদ্ধকে বলা হবে ‘হাওয়া-কলের যুদ্ধ’৷ এই উপলক্ষ্যে নেপোলিয়ন একটা নতুন খেতাবের সৃষ্টি করল, যার নাম— ‘সবুজ কেতন সম্মান’ এবং খেতাবটা সে নিজেই নিজেকে দিল৷ এইভাবে আনন্দ উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে জাল নোটের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটা সকলে যেন ভুলেই গেল একেবারে৷
এর কিছুদিন পরের কথা৷ খামার বাড়ির মাটির নীচের ভাঁড়ার ঘর থেকে এক বাক্স হুইস্কি খুঁজে পেল শুয়োরেরা৷ প্রথমবার বাড়িটা দখল করার সময় বোধহয় কোনওভাবে সেটা নজর এড়িয়ে গিয়েছিল সবার।
সে-রাতে খামারবাড়ি থেকে উঁচু গলায় গান শোনা গেল। সবাই তো ভয়ানক অবাক, কারণ সেই গানের সঙ্গে ইংল্যান্ডের পশুরা গানটাও মিশে রয়েছে খানিক খানিক৷ রাত সাড়ে ন’টায় নেপোলিয়ন বেরিয়ে এল খামার বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে৷ সবাই তাকে স্পষ্ট দেখতে পেল। তার মাথায় মিস্টার জোন্সের গোল টুপি। সে লাফাতে লাফাতে খুব দ্রুত উঠোনটাকে একবার চক্কর দিল। তারপর আবার ঢুকে পড়ল ভেতরে।
পরদিন সকালে দেখা গেল খামারবাড়িটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে আছে। একটা শুয়োরেরও পাত্তা নেই। সকাল ন’টা নাগাদ বিষণ্ণ পদক্ষেপে ধীরে ধীরে খামারবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল স্কুইলার। তার চোখ-মুখ অন্ধকার৷ লেজটা নিস্তেজ হয়ে ঝুলে রয়েছে৷ স্কুইলার জন্তুদের একজোট করে বলল যে, সে একটা ভয়ংকর খবর শোনাতে এসেছে৷ খবরটা হল, কমরেড নেপোলিয়ন এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে৷
নিমেষে যেন হাহাকার পড়ে গেল৷ খামারবাড়ির দরজার বাইরে খড় বিছিয়ে হত্যে দিল জন্তুরা৷ কেউ যদি হাঁটাচলা করছে, তো সেটাও একেবারে পা টিপে টিপে৷ কখনও একে অপরকে জলভরা চোখে জিজ্ঞেস করছে, নেতা মারা গেলে তাদের কী হবে! কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, স্নোবল না কি কৌশলে নেপোলিয়নের খাবারে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে৷ এগারোটার সময় স্কুইলার বেরিয়ে এসে আর একটা ঘোষণা করল৷ মৃত্যুর আগে তার শেষ কাজ হিসেবে নেপোলিয়ন কঠোর আদেশ জারি করেছে যে, কেউ মদ্যপান করলেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে৷
সন্ধের মধ্যেই অবশ্য নেপোলিয়নের অবস্থার অনেকটা উন্নতি হল৷ পরদিন সকালে স্কুইলার এসে সকলকে জানাল যে, নেপোলিয়ন দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে। সেদিনই সন্ধে থেকে কাজকর্ম করতে শুরু করল নেপোলিয়ন। পরদিন জানা গেল, সে হুইম্পারকে উলিংডনে পাঠিয়েছে মদ তৈরি ও পাতন-পদ্ধতির উপর বইপত্র কিনে আনার জন্য৷ এক সপ্তাহ পরে নেপোলিয়ন হুকুম দিল, ফল বাগানের পাশের ছোটো মাঠটায় লাঙল চালানো হবে৷ আগে ঠিক করা হয়েছিল কাজ থেকে অবসর নেওয়া জানোয়ারদের চরার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হবে মাঠটাকে৷ মাঠটা এমনিতে বেকার বেকার পড়েই আছে, গাছপালাও তেমন হয় না৷ তাই মাঠটাকে ভাল করে চষে বীজ লাগানো হবে। শীঘ্রই জানা গেল নেপোলিয়ন জমিটাতে যব চাষ করতে চায়৷

এই সময় খামারে এমন একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল যার কোনও ব্যাখ্যাই নেই কারও কাছে। এক রাতে বারোটা নাগাদ হঠাৎ খামারের উঠোনে কিছু একটা ভেঙে পড়ার জোর শব্দ পাওয়া গেল। জন্তুরা হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এল নিজেদের খুপরি থেকে। জ্যোৎস্না রাত৷ চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। সবাই দেখল, গোলাবাড়ির দেওয়ালের একেবারে শেষ প্রান্তে, যেখানে সাতটি বিধান লেখা আছে, তার ঠিক নীচে দু-টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে রয়েছে একটা মই। আর সেই মইয়ের ঠিক পাশে হতবুদ্ধি অবস্থায় হাত-পা ছড়িয়ে চিৎপাত হয়ে রয়েছে স্কুইলার৷ তার হাতের কাছেই একটা লণ্ঠন, একটা রং করার ব্রাশ আর একটা সাদা রঙের ডিবে উল্টে রয়েছে। কুকুরগুলো সঙ্গে সঙ্গে স্কুইলারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর সে কিছুটা ধাতস্থ হতেই তাকে রীতিমতো পাহারা দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেল খামারবাড়িতে৷ ব্যাপারটা যে আসলে কী ঘটেছে তা জন্তুদের মোটেই বোধগম্য হল না৷ ব্যতিক্রম বেঞ্জামিন। সে এমনভাবে মাথা নাড়তে লাগল যেন সে সব বুঝেছে, কিন্তু মুখ ফুটে একটা কথাও বলল না৷
কয়েকদিন পরেই সাতটা বিধান পড়তে গিয়ে মুরিয়েল দেখল আবার একটা বিধান তারা ঠিকঠাক মনে করতে পারছে না। তাদের মনে হচ্ছিল যেন পঞ্চম বিধানে লেখা রয়েছে, ‘কোনও জন্তু মদ্যপান করবে না৷’ কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে একটা শব্দ তারা বেমালুম ভুলেই বসে আছে৷ আসলে পঞ্চম বিধানটি হল, ‘কোনও জন্তু অতিরিক্ত মদ্যপান করবে না৷’
৷৷ ৯৷৷
বক্সারের ফাটা খুর ঠিক হতে অনেকটা সময় লাগল৷ বিজয় উদযাপন শেষ হওয়ার পরদিন থেকেই হাওয়া-কল তৈরির কাজ চালু হয়ে গেছে। বক্সার এক দিনও ছুটি নিতে রাজি হল না৷ সে যে ব্যথায় কাতর হয়ে রয়েছে সেটা বাকিরা বুঝতে পারলে তার কাছে বড়োই অসম্মানের ব্যাপার হবে৷ তাই সে এমন একটা ভাব করে চলে যেন তার কিছুই হয়নি৷ কিন্তু সন্ধেবেলা, একান্তে, সে ক্লোভারের কাছে স্বীকার করে যে, খুরের ব্যথায় তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে৷ ক্লোভার কিছু ভেষজ গুল্ম চিবিয়ে তার ক্ষতস্থানে পুলটিশ দিয়ে দেয়৷ সে এবং বেঞ্জামিন বক্সারকে বারংবার অনুরোধ করে কম খাটাখাটনি করতে৷ ক্লোভার বুঝিয়ে বলে, “ঘোড়ার ক্ষমতা কিন্তু চিরস্থায়ী নয়৷” কিন্তু বৃথাই চেষ্টা৷ বক্সার কোনও পরামর্শ কানেই তোলে না। তার কথামতো, তার জীবনে এখন একটাই লক্ষ্য— অবসর নেওয়ার আগে সে হাওয়া-কলটাকে সম্পূর্ণ হতে দেখে যেতে চায়৷

শুরুতে, অ্যানিম্যাল ফার্মের আইনকানুন তৈরির সময় ঘোড়া আর শুয়োরের অবসরের বয়স ঠিক করা হয়েছিল বারো বছর৷ গোরুর চোদ্দো, কুকুরের নয়, ভেড়ার সাত আর হাঁস-মুরগির পাঁচ বছর৷ বেশ ভালোমতো অবসর ভাতা দেওয়া হবে বলেও ঠিক করা হয়েছিল সেই সময়৷ কোনও জন্তু এখনও অবধি ভাতা-সহ অবসর নেয়নি বটে, তবুও আজকাল এই বিষয়টা নিয়ে বেশ ঘন ঘন চর্চা হচ্ছে। ফল বাগানের পাশের ছোটো মাঠটায় যেহেতু এখন যব চাষ করা হবে বলে ঠিক হয়েছে, তাই গুজব রটেছে যে, বিশাল ঘাস জমির একটা অংশ বেড়া দিয়ে ঘিরে আলাদা করে বুড়ো জন্তুদের চরে বেড়াবার জায়গা বানানো হবে৷ বলা হচ্ছে ঘোড়াদের অবসর ভাতা হবে প্রতিদিন পাঁচ পাউন্ড শস্য আর শীতকালে পনোরো পাউন্ড খড়৷ ছুটির দিনগুলোতে একটা গাজর বা হয়তো একটা আপেল মিলবে। আগামী বছরের গ্রীষ্মে বক্সারের বারো নম্বর জন্মদিন আসতে চলেছে।
ইতোমধ্যেই আবার শুরু হল কষ্টের দিন৷ গত বছরের মতোই এবারেও শীতের কামড় মারাত্মক৷ খাবারেরও ঘাটতি দেখা দিয়েছে৷ সকলের খাবারের বরাদ্দ ফের কমিয়ে দেওয়া হল। বরাদ্দ কমল না কেবল শুয়োর আর কুকুরদের। খাবারের সমান বণ্টন ব্যাপারটা যে পশুবাদের নীতির বিরোধী— সেটা স্কুইলার সকলকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিল। দেখে যা-ই মনে হোক না কেন, আসলে যে খাবার-দাবারের কোনও ঘাটতি নেই— সেটা বাকি জন্তুদের কাছে প্রমাণ করতে স্কুইলারের বিন্দুমাত্র সমস্যা হল না৷ সে বলল, এটা সত্যি যে সাময়িকভাবে খাবারের বরাদ্দের ক্ষেত্রে একটা ‘নতুন ব্যবস্থা’ চালু করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, (স্কুইলার সবসময় এই ‘নতুন ব্যবস্থা’ কথাটা বলে থাকে৷ কখনও বরাদ্দ ‘কমিয়ে দেওয়া’ বলে না৷) কিন্তু যদি জোন্সের আমলের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা হলে দেখা যাবে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে৷ উচ্চকণ্ঠে দ্রুত সব পরিসংখ্যান আউড়ে স্কুইলার জন্তুদের কাছে প্রমাণ করে দিল যে, জোন্সের আমলের চেয়ে এখন আরও বেশি জই, খড় আর শালগম উৎপন্ন হয়। তাদের কাজের সময় অনেকখানি কমেছে। পানীয় জল এখন আরও বেশি পরিশুদ্ধ৷ জন্তুদের আয়ু বেড়েছে৷ শিশু-মৃত্যুর হার কমেছে। তাদের থাকার খুপরিতে খড়ের পরিমাণ এখন অনেক বেশি থাকে৷ এ ছাড়াও মাছির উৎপাতও এখন অনেক কম।
ছবি সৌজন্য: PublicDomainpictures, Istock, PeakPx,
অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।