সে-বছর জন্তুরা সব একেবারে কেনা গোলামের মতো খাটল। সক্কলে খুশিমনেই কাজ করছিল, কারণ এখানে কোনওরকম ত্যাগস্বীকার করার ব্যাপার নেই। সবাই ভালোমতোই জানে যে তারা যা-কিছু করছে তা নিজেদের এবং নিজেদের উত্তরসূরিদের লাভের জন্যই করছে। অলস এবং চোর স্বভাবের মানুষদের জন্য নয়। সারাটা বসন্ত আর গ্রীষ্ম জুড়ে জন্তুরা সপ্তাহে ষাট ঘণ্টা করে কাজ করল। অগাস্ট মাসে নেপোলিয়ন ঘোষণা করল যে এবার থেকে রবিবার বিকেলেও কাজ করতে হবে। তবে এই কাজ বাধ্যতামূলক নয়। স্বেচ্ছাশ্রম। যার ইচ্ছা হবে সে করবে, যার ইচ্ছে হবে না সে করবে না। কিন্তু যে বা যারা এই কাজে অনুপস্থিত থাকবে তাদের খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক কমিয়ে দেয়া হবে।
এত কিছুর পরেও বেশ খানিকটা কাজ বাকি থেকে গেল। গতবারের চেয়ে এ বছর ফসল একটু কম হয়েছে। গ্রীষ্মের শুরুতে দুটো জমিতে মুলো চাষ করার কথা ছিল, কিন্তু আগেভাগে সেখানে লাঙল দেওয়ার কাজ শেষ করে রাখা হয়নি বলে তা আর করা গেল না। সুতরাং এটা দিব্যি আন্দাজ করা যাচ্ছে যে আগামী শীতে কপালে দুর্ভোগ নাচছে। হাওয়া কল নিয়ে আবার অপ্রত্যাশিত সব সমস্যা দেখা দিচ্ছে। খামারে বেশ ভালো একটা চুনাপাথরের খাদ আছে। খামার বাড়ির বাইরের দিকের একটা ঘরে বালি সিমেন্টও মজুদ রয়েছে অনেক। সুতরাং গাঁথনির জন্য প্রয়োজনীয় সব কাঁচামাল হাতেই রয়েছে। মুশকিলটা হল অন্য জায়গায়। পাথরগুলোকে ভেঙে কীভাবে সুবিধেজনক মাপে আনা যায় সেটা জন্তুরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। গাঁইতি আর শাবল ছাড়া এই কাজ করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যন্ত্রগুলো ব্যবহার করতে গেলে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হয়, যা কোনও জন্তুই পারে না। হপ্তাখানেক গাঁইতি-শাবল নিয়ে বৃথা চেষ্টা করার পর একজনের মাথায় আসল বুদ্ধি খেলল। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ব্যবহার করতে হবে।
খাদানের মধ্যে অনেক বড়ো-বড়ো পাথর পড়ে আছে। সেগুলো আকারে এতই বিশাল যে সাধারণভাবে ব্যবহার করা অসম্ভব। পাথরগুলোকে তখন দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলা হল। তারপর গোরু, ঘোড়া ও ভেড়ার মতো যে-সব জানোয়ার দড়ি টানতে পারে তারা, এমনকী প্রয়োজনে শুয়োরেরা পর্যন্ত হাত লাগিয়ে সবাই মিলে ধীরে ধীরে সেই পাথর তুলে নিয়ে আসতে লাগল খাদ থেকে চুড়োয়। ব্যাস। এবার চুড়ো থেকে নিচে ফেলে দিলেই কেল্লা ফতে। পাথর ভেঙে চৌচির। সেই টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার পর পাথর বওয়া তুলনায় সহজ।
ঘোড়াগুলো গাড়ি ভর্তি করে পাথর বইতে লাগল। ভেড়ার দলের প্রত্যেকে টেনে টেনে নিয়ে যেতে লাগল একখণ্ড করে। এমনকি মুরিয়েল আর বেঞ্জামিনও নিজেদের একটা পুরনো গাড়ির সঙ্গে জুতে নিয়ে তাদের ভাগের কাজটুকু সেরে দিতে লাগল। গ্রীষ্মের শেষে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাথর জমা হতেই শুয়োরদের তদারকিতে শুরু হয়ে গেল হাওয়াকল তৈরির কাজ। কিন্তু এই পদ্ধতি অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য। সময় লাগছে প্রচুর। মাঝে মাঝে তো সে-রকম বড়োসড়ো একটা পাথর তুলতে গিয়ে পুরো দিনটাই কাবার হয়ে যায়। তারপর যখন সেটাকে চুড়ো থেকে নীচে ফেলা হয় তখন হয়তো সেটা ভাঙেই না।
বক্সার না-থাকলে এসব কিছুই হয়তো করা সম্ভব হত না। মাঝে মাঝে তো মনে হয় যেন বক্সারের একার শক্তি খামারের বাকি সব জন্তুর মিলিত শক্তির সমান। কখনও কখনও কী হয়, ভারী পাথর টেনে তোলার সময় তা ফস্কে গিয়ে গড়াতে শুরু করে ঢাল বেয়ে। সেই সঙ্গে টেনে নিয়ে যেতে থাকে যারা পাথর তুলেছিল তাদেরকেও। অসহায় জন্তুরা হাহাকার করে ওঠে। এমন সময় সামাল দেয় বক্সার। প্রাণপণ দড়ির টান ধরে রেখে সে পাথরের গড়ানো বন্ধ করে। বক্সার যখন নিজের দেহের সব শক্তি একত্র করে ভারী পাথর টানতে টানতে প্রতি ইঞ্চি চড়াই ওঠে, তখন ওর নিশ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হয়ে ওঠে। খুরের ডগা যেন গেঁথে বসে মাটিতে। তার চওড়া পিঠের দু’পাশ বেয়ে দরদরিয়ে ছোটে ঘামের স্রোত।

এই সময় ফার্মের সবাই তার দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। ক্লোভার অবশ্য তাকে এত বেশি পরিশ্রম করতে বহুবার বারণ করেছে। কিন্তু বক্সার তা শুনলে তো! তার জীবনে এখন দুটোই মন্ত্র— ‘আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে’ আর ‘নেপোলিয়ান সর্বদাই সঠিক’। এই মন্ত্র দুটোই যেন তার জীবনের সব সমস্যার সমাধান করার জন্য যথেষ্ট। যে মোরগছানাটা রোজ সকালে তাকে বাকিদের চেয়ে আধঘণ্টা আগে ডেকে দেয়, তাকে বক্সার বলে দিয়েছে, এখন থেকে আধঘণ্টার বদলে পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে ডেকে দিতে। এ-ছাড়াও অবসর সময়ে (যদিও সে আজকাল আর অবসর খুব একটা পায় না) সে একাই চলে যায় খাদে। তারপর কারও সাহায্য ছাড়াই পাথরের টুকরো গাড়িতে বোঝাই করে হাওয়াকল তৈরির জায়গায় রেখে আসে।
কঠোর পরিশ্রম করতে হল বটে, তবে গরমকালটা কিন্তু জন্তুদের নেহাত মন্দ কাটল না। জোন্সের আমলে জন্তুরা যে পরিমাণে খাবার পেত এখন তার চেয়ে যদি বেশি না-ও পায় তাতেই বা কী এল-গেল, অন্তত তার চেয়ে কমও তো পাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় সুবিধে হচ্ছে এখন কেবল নিজেদের খাবারের ব্যবস্থাটুকু করলেই তাদের চলে যায়, বেফালতু পাঁচ-পাঁচটা মানুষকে পুষতে হয় না। শুধুমাত্র এই আনন্দের কাছেই যেন তাদের অনেক ব্যর্থতা তুচ্ছ হয়ে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে জন্তুরা নিজস্ব পদ্ধতিতে মানুষের থেকেও বেশি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে এবং তাতে খাটনিও বাঁচছে। যেমন আগাছা নিড়ানোর কথাই ধরা যাক। জন্তুরা যেমন পরিষ্কারভাবে জমি থেকে আগাছা সাফ করতে পারে তা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কোনও জন্তুই আজকাল আর চুরি-চামারি করে না, তাই চাষের জমিকে আর জন্তুদের চরার জমি থেকে বেড়া দিয়ে আলাদা করে রাখতে হয় না। সুতরাং বেড়াঝোপ আর ফটকের রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হচ্ছে না।
ঘোড়াগুলো গাড়ি ভর্তি করে পাথর বইতে লাগল। ভেড়ার দলের প্রত্যেকে টেনে টেনে নিয়ে যেতে লাগল একখণ্ড করে। এমনকি মুরিয়েল আর বেঞ্জামিনও নিজেদের একটা পুরনো গাড়ির সঙ্গে জুতে নিয়ে তাদের ভাগের কাজটুকু সেরে দিতে লাগল। গ্রীষ্মের শেষে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাথর জমা হতেই শুয়োরদের তদারকিতে শুরু হয়ে গেল হাওয়াকল তৈরির কাজ। কিন্তু এই পদ্ধতি অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য। সময় লাগছে প্রচুর।
তবুও গ্রীষ্ম যতই ফুরিয়ে আসতে থাকল, ততই যেন কিছু ব্যাপারে ঘাটতি দেখা দিতে লাগল, যেগুলোর কথা আগে ভাবাই হয়নি। প্যারাফিন তেল, পেরেক-গজাল, কুকুরের বিস্কুট এবং ঘোড়ার নালে লাগাবার লোহা— এর কোনওটাই খামারে তৈরি করা সম্ভব নয়। পরবর্তীকালে বীজ, কৃত্রিম সার, হরেকরকমের যন্ত্রপাতি এবং সবশেষে হাওয়াকলের কলকব্জা— সব কিছুরই প্রয়োজন পড়বে। এগুলো যে কীভাবে তৈরি করা যাবে তা কারও কল্পনাতেও আসছে না।
এক রবিবার খামারের সব পশুরা তাদের সারা সপ্তাহের কাজের নির্দেশিকা বুঝে নেবার জন্য জমায়েত হয়েছে, এমন সময় নেপোলিয়ন ঘোষণা করল যে সে একটা নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন থেকে অ্যানিম্যাল ফার্ম তার প্রতিবেশী খামারগুলো সঙ্গে ব্যবসা করবে। না, এর পেছনে কোনও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নেই। এই মুহূর্তে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র সংগ্রহ করার জন্যই এই পদক্ষেপ। নেপোলিয়ন বলল, অন্যান্য যে-কোনও কিছুর চেয়ে হাওয়াকল তৈরির ব্যাপারটাতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সুতরাং সে খড়ের একটা গাদা এবং এবছর যে গম ফলেছে তার কিছুটা অংশ বিক্রি করার সব ব্যবস্থা সেরে ফেলেছে। এর পরেও যদি টাকার প্রয়োজন হয় তা হলে সে-টাকা মুরগির ডিম বেচে তোলা হবে। উইলিংডনে সবসময়ই ডিমের একটা চাহিদা থাকে। নেপোলিয়ন বলল, শোনো মুরগিরা, এই যে তোমরা এত বড় একটা ত্যাগ স্বীকারের সুযোগ পেলে একে তোমাদের উচিত স্বাগত জানানো। ভাবো একবার, হাওয়াকল তৈরির কাজে তোমাদের কেমন দুর্ধর্ষ একটা অবদান রয়ে যাচ্ছে।

জানোয়ারদের মধ্যে ফের একটা মৃদু অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল। মানুষের সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক রাখা হবে না, কোনওরকম ব্যবসা-বাণিজ্য করা চলবে না, টাকা-পয়সা ব্যবহার করা থেকে শতহস্ত দূরে থাকা হবে— জোন্সকে তাড়িয়ে দেয়ার পর যে বিজয়সভা হয়েছিল তাতে এই সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল না? জন্তুদের যতদূর মনে পড়ছে তেমনই কিছু একটা হয়েছিল বটে। নেপোলিয়ন সাপ্তাহিক সভা বন্ধ করে দেওয়ার সময় যে চারটে বাচ্চা শুয়োর হল্লা করেছিল তারা এবারও মৃদু প্রতিবাদ জানানোর একটা চেষ্টা করল বটে, কিন্তু কুকুরগুলো তৎক্ষণাৎ ভয়ঙ্করভাবে গর্জে উঠে তাদের থামিয়ে দিল। তারপর ভেড়াগুলো যথারীতি স্লোগান জুড়ে দিল, “চারপেয়েরা ভালো, দু’পেয়েরা খারাপ।” সভার বেসামাল ব্যাপারটা মুহূর্তেই চাপা পড়ে গেল।
জোন্সের আমলে জন্তুরা যে পরিমাণে খাবার পেত এখন তার চেয়ে যদি বেশি না-ও পায় তাতেই বা কী এল-গেল, অন্তত তার চেয়ে কমও তো পাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় সুবিধে হচ্ছে এখন কেবল নিজেদের খাবারের ব্যবস্থাটুকু করলেই তাদের চলে যায়, বেফালতু পাঁচ-পাঁচটা মানুষকে পুষতে হয় না। শুধুমাত্র এই আনন্দের কাছেই যেন তাদের অনেক ব্যর্থতা তুচ্ছ হয়ে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে জন্তুরা নিজস্ব পদ্ধতিতে মানুষের থেকেও বেশি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে এবং তাতে খাটনিও বাঁচছে।
শেষমেশ নেপোলিয়ন নিজের সামনের পা তুলে সকলকে শান্ত করল, তারপর জানাল যে ইতিমধ্যেই সব রকম ব্যবস্থা সে করে ফেলেছে। মানুষের সংস্পর্শে আসাটা সত্যিই অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার, এবং কোনও জন্তুকেই সে কাজ করতে হবে না, কারণ সবার হয়ে এই বিশ্রী কাজের দায়িত্বটা সে নিজের ঘাড়েই তুলে নিচ্ছে। উইলিংডনের এক উকিল— মিস্টার হুইম্পারের সঙ্গে ওর কথা হয়েছে। অ্যানিম্যাল ফার্ম-এর সঙ্গে বাইরে দুনিয়ার যোগাযোগ রাখার কাজটা তিনিই করবেন। প্রতি সোমবার সকালে ফার্মে এসে তিনি নিজের কাজ বুঝে নেবেন। বরাবরের মতো এবারও ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম দীর্ঘজীবী হোক’ এই বলে নেপোলিয়ন নিজের বক্তৃতা শেষ করল। এরপর ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’ গেয়ে সভা শেষ হল।
পরে স্কুইলার এল খামারের জন্তুদের যাবতীয় দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে। সে বুঝিয়ে বলল যে, ব্যবসা করা যাবে না বা টাকা-পয়সায় হাত দেয়া যাবে না এমন কোনও সিদ্ধান্ত কস্মিনকালেও নেয়া হয়নি। শুধু তা-ই নয়, এমন কোনও প্রস্তাবও কখনও কেউ রাখেনি। এই পুরো ব্যপারটাই মনগড়া, খুব সম্ভবত স্নোবল যে-সব মিথ্যে কথাগুলো ছড়িয়েছিল এটা তার মধ্যেই একটা। এ-সব কথা শুনেও কেন জানি কিছু জন্তুর মন থেকে সন্দেহটা পুরোপুরি মিটল না। তখন সুচতুরভাবে স্কুইলার তাদের জিজ্ঞেস করল, “কমরেডস তোমরা কি নিশ্চিত যে এটা তোমাদের কোনও স্বপ্ন-টপ্ন নয়? তোমাদের কাছে এ বিষয়ে কোনও লেখাজোকা বা দলিল-প্রমাণ আছে কিছু?” হক কথা! এ-বিষয়ে সত্যিই কোথাও একটা শব্দও লেখা নেই। সুতরাং জন্তুরা নিশ্চিন্তে মেনে নিল যে ভুলটা তাদের নিজেদেরই।
*ভিতরের ছবি সৌজন্য: Ralph Steadman
অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।