banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

গল্প: প্রাণবায়ু

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Oxygen

দীর্ঘদিন ধরিয়া ঘ্যানর ঘ্যানর করিয়া মুখের কষ উঠিয়া গেল, তবু আমার অর্ধাঙ্গ মহাশয় কোথাও বেড়াইতে লইয়া গেলেন না। দিঘা, পুরীর নাম করিয়া কত টলাইবার প্রচেষ্টা করিলাম। সমুদ্রের বায়ুসেবন করিলে শরীর, মন ভাল হয়। সর্বোপরি কত্তামশাইয়ের সঙ্গে নিভৃতে দু’টি খোশগল্পও করা যাইবে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! তিনি একচুলও নড়িলেন না। প্রত্যহ যাহা করিয়া থাকেন, কোলবালিশ জড়াইয়া ঘুমাইয়া রহিলেন। মশারির অভ্যন্তরে ক্রমাগত নাসিকাগর্জনধ্বনি শুনিতে শুনিতে আমার দম আটকাইয়া যাইবার জোগাড়। 

প্রকৃতপক্ষে, স্বামীটিকে ‘মহাশয়’ না বলিয়া ‘হাড়কেপ্পন’ বলিলেই যথোপযুক্ত হইত। বেড়াইতে লইয়া গেলে অর্থব্যয় হইবেই। অতএব, ভ্রমণ বাতিল। সদাই বলেন, “হাওয়া খাইবার জন্য সমুদ্রপারে যাইবার কী হইল? এই তো ছাতে লাইফস্টাইল পত্রিকায় নিত্যনৈমিত্তিক মনোহরা খাদ্যসমূহের ছবি দেখিয়া বায়না করিতাম রেস্তোরাঁয় নৈশভোজের নিমিত্ত। তাহাতেও প্রবল আপত্তি। অর্থের অপচয় হইবে! সমুদয় লোকের বাজারের পর বেলাশেষে ঝড়তি পড়তি সবজি, মাছ, সস্তায় কিনিয়া আনিতে পারার মধ্যে যে কতখানি বিজয়োল্লাস থাকিতে পারে, এই ব্যক্তিকে না দেখিলে কেহ বিশ্বাস করিবেন না।

অতঃপর আমার দিনগুলি কাটিতেছিল বিস্বাদ। আলুনি। প্রত্যহ হস্তপদ পুড়াইয়া রান্নাবান্না এবং টিভিতে একঘেয়ে মেগাধারাবাহিক দেখিয়া কালাতিপাত। অবরে সবরে ছাতে উঠিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস নির্গমন। 

একমাত্র কন্যা বিবাহের পর শ্বশুরালয়ে। তাহার সঙ্গে প্রত্যহ ঘণ্টাখানেক মোবাইলে বকবক করিয়া চিত্ত বিনোদন করি। কর্তা আপিস হইতে ফিরিয়া চলিয়া যান তাসের আড্ডায়। ফিরিতে ফিরিতে রাত্রি। সেইস্থানে সঙ্ঘ, ঘাসফুল, লেনিনবাদ লইয়া কতই না গুরুগম্ভীর আলোচনা। শুধু পত্নীর সঙ্গে কোনওরূপ গল্প থাকিতে পারে না! আমার কপাল খারাপ। এক্ষণে বলিয়া রাখি, পূর্বে এসকল দেখিয়া ভাবিয়া ম্রিয়মাণ হইতাম। কত কাঁদিয়াছি, অভিমান করিয়াছি, রাগিয়া উচ্চৈঃস্বরে গাল পাড়িয়াছি। আমার বক্তব্যে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করিয়া পাশবালিশ জড়াইয়া তিনি শুইয়া পড়িয়াছেন। আমা অপেক্ষা পাশবালিশ আপন হইল দেখিয়া আমি বালিশ ছুঁড়িয়া ফেলিয়াছি। লাভ হয় নাই। কূজন করিবার কালেই অবহেলা করিয়াছেন, এখন তো সে বয়সই নাই। 

ইদানীং স্বামীরত্নটিকে আচ্ছা করিয়া টাইট দেওয়ার প্রবল মনোবাসনা জাগিয়া উঠে। শুধু অনুকূল পরিস্থিতির অভাবে গুমরাইয়া থাকি। অবশেষে আসিল সেই একদিন, যেদিন কর্তা বাড়ি ফিরিলেন, কিন্তু চা-জলখাবার খাইয়া সান্ধ্য-আড্ডায় যাইলেন না। কহিলেন, মাথা ব্যথা। মাথা টিপাইবার নিমিত্ত কক্ষে ডাকিলেন। ভাবিলাম, কোনওপ্রকারে এড়াইব। কিন্তু তাঁহার চোখ ছলছল। শরীরের উত্তাপও ক্রমবর্ধমান। নৈশাহারের কিছুই মুখে তুলিলেন না। কহিলেন স্বাদ-গন্ধহীন! তাজ্জব  হইয়া ভাবিলাম, হইল কী। পাতে অন্ন ফেলিয়া দিতে কখনও তো দেখি নাই হিসাবি মানুষটিকে!

ইত্যবসরে লক্ষ করিলাম, আমারও শরীরগতিক সুবিধার নহে। ম্যাজম্যাজ করিতেছে। খুকখুক কাশির দমক উঠিতে লাগিল। মুখপুস্তিকায় মানুষজন অহরহ পোস্টাইতেছেন করোনা করোনা! তাহা হইলে কি সেই অলপ্পেয়ে ব্যারামবাবু রাসকীর্তন করিতে আসিলেন? দুশ্চিন্তায় ঘুম আসিল না। হে ভগবান, এখন কী করিব? ব্যাধি যদি প্রবল হয়, তাহা হইলে কী হইবে? দুইজন বাঁচিব তো? প্রাণবায়ু এত সহজে হারাইতে চাহি না। 

সাতপাঁচ ভাবিয়া স্থির করিলাম, কন্যার নিকট সর্বস্ব প্রকাশিব। কোথায় বিমার কাগজ, কত অর্থ ধারবাকি, কত ফেরত পাইব, সমুদয়। কন্যা নিশীথ রাত্রে অকস্মাৎ ফোন পাইয়া, তদুপরি উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দলিল-দস্তাবেজের আলোচনা শুনিয়া ভীষণ ঘাবড়াইয়া গেল এবং তারস্বরে কান্না জুড়িল। হঠাৎ করিয়া কর্তা আসিয়া ফোন কাড়িয়া লইলেন। আমাকে টানিতে টানিতে পাশের কক্ষে লইয়া গিয়া বলিলেন, “আজ হইতে আমি আর তুমি সম্পূর্ণ ভিন্ন থাকিব।” আমি ছলছল চক্ষু লইয়া কহিলাম, “সে তো এমনিই থাকি। নূতন কী!”

কর্তা বলিলেন, “আলাদা শয্যায় বিশ্রাম লইয়া শরীর সুস্থ কর। নচেৎ ডাক্তারবদ্যি ডাকিতে হইবে। সে অনেক খরচ।” এতক্ষণে বোধগম্য হইল ওঁর বাক্যের সারমর্ম। পাছে ঔষধ, চিকিৎসকে প্রচুর অর্থব্যয় হয়, তাই প্রথম হইতেই সাবধানতা অবলম্বন করিতেছেন। ঢোঁক গিলিয়া শুধাইলাম, “পৃথক শয্যায় আমার ঘুম হইবে বলিয়া তোমার মনে হয়?” মৃদু ভর্ৎসনা করিয়া তিনি কহিলেন, “করোনা জ্বর ছেলেখেলা নহে গিন্নি। এ যাত্রায় বাঁচিয়া গেলে জানিবে অনেক ভাগ্য।”
“একাকী শুইলে আমার নিদ্রা আসিবে না।” ভীতকণ্ঠ বলিলাম। কর্তা স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া উত্তর করিলেন,
“প্রাজ্ঞজন বলিয়াছেন করোনাকে কোলবালিশের মতো ভাবিয়া, চাপিয়া ধরিয়া ঘুমাইয়া পড়িতে। সুতরাং তাহাই কর।”
সে রাত্রে কাহারও চক্ষে ঘুম আসিল না। অগত্যা এপাশ ওপাশ করিয়া আমার সঙ্গেই কথা শুরু করিলেন কর্তা।

একমাত্র কন্যা বিবাহের পর শ্বশুরালয়ে। তাহার সঙ্গে প্রত্যহ ঘণ্টাখানেক মোবাইলে বকবক করিয়া চিত্ত বিনোদন করি। কর্তা আপিস হইতে ফিরিয়া চলিয়া যান তাসের আড্ডায়। ফিরিতে ফিরিতে রাত্রি। সেইস্থানে সঙ্ঘ, ঘাসফুল, লেনিনবাদ লইয়া কতই না গুরুগম্ভীর আলোচনা। শুধু পত্নীর সঙ্গে কোনওরূপ গল্প থাকিতে পারে না! আমার কপাল খারাপ। এক্ষণে বলিয়া রাখি, পূর্বে এসকল দেখিয়া ভাবিয়া ম্রিয়মাণ হইতাম। কত কাঁদিয়াছি, অভিমান করিয়াছি, রাগিয়া উচ্চৈঃস্বরে গাল পাড়িয়াছি। 

পর পর তিনদিন গৃহে আবদ্ধ থাকিয়া তাঁহার খোলনলচে বিস্তর পরিবর্তিত হইতে লাগিল! দুর্জনে যাহাকে ভাইরাসের ‘মিউটেশন’ কহিয়া থাকে, অনেকটা সেইরূপ। এই ত্রিশ বৎসরের দাম্পত্য জীবনে ভাবিতে পারি নাই কখনও আমার গলায় গান শুনিতে চাহিবেন। তাহাও ঘটিল। তিনি ও ঘর হইতে ফরমায়েশ করেন আর আমি এ ঘর হইতে দু’কলি গাহিয়া উঠি। উনিও দু’একবার গুনগুন করেন। কণ্ঠের মন্দ্রতা শুনিয়া পুলকিত হইলাম। তাহা ব্যতীত কী পাহাড়প্রমাণ গল্প ওঁর ঝুলিতে জমা ছিল, মালুম হইল। আপিসের বেয়ারা কীরূপ বজ্জাতি করিয়া থাকে কিংবা সহকর্মীদের কূটকচালি, বলিতে লাগিলেন জ্বরের ঘোরে। কবে আপিসের চড়ুইভাতিতে উনি কারণবারি পান করিয়া ঈষৎ টালমাটাল হইয়াছেন, প্রতিবেশিনী লীলাবতী কারণে অকারণে কীরূপে ওঁকে কটাক্ষ করিয়া থাকে, সবই অবগত হইতে লাগিলাম। লীলাবতীর প্রতি রাগে গা রি রি করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। পুরুষমানুষের মনের অর্গল খুলিয়া দেওয়ার জন্য করোনার প্রতি প্রসন্ন হইতেছিলাম। মনে হইতেছিল যেন পুরীর সমুদ্রতীরে বসিয়া আছি। একের পর এক ঢেউ আসিয়া আমাকে ভিজাইয়া যাইতেছে। 

এইরূপে একহপ্তা কাটিয়া গেল। কর্তামশাইয়ের গল্প শেষ হইতেছিল না! কত আখ্যান! বিস্মিত হইয়া ভাবিলাম, ইনিই কি সেই মানব? নাকি কেহ তুকতাক করিয়াছে! একবার সন্দেহ হইল, উন্মাদ হইলেন না তো! কিন্তু তিনি যেরূপ প্রগল্ভ হইয়া বকিতেছিলেন, করোনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে জল আসিয়া গেল।

সুখবরটা এতক্ষণ বলি নাই! স্বাদ-গন্ধ পাইতেছেন না, উপর্যুপরি আমার জ্বর দেখিয়া তিনি পাড়ার ‘হোম ডেলিভারি’ হইতে প্রতিদিন খাবার আনাইতে লাগিলেন। আনন্দে মন পরিপূর্ণ হইয়া গেল। আহা! কতদিন অন্য কাহারও রন্ধন খাই নাই! কিছুদিন সত্যই বিশ্রাম পাইলাম। হপ্তাখানেক এরূপ একত্রে কাশিয়া বাসিয়া কাটাইলাম। ইতিমধ্যে পাড়াপ্রতিবেশীগণ গবাক্ষ দ্বারা কুশল জানিয়াছেন। ফোনে জনৈক চিকিৎসকের পরামর্শও পাইয়াছি বিনামূল্যে। তাঁহার উপদেশে প্রাণবায়ু মাপিবার একটি যন্ত্র ক্রয় করিলাম। ব্যয় হইবে শুনিয়া প্রথমে কর্তা গাঁইগুই করিতেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যিস ওঁর কথা অমান্য করিয়াই অক্সিমিটার নামক যন্ত্রটি কিনিলাম! কর্তার মধ্যমায় লাগাইতে না লাগাইতেই যন্ত্র কহিল ফুসফুসে বায়ু কম! 

সে কী! তাজ্জব হইয়া গেলাম। একবার মাপিলাম। দুইবার। তিনবার। ফল একই। ভীত হইয়া ডাক্তারকে ফোন করিতেই তিনি বলিলেন ছ’মিনিট হাঁটাইয়া পুনরায় মাপিতে। কিয়ৎক্ষণ হাঁটাইতেই দুদ্দাড় করিয়া বায়ুর সূচক নামিতে লাগিল। অষ্টাশি! সর্বনাশ! পঁচানব্বইয়ের নীচে নামিলেই সমূহ বিপদ শুনিয়াছি। অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হইলাম। তিনি কহিলেন, অক্সিজেন প্রয়োজন। 

অক্সিজেন! অর্থাৎ শ্বাসবায়ু? সে আমি কোথা হইতে পাইব? পাড়ার যেসব বখাটে ছোকরা ইতিপূর্বে রকে বসিয়া সুন্দরী মেয়ে খুঁজিত, তাহারাই এখন দল বাঁধিয়া অক্সিজেন সিলিন্ডার খুঁজিয়া বেড়ায়। বুঝিলাম, ওই গ্যাস রূপসী কন্যা অপেক্ষাও অধরা। তবু তাহাদের কাছেই উপর্যুপরি সনির্বন্ধ অনুরোধ করিতে লাগিলাম। উহারা কহিল, “মাসিমা, অক্সিজেন এখন চড়া দামে বিকাইতেছে। কালোবাজারি হইতেছে!” আমি হাতের একজোড়া রুলি খুলিয়া কহিলাম, “যাহাই দাম হউক, অবিলম্বে লইয়া আইস বাছারা। আমার স্বামীকে যেরূপেই হোক বাঁচাইয়া দাও।”  

 

আরও পড়ুন: ঋতা বসুর কলমে: দু’টি নারীঘটিত গল্প

 

ইতিমধ্যে বেলা গড়াইয়া গেল। কিন্তু অক্সিজেনের খবর মিলিল না। এদিকে কর্তার শরীর আরও দুর্বল হইয়াছে। বিছানার একপাশে পড়িয়া আছেন। আমার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হইল। হে ভগবান, এই মানুষটির প্রতি রাগ পুষিয়া রাখিয়াছিলাম! প্রতিশোধ লইব ভাবিয়াছিলাম! নিজের প্রতি অবিমিশ্র ঘৃণায় মন দাউদাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। এখন কী করিব? অক্সিজেন যোগাড় হয় নাই। ছেলেরা হিমশিম খাইতেছে। মুহূর্মুহূ ফোন আসিতেছে। কন্যা এবং জামাতা  চলিয়া আসিয়াছে। যদিও আমি তাঁহাদেরকে বাড়িতে প্রবেশ করিতে নিষেধ করিলাম বলিয়া প্রতিবেশীর দাওয়ায় উৎকণ্ঠিত বদনে বসিয়া রহিল। উঁহাদের ইচ্ছা, পিতাকে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করে।  

হাসপাতালে! শুনিয়া আমার প্রাণ উড়িয়া গেল। শুনিয়াছি, হাসপাতালে যাইলে মানুষ সহজে ফিরিয়া আইসে না। মনে মনে ঠাকুরের নাম জপিতে লাগিলাম। হে মধুসূদন! বিপদের কান্ডারি! রক্ষা কর। সিঁথির সিঁদুর রাখিলে তুমি যা বলিবে করিব। সহসা হৃদয়ের অন্তঃস্থল হইতে কে যেন বলিয়া উঠিল, “সত্যি বলিতেছিস? ভয় পাইবি না তো?”
“তিনসত্যি ঠাকুর।”  

পিছন ফিরিয়া দেখি জানলায় লীলাবতী। মাস্ক পরিহিতা। তবু দেখিয়াই চিনিলাম। লীলাবতী এই ছোঁয়াচে রোগ অগ্রাহ্য করিয়া আসিয়াছে! প্রথমটায় বিস্ময় হইলেও বিপুল সন্দেহ হইল। তবে কি তলায় তলায় লীলাখেলা চলিতেছে? আমিই মূর্খ মেয়েমানুষ! কিছু বুঝি নাই? লীলাবতী গবাক্ষের বাহির হইতেই বলিল, “ধন্বন্তরী ঔষধ আনিয়াছি মদনের নিকট হইতে। তোমার স্বামীকে শীঘ্র খাওয়াইয়া দাও।” 

এক পাতা সাদা বড়ি জানলার গরাদের ফাঁক হইতে ছুড়িয়া দিল লীলাবতী। মদনকে চিনি। ঔষধ কোম্পানির কর্মচারী। দু’চাকা ফটফটাইয়া প্রায়শ কলিকাতা যায়। কিন্তু মদন কেন স্বামীর জন্য ঔষধ পাঠাইল?   

বহু চেষ্টা করিয়াও চিকিৎসককে ফোনে পাইলাম না। শলাপরামর্শ না করিয়াই রোগীকে এই বড়ি খাওয়াইব? মনে কুডাক ডাকিল। জানলার বাহিরে কন্যা ফুঁপাইয়া কাঁদিতেছে। তাহাকে দেখিয়া মায়া হইল। তথাপি ধমক দিয়া কহিলাম, “চুপ কর। পিতা কি মরিয়া গিয়াছে নাকি যে মড়াকান্না জুড়িয়াছিস? আমি তো এখনও রহিয়াছি।” মুখের বাক্য শেষ না হইতেই চিকিৎসক ফোন করিলেন। ধড়ে প্রাণ আসিল। দৌড়াইয়া ফোন ধরিলাম। তিনি কহিলেন, “কী হইল? কামদেব ঔষধ পাঠাইয়াছে?” আমাকে নীরব দেখিয়া ফের বলিলেন, “দ্রুত ওই স্টেরয়েড বটিকা খাওয়াইয়া দিন। দিনে দুইবার করিয়া পাঁচদিন। ঠিক হইয়া যাইবে।”  

 

আরও পড়ুন: পিনাকী ভট্টাচার্যের কলমে: দুর্জয়বাবুর দুঃসময়

 

আমি কহিলাম, “কিন্তু মদন হঠাৎ!” চিকিৎসক হো হো করিয়া হাসিয়া কহিলেন, “মদন ফোন করিয়াছিল রোগীর হালচাল জানাইবার জন্য। আমিই বলিয়াছি ধন্বন্তরী দিতে।” আশ্বস্ত হইলাম। বটিকা খাইবার পর স্বামী বালিশে হেলান দিয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন। আমিও স্বস্থানে ফিরিয়া আসিলাম। কন্যা এবং জামাতা ঘণ্টা দুয়েক বাহিরেই অপেক্ষা করিল, যদি পিতার অবস্থার অবনতি ঘটে। কিন্তু বোধ হইল মানুষটির ফুসফুস কিঞ্চিত শান্ত হইয়াছে। 

পাড়ার হোম ডেলিভারি হইতে রাত্রের খাবার আসিল। কিন্তু উনি না খাইলে আমি কীরূপে খাইব! তাঁহার উপর মুশকিল, অক্সিমিটারে এখনও নব্বই দেখাইতেছে। মন্দ আশঙ্কায় প্রাণ কাঁপিতে লাগিল। কখন নিজেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম খেয়াল নাই। ওঘর হইতে ‘মধু’ ডাক শুনিয়া চমক ভাঙিল। মধু নাম কালক্রমে বিস্মিত হইয়াছিলাম। বিবাহের পর ফুলশয্যার রাতে তিনিই ‘মাধবী’ নামটিকে ‘মধু’ করিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু মাসে মাসে বৎসরে বৎসরে সেই নাম কোন দূরস্মৃতির গর্ভে পলির পরতে চাপা পড়িয়া গিয়াছিল। আজ এক্ষণে জাগিয়া উঠিল। 

“মধু শিগগির আইস।” আমার শরীরেও জ্বরহেতু জড়তা। উঠিতে সময় লাগিল। কর্তা ক্রমাগত ডাকিতেছেন। গলার ভাবটাও নরম। আমাকে দেখিয়া কহিলেন,  
“মধু আমাকে উপুড় করিয়া দাও। একা পারিতেছি না।”  
“কেন?” 
“দাও বলিতেছি। আর একটি বালিশ আনো।”
“কী করিবে?”
“নিম্নোদরে রাখিব।”  
“পারিব না। আমারও ভরপুর ক্লান্তি! রাত্রি চার প্রহর। দু’টোর ঘণ্টা পড়িল।” 
“তাহা হইলে তুমিই বালিশের ভূমিকা লহ!”
“পাগল হইয়াছ? রাত্রি দ্বিপ্রহরে এ কী মতিভ্রম!” 
“তোমার স্মরণে আছে সেই বৈশাখ মাসের রাত? জুঁই-বেলি দিয়া সজ্জিত শয্যা গন্ধে ম ম করিতেছিল। আমি তখন কী করিয়াছিলাম!”  

জানলার বাহিরে কন্যা ফুঁপাইয়া কাঁদিতেছে। তাহাকে দেখিয়া মায়া হইল। তথাপি ধমক দিয়া কহিলাম, “চুপ কর। পিতা কি মরিয়া গিয়াছে নাকি যে মড়াকান্না জুড়িয়াছিস? আমি তো এখনও রহিয়াছি।” মুখের বাক্য শেষ না হইতেই চিকিৎসক ফোন করিলেন। ধড়ে প্রাণ আসিল। দৌড়াইয়া ফোন ধরিলাম। তিনি কহিলেন, “কী হইল? কামদেব ঔষধ পাঠাইয়াছে?” 

এক লহমায় মন চলিয়া গেল পঁচিশ বৎসর পূর্বের সেই মধুক্ষরা রাতে। যুগপৎ আনন্দে ও ভয়ে কাঁপিয়া উঠিলাম। শেষের সময় আসে নাই তো? এ কী পরিবর্তন? উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়া দেখিলাম পূর্ণচন্দ্রমা প্রকাশিত। একটি কোকিল কুহুস্বরে গাহিতেছে দূর আম্রপালী বৃক্ষে বসিয়া। কর্তা আমাকে টানিয়া লইলেন। তাহারপর… লজ্জার কথা… ছি ছি! আমার উপরে উপুড় হইয়া শুইয়া পড়িলেন বিছানায়। স্বগতোক্তি করিলেন, “আর ছাড়িব না। মদনের নিকট হইতে শিখিয়াছি। লীলাবতীর করোনাকালে এইরূপে বাঁচাইয়াছে!”  

আমি সঙ্গে সঙ্গে জ্বলিয়া উঠিলাম। “কী? ওই কুলটার সঙ্গে মদন?” স্বামী আমার ওষ্ঠে করতল চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, “ভাইরাস ভালবাসার ভঙ্গি শিখাইতেছে। মৌন হইয়া থাক। কোনও শরীর অপবিত্র নহে।” আমার শরীরের প্রতিটি রোমকূপ পরিচিত পুরুষের অপ্রত্যাশিত অঙ্গস্পর্শে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। স্বামী আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া ধরিয়া আমার উপর উপুড় হইয়া শুইয়া রহিলেন সারা রাত।  

যখন ঘুম ভাঙিল বেলা হইয়াছে। রৌদ্রে ঝকঝক করিতেছে উঠান। কর্তার মুখ প্রফুল্ল, সতেজ। উৎকণ্ঠিত চিত্তে কহিলাম “অক্সিজেন?” কর্তা মৃদু হাসিয়া অক্সিমিটারে বাঁ মধ্যমা প্রবেশ করাইলেন। বিস্মিত চক্ষু দেখিল সাতানব্বই! 

ভাইরাসের মহিমা বটে! কিন্তু বিস্ময়সূচক কিছু বলিবার পূর্বেই কর্তা আমার মুখ বন্ধ করিয়া দিলেন।

পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।

18 Responses

  1. লেখার হাতটি অসাধারণ সুন্দর আর গল্প বলার স্টাইল মনোগ্রাহী । আপনার গল্পের আমি একজন মুগ্ধ পাঠক / শ্রোতা । অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানাই ।

  2. চমৎকার আঙ্গিক এবং চমৎকার ব‍্যাঞ্জনায় ও উপযুক্ত ভাষা ও শব্দ নির্বাচনে গল্পটি জীবনবোধ প্রকাশের নান্দনিক কাব‍্য।
    জীবন মরণমাঝে এস গো বধুর সাজে…
    সৃষ্টিশীল লেখনী। ধন‍্য।

  3. লেখিকা একজন চিকিৎসক। তিনি তাঁহার সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত।কিন্তু দায়নির্বাহ যে এত সরস হইতে পারে তাহা ইতপূর্বে জানা ছিলনা।অতিমারী আমাদের সবটুকু ছিনাইয়া লইতে পারে নাই। আমাদের এই দুঃসময়ে যে সৃজনশীল মানুষ গুলি আমাদের প্রতিনিয়ত সাহস জোগাইতেছেন তাহার ইতিহাস কখনো লেখা হইলে সেখানে দোলনচাঁপার নাম অবশ্যই প্রথমদিকে রহিবে।

  4. গল্পের উপস্থাপনের রসবোধে অন্তত আপ্লুত হইলাম!! Jokes apart, সত্যিই খুব উপভোগ করলাম, ভাষা আর কিছু শব্দচয়ন বিশেষ করে সমযোপযোগি লেখা। অনেক শুভেচ্ছা🙏

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com