banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বিদুর: এক দূরদ্রষ্টা রাজপুরুষ

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Bidur - The minister of Dhritarashra

মহাভারত, বা বলা ভাল, মহাভারতের চরিত্রদের নিয়ে লিখতে গেলেই যে সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হয় অধিকাংশ সময়, সেটা হল, চরিত্রগুলোকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করা।

আসলে, যেহেতু মহাভারত কোনও একজন ব্যক্তির একই সময়ে লেখা নয়, তাই কাহিনির বিভিন্ন অংশে একই চরিত্রের প্রতি লেখকের মমত্ব, নৈর্ব্যক্তিকতা, এমনকি গুরুত্বও পালটে যায় অনেকটা। এটা রামায়ণেও দেখা যায়, তবে মহাভারতের কাহিনিতে স্তর এবং সময়কাল, দুইই যেহেতু অনেক বেশি, তাই এটা প্রকট হয় অনেক ব্যাপকভাবে। মূল চরিত্রদের ক্ষেত্রে প্রভাবটা তাও কিছুটা কম, কিন্তু পার্শ্বচরিত্রদের ক্ষেত্রে সেটা খুবই স্পষ্ট।

আমাদের আলোচ্য বিদুরের কথাই ধরা যাক। প্রথমতঃ, তাঁর ধী, প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধি ইত্যাদির গভীরতা বিচার করলে তাঁর পার্শ্বচরিত্রে পর্যবসিত হওয়া এবং কুরুক্ষেত্রের সময় থেকে তীর্থযাত্রার অছিলায় তাঁর প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াটাই একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। দ্বিতীয়তঃ, রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে, তিনি ছিলেন কৌরবপক্ষে পাণ্ডবদের সবচেয়ে সক্রিয় সুহৃদ। পাণ্ডবরা, বিশেষত কুন্তী এবং যুধিষ্ঠির তাঁকে যতখানি বিশ্বাস করতেন, সম্ভবত আর কাউকেই অতখানি করতেন না। অন্যদিকে, পাণ্ডবদের সবচেয়ে বড় পরামর্শদাতা ছিলেন বাসুদেব কৃষ্ণ। তাঁর মূল রাজনৈতিক লক্ষ্য কিন্তু ছিল সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে সব রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করা। 

পাঞ্চজন্য’ গ্রন্থে লেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্র এ বিষয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন, তাই এর যুক্তি নিয়ে বেশি আলোচনা অবান্তর। তাও, যাঁরা পড়েননি, তাঁদের জ্ঞাতার্থে সংক্ষিপ্তভাবে ব্যাপারটা বলা যাক। বাসুদেবের মূল লক্ষ্য ছিল, সমগ্র উত্তর ভারতের রাজাদের সংঘবদ্ধ করা, যাতে কোনও বিদেশি শক্তির হাতে ভারতবর্ষের নিরাপত্তা বিপন্ন না হয়। তার প্রথম ধাপ ছিল যাদবদের সমস্ত গোষ্ঠীগুলিকে তাঁর অধীনে ঐক্যবদ্ধ করা, যার সূচনা কংসবধ দিয়ে।

এরপর তিনি প্রবৃত্ত হন সমগ্র উত্তর ভারতকে একত্রিত করতে। বিবাহ, যুদ্ধ ও কূটনীতির দ্বারা এ কাজে কিছুটা অগ্রসর হন বটে, তবে তৎকালীন উত্তর ভারতে দ্বারকা ছাড়া শক্তির ভরকেন্দ্র ছিল চারটি। জরাসন্ধ শাসিত মগধ, দ্রুপদ শাসিত পাঞ্চাল, বিরাট শাসিত মৎস্যরাজ্য এবং অবশ্যই, দুর্যোধন শাসিত হস্তিনাপুর। তাই প্রথমে পাণ্ডবদের সাহায্যে জরাসন্ধ বধ, অর্জুনের বিবাহসূত্রে পাঞ্চালরাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা, অজ্ঞাতবাসের সময়ে কীচকবধ ও পরে বিরাটের মিত্রতা এবং সর্বশেষে কুরুক্ষেত্র– এ সমস্তই ছিল সেই বৃহত্তর পরিকল্পনারই অঙ্গ।

 

আরও পড়ুন: মৃন্ময় প্রামাণিকের কলমে: সুন্দ-উপসুন্দ উপাখ্যান ও লিঙ্গ-যুদ্ধের নীতি

 

এখানে দুটো প্রশ্ন জাগে।

এক, কৃষ্ণের উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক না কেন, একথা অনস্বীকার্য, যে এর ফলে হস্তিনাপুরের স্বাধীনতা খর্ব হওয়া ছিল অনিবার্য। এবারে, বাকিরা যদি কৃষ্ণের এই পরিকল্পনা না-ও বুঝে থাকেন, সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং স্বয়ং ব্যাসদেবের পুত্র ও শিষ্য বিদুর একথা বুঝতে পারেননি, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্ব তাঁর না-থাকতে না পারে, কিন্তু এ বিষয়ে হস্তিনাপুরের মহামন্ত্রী ছাড়া তাঁর আর কোনও ভূমিকা না থাকাটা খুবই বিস্ময়কর। কৃষ্ণের প্রকল্পে যদি তাঁর সায় থাকে, তাহলে তাঁকে সাহায্য করা, বা সায় না থাকলে তাতে বাধা দেওয়ার কোনো প্রয়াস কিন্তু বিদুরের তরফে দেখা যায় না। 

দুই, কৃষ্ণের তরফেও কিন্তু বিদুরকে এই পরিকল্পনার অংশ করার ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দেখা যায় না। তৎকালীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক মস্তিষ্ককে এত বড় একটা রাজনৈতিক পরিকল্পনায় শামিল না করাটা একটু অদ্ভুত নয় কি? অবশ্য একটা ব্যাখ্যা হতে পারে যে, কৃষ্ণ তাঁকে এই ভেবেই শামিল করেননি যে তাঁর এ বিষয়ে নিজস্ব মতামত থাকতে পারে, এবং সেটা কৃষ্ণের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের পথে বাধা হতে পারে।

যাই হোক, দ্বিতীয় প্রশ্নটায় আমরা পরে আসব। আগে আমরা বরং প্রথম প্রশ্ন, অর্থাৎ বিদুরের উদ্দেশ্য নিয়ে একটু মাথা ঘামাই। কিন্তু, তার আগে আরও কয়েকটা ব্যাপার একটু খতিয়ে দেখতে হবে আমাদের। যেমন: বিদুরের চরিত্রে আপাতদৃষ্টিতে বেশ কিছু বৈপরীত্য ধরা পড়ে।

একদিকে, ব্যাসদেবের ঔরসে জন্ম হওয়া সত্ত্বেও আজীবন দাসীপুত্র‘-এর পরিচয় বয়ে বেড়াতে হয়েছে বলে অত্যন্ত যন্ত্রণা পেতেন বিদুর। আবার এও সত্যি, যে অগাধ পাণ্ডিত্য এবং প্রগাঢ় ধর্মচেতনা সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব, এবং হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনের প্রতি তাঁর প্রায় দাসসুলভ বিশ্বস্ততা দেখা যায়। একদিকে তিনি পাণ্ডবদের সবচেয়ে বড় পরামর্শদাতাদের একজন, তাঁদের সর্বাপেক্ষা শুভাকাঙ্ক্ষী, তাঁদের জতুগৃহ থেকে বাঁচাচ্ছেন। অথচ যুধিষ্ঠির যখন ইন্দ্রপ্রস্থে নিজেদের রাজত্ব গড়লেন, তখন তিনি সেখানে গেলেন না। যে হস্তিনাপুরের স্নেহান্ধ রাজার কানে তাঁর সমস্ত সুপরামর্শ তিনি চিরকাল ‘অপাত্রে দান’ করে গেছেন, যুধিষ্ঠিরের মন্ত্রী হয়ে তিনি যদি তাঁকে সেগুলি দিতেন, তাহলে মহাভারতের গতি কোনদিকে যেত, কে বলতে পারে?

আরও একটা কথা এখানে মনে রাখা জরুরি। যুধিষ্ঠিরকে জ্ঞান ও ধর্মচেতনার শিখর ধরা হলেও, তাঁর ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুতির বেশ কিছু উদাহরণ (অশ্বত্থামা হতছাড়াও) আজকের যুগে দাঁড়িয়ে বিচার করলে চোখে পড়ে। বিদুরের ক্ষেত্রে কিন্তু সেরকম উদাহরণ বিরল। তাঁকে ধর্মের অবতারও বলা হয়। এবার, এমন একজন মানুষ, ধৃতরাষ্ট্র, শকুনি, দুর্যোধন অধ্যুষিত হস্তিনাপুর সভার মতো চরম অধর্মের পাঁকে বাস করতেন কেন? ভীষ্মের মতো কোনও প্রতিজ্ঞার দায়বদ্ধতা তো তাঁর ছিল না! দ্রোণ বা অশ্বত্থামার মতো পার্থিব সম্পদ বা প্রাচুর্যের প্রতিও কোনও আসক্তি ছিল না তাঁর। তা হলে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর মহাভারতে আছে কিনা, তা বলা কঠিন। তবে মিহির সেনগুপ্ত তাঁর বিদুরবইতে এ প্রসঙ্গ নিয়ে যে আলোচনা করেছেন, সেটা আমার ভাবনাকে একটা নতুন পথে চালিত করেছে।

Dhritarashtra
ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি বিদুর ছিলেন একরকম দাসসুলভ বিশ্বস্ত

মূলতঃ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেই তাঁর খ্যাতি হলেও, বিদুরের ভিতর একটা গূঢ়, অন্তঃসলিলা সামাজিক উদ্দেশ্য ছিল। এর উৎস খুঁজতে হলে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে বেশ কিছুটা পিছনে, বিদুরের জন্মেরও বহু আগে। মহাকাব্য নিয়ে যাঁরা অল্পবিস্তর চর্চা করেন, তাঁরা সবাই নিশ্চয়ই ‘নিয়োগপ্রথা’ সম্বন্ধে জানেন। যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য সংক্ষেপে বলি, কোনও রাজা বা রাজবংশীয় পুরুষ পিতৃসুখে অক্ষম হলে কোনও উচ্চবংশজাত পুরুষকে নিয়োগকরা হত তাঁদের স্ত্রীদের গর্ভধারণে সাহায্য করতে। সেই সন্তান কিন্তু পিতৃপরিচয়, সম্মান, সবই রাজপুত্রের মতোই পেত। যজ্ঞে বা দেবতাদের বরে পাওয়া রাজাদের সকলের জন্মের এইটেই আসল কারণ বলে আধুনিক প্রায় সমস্ত গবেষকই একমত। একেই বলা হত ‘নিয়োগপ্রথা’। রামায়ণেও এর উদাহরণ আছে।

যাই হোক, যে পুরুষটি এই প্রথায় নিয়োগহতেন, তাঁর পরিচয় স্বভাবতই থাকত অত্যন্ত গোপন। সন্তান নিজেও অধিকাংশ সময়ে নিজের প্রকৃত পরিচয় জানতেন না। কিন্তু, ত্রেতা থেকে দ্বাপর যুগে বর্ণাশ্রম প্রথার তীব্রতা যত বৃদ্ধি পেয়েছে, ততই নিয়োগপ্রথায় উচ্চবংশজাতপুরুষটির রক্তের শুদ্ধতা সম্বন্ধে খুঁতখুঁতুনি বেড়েছে রাজবংশে। রক্তের শুদ্ধতা নিয়ে এই বদ্ধ সংস্কার ইতিহাসে ইংল্যান্ড, স্পেন, ফ্রান্স ইত্যাদি বহু ইয়োরোপীয় রাজবংশে দেখা গেছে। এর প্রধান ফসল বহুল পরিমাণে ‘inbreeding’ এবং তার ফলে রাজবংশের মধ্যে বিবিধ রোগব্যাধি, বিশেষত যৌনরোগের বিপুল সংক্রমণ। হস্তিনাপুরও যে এর ব্যতিক্রম ছিল না, সে কথা মিহির সেনগুপ্ত অতি সুচারুভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

একটু ভাবলেই বোঝা যায়, ভীষ্মের বাবা শান্তনু ছিলেন একজন বিকৃতকাম ব্যক্তি। প্রৌঢ়ত্বেও পৌঁছেও যে তাঁর সেই প্রবণতা যায়নি, সে কথা তাঁর পুত্রের চেয়েও ছোট সত্যবতীকে প্রতি একবার দেখেই তাঁর কামোত্তেজনা থেকেই বোঝা যায়। সেটা এমন কিছু ব্যতিক্রম না হলেও খুব সম্ভবত তাঁর কোনও জটিল যৌন ব্যাধিও ছিল। সে কারণেই দেবব্রতর আগে তাঁর সাত পুত্র জন্মের পরেই মারা যায়। এবং তাঁর ঔরসে সত্যবতীর পুত্রদের মধ্যে চিত্রাঙ্গদ মারা যান অল্পবয়সে; বিচিত্রবীর্যও ছিলেন পিতৃসুখে অক্ষম। এ কারণে, একটা ব্যাপার খুবই অদ্ভুত, যে দেবব্রত বা ভীষ্ম ছিলেন এমন মহাবীর পুরুষোত্তম। তাই মিহিরবাবু এখানে বলছেন, যে খুব সম্ভবত দেবব্রতও ছিলেন পিতৃসুখে অক্ষম। এবং সেই দুর্বলতা ঢাকার জন্যই সম্ভবতঃ তাঁর ব্রহ্মচর্য রক্ষার প্রতিজ্ঞা। নাহলে পিতার নারীসঙ্গের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য সত্যবতী ছাড়া অন্য কোনও সুন্দরী নারীর খোঁজ করা কি তাঁর পক্ষে খুব দুঃসাধ্য হত? পরবর্তীকালে অম্বাকে প্রত্যাখ্যান করার পিছনেও সম্ভবত এটাই ছিল মূল কারণ।

যাই হোক, পিতার এমন উদাহরণ সত্ত্বেও ভীষ্মের মধ্যে এই রাজরক্তের শুদ্ধতা রক্ষার বাসনা কিন্তু ছিল পুরোমাত্রায়। সেই কারণেই, যতই বড় জ্ঞানী ঋষি হোন না কেন, নিজের ভ্রাতৃবধূদের নিয়োগপ্রথার ক্ষেত্রে বনবাসী ভীষণদর্শন ব্যাসদেব তাঁর বিশেষ পছন্দ ছিল না। কিন্তু এইখানেই পাওয়া যায় তাঁর বিমাতা সত্যবতীর ক্ষুরধার বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের পরিচয়। সত্যবতী ছিলেন ধীবররাজের কন্যা। আর্য উপনিবেশ বিস্তারের ফলে অনার্যদের অস্তিত্বসঙ্কট তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন পুরোমাত্রায়। ফলে সম্ভবত আর্য সাম্রাজ্যবিস্তারে অনার্যদের অস্তিত্বরক্ষা এবং অনার্য ঔরসে রাজবংশবিস্তারই ছিল শান্তনুকে দেওয়া শর্তের পিছনে তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। অনার্য সমাজে কিন্তু তখনকার দিনে নারীদের স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি। জারজ হলেও ব্যাসকে ধীবরসমাজ পূর্ণ আদরে গ্রহণ করেছিল। সত্যবতীও কখনও এই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। এবং মহাজ্ঞানী, দূরদর্শী ব্যাসও হয়তো ভেবেছিলেন যে আর্য এবং অনার্যদের বর্ণসংকরই ভারতবর্ষে এই দুই সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক সহাবস্থানের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান। সে কারণে, মূলতঃ সত্যবতীর উদ্যোগেই অম্বিকা, অম্বালিকা ও এক দাসী ব্যাসদেবের সেবাকরে পুত্র হিসেবে লাভ করেন ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু ও বিদুরকে। 

 

আরও পড়ুন: পার্থ বসুর কলমে: অলীক অলকেন্দু

 

অন্যান্য পুত্রদের প্রতি ব্যাস অপেক্ষাকৃত নৈর্ব্যক্তিক ভাব পোষণ করলেও বিদুর ছিলেন তাঁর স্নেহধন্য। হয়তো ব্যাসকে দেখে অম্বিকা ও অম্বালিকার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে তিনি বুঝেছিলেন, যে এঁদের পুত্ররা তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে না। বিদুরও পিতামহী সত্যবতী ও ব্যাসের এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। হস্তিনাপুরের মহামন্ত্রী হিসাবেও তাঁর এই উদ্যোগ ছিল অব্যাহত। এবং এ ব্যাপারে সুহৃদ হিসাবে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর ভ্রাতৃবধূ কুন্তীকে। কুন্তীর এ বিষয়ে সহমর্মিতার কারণ ঠিক স্পষ্ট নয় অবশ্য। হতে পারে, পান্ডু যেহেতু ছিলেন পিতৃসুখে অক্ষম, তাই অবিবাহিত, সংবেদনশীল দেবরের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। অথবা, হয়তো অবিবাহিত অবস্থায় দুর্বাসার ঔরসে পাওয়া পুত্রকে ত্যাগ করার অপরাধবোধ তাঁকে বিদুরের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। 

কারণ যাই হোক, এর প্রমাণ পাওয়া যায় বনবাসে থাকাকালীন নিজের ও মাদ্রীর ‘নিয়োগপ্রথা’ সম্বন্ধে তাঁর উদ্যোগ দেখে। বিদুর যে যুধিষ্ঠিরের প্রকৃত পিতা, সেটা এখন আর খুব নতুন কথা নয়। এর সপক্ষে বহু যুক্তি ও প্রমাণ বুদ্ধদেব গুহ, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় গবেষকরা দিয়ে গেছেন। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বিদুরের আত্মিক যোগ, দু’জনের নীতিবোধ, শান্ত প্রকৃতি ও জ্ঞানের মিল- সমস্তই সেদিকে নির্দেশ করে। কিন্তু, অন্য পাণ্ডবদের ব্যাপারেও এটা ভাবা খুবই সঙ্গত, যে তাঁদের কারও প্রকৃত পিতাই সম্ভবত উচ্চরাজবংশীয় ছিলেন না, কারণ তাঁদের জন্মের সময়ে সস্ত্রীক পান্ডু ছিলেন বনবাসে। এই পিতাদের নির্বাচনও করেছিলেন কুন্তীই কারণ দুর্বাসার বরতাঁরই ছিল। তবে এ বিষয়ে বিদুরই যে ছিলেন তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই, কারণ পান্ডু তখন খুবই অসুস্থআর বিদুরই একমাত্র তাঁদের সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রাখতেন। তাছাড়া, হস্তিনাপুরের মহামন্ত্রী হিসাবে যেহেতু রাজ্যের গুপ্তচরেরা ছিল তাঁরই নিয়ন্ত্রণে, তাই ব্যাপারটার গোপনীয়তা রক্ষা তাঁর সাহায্য ছাড়া সম্ভব হত না।

এই সূত্র ধরে যদি এবার আমরা পরবর্তী ঘটনাক্রম বিচার করি, তাহলে পাণ্ডবদের সঙ্গে বিদুরের যে গভীর আত্মিক যোগ, তার কারণ হিসাবে যুধিষ্ঠিরের প্রতি তাঁর পুত্রস্নেহ ছাড়াও একটা বড় কারণ পাওয়া যায়। তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর বর্ণসংকরের আদর্শকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া তখনই সম্ভব, যদি কুন্তীর আদর্শে, হস্তিনাপুরের রাজবংশের গন্ডির বাইরের কাউকে হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে বসানো যায়। তিনি হয়তো এও ভেবেছিলেন, যে মহাবীর পাণ্ডবরাই পারবে সমগ্র ভারতবর্ষকে এক রাজছত্রের তলায় এনে এই বর্ণাশ্রমের গোঁড়ামির মূলে কুঠারাঘাত করতে। অবশ্য, এত বড় পরিকল্পনার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ মহাভারতে পাওয়া যায় না। তবে পরিকল্পনার ব্যাপ্তি যাই হোক না কেন, বিদুরের এই পরিকল্পনার জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল হস্তিনাপুর এবং তার রাজসিংহাসনের গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা। 

Disrobing_of_Draupadi
দ্যূতসভায় দুর্যোধন কর্তৃক দ্রৌপদীর চরম অবমাননা

সম্ভবত, সেই কারণেই দুর্যোধনের শত অপমান সত্ত্বেও তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছেন ধৃতরাষ্ট্রকে যে কোনওপ্রকারে বুঝিয়ে পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসানো, অথবা অন্ততপক্ষে তার সুযোগটুকু করে দেওয়া। ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের পর তাঁর পরিকল্পনা অনেকটা পূর্ণাঙ্গ রূপ নিতে শুরু করে। কিন্তু, তখনই ঘটে এক চরম দুর্যোগ। দ্যূতসভায় হস্তিনাপুরের রাজদরবারে কৌরবরা যে সীমা লঙ্ঘন করে এবং সর্বসমক্ষে দ্রৌপদীর যে অমর্যাদা হয়, তাতে বিদুর প্রথম উপলব্ধি করেন, যে হস্তিনাপুরে এক অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এবং কুরু-পাণ্ডব দুপক্ষই যেরকম প্রভাবশালী, তাতে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে সমগ্র ভারতবর্ষের বড় রাজ্যগুলি।

এখানেই আমরা আসব একেবারে শুরুতে উল্লিখিত দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে। কৃষ্ণের উদ্দেশ্য আমরা আগেই আলোচনা করেছি এবং এখানেই সম্ভবত কৃষ্ণের সঙ্গে বিদুরের মূল পার্থক্য। ‘পাঞ্চজন্য’ গ্রন্থে গজেন্দ্রকুমার মিত্র এমন ইঙ্গিত পর্যন্ত করেছেন যে, কুরুসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণও ছিল কৃষ্ণের অভিপ্রেত, কারণ এতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু, কূটনৈতিক পদ্ধতিতে রাজ্যদের ঐকবদ্ধ করায় বিদুরের নিরুক্ত সমর্থন যদি থেকেও থাকে, কুরুক্ষেত্রের মতো কোনও বিধ্বংসী মহাযুদ্ধ ছিল তাঁর সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। কারণ তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যবিস্তারের মাধ্যমে সমাজসংস্কার, কৃষ্ণের মতো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। এবং বিদুর জানতেন, যে সর্বভারতব্যাপী সর্বগ্রাসী কোনও যুদ্ধ হলে তাতে যেই জিতুক, তার ফলে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে, তাতে যে কোনও সমাজসংস্কারের পরিকল্পনা পিছিয়ে যাবে অনেকখানি। তাই তিনি সর্বান্তকরণে চেয়েছিলেন এ যুদ্ধ না হোক।

কিন্তু পাণ্ডবদের বনবাসের সময়েই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তেরো বছর বাদে দুর্যোধন সুবোধ বালকের মতো রাজ্য প্রত্যর্পণ করবেন না, এবং একটা সর্বগ্রাসী যুদ্ধ হবেই। হয়তো সেই কারণেই এই সময় থেকে তাঁকে দেখি রাজ্যচালনার ব্যাপারে আস্তে আস্তে পশ্চাদপটে চলে যেতে, কারণ শুধু পদমর্যাদা রক্ষার জন্য রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর কোনওদিনই ছিল না। তাও, পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাস থেকে ফেরার পর থেকে শান্তি আলোচনার সময়ে তিনি চেষ্টা করেছিলেন যুদ্ধ বন্ধ করার, ধৃতরাষ্ট্রকে দুর্যোধনের লালসার ভয়ঙ্কর পরিণাম বোঝানোর মাধ্যমে। ফলস্বরূপ তাঁকে হস্তিনাপুর থেকে বহিষ্কার করেন দুর্যোধন। তখন কিন্তু কুরুক্ষেত্র অবশ্যম্ভাবী।

সেই কারণেই বিদুর তাঁর সমস্ত আশা পরিত্যাগ করে চলে যান পিতা ব্যাসদেবের আশ্রমে, এবং সেখান থেকে তীর্থে। লক্ষণীয় এই যে, তিনি কিন্তু পাণ্ডবদের যুদ্ধে সাহায্য করতে আসেননি। সত্যি বলতে কী, কুরুক্ষেত্র শুরু হওয়ার পর থেকে আর বিদুরের উল্লেখই পাই না আমরা। এমনকী, যুধিষ্ঠির রাজা হওয়ার পর তাঁর মন্ত্রিত্বও গ্রহণ করেননি বিদুর। কারণ তাঁর আদর্শ রূপায়নের পরিস্থিতি তখন আর ছিল না। কুন্তী, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সঙ্গে তিনি যোগ দেন বানপ্রস্থে।

মহাভারতে মহাবীর, মহারথীর কোনও অভাব নেই। এমনকি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, শাস্ত্রজ্ঞান ইত্যাদিতেও বিদুরের সমকক্ষ বা তর্কসাপেক্ষে তাঁর চেয়েও শ্রেষ্ঠ কেউ কেউ থাকতে পারেন। তবে সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে, সমগ্র ভারতবর্ষে আধুনিক সংস্কার প্রচলনের মহৎ আদর্শে নিজেকে কায়মনোবাক্যে সমর্পণ করার এমন উদাহরণ এক রচয়িতা ব্যাসদেব ছাড়া মহাভারতে আর পাওয়া যায় না।

*লেখার ভেতরের ছবিসৌজন্য: Wikipedia, Wikiwand
*তথ্যঋণ: মিহির সেনগুপ্ত – বিদুর 
মহাভারত – রাজশেখর বসু 
পাঞ্চজন্য – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
মহাভারতের প্রতিনায়ক – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি
মহাভারতের কথা – বুদ্ধদেব গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com