আবার বাংলা বছর ঘুরতেই আমাদের প্রাণের কবি রবি ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) জন্মদিন এসে গেল। মানুষটির সৃষ্টি যেমন কালজয়ী, বিস্ময়কর আর মুক্তমনা চিন্তার প্রতিফলন, তেমনই তাঁর খাদ্য প্রীতিও সংকীর্ণতা ছাপিয়ে শৈল্পিক দিকের আর এক নিদর্শন।

ঠাকুর বাড়ির (Tagore family) সন্তান হিসেবে রবি ঠাকুর (Rabindranath Tagore) যে ভোজন রসিক হবেন, এ নিয়ে কোন দ্বিধাই নেই। কিন্তু রবি ঠাকুর শুধু খেতে ভালোবাসতেন তাই নয়, তিনি রান্না এবং রেসিপি (Recipes) নিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষাও করতেন এবং করাতেন। বলাই বাহুল্য, ঠাকুরবাড়ির হেঁসেল (Kitchen) শুধু বাঙালি পদেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সেখানে ঢুকে পড়েছিল ইউরোপ, তুরস্ক, জাপান, মধ্য প্রাচ্যের রান্নাও। সঙ্গে ভারতের নানা প্রান্তের খাবার তো আছেই!
রবি ঠাকুরের খাবার প্রীতি নাকি বেশ মজার ছিল! খামখেয়ালী সভার মতই তাঁর খাবার প্রীতি ছিল খামখেয়াল। এক এক সময় এক একটি খাবারের প্রতি তাঁর আকর্ষণ চলতো দীর্ঘদিন। সেই সবুজ নিমপাতার শরবতের গল্প আজ সবার জানা।তিনি যেমন ভালবাসতেন কাঁচা ইলিশের ঝোল, তেমনি নানান স্যুপ, স্যালাড আর কাবাব।
বালক রবির (Rabindranath Tagore) জীবন স্মৃতিতে ছেলেবেলার নানান কথায় যেমন ভৃত্যের লুচি পরিবেশনের মজাদার গল্প পাওয়া যায়, তেমনই পাওয়া যায় বাড়ির ছাদে মা-কাকিমা-বৌদিদের লেবুর জারক আচার বানানোর কথা, চুল শুকোতে শুকোতে পিতলের গামলায় কলাই ডালবাটা ফেটিয়ে বড়ি দেওয়ার কথা, ইঁচড়ের আচার এর কথা, কাঁচা আম শুকোনোর কথা। বালক বয়সেরর কাব্য রচনায় আসে খাবার বিবরণ, সেই দুই লাইন কে না চেনে!…
” আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি
সন্দেশ মাখিয়ে দিয়া তাতে….”
সন্দেশ মাখা দুধ,আমসত্ত্ব ছাপিয়ে বালক রবি বড় হয়ে নানান খাদ্য গবেষণা করতেন… এটা দিয়ে ওটা, ওটা দিয়ে সেটা, সেরকম মারমালেড দিয়ে ছাতু মাখতেন খাসা..
যে দেশ বা যে স্থানে যেতেন, সেখান থেকে শিখে এবং লিখে আনতেন নতুন রেসিপি, আর সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন মেনু কার্ড। সেগুলি উপস্থাপন করা হতো ঠাকুর বাড়ির হেঁসেলে।
রবি ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) খাবার প্রীতি নাকি বেশ মজার ছিল! খামখেয়ালী সভার মতই তাঁর খাবার প্রীতি ছিল খামখেয়াল। এক এক সময় এক একটি খাবারের প্রতি তাঁর আকর্ষণ চলতো দীর্ঘদিন। সেই সবুজ নিমপাতার শরবতের গল্প আজ সবার জানা।তিনি যেমন ভালবাসতেন কাঁচা ইলিশের ঝোল, তেমনি নানান স্যুপ, স্যালাড আর কাবাব।

রবি ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) এহেন খাদ্যান্বেষণ ও খাদ্য প্রেম সঞ্চারিত হয় তাঁদের পরিবারের মধ্যে। দুজন মানুষের দুটি বই এর উল্লেখ না করলেই নয়। প্রথমটি প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী, যিনি হেলাফেলার কাজ “রান্না করা” কে নিয়ে যান শিল্পের পর্যায়ে, যাঁর রচিত বই বাংলা রেসিপি বইয়ের অমূল্য সম্পদ বলা যায়। আর দ্বিতীয়টি, অবশ্যই পূর্ণিমা ঠাকুরের ‘ঠাকুর বাড়ির রান্না’।
দুটি বইতেই অম্বল, ছেঁচকি, চচ্চড়ি থেকে স্যুপ, স্টিউ, স্যালাড, বেকড রান্না সব কিছুই পাওয়া যায়। এক বারে যাকে বলে মণিমুক্তের খনি।সেই খনি থেকেই তুলে আনলাম কিছু রেসিপি, গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোই হোক না হয়…
আজকের খাদ্যতালিকা
১.খই এর বড়া
২.নারকেল দিয়ে মুসুর ডাল
৩.ইঁচড়ের দই বড়া
৪. শসা নারকেল দিয়ে চিংড়ি মাছ
৫.কবি সংবর্ধনা বরফি, যেটি প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী রবি ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) জন্মদিনে স্বহস্তে বানিয়েছিলেন, এবং এটি কবির খুবই প্রিয় একটি মিষ্টি।

খই এর বড়া
- খই এক বাটি
- নারকেল কোরা ১/২ বাটি
- চাল গুঁড়ো ২ টেবিল চামচ
- কাঁচা লঙ্কা ২ টো কুচি
- নুন স্বাদমতো
খই বেছে নিয়ে অল্প জল এ ভিজিয়ে নরম করে নিতে হবে, যতক্ষণ জল টেনে নিচ্ছে। নরম খইতে নারকেল কোরা বাটা, চাল গুঁড়ো, নুন, লঙ্কাকুচি দিয়ে মেখে চ্যাপ্টা বড়ার আকার দিতে হবে। এর পর ঘি গরম করে গরম ঘি’তে বড়া দিয়ে নরম আঁচে ভাজতে হবে মিনিট তিনেক। প্রথম পাতে রইলো খই এর বড়া।

নারকেল মুসুর ডাল
- মুসুর ডাল এক বাটি
- এক চা চামচ আদা বাটা
- এক চা চামচ ধনে বাটা
- এক বাটি নারকেল কোরা বাটা
- তেঁতুলের পেস্ট বড়ো দুই চামচ
- ঘি বড় দুই চামচ
- নুন ও চিনি স্বাদমতো
- কয়েকটা কারি পাতা
এক বাটি মুসুর ডাল ভালো করে ধুয়ে, লঙ্কা দিয়ে সেদ্ধ করে রাখতে হবে।আদা, ধনে আর নারকেল কোরা বেটে রাখতে হবে। ঘি গরম করে তাতে এই বাটা মশলা দিয়ে কষে, নুন চিনি দিয়ে, তেঁতুলের ক্বাথটা দিতে হবে। তারপর যাবে ডাল সেদ্ধ। ফুটে ঘন হলে আঁচ নিভিয়ে কয়েকটা কারি পাতা দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে।

ইঁচড়ের দই বড়া
বড়ার জন্যে :
- ইঁচড় খোসা ছাড়িয়ে কেটে রাখা দুই বাটি
- কাঁচা মুগ ডাল ভিজিয়ে রাখা আধ কাপ
- আদা বাটা আধ চা চামচ
- ধনে বাটা আধ চা চামচ
- নুন আর চিনি স্বাদ মত
- বড়া ভাজার জন্য তেল
দই এর ঝোলের জন্যে:
- আদা বাটা এক চা চামচ
- ধনে ও জিরে বাটা এক চা চামচ করে
- দই দেড় কাপ
- নুন চিনি স্বাদমতো
- গরমমশলা এক চা চামচ
- দুই টেবিল চামচ ঘি
ইঁচড় সেদ্ধ করে ভেজানো মুগডালের সঙ্গে বেটে নিয়ে বাকি বড়ার মশলা মিশিয়ে গোলগোল বড়া তৈরি করে, তেলে ভাজতে হবে। ওদিকে, আলাদা প্যানে তেল গরম করে তাতে আদা, ধনে, জিরে বাটা দিয়ে কষে, ফেটানো দই, নুন, চিনি মিশিয়ে বড়া দিতে হবে। একটু ফুটলে শেষে ঘি গরমমশলা দিয়ে নামিয়ে নেওয়া…

শসা নারকেল দুধ দিয়ে চিংড়ি মাছ
- ১ টি নারকেলের দুধ, (এক কাপ গাঢ় দুধ আর এক কাপ পাতলা)
- ৫০০ চিংড়ি খোসা ও শিরা ছাড়ানো
- দুটো শসা কিউব করা
- ধনে বাটা এক টেবিল চামচ
- হলুদ বাটা এক চা চামচ
- পেঁয়াজ কুচি একটি
- আদা এক ইঞ্চি মতো মিহি কুচি
- রসুন ৩/৪ টি মিহি কুচি
- লঙ্কা তিনটি কুচি করা
- নুন স্বাদ মতো
শসা কিউব, ধনে হলুদ বাটা, নারকেল এর পাতলা দুধ মিশিয়ে তাতে পেঁয়াজ, লঙ্কা, আদা, রসুন কুচি, চিংড়ি আর বাকি সব মিশিয়ে গ্যাসে আধ ঘন্টা কম আঁচে ফোটাতে হবে। একদম নামানোর আগে গাঢ় নারকেল দুধ মিশিয়ে, ঢাকা খুলে নুন মিশিয়ে একটু ফুটিয়ে নামাতে হবে।

কবি সংবর্ধনা বরফি
- ছোট ১ বাটি ফুল কপির ফুল
- ২ টেবিল চামচ ছোলার ডালের বেসন
- ১ বাটি আমন্ড আর কাজু কুচি
- ১ কাপ ছানা
- ২ টেবিল চামচ ঘি
- ১/২ কাপ কনডেন্সড দুধ
- ১ কাপ চিনি গুঁড়ো
- ৩ এলাচ গুঁড়ো
- ১ টেবিল চামচ ময়দা
এলাচ গুঁড়ো জলে দিয়ে তাতে কপি সেদ্ধ করে নিতে হবে। সেদ্ধ কপি জল ঝড়িয়ে প্যানে ঘি গরম করে কপি ভাজতে হবে। সেই ভাজা কপিতে বেসন মিশিয়ে মিক্সারে পেস্ট করতে হবে।
কড়াইতে ঘি গরম করে ছানা দিয়ে ভাজতে ভাজতে কপি বেসন পেস্ট ঢেলে ভাল করে মেশাতে হবে। তারপর, পরপর দিতে হবে কনডেন্সড দুধ, চিনি গুঁড়ো, আর ময়দা। বেশ আঠালো হয়ে এলে কাজু আমন্ড কুচি মিশিয়ে গ্যাস অফ করতে হবে। ঘি লাগানো থালায় ঢেলে সমান করে দিয়ে, ঠান্ডা হলে বরফির আকারে কাটতে হবে। ওপরে জাফরান দিয়ে সাজিয়ে নিলেই তৈরি সেই বিখ্যাত মিষ্টি।
কবির (Rabindranath Tagore) কালজয়ী রচনার মত, ওনার রসনা তৃপ্তির পদগুলিও বেঁচে থাক আমাদের মাঝে, বাঙালির রসনায়, ডাক দিক চিরনূতনকে…
ছবি সৌজন্য: লেখক, ফুড ব্লগ মহামুশকিল
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।