আজ প্রায় পাঁচ মাস অতিক্রান্ত। শঙ্করাচার্য, নিম্বার্ক, রামানুজ, রূপ গোস্বামীর কারিকা, দেহভেদ নিরূপনের গূঢ় তর্কে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মালিহাটি। রাধামোহনপন্থী পণ্ডিত, উড়িষ্যার বিরাজ বিদ্যাভূষণ অদ্বৈত ব্রহ্মবাদকে এমন আক্রমণ করেন, যে উভয় পক্ষে হাতাহাতির উপক্রম হয়। জীব ও ব্রহ্মা এক, একথা বললে জীবকে অনন্ত নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে– এই উক্তি করায় বিরাজপন্থীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো অভিশাপ বর্ষণ করেন ব্রজদেবপন্থীরা।
[the_ad id=”266918″]
মুর্শিদকুলির আদেশে আসা শ্রান্ত ক্লান্ত শেখ বদরুদ্দিন, সৈয়দ করমউল্লাহ, শেখ হিঙ্গান, কাজী সদরউদ্দিন এই মহাবিতর্কের অবসানের অপেক্ষায় আছেন। বিপদ একটাই, খবর এসেছে পণ্ডিত ব্রজদেব হঠাৎ করে ভাবের ঘোরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁর সাময়িক অনুপস্থিতিতেই বিতর্কসভা চলেছে। স্নানের সময় তিনি নাকি ভাব বিহ্বলতায় স্বয়ং রাধিকাকে দর্শন করেছেন। তারপর থেকেই তাঁর এই অবস্থা!
বিচলিত হয়েছেন আরও একজন। যিনি নবাব-আদেশের সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব কৌতূহলে এই বিতর্কসভায় উপস্থিত হয়েছেন। আহসান খাঁ ভাবেন, এ এক আশ্চর্য সন্ধিক্ষণ! কোথায় গিরিকন্দর ঘেরা মরুশহর আর কোথায় এই বৃষ্টিভেজা বাংলা! বারংবার কেন তাঁরই নসিবে ঘুরে ঘুরে আসে স্বপ্নাহত সেই মুহূর্তগুলি? যতবার পরিত্যাগ করতে চেয়েছেন, ততই যেন তাঁর সর্বাঙ্গ দিয়ে উঠেছে ঘনঘোর বর্ষার মতো সেই মুখ। এখন তাঁর পেশা মুখসুদাবাদের সন্দেহভাজনদের ছবি আঁকা।
এই মন্ত্রণাদাতা আর গুপ্ত শিল্পীর ভূমিকার আগে তিনি ছিলেন স্বাধীন মুসাব্বির। তসবির চিরকাল তাঁর প্রাণ। শৈশব কেটেছিল কিতাবের তসবির দেখে, অনুকরণ করে। ভাগ্যান্বেষণে দিল্লি আসার পথে কত পারস্যদেশীয় মুসাব্বিরের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। কিন্তু বাদশা ঔরঙ্গজ়েব সব হারাম করে দিল। কত শিল্পীর সাধের শহর দিল্লিতে ভাগ্য গড়া হল না তাঁর। রাজস্থানে থাকতেই গুরু বিরিজমোহনের কাছে রাধার ছবি দেখেছিলেন। প্রাক-যৌবনের উত্তাল শরীরে নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল সেই গৌরাঙ্গীর আকর্ণ বিস্তৃত চোখ।
রাগমালার পরতে পরতে ফুলে ওঠা বিচিত্র ভঙ্গিমা। চতুর্দিকে বৃষ্টিধারা, ঘন সবুজের মাঝে ময়ূর পাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে বিদ্যুৎরেখার সোনালি পাড়ের নিচে রাধা ও কৃষ্ণবেশী মহারাজ বীর সিং। বিরিজমোহন রাজার নির্দেশে কৃষ্ণের মুখে রাজার মুখ বসিয়েছিলেন। আর রাধিকার মুখে রাজার প্রেমিকা কাঞ্চনের মুখ। রাজার প্রধানা রানি সুহাগ বিরিজমোহন আর কাঞ্চনের শির কূপের অতলে ছুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে হল কী? আহসানকে পালিয়ে আসতে হল। কিন্তু সেই ছবি তো নষ্ট হল না! কোথায় হারিয়ে গেল রাজার গর্বিত রাজপুতানী পত্নীরা! ছবিতে ছবিতে বেঁচে থাকল বাঈজি কাঞ্চন!
[the_ad id=”266919″]
বিরিজমোহনের শিক্ষানবিশ শাগরেদরা গুরুর ছবি নকল করে রাখত হুবহু। তেমনই এক ছবি নকল করার সময় রাধার স্থানে বসিয়েছিলেন তাকে। তাকে নিয়ে আঁকা তসবির হাতছাড়া করেননি হাজার মুসিব্বতেও। আশ্চর্য তাঁর ভাগ্য! তাকেই কিনা আবার দেখে ফেলবেন ওই টুটাফাটা ঘাটের ওপারে জলের ভিতর! শুধু একা তাকে নয়! সঙ্গে সেই পণ্ডিতকেও! দু’জনকে একসঙ্গে না দেখলে পণ্ডিতের কথা স্মরণেই আসত না হয়তো কখনও।
না! এবারে ফিরবেন তিনি। শুধু একটাই কাজ বাকি। যার আমানত তাকে দিয়ে স্মৃতিমুক্ত হওয়া। এই ক’দিনে মালিহাটিতে তর্কের গূঢ় মারপ্যাঁচের মাঝে কত যে আশ্চর্য বয়েত শুনেছেন! রাধার অভিসার, শৃঙ্গারের আকুলতা যেন ভক্তের ভগবানের কাছে পৌঁছবার আকুতি। রাধা মানে যেন এক অনন্ত অপেক্ষা। চিরকালীন বৃন্দাবনে সে এক স্থির বিরহী। এ যেন নমাজের শুদ্ধ ধ্যানের মধ্যে দিয়ে আল্লাহর কাছে পৌঁছবার শুদ্ধতা।
[the_ad id=”270084″]
আহসান খাঁ অস্থির হয়ে ওঠেন। সামনে দোল উৎসব। বেগম মণিকুন্তলার অনুরোধে প্রাসাদে বসন্ত উৎসব পালিত হয়।আরও দুই বেগম থাকলেও এই অল্পবয়সী হিন্দু বেগমের অনুরোধ বা আদেশ অগ্রাহ্য করার সাহস নেই খাঁ সাহেবের। শুষ্ক তৃষ্ণার্ত ভূমিতে যেমন জল মুহূর্তে অন্তর্হিত হয়, আহসান খাঁ-এর বাংলার প্রতি তৃষ্ণা তেমনই তীব্র ও সর্বগ্রাসী।
One Response
সাবলীল সুন্দর, ভালো লাগছে