জীবনের অপরাহ্ণে এসে কারও সঙ্গে আলাপনে যদি খাবার পছন্দের প্রসঙ্গ আসে, অজান্তেই উত্তর বেরিয়ে আসে, ‘আমি সর্বভুক ও স্বল্পাহারী’। মনের মধ্যে কী ভীষণ ছাপ রেখে গেলেন ‘আগন্তুক’-এর মনমোহন মিত্র! মনে পড়ে? ইঁদুর, আর্মাডিলো কিছুই বাদ রাখেননি, জীবনের প্রয়োজনে, বেঁচে থাকার আর মানুষের জীবনযাত্রা চেনার তাগিদে কত কী করেছেন তিনি! আর বহু বছর পর দেশে ফিরে, ডাল, ভাজা, ঘন্ট আর মাংস দিয়ে তৃপ্তি করে ভাত খাওয়া… কী সুন্দর একটি বর্ণময় তাৎপর্যপূর্ণ জীবনের বর্ণনা খাবারের মধ্যে দিয়ে!
তারপর,’পথের পাঁচালী’তে, ওই যে দুর্গার পেয়ারা চুরি করে ইন্দির ঠাকরুনের সাথে নুন ঝাল দিয়ে মাখা, বৃষ্টির দিনে সর্বজয়ার কচু শাক নিয়ে বাড়ি ফেরা… সব কিছু দিয়ে রায়মশাই ছবি আঁকলেন নিম্নবিত্ত গ্রামবাংলার সাধারণ জীবনযাত্রার।
প্রায় প্রতিটা সিনেমাতেই ঘুরে-ফিরে রায়মশাই কোনও না কোনওভাবে খাবার এনেছেন, চলচ্চিত্র ক্যানভাসে প্রয়োজনীয় চিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে… কখনও ‘শাখা প্রশাখা’তে উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের ডাইনিং টেবিলে একসাথে খাওয়ার দৃশ্য, কিংবা ‘মহানগর’-এ পুরুষ আধিপত্য পরম্পরাকে ভেঙে রোজগেরে বৌমাকে মাছের মুড়ো এগিয়ে দেওয়া…
আর? যেটা না মনে করলেই নয়! ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’, কে ভুলতে পারে ভূতের রাজার সেই বর! কে ভুলতে পারে সেই দৃশ্য! যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে বুভুক্ষু সৈনিকদের সামনে উড়ে আসা রসগোল্লার হাঁড়ি বাধ্য করে যুদ্ধ আর অস্ত্রের সামনে ক্ষুধা নিবৃত্তিকে বেছে নিতে…
আসলে এইসব দৃশ্য দিয়ে রায়মশাই মানবতা আর মানব সভ্যতার ইতিহাসের নিদর্শন রেখে গেছেন।

শুধু কি চলচ্চিত্র? আমাদের ফেলুদা কম যায় কিসে! ফেলুদার গুরুদেব হোমসকে যদিও কদাচিৎ খেতে দেখা গেছে, ফেলুদা কিন্তু আমাদের আপাদমস্তক খাদ্যপ্রেমিক! দুপুরের খাবার শেষে চারমিনার ছাড়াও একখান মিষ্টি পান তার চাই-ই। কিম্বা ফেলুদার ‘ডায়মন্ডা’ প্রীতি, মিষ্টি যে কী ভালোবাসত! ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ হনুমান হালুইকরের রাবড়ি, ‘বেনারস’-এর জিলিপি।
ফেলুদা যেমন ষোলো আনা বাঙালি, তেমনই বিশ্বজনীন। তাই ‘গোরস্থানে সাবধান’-এ যেমন ‘নিজাম’-এর মাটন রোল, ব্লু ফক্স রেস্তোরাঁ’র কথা এসেছে, তেমনই কাঠমান্ডুতে স্টিমড মোমো, দার্জিলিং-এর ‘কেভেন্টারস’-এর হট চকোলেট, আর সানডিলা’র লাড্ডুর কথাও অনায়াসে এসেছে। এসেছে রেলের ক্যান্টিনের খাবারের প্রশংসাও। ফেলুদার স্ট্রিট ফুডের প্রতি ভালবাসা চিনতে শিখিয়েছে শহরকে, জানতে শিখিয়েছে মানুষগুলোকে, গোয়েন্দার চোখকে করেছে তীক্ষ্ণতর। এভাবেই হোমসের ছায়া থেকে বেরিয়ে ফেলুদা হয়ে গেছে আপাদমস্তক বাঙালি গোয়েন্দা আর বাঙালির প্রিয় গোয়েন্দা।

এত কিছু যিনি লিখলেন আর জীবনের ছবি আঁকলেন, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কী কী খাবার প্রিয়? ডঃ অনুপ ঘোষালের একটি ইন্টারভিউ থেকে জানা যায়, রায়মশাইয়ের প্রিয় ছিল লুচি, অড়হর ডাল আর বেগুন ভাজা। চিকেন পছন্দ করতেন না একদমই, মাটন ছিল প্রিয়। আবার অতি সাধারণভাবে ঘি-চিনি দিয়ে মুড়ি মেখেও খেতে ভালবাসতেন।
রোজকার জীবনে খুব স্বল্পাহারী এবং নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন যদিও, অল্প স্যান্ডউইচ আর টক দই ছিল শুটিং-এর সময়ে নিত্যসঙ্গী। এ ছাড়াও ফেলুদার বই পড়ে আমার কেন জানি মনে হয় নিউ মার্কেটের ডালমুট, বাগবাজারের মোহন সুইটসের খাস্তা কচুরি, গড়পারের সিঙাড়াও হয়তো খুবই পছন্দের ছিল ওঁর, কে জানে!
ফেলুদার মতন, তার সৃষ্টিকর্তা রায়মশাইও ছিলেন আপাদমস্তক বাঙালি হয়েও বিশ্বজনীন। ওঁর ছেলের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় রায়মশাই মাঝেসাঝেই যেতেন পার্কস্ট্রিটে কন্টিনেন্টাল খাবার খেতে। এর মধ্যে ফিশ ম্যুনিয়ের ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়।
আরও পড়ুন: হালিম খেয়ে জালিম হল দুনিয়া
এত বড় গৌরচন্দ্রিকা করলাম, আর রায় মশাইয়ের জন্মদিনে তাঁর প্রিয় খাবার একটা কিছু বানাব না, তা হয় নাকি!
ওঁর সবচেয়ে প্রিয়, মাংসের ঝোল, অড়হর ডাল, বেগুন ভাজা এগুলো যেহেতু জানা-শোনা, বরং বানাই কিছু কন্টিনেন্টাল খাবার দাবার। যার মধ্যে প্রথমে রইল ওঁর প্রিয় ফিশ ম্যুনিয়ের, অন্যগুলো ওঁর প্রিয় কিনা জানা নেই যদিও, তবে সবার ভালো লাগবে…
আজকের মেনুতে থাকছে:
১. ফিশ ম্যুনিয়ের
২. কর্ডন ব্লু
৩. প্রন ককটেল

ফিশ ম্যুনিয়ের
এই ম্যুনিয়ের কে প্রথম বানায় তা নিয়ে অনেক রহস্য। কেউ বলে কোনও ফরাসি শেফ, কেউ বলে কোনও আটা চাকি কর্মীর বউ প্রথম এটি বানায়। এরকম নানা মত হলেও, এটি একদম সহজে বানানো দারুণ স্বাদের খাবার, নইলে কি রায়মশাইয়ের প্রিয় হয়?
যদিও শোল মাছের ম্যুনিয়ের ফরাসিদের সব চেয়ে প্রিয়, আমরা করব ভেটকি ম্যুনিয়ের…
লাগবে—
(দুজনের অনুপাতে) ২ x ১০০ গ্রাম ভেটকি ফিলে
ভাজার জন্য মাখন
কোট করার জন্যে ময়দা, নুন, গোলমরিচ স্বাদমতো
সঙ্গে খাবার জন্যে—
গার্লিক পটেটো ম্যাশড: ৩ টে আলু ও ৩ কোয়া রসুন একসঙ্গে সেদ্ধ করে স্বাদমতো নুন, গোলমরিচ আর মাখন দিয়ে একদম মাখনের মত নরম করে মাখা।
লেমন বাটার সস-এর জন্যে—
১ টা লেবুর রস
ধনে পাতা মিহি কুচি
মাখন ৬০ গ্রাম
একটা ছড়ানো প্যানে মাখন নিয়ে একটু বাদামি করে, তাতে লেবু স্লাইস দিয়ে আগুন থেকে সরিয়ে রাখতে হবে। ওদিকে, ভেটকি ফিলে ভালো করে ধুয়ে, তোয়ালে দিয়ে মুছে, নুন-গোলমরিচ মেশানো ময়দাতে দু’পিঠ ভালো করে কোট করে ওই বাদামি করা মাখনে এপিঠ-ওপিঠ চার পাঁচ মিনিট ভাজতে হবে, পাতলা ময়দার লেয়ারটি যাতে বেশ বাদামি হয়। মাছগুলো প্রয়োজনে একটা করে ভাজতে হবে, যাতে দুটো মাছ একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে না যায়।
ওদিকে আলুসেদ্ধ মাখা রেডি, সেটা প্লেটে দিয়ে ওপরে মাছ ভাজাটা সাজাতে হবে।
সস-এর জন্যে মাখন গরম করে, তাতে খুব মিহি করে কুচিয়ে রাখা বেল পেপার অল্প ভেজে, আঁচ থেকে সরিয়ে লেবুর রস আর ধনেপাতা কুচি মেশালেই রেডি সস!
পাতলা মুচমুচে ময়দা দিয়ে মাছভাজার সঙ্গে এই সস একদম অমৃত! মন ভরে যাবে, কিন্তু শরীর থাকবে হালকা আর মেজাজ ফুরফুরে!

চিকেন কর্ডন ব্লু
৪ টি হাড় ছাড়া চিকেন ব্রেস্ট, নুন গোলমরিচ মাখিয়ে রাখা
১ টেবিল চামচ রসুন পাউডার
১ টেবিল চামচ পেঁয়াজ পাউডার
১৬ টা চিজ স্লাইস
২৫০ গ্রাম হ্যাম
ভাজার জন্য তেল
চিকেন কোট করার জন্যে—
১ কাপ ময়দা
৪ টে ডিম
২ কাপ ব্রেড ক্রাম্ব
সস-এর জন্যে—
৩ টেবিল চামচ মাখন
২টো রসুন কোয়া একদম কুচি করা
৩ চামচ ময়দা
২ কাপ দুধ
১ চামচ সরষে বাটা, খোসা বাদ দেওয়া
১ কাপ চিজ কোরানো
নুন, আর গোলমরিচ স্বাদ মতো
চিকেন ব্রেস্টের নীচে আর ওপরে প্লাস্টিক দিয়ে, একটা নোড়া বা ছোট হাতুড়ি বা ভারি কিছু দিয়ে চেপে চেপে, এক সেন্টিমিটার পাতলা করে নিতে হবে। তারপর এতে নুন, মরিচ, রসুন আর পেঁয়াজ গুঁড়ো মিশিয়ে ম্যারিনেট করতে হবে আধঘণ্টা। আধঘণ্টা এই পাতলা চিকেনের ওপর দুটো চিজ স্লাইস, তার ওপরে হ্যাম আবার তার ওপরে চিজ স্লাইস দিয়ে একটা ধার থেকে রোল করে নিতে হবে। এই রোলটা প্লাস্টিকে ভালো করে ঢেকে, টাইট করে রাখতে হবে, যাতে রোল খুলে না যায়। এটা চলে যাবে ফ্রিজে, বেশ কিছুক্ষণের জন্যে। ওদিকে ডিম ফেটিয়ে রাখা— পরের কাজ, আর তার সঙ্গে ময়দাতে নুন মরিচ মিশিয়ে রাখাও। প্লাস্টিকে জড়ানো চিকেন রোল সেট হলে, প্লাস্টিক খুলে একবার ডিমে ভালো করে ডুবিয়ে তারপর ময়দা আর ব্রেড ক্রাম্বে কোট করে, গরম তেলে ঢিমে আঁচে ভাজতে হবে, যাতে বাইরেটা যেমন বাদামি হয়, তেমনই ভেতরে চিজটাও গলতে শুরু করে।
ওহ, এটা ভাজার আগে সস রেডি করে রাখা আর একটা কাজ।
মাখন গরম করে তাতে রসুন ভেজে, আঁচ কমিয়ে ময়দা দিয়ে ভালো করে নাড়তে হবে। তারপর দুধ অল্প করে ঢালতে ঢালতে ক্রমাগত নাড়তে হবে। ময়দা দুধে মিশে গেলে সর্ষে পেস্ট, চিজ কোরা, নুন আর মরিচ মিশিয়ে নামিয়ে রাখতে হবে।
ওদিকে গরম গরম চিকেন ভেজে, ছুরি দিয়ে স্লাইস করলেই বেশ স্প্রিং রোলের মতো চিকেন কর্ডন ব্লু সস দিয়ে খাওয়ার জন্যে রেডি।

প্রন ককটেল
লাগবে—
৪০০ গ্রাম চিংড়ি সেদ্ধ করে রাখা
২০০ গ্রাম মেয়োনিজ
৫০ গ্রাম টমেটো কেচাপ
কয়েক ফোঁটা টাবাস্কো সস
১ ছোট চামচ ওয়াস্টাশার সস
স্বাদ মতো প্যাপ্রিকা বা লংকা গুঁড়ো
নুন আর মরিচ স্বাদ মতো
সাজানোর জন্যে লেটুস, কিংবা নিজের ইচ্ছে মতো সাজানো।
চিংড়ি বাদে সমস্ত কিছু মিশিয়ে একদম বরফ-ঠান্ডা করে রাখতে হবে। তারপর সেদ্ধ চিংড়ি মিশিয়ে, একটা ককটেল গ্লাসে কয়েক চামচ দিয়ে, লেটুস বা লেবু স্লাইস দিয়ে সাজিয়ে একদম ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশন করা..
একদম বরফ ঠান্ডা হলে তবেই এর মজা…
সব কিছু রেডি যখন, এবার বইয়ের তাক থেকে এক খান ‘ফেলুদা’ নিয়ে বসি। ওঁর জন্মদিনে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো আর কি…
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।
2 Responses
Wonderful article!
Lovly