সাদা একটা বাড়ি। লম্বা। সামনে খোলা বারান্দা। একপাশে সিমেন্ট বাঁধানো বসার জায়গা। তার পিছন দিয়ে ফুলে ভরা বোগেনভিলিয়ার ঝাঁকড়া লতা। লতার ছায়ায় বারান্দার ওই দিকটা ঢাকা। ভিতরে বড় বড় চার পাঁচটা ঘর। মস্ত বসার ঘর। রান্নাঘরটাও দশাসই। তাতে বাঁধানো উনুন। সামনে পিছনে ঘাস ও গাছে ভরা বাগান। এসবই লেখা থাকত মায়ের চিঠিতে।
মা নিজে চিঠি লিখতেন না। হাতের লেখা নাকি খারাপ। পড়া যায় না। সুন্দর হাতের লেখায় বাবা লিখতেন, মায়ের জবানিতে। সারা জীবন আমাদের সঙ্গে পত্রালাপ এই রকমই চলেছে। যাঁর হাতের লেখা পড়ছি, তাঁর মুখের ভাষা এরকম নয়, জানি। অর্ধনারীশ্বরের মূর্তির মতো ভাষা ও হস্তাক্ষরের মিশ্রণ। বাবা যেসব কথা বলি বলি করেও বলতে পারছেন না, চিঠির দুই লাইনের ভিতর থেকে সে সব পড়ার চেষ্টা চলত আমাদের। মোবাইল নেই, কলকাতার বাসায় ফোন নেই। ভরসা কেবল নীল ইনল্যান্ড লেটার। একদিকে বাবা মা। অন্যদিকে তিন সন্তান। এখন ভাবলে মনে হয়, চিন্তায় নিদ্রাহীন রাত কাটত নিশ্চয়ই। কিন্তু অতটা দুঃসহ ছিল না জীবন।
রৌরকেলার সরকারি আবাসের বিবরণ চিঠিতে পড়ে সব স্পষ্ট হয়ে ফুটেছিল মনের সামনে। কিন্তু গরমের ছুটিতে তিন ভাইবোন কলকাতা থেকে সেখানে পৌঁছে দেখি, ওমা! বাগান কই? ঝোপঝাড়, ফুলের গাছ, ফলের বাগান? গালে হাত দিয়ে বসে আছেন চিন্তিত মাতা। বললেন, ওরে বাবা! এখানে সাপ বেরোয়। লোক ডেকে সব সাফ করিয়েছি। কী ভীষণ জায়গা!
সামনের খোলা জায়গায় জেগে আছে কেবল মস্ত তিনটি রক্তজবার গাছ। একেবারে পাশাপাশি। রক্ষা পেয়েছে কেবল তারা। মার মনে হয়েছে, ওরা যেন আমরা তিন ভাই বোন। আর বাবার অচলা ভক্তি মা কালীর প্রতি। তাই রক্তজবাদের নিষ্কৃতি। অল্পদিনের জন্য এসেছি। শোওয়ার খাট ও কয়েকটি চেয়ার ছাড়া আসবাব নেই। সেগুলিও এই বাড়ির সম্পত্তি। ফাঁকা ঘরগুলিতে, বাগানে সারাদিন ঘুরে সময় কাটত না।

একদিন অফিসের লোকজন এসে একটা গোবদা কালো ফোন লাগিয়ে দিয়ে গেল। যন্ত্রটা হাতের কাছে পেয়ে কৌতূহল তো হল। কিন্তু ফোন করার তো কোনও মানুষ নেই। মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম শহর ছাড়িয়ে বিকেলের পাহাড়ে। লোকালয়ের কাছঘেঁষা জঙ্গলে ভরা ছোটখাটো পাহাড়, আসলে তো পূর্বঘাট পর্বতশ্রেণীর একটি বাহু। মাঝ দিয়ে পায়ে চলা পথ। খানিকটা পাহাড় চড়ে পাথরে বসে থাকতাম। ছোড়দা আড়বাঁশি বাজাত। বাঁশির সুর ভেসে মিশে যেত বাতাসের গানে।
আমরা থাকতাম ইস্পাত কলোনির এক নম্বর সেক্টরে। অনেক দূরে বাজার। মামারবাড়ি সেক্টর ছয়ে। ওই পথে যেতে পথের ধারে বাজার দেখতাম। তাজা শাক সবজি, মাছ। পাইকারি হারে বর্ধিত চিকেনের দিন তখনও দূর। দেশি মুরগি রান্নার সুবাস জড়িয়ে থাকত বাড়ির বাতাসে। বাড়িটির নম্বর মনে রাখিনি। নম্বর অবশ্য বদলেও যায় সময়ের সঙ্গে। মজার ব্যাপার, ঠিক দু’দশক পর, যে জেলার অন্যতম শহর রৌরকেলা, আমি সেই সুন্দরগড়ের ডি এম। মনে আছে এক শীতসন্ধ্যায় কলোনি ঘুরে ঘুরে সেই বাড়িটা খুজছিলাম। লালবাতির গাড়ির পিছনে আরও গাড়ি। লোকজন। বাড়িটা পাওয়া গেল না কিছুতেই।
সব বাড়িই যেন একরকম, আর সেই বাড়িটার চেয়ে অন্যরকম। মনে মনে কি খুঁজছিলাম না চোদ্দো বছরের এক কিশোরীকেও, কোয়েল নদী দেখতে ভালোবাসত যে। কোয়েল আর শঙ্খ– দুই নদী বেদব্যাসে এসে হয়েছে ব্রাহ্মণী। আমার প্রথম উপন্যাস ‘মহুলডিহার দিন’-এ এই সুন্দরগড় জেলা, ব্রাহ্মণী নদীর কাছে বসত করা মানুষদের কথা আছে। জীবনে সব কিছু একেবারে হারায় না। সময়ের অশ্মস্তরের নীচে জীবন্ত থাকে হৃদয়, স্মৃতিও।
মায়েদের একটি মাত্র ছোটভাই অসীম। অনেকদিন থেকেই রৌরকেলায়। শিবপুরের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতায় কাজ সুলভ ছিল না। স্টিল প্ল্যান্টে প্রথম চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ১৯৬০-এর দশকের শুরুতেই। বিয়ের পর মামিমাও গেলেন। ওঁদের তিন সন্তানকে নিয়ে জমজমাট সংসার। তারা অবশ্য আমাদের ছেয়ে অনেক ছোট। ১৯৭০-এও খুদেই বলা যায় মাপ ও বয়সের হিসেবে। খুব ছোটবেলায় একবার আমরা রৌরকেলায় এসে ছুটি কাটিয়েছিলাম। মা এসেছিলেন অবিবাহিত ছোট ভাইটির সংসার গুছিয়ে দিতে। একটা খাট আমার খুব পছন্দের ছিল। সেটা মামাকে দিয়ে দিতে হবে জেনে বুক ভেঙে গিয়েছিল একেবারে। বয়স হয়তো আড়াই, কারণ তখনও হাজরা রোডের বাড়িতে আসিনি। পড়ে গিয়ে হাঁটু কেটে রক্তারক্তি। তুলো গজ ইত্যাদি দিয়ে ব্যান্ডেজ করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: মন্দার মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে খলিল জিব্রানের প্রফেট
এবার এসে দেখলাম, সবার ছোট মামাতো ভাইটি আমার সেই বয়সের। আদিবাসী রমণী লতার প্রতি ভালোবাসায় সে পাগল। রান্নাঘরের মেঝেতে মামিমা। বাবুল এসে পিঁড়ি নিয়ে লতাকে বলছে, ‘বস, লতা, বস।’ লতা হেসে অস্থির। বাবুল আমাকে মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তার হাতে গাছপাকা জামের রেকাবি দিয়ে মামিমা বলেছিলেন, অর্ধেক তুমি খাও, অর্ধেক ঠাকুরকে দিও। বাবুল প্রতিটি জাম অর্ধেক করে খেয়ে রেকাবি রেখেছিল ঠাকুরঘরে। ঠাকুর নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন পাখিতে খাওয়া।
একটা ছোট্ট ঘটনা এখনও মনে আছে। রান্নাঘরের উনুনে কয়লার আঁচ থাকত অনেকক্ষণ। আমাদের ছোট পরিবারের কাজকর্ম মেটার পরেও। নির্জন দুপুরে সবাই বিশ্রাম করছে। আমি চুপচাপ গেলাম কয়েকটা কাঠচাঁপা ফুল গাছতলা থেকে কুড়িয়ে। কালিদাসের ‘বহ্নৌ ইব পুষ্পরাশিম’ মাথায় ছিল। একটা করে ফুল আগুনে দিচ্ছি আর দেখছি আগুনের তাতে তাদের কুঁকড়ে উঠে তারপর ছাই হয়ে যাওয়া। হঠাৎ চমকে দেখি, বাবা। কখন এসে দাঁড়িয়েছেন বুঝতে পারিনি। বললেন, ছি! তুমি না কবি! কবি কখনো ফুলকে আগুনে পোড়াতে পারে? কথাটা মনে আছে আজও। আর সেই বেদনার্ত মুখ। ফুল আগুনে নিক্ষেপ করার পরীক্ষা নিরীক্ষা আর করিনি। বরং নিজে আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটেছি অনেকবার।
জঙ্গল কেটে সাফ করে দিলেও বনের প্রাণিরা কিন্তু পুরোপুরি আমাদের পাশ ছেড়ে যায়নি। পরবর্তী জীবনে বনে জঙ্গলে গ্রামগঞ্জে কাজ করতে হবে বলেই কিনা জানি না, বন্য প্রাণির ভয় আমার তখনও তেমন ছিল না। একদিন বিকেলে বারান্দায় বাঁধানো বসার জায়গাটায় আমি আর মা গল্প করছি। বোগেনভলিয়ার ফুলে ভরা লতাটাকে মা কাটিয়ে ফেলেননি। হঠাৎ মনে হল আমাদের মাঝখান দিয়ে যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ চলে গেল। বিরাট লম্বা তেমনই মোটা হলুদ রঙের এক সাপ বোগেনভিলিয়ার পাতার আড়াল থেকে লাফিয়ে আমাদের মাঝখান দিয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ল। তারপর এঁকে বেঁকে বাগানের ভিতর দিয়ে পলকে উধাও। সেই সৌন্দর্য আমার মনে চিরকালীন ছাপ ফেলে গেল। এখনও চোখ বন্ধ করলেই তাকে দেখতে পাই।
গরমের ছুটি কাটিয়ে আমি ফিরে এলাম হস্টেলে। দাদারা হাজরা রোডের বাসায়। তার কয়েকমাস পর পুজো। পুজোর পর বাবার বদলি হল কলকাতায়। আমাদের ভাঙা সংসার জোড়া লাগল। বিচ্ছেদের যে সময়টাকে আদিগন্ত সমুদ্রের মতো দীর্ঘ মনে হত, সেটা আসলে ছিল আটমাস। একবছরেরও কম। কিন্তু আমাদের টালমাটাল তরণী যেন আর তীরে পৌঁছতে পারছিল না। রান্নাঘরের অবস্থা তথৈবচ। দুই ভাই রান্না করে, বাজার করে, বাসন মেজে পড়াশুনোর সময় আর পায় না।

আমার ক্লাস ইলেভেন এগিয়ে আসছে। হায়ার সেকেন্ডারিতে আমি যে প্রথম দশের মধ্যে থাকব, তাই নিয়ে স্কুলের স্বপ্ন অনেক বছর ধরেই। এদিকে ইংরাজি অঙ্ক দুইয়েরই পড়ানো যথেষ্ট ভালো নয়। শিক্ষিকা বদলে যাচ্ছেন। কখনও সুদীর্ঘ ভেকেন্সি। বন্ধুদের একদল কানে মন্ত্র দিতে থাকল, এখানে থাকলে রেজাল্ট ভালো হবে না। তুই কোনও ভালো স্কুলে চলে যা। হায়ার সেকেন্ডারির আগে তোকে যে কোনও স্কুল নেবে। এতটা বিশদে না বললেও বাড়িতে কথাটা তুলেছিলাম। বাবা সংক্ষেপে বললেন, ‘যে স্কুল তোমাকে এতদিন লালন করল, ভালো রেজাল্টের আশায় তাকে ছেড়ে যাবে? তাই কখনও হয়? যা হবার এখান থেকেই হোক।’
হস্টেল থেকে বাড়ি ফিরে এসে আমার একাকিত্বের ক্ষতে প্রলেপ পড়ল। সন্দেশে কবিতা প্রকাশও নতুন জীবন পেল। ১৯৭০-১৯৭৩ পর্বে কবিতার পৃথিবী নানা কলকোলাহলে ভরে উঠছিল। এর আরম্ভ ১৯৭০-এ লেখা একটি কবিতা দিয়ে।
“আঁকাবাঁকা শিংঅলা পাহাড়ি হরিণ যদি হই,
তবে ঐ ঘুমন্ত পাহাড়টা একছুটে যাই পেরিয়ে”—
আমার সন্দেশী বন্ধু উজ্জ্বল পরে ব্যাখ্যা করে বলেছিল, মোৎজার্টের “Eine Kleine Nachtmusik”-এর সঙ্গে এই কবিতার চলনের গভীর মিল। তবে লেখার সময় এসব কিছুই জানা ছিল না। কেবল ছিল বাড়ি ছেড়ে হারিয়ে যাওয়া এক মেয়ের আকুলতা। তাকে কারও মনে থাকবে কি? হারিয়ে যাওয়া এই মেয়ে পরেও নানাভাবে ফিরে এসেছে আমার কবিতায়।
*ছবি সৌজন্য: Freepik, Pinterest, Facebook
কলকাতায় জন্ম, বড় হওয়া। অর্থনীতির পাঠ প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখক জীবন আরম্ভ। সূচনা শৈশবেই। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য লেখায় অনায়াস সঞ্চরণ। ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার সদস্য ছিলেন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়। মহুলডিহার দিন, মহানদী, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, ব্রেল, কবিতা সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ ইত্যাদি চল্লিশটি বই। ইংরাজি সহ নানা ভারতীয় ভাষায়, জার্মান ও সুইডিশে অনূদিত হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। শরৎ পুরস্কার, সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণপদকে সম্মানিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর সোমেন চন্দ পুরস্কার ফিরিয়েছেন নন্দীগ্রামে নিরস্ত্র মানুষের হত্যার প্রতিবাদে। ভারতের নানা প্রান্তের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর উন্মোচিত তাঁর লেখায়। ভালোবাসেন গান শুনতে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে, প্রকৃতির নানা রূপ একমনে দেখতে।
4 Responses
লেখাটি খুব গতিশীল। আর অনুভবের অনুভূতি তে ভরা। ভালো লাগলো। গদ্যই মনে হয় আপনি সাবলীল। ভালো থাকুন।
বি ই কলেজ, শিবপুর-এ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ ছিল না। কারণ, বিভাগটি ছিল না।
শিবপুরের বি ই কলেজে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ নেই।
chamotkar lagche…….school bodlabaar byapare apnaar babar kotha jene amaar babar kotha mone porlo……tai D.L.Roy street sthito RaniBhabani School-e class I theke classX porjonto porechilam,eta barir kache chilo….kintu class IX-e othar por bari bodlabar karone DumDum theke bachor derek daily passenger-i korechi.
Shibpur-e Metallurgical Engg Deptt ache…ebong degree niye bachor bachor chatrora desher nana steel plant-e kaaj korche…mone hoy apnar mama-o tai korechen …….ete aboshyo apnaar golpey ektuo aanch lageni…..aro lekha porbo bole udgreeb hoye achi…