ট্রেন ছুটছিল পঞ্চাশ বছর পিছনে। ট্রেন ছুটছে আমার আমার যৌবনবেলার দিকে। আমি কি জুড়ানকে সব বলব? জুড়ান কি শ্যামাশ্রীকে দেখেছে? তবে সে কাকলি গানের ইস্কুল চিনত। পঞ্চাশ বছরে ফেলে আসা যত মানুষ কলকল করছে ট্রেনের ভিতরে। সীমান্তের ওপারে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। কারা যেন স্লোগান দিচ্ছে জয় বাংলা। মা বলে কপোতাক্ষ নদের কথা। সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে। শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কথা আকাশে বাতাসে…অংশুমান রায়। পঞ্চাশ বছর আগের কথা বলছে সকলে। একজন গাইছে, মনে করও আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে। সুমন কল্যাণপুর কোথা থেকে উড়ে আসছে জানি না।
আমি জানি এই যাত্রার কথা নীলমাধবের কানে চলে যাবে। নীলমাধবের বিপক্ষে চলে গেছি আমি। মসলন্দপুর ষ্টেশন থেকে দূরে লবঙ্গ নামের সেই কলোনি। আসলে তা লবঙ্গ নয়, ওপারের লবঙ্গ গ্রামের মানুষজন কলোনি গড়ে নাম দিয়েছিল লবঙ্গ উপনিবেশ। তার মানে জুড়ান সেই গ্রামের কথা জেনে তার শংসাপত্র লিখেছিল। বানায়নি বটে, আবার বানিয়েছেও। এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর। সেই সবুজ সাদা বুটির কামিজ আর সাদা সালোয়ার।
সে আমাকে বলল, আমি তোমাকে কোথায় দেখেছি বল দেখি অনুতোষ আঙ্কেল?
তাদের পাকা গাঁথনি, সিমেন্টের মেঝে, মাথায় অ্যাসবেস্টসের ছাউনি। বাড়িটি কোনওক্রমে খাড়া করা। এই বাড়িতেই ইলিশ নিয়ে আসে নীলমাধব। আমি ঘরটি দেখছিলাম। মা লক্ষ্মীর পট, আগেরবারের সরস্বতীর মূর্তি। দেওয়ালে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ছবি বাঁধানো। বসন্ত মল্লিক হাস্যমুখে জোড় হাতে আহ্বান করলেন, আসুন স্যার আসুন, গান শুনতে কেউ কেউ আসে তো, যেমন জুড়ান স্যার।
“জুড়ান আসে এখানে, আপনার বাড়ি?” আমি অবাক। জুড়ান মাথা নামিয়ে আছে।
“ইয়েস স্যার আসেন,ওঁর স্ত্রী মারা গেলেন গেল মাসে, উনি এখানে এলেন পরদিন, দাহ করে এলেন, গান শুনবেন, শুনেছিলেন আপনাদের শ্যামাশ্রীর কাছে, সকাল থেকে সন্ধে, বারেবারে কত বারে, শুনতে শুনতে কাঁদলেন, বললেন, উনি শোনেননি গান, লিপি শুনেছে, লিপির মাথার বিষ ধুয়ে গেছে গানে, ওঁর স্ত্রী ছিলেন লিপিকা রায়।” বলে বসন্ত হাত ধরল জুড়ানের, বলল, “গানই শোক নিবারণ করবে স্যার, আপনারা এলেন, রাতে চুনো মাছের ঝাল দিয়ে ভাত খেয়ে যাবেন।”
শ্যামাশ্রী বলল,”সারাদিন গাইতে বলো, আমি গাইব, আমাকে কে শেখাবে, বাবার কি সেই ক্ষমতা আছে, আমি ঐ ছবিকে প্রণাম করে শিখি।” আলাউদ্দিন খাঁর ছবির দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল মেয়ে।
সে বলল, আমার গানের ইস্কুল হলে আমার স্বপ্ন পুরণ হবে, কিন্তু…।
সে আবার বলল, তোমাকে কোথায় দেখেছি ভালমানুষ?
সেই যে কাকলি গানের বাড়িতে।
কোন বাড়ি? সে খুঁজতে থাকে নিজের মনের ভিতরে।
আবার বললাম, কাকলি গানের বাড়ি।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে, পালোধী স্যারের বাড়ি তো? শ্যামাশ্রী বলল, “ভাবলাম তুমি কবে যেন গান শুনতে এসেছিলে এই বাড়িতে।”
না কাকলি গানের বাড়ি। আমি বললাম, পালোধীদের বাড়ির ঐ নাম ছিল ৫০ বছর আগে।
“সে নাকি আমাদের বাড়ির নাম ছিল ওপারে, সত্য মিথ্যা জানি না, ঐ জুড়ানচন্দ্র রায় মশায় বলেছেন, আমার বাবা বলল, হতে পারে, ঠাকুদ্দা জানত, বাবার তো এদেশে জন্ম, আমি তাই ভাবছি, তোমায় কেন লাগছে এত চেনা, এত আপন…”এক কলি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান গুনগুন করে সে আবার বলল, “কেন এত কেন চেনা লাগে আমার, কাকলি গানের বাড়ি, গানের বাড়ি, গানের বাড়ি, ভাল মানুষ আমি আমার ইস্কুলের নাম দিচ্ছি কাকলি গানের বাড়ি।”
“আমি তো সেই কথা বলতে এসেছি শ্যামাশ্রী।”
কী সুন্দর বললে তুমি শ্যামাশ্রী, আমাকে একজন বলতেন। সে বলতে বলতে বিষণ্ণ হল, কে বলতেন তা আমি ভুলে গেছি ভালমানুষ, মনে হয় এই বাড়িতে কেউ গান শুনতে এসে, নাকি অন্য কোথাও!”
“তোমার বাড়িতে লোকে গান শুনতে আসে?” জিজ্ঞেস করলাম।
“আসে গো আসে, শোকে তাপে পুড়ে আসে, কান্নাভরা মুখ নিয়ে আসে।” শ্যামাশ্রী বলল।
ইস্কুল কর, গান ছড়িয়ে দাও, আমি চাই গান নিয়ে কলকাতায় ফের তুমি।
“কলকাতা কেন, কলকাতায় গানের সুর বয়ে যেতে পারবে না ভালমানুষ,” সে হাসল, হাসিতে সাদা আলো ছড়িয়ে গেল, বলল, “কত গ্রাম কত গঞ্জ, মানুষ কত দুঃখে আছে ভালমানুষ, গান শুনিয়ে দুঃখ যদি দূর করতে পারি, কলকাতা আমি ফিরব না অনুতোষ।”
আমি স্পষ্ট শুনলাম সে ডাকল, অনুতোষ, নিজের নাম সুর হয়ে প্রবেশ করল মরমে, বললাম, “আমি তো আছিই। কাকলি গানের বাড়ি প্রতিষ্ঠা কর শ্যামাশ্রী, কাকলি গানের বাড়িতে গান শুনিয়েছিলে তুমি, মনে পড়ে।”
সে মাথা নামিয়ে বলল, মনে পড়ে।
আমি যেন আলোর স্রোত বয়ে যেতে দেখলাম শ্যামাশ্রীর মুখের উপর দিয়ে। বড় বড় দুই চোখ, গ্রীবাখানি সেই দূর অতীতের মতো বাঁকিয়ে আমাকে বলল, একটা গান আছে ভালমানুষ, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়েছিলেন, তোমায় কেন লাগছে এত চেনা…,কী গান শুনবে বলো।
যা মনে হয়। মৃদু গলায় বললাম।
সে খালি গলায় গাইল, এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর…।
আলোকে মোর চক্ষুদুটি, মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুটি…আলোই গান হয়ে বয়ে যেতে লাগল আমার চারদিকে। আমি দেখলাম সেই শ্যামাশ্রী ঘোরের ভিতরে গেয়ে চলেছে সেই গান।
একদিন সকালে সুমিতাভ আমাকে ফোন করলেন। এই যে কয়েকদিন আগে তিনি আমাকে একলা রেখে বাড়ি চলে গেলেন সেই কারণে মার্জনা চাইলেন। ডাকলেন আমাকে তাঁর ফ্ল্যাটে। আমি সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম। তিনি তিনতলায় থাকেন। ফ্ল্যাটের পেছন দিকে একটি ব্যালকনি। ব্যালকনি থেকে পার্শ্বনাথ দিগম্বর জীউ এর মন্দির, বাগান, কৃত্রিম পাহাড়, ঝর্না, জলাশয়। ওই জলাশয়ে প্রচুর রঙিন মাছ আছে। ছোটবেলায় দেখেছি। মন্দির এমনিতে শান্তই থাকে, তবে মাঝে মাঝে মোচ্ছব লাগে। তখন বিকট শব্দে মাইক বাজে। কার্তিক পূর্ণিমায় বড় উৎসব হয় যে তা আমার জানা। সুমিতাভর বাড়ি খুব শান্ত। সুমিতাভ আমাকে নিয়ে গেলেন ব্যালকনিতে, বললেন, একটি গল্পের জন্মের সাক্ষী আপনি, তাই ডেকেছি সেই গল্প বলতে।
কলকাতার আকাশে বর্ষার মেঘ। এর ভিতরে দু’দিন বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভোরে বৃষ্টি হলে, আমাদের প্রাতঃভ্রমণ বিঘ্নিত হয়। ব্যালকনিতে আমরা বসেছি। আমি জিজ্ঞেস করেছি, কোন গল্প বলুন তো?
আবদাল্লা, চঞ্চলচন্দ্র এবং মঞ্জরীর কাহিনি। মৃদু গলায় বললেন সুমিতাভ।
গল্প এমন হয়? আবদাল্লার সঙ্গে মঞ্জরী এবং চঞ্চলচন্দ্রর সম্পর্ক কোথায়? মঞ্জরীর সঙ্গে চঞ্চলের শেষ দেখা চল্লিশ বছর আগে। যেমন শ্যামাশ্রী ও আমার পঞ্চাশ বছরের ব্যবধান। চঞ্চল দেশের বাইরে চাকরি করেছেন সারাজীবন। আবদাল্লা এক নিরাশ্রয় পথবাসী বৃদ্ধ। আর আমরা পেনশনভোগী মানুষ। কারও কারও অনেক সঞ্চয়। কেউ কেউ স্বল্প সঞ্চয় নিয়ে বেঁচে আছেন। সুমিতাভ বললেন, জেরুজালেম গিয়ে জেরুজালেম সিনড্রোম হোক, অন্য যে কোনও কারণে হোক হোটেলে ফিরে এক গভীর রাতে আচমকা মঞ্জরীর কথা মনে পড়ে যায় চঞ্চলের।
আল-ফারাবি এক বিলাসবহুল হোটেল। ঝলমলে বার, ঝলমলে উদ্যান, সুইমিং পুল। তখন কলকাতায় বর্ষা। তখন জেরুজালেমেও বর্ষার মেঘ এসেছিল। কিন্তু ওসব দেশে তো বৃষ্টিপাত কম। কিন্তু সামান্য বর্ষাই তাঁকে স্মৃতি ফিরিয়ে দিল। সে রাতে ঘুম হয়নি চঞ্চলচন্দ্রর। তিনি পাগলের মতো ফেসবুক সার্চ করেছেন। মঞ্জরী কি ফেসবুকে থাকবে না? এত বছর বাদে তিনি ক্ষমা চেয়ে নেবেন।
পরে জেনেছিলেন মঞ্জরীর বাবা গড়বেতা চলে গিয়েছিলেন পরিবার নিয়ে। মঞ্জরী পুরোন শহর থেকেই বি, এ, পরীক্ষা দিয়েছিল। মঞ্জরী একটি গান গাইত। বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ় এল। এই গান যুবক চঞ্চলচন্দ্র শুনেছিলেন স্থানীয় রবীন্দ্র জন্মোৎসবে। এই গানই এত বছর বাদে ফিরিয়ে দিল মঞ্জরীকে। বহুযুগের ওপার হতে মনের ভিতরে উদয় হল কুড়ি বছরের মঞ্জরী। রূপের আলোয় ঝলমলে মুখ। চোখের ইশারায় বুক কেঁপে যেত। ঈষৎ কটা ছিল দুই চোখ। সেই চোখে ছিল অমোঘ আকর্ষণ।
মন থেকে একটুও মুছে যায়নি সে। তিনি ফেসবুক সার্চ করতে লাগলেন মঞ্জরী চৌধুরী, সাকিন গড়বেতা…নাম লিখে। যাদের পেলেন মিলল না। কত মঞ্জরী রয়েছে পৃথিবীতে। খুঁজে পাবেন কী করে চঞ্চল। চল্লিশ বছরে কি আগের মঞ্জরী আছে সে। ছবিতে মিলবে না। কিন্তু পেলেন শেষ রাতে, যখন এদেশে সকাল হয়ে গেছে, বর্ষা নেমেছে সকালেই। মঞ্জরীর বাড়ির লাগোয়া পুষ্পবন ভিজে যাচ্ছে নবীন মেঘের উল্লাসে। মঞ্জরী ব্যালকনিতে বসে দেখছে বর্ষাস্নাত সকাল। মঞ্জরী জানেও না, দূর পাশ্চাত্যে, এশিয়ার শেষপ্রান্তে পবিত্র নগর জেরুজালেমে বসে একজন তাকে খুঁজে যাচ্ছে রাত জেগে। অনুতাপে বুক পুড়ছে। দেশে ফিরে গোপনে খুঁজে বের করবেন শুভাননের বাবা মাকে। তাঁরা কি বেঁচে আছেন তাঁদের সন্তানের ঘাতকের ফিরে আসার জন্য?
ঘাতক, কে ঘাতক? আমি কেঁপে উঠলাম।
হাজতবাসের পর শুভানন গলায় দড়ি দিয়েছিল। সুমিতাভ বললেন।
আপনি লিখলেন, না সত্য? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সুমিতাভ বললেন, সাহিত্যের সত্য ঘটমান সত্যের চেয়ে বড়।
লোকটা তাহলে খুনি, খুনি করে দিলেন ওকে?
সুমিতাভ সরাসরি জবাব দিলেন না। চঞ্চলচন্দ্র মঞ্জরীকে পেলেন চন্দ্রকোনায়। চন্দ্রকোনা শহর গড়বেতার কাছাকাছি। দেখলেন ষাট বছরের এক প্রবীণার মুখ। চেনা মুখ বদলে গিয়েও চেনা রয়ে গেছে। তাঁর মনে পড়ল, সেই চৈত্র দুপুরের কথা। তাঁদের শহরের সেই রেলস্টেশন। দিনে কটিই বা গাড়ি যায়। দুপুরে খাঁ খাঁ করতে থাকে চারদিক। সে এসেছিল প্রেমিকের জন্য দয়া প্রার্থনা করতে। কিন্তু চঞ্চলচন্দ্র তখন মঞ্জরীর জন্য উন্মাদ। প্রিয় নারীর জন্য মানুষ কী না করতে পারে।
অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।