Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

আবার রাশিয়া দেখলাম: শেষ পর্ব: শংকর ঘোষ

বাংলালাইভ

জুন ১৫, ২০২২

Erstwhile USSR map
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

শতবর্ষে পা দিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শংকর ঘোষ। বাংলা তথা ভারতীয় সাংবাদিকতার আধুনিক যুগের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। তাঁর লেখায় কোনওদিনই কোনও গ্ল্যামারের ঝলকানি বা রাজনৈতিক উস্কানিমূলক মন্তব্য থাকত না। থাকত এক শান্ত সৌন্দর্য, ধৈর্যবান পর্যবেক্ষণ আর ভারসাম্যময় বিশ্লেষণ। সব মিলিয়ে অর্ধ-শতাব্দী ব্যাপী কর্মজীবন নিয়ে তিনি যেন সাংবাদিকতার এক খোলা পাঠ্যপুস্তক। তাঁকে বাংলা সাংবাদিকতার শিক্ষক বললে এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। ১৯৪৫ সালে তাঁর সাংবাদিকতায় যোগদান। তারপর নানাভাবে তা প্রবাহিত থেকেছে গত শতাব্দীর একেবারে শেষ পর্যন্ত। সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করেছেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’, ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় সব সংবাদপত্রে। নতুন পথ দেখিয়েছেন ‘ওভারল্যান্ড’ সম্পাদনা করতে এসে। স্পষ্ট, অকম্পিত বাচন বরাবর তাঁর পছন্দ। নিজের কলমেও এর প্রকাশ অবিচল থেকেছে। এর জন্য বহু উঁচু পদ ও নানা সুযোগসুবিধা হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু বদলাননি শংকর ঘোষ। তাঁর বিপুল রচনারাজি পড়লে আজ তাঁকে এক একক ‘ক্রুসেডার’ মনে হয়। যেন সময়-পথের একলা অভিযাত্রী। এক নির্ভীক মেধাবী বাঙালি, এক সত্যদ্রষ্টা বিশ্বজনীন ভারতীয়ের ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে।

যে নিবন্ধ বাংলালাইভ পুনঃপ্রকাশ করতে চলেছে, তার প্রথম প্রকাশকাল ছিল ডিসেম্বর ১৯৭৩। এটি তাঁর দ্বিতীয় সোভিয়েত সফর। প্রথমবার গিয়েছিলেন ১৯৫৫ সালে। তখন ভারতে নেহরু শাসনের স্বর্ণযুগ। আর শংকর ঘোষ আনন্দবাজার পত্রিকা ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিনিধি হিসাবে দিল্লিতে। নেহরুর সঙ্গে বান্দুং সম্মেলন রিপোর্ট করে সবে কলকাতায় ফিরে আনন্দবাজার দফতরে অশোক সরকারের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। অশোকবাবু জানালেন, নেহরু সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যাচ্ছেন, শংকরকে যেতে হবে ওঁর সঙ্গে। 

সেই পাঁচের দশকে, স্তালিনের মৃত্যুর পর নেহরুই প্রথম আন্তর্জাতিক নেতা, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছিলেন এবং যুদ্ধ ও শান্তি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। সেটা ক্রুশ্চেভ ও বুলগানিনের যৌথ নেতৃত্বের আমল। সোভিয়েত সফরের ওপরে প্রাত্যহিক রিপোর্ট ছাড়াও শংকর ছটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যা প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায়। এর দীর্ঘ ১৮ বছর বাদে, ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ফের তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে যান সরকারি অতিথি হিসাবে। ১৯৭৩ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই লেখায় তাই বারবার ১৯৫৫ সালে দেখা সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা লিখেছেন তিনি, তুল্যমূল্য বিচার করছেন। তাঁর চোখে দেখা দুটি ভিন্ন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিন্ন দুটি চেহারা পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। আর এখানেই রিপোর্টার শংকর ঘোষের কলমের গুণ। তাঁর স্ত্রী ও সুলেখক শ্রীমতী আলপনা ঘোষের বদান্যতা ও প্রশ্রয়ে এই দুষ্প্রাপ্য লেখাদুটি পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। তাঁকে বাংলালাইভের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা। 

বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনায় এশিয়ার যৌথ নিরাপত্তা পরিকল্পনার প্রসঙ্গ উঠেছিল। পরিকল্পনাটি আসলে কী তা তাঁরা বলতে পারলেন না, কেননা ব্রেঝনেভ স্বয়ং এখনও এই পরিকল্পনার খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করেননি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ব্রেঝনেভের পরিকল্পনা যদি এশিয়ার দেশগুলির কাছে গ্রাহ্য হয় তাহলে তাঁরাই স্থির করবেন এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার চূড়ান্ত রূপ কী হবে। ভারত সরকার যে এই পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি, তা সোভিয়েট বিশেষজ্ঞদের অজানা থাকার কথা নয়। হয়তো সেজন্যই তাঁরা বললেন, সোভিয়েট ইউনিয়ন এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোনো দেশের উপর চাপিয়ে দিতে চায় না। সোভিয়েট ইউনিয়নের ইচ্ছা, এই নিরাপত্তা ব্যবস্থায় চীনও অংশীদার হোক; ব্রেঝনেভ নিজেই বলেছেন, চীন ও সোভিয়েট ইউনিয়ন সমেত এশিয়ার সকল দেশের জন্য এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রস্তাব। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, যতদিন সব দেশ সম্মত না হয় ততদিন ব্রেঝনেভ পরিকল্পনা মুলতবী রাখতে হবে।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছিল, চীন ও সোভিয়েট ইউনিয়নের বর্তমান সম্পর্কের জন্য যখন চীনের এই নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন পরিকল্পনার আংশিক রূপায়ণে এই অনুমান কি অসঙ্গত হবে যে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা চীনের বিরুদ্ধে? বিশেষজ্ঞরা বললেন, চীনের এই ভুল ধারণা একদিন দূর হবে। কেননা যৌথ নিরাপত্তা পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য হল চীনকে এশিয়ার জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা। যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার আলোচনা প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের ভারত-সোভিয়েট শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তির কথাও উঠেছিল। এই চুক্তির নবম ধারার নিহিতার্থ নিয়ে এদেশে বিতর্ক ও জল্পনার শেষ এখনও হয়নি। বিতর্কের প্রধান বিষয় হল, চুক্তিকারী দেশ দু’টির একটি আক্রান্ত হলে আর একটি সেই আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সামরিক সাহায্য দেবে কি না। সোভিয়েট বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল, পারস্পরিক আলোচনায় যদি স্থির হয় সামরিক সাহায্যের প্রয়োজন আছে, তাহলে দেবে। আলোচনায় অবশ্য অন্যরকম সাহায্যও স্থির হতে পারে, যেমন রাষ্ট্রপুঞ্জে দুই দেশের যৌথ প্রচেষ্টা বা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বমত সংগঠনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান। 

প্রশ্ন করেছিলাম, ভারত-সোভিয়েট চুক্তিতে যখন সামরিক সাহায্যের বিধান রয়েছে তখন তার সঙ্গে মার্কিন নেতৃত্বে গঠিত আঞ্চলিক সামরিক জোটগুলির তফাৎ কোথায়। তাঁরা উত্তর দিলেন, সামরিক জোটগুলি সংগঠিত হয়েছিল একটা কিছুর, সোজা কথায়, কমিউনিজ়মের বিরুদ্ধে। ভারত-সোভিয়েট চুক্তি বা এশিয়ার যৌথ নিরাপত্তা পরিকল্পনা কারও বিরুদ্ধে নয়। তাদের উদ্দেশ্য, চুক্তিবদ্ধ দেশগুলির বর্তমান সীমান্ত রক্ষা করা। এশিয়ার আভ্যন্তরিক বিরোধ প্রধানতঃ বিভিন্ন দেশের সীমানা নিয়ে। ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে সীমান্ত বিরোধ অনেক বেশি তীব্র ছিল এবং কিছুদিন পূর্বেও কেউ আশা করতে পারেননি যে এই বিরোধগুলির শান্তিপূর্ণ মীমাংসা এত শীঘ্র সম্ভব হবে। ইউরোপের অতি জটিল সীমান্ত বিরোধগুলির নিষ্পত্তি যদি আলোচনার মধ্য দিয়ে সম্ভব হয় তাহলে এশিয়ায় বিরোধগুলি অনুরূপভাবে না মেটার কোন কারণ নেই। 

Soviet Soldiers
সোভিয়েত সেনা

এই সব দীর্ঘ আলোচনার সময় লক্ষ্য করলাম, অস্বস্তিকর প্রশ্নের জবাব দিতে সোভিয়েট বিশেষজ্ঞরা আর পশ্চাৎপদ নয়। হয়তো প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাঁদের ব্যক্তিগত অভিমত ও সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি বা সোভিয়েট সরকারের অভিমতে কোনো তফাৎ নেই। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সোভিয়েটবিরোধী প্রশ্নেরও কোনও অসহিষ্ণুতা প্রকাশ না করে জবাব দেওয়া অভিনব। আগের বারে তা দেখিনি, সেবার অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতূহল নীরবতার বলি হয়েছিল। সোলঝেনিৎসিন, সাবারভ, বিক্ষুব্ধ লেখকদের সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরও এবার পেয়েছি। তাঁরা তাঁদের বক্তব্য রেখেছেন— সোলঝেনিৎসিন সম্পর্কে বিশদভাবে, অন্যদের বিষয়ে সংক্ষেপে। সে-বক্তব্যের যুক্তিযুক্ততা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে, কিন্তু এই বিষয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া সোভিয়েট ইউনিয়নের দায়িত্বশীল নাগরিকের পক্ষে কম কথা নয়। কারও সঙ্গে আলাপের সুযোগ চেয়েছিলাম। উত্তরে শুনলাম, সোলঝেনিৎসিন ছাড়া অন্য যেসব তথাকথিত বিক্ষুব্ধ লেখকদের কথা পশ্চিমী পত্রপত্রিকায় বেরোচ্ছে, তাঁদের কেউই সোভিয়েট ইউনিয়নে লেখক হিসাবে পরিচিত নন। আর সোলঝেনিৎসিনের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। কিন্তু সোলঝেনিৎসিন সম্পর্কিত আলোচনায় অংশ নিতে কেউ দ্বিধা বোধ করেননি।

সোলঝেনিৎসিন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল তুর্কমেনিয়া লেখক সংঘের সাধারণ সম্পাদক ও সোভিয়েট ইউনিয়ন লেখক সংঘের অন্যতম সম্পাদক, রহিম এসানভের সঙ্গে। এসানভ বললেন, নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলেই কেউ মহৎ লেখক হয়ে যান না। সোভিয়েত ইউনিয়নে সোলঝেনিৎসিনের চেয়ে বড় লেখক অনেকে আছেন, কিন্তু তাঁদের উপেক্ষা করে সোলঝেনিৎসিনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে কেবল তাঁর লেখার ‘রাজনৈতিক তাৎপর্য’-এর জন্যে। একমাত্র সুইডিশ একাডেমিই স্থির করবে যে জগতের শ্রেষ্ঠ লেখক, এ-ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক। প্রকৃত গণতান্ত্রিক উপায়ে স্থির করা হয় লেনিন শান্তি পুরস্কার কে পাবেন। এই নির্বাচনের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিটি আছে। ভারতও সে কমিটির সদস্য। বললাম, শোলোকভও তো নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এসানভ উত্তর দিলেন, শোলোকভ তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, কেবল নোবেল পুরস্কার নয়, তিনি নিজেও নোবেল পুরস্কারকে লেখক হিসাবে তাঁর সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি বলে মানেন না। পাস্তেরনাকের কথা উঠল। এসানভ বললেন, সোভিয়েট ইউনিয়নে পাস্তেরনাক মহৎ কবি হিসাবে স্বীকৃত; পশ্চিমী চিরায়ত সাহিত্যের অনুবাদক হিসাবেও তাঁর বিপুল খ্যাতি। সোভিয়েট ইউনিয়ন পাস্তেরনাক ও সোলঝেনিৎসিনকে সমগোত্রীয় লেখক মনে করে না। পাস্তেরনাকের বই এখনও সোভিয়েট ইউনিয়নে বৃহৎ সংস্করণে ছাপা হচ্ছে। 

Worker and Supervisor Moscow
মস্কোয় কারখানার কর্মী আর সুপারভাইজার

সোলঝেনিৎসিনের বই যখন বিদেশে ছাপা হয়ে সোভিয়েট ইউনিয়নে চোরাচালান হচ্ছে, তখন তাঁর বই সোভিয়েট ইউনিয়নে ছাপলে ক্ষতি কী, এ-প্রশ্নও করেছিলাম। এসানভ বললেন, সোভিয়েট ইউনিয়নে সব বইয়ের প্রকাশক সোভিয়েট সরকার। লেখক সংঘও সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী। সুতরাং সোভিয়েট-বিরোধী কোন লেখা ছাপার জন্য লেখক সংঘ সোভিয়েট সরকারের কাছে সুপারিশ করতে পারেন না। দেশের শাসনব্যবস্থায় কোনো গলদ নেই, তা নয়। সোভিয়েট লেখকরা এইসব গলদ সম্পর্কে সচেতন। সোভিয়েট ইউনিয়নের খ্যাতনামা লেখকরা এ সম্পর্কে লিখছেন। কিন্তু সোলঝেনিৎসিন একদেশদর্শী। তিনি কেবল অন্ধকার দিকটিই দেখান, উজ্জ্বল দিকটি নয় এবং সেজন্যই বুর্জোয়া গণতন্ত্রে তাঁর এত কদর। এসানভ বললেন, সোলঝেনিৎসিনের বই সোভিয়েট ইউনিয়নে ছাপা না হলেও তাঁর লেখক সংঘের সদস্য থাকার কোনও বাধা ছিল না। সদস্য থাকলে তিনি ভাতা-সহ অনেক সুবিধা পেতেন। কিন্তু তিনি সদস্যপদে ইস্তফা দিয়েছেন, লেখক সংঘের সদস্য কার্যত ফেরত পাঠিয়েছেন।

একজন বিদেশী রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেও সোলঝেনিৎসিনের বিষয়টি আলোচনার সুযোগ হয়েছিল। তিনি বললেন, সোলঝেনিৎসিন বা সাকারভ কী উদ্দেশ্য পশ্চিমী সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের কাছে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তা তিনি বলতে পারেন না। তবে তাঁরা যে বিবৃতি দিতে পেরেছিলেন ও এখনও পারছেন সেইটাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ, যে সোভিয়েট ইউনিয়নে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের উপর সরকারি খবরদারি কিছু শিথিল হয়েছে। তিনি বললেন, স্টালিনের আমলে সমালোচনার কণ্ঠরোধ করা হত সমালোচকদের খতম করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে খতমের বদলে সমালোচকদের পাঠানো হত সাইবেরিয়ার বন্দিশিবিরে। তৃতীয় পর্যায়ে সমালোচকদের ব্যক্তিস্বাধীনতার হস্তক্ষেপ বন্ধ হল কিন্তু তাঁরা একঘরে রইলেন। চতুর্থ পর্যায় তাঁরা একঘরেও রইলেন না, তাঁদের শুধু উপেক্ষা করা হত। এই পর্যায় শেষ হয়ে পঞ্চম পর্যায়ের সূচনায় সোলঝেনিৎসিন-সাকারভ বিতর্কের সূত্রপাত। পশ্চিমী দেশগুলিতে এই বিতর্ককে কেন্দ্র করে যে শোরগোল শুরু হয়েছে তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সোভিয়েট ইউনিয়ন তার উদারনীতির রাশ টেনেছে। সোভিয়েট ইউনিয়নের পত্রপত্রিকায় সরকার ও আমলাতন্ত্রের সমালোচনামূলক কিছু কিছু সংবাদ ও অভিমত প্রকাশিত হতে শুরু হয়েছিল, কিন্তু এখন তা বন্ধ হয়েছে। এই ধারাটি অব্যাহত থাকলে হয়ত একদিন আমলাতন্ত্রের বা সরকারের গাফিলতির প্রকাশ্য সমালোচনায় কোনো বাধা থাকত না। অবশ্য সোভিয়েট ইউনিয়নে সোভিয়েট সমাজতন্ত্রের বিরোধী কোন কথা কখনও বরদাস্ত করা হবে মনে হয় না। 

Soviet Union
আজকের সোভিয়েট জীবনের অনেক কিছুই আঠার বছর আগে অচিন্তনীয় ছিল

সরকারি ক্ষেত্রে উদারনীতি সাধারণ মানুষেও সংক্রমিত হয়েছে। তাঁরাও সোভিয়েট ইউনিয়নের সব কিছু ভাল একথা আর বলেন না; অনেক দোষত্রুটি সম্বন্ধে তাঁরা সজাগ। আর্মেনিয়ার প্রধান সংবাদপত্রের সম্পাদক দুঃখ করলেন যে কোনো কোনো লাভজনক যৌথ খামারে তার সমবায় সমিতির সভাপতির মাসিক বেতন ৬০০ রুবল (প্রায় ৬,০০০ টাকা) নির্দিষ্ট করা হয়েছে আর সাধারণ শ্রমিকের বেতন হয়েছে ২৫০ রুবল; অথচ দু’জনে একই কাজ করেন। এই বৈষম্য দূর করার জন্য তাঁর কাগজ চেষ্টা করছে। তাঁর পত্রিকা আরও একটি সমস্যা নিরাকরণের জন্য চেষ্টা করছে; সেটি কর্মবিমুখতা। পঁচিশ কোটি লোকের দেশ সোভিয়েট ইউনিয়নে কর্মখালির চেয়ে উমেদারের সংখ্যা কম। অথচ এখানেই এক শ্রেণীর তরুণ-তরুণী বেকার, অলস জীবনযাপন করছেন। তাঁদের বেশিরভাগই উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেছেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কারিগরি শিক্ষালয়ে প্রবেশের যোগ্যতা দেখাতে পারেননি। তাঁরা সাধারণ শ্রমিকের কাজ এখানেই পেতে পারেন এবং সে-কাজ ছাড়া অন্য কিছুর যোগ্যতাও তাঁদের নেই। কিন্তু তাঁরা চান সাদা পোশাকের শ্রমিকের কাজ, এবং সে-কাজ না পাওয়ায় তাঁরা বেকার থাকা মনস্থ করেছেন। অবশ্য অনির্দিষ্টকাল বেকার থাকা সক্ষম সোভিয়েট নাগরিকের পক্ষে সম্ভব নয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে এইসব বেকার তরুণ-তরুণী সাধারণ শ্রমিকের কাজ নিতে বাধ্য হবেন। আর একজন দুঃখ করলেন, কোন কোন জায়গায় বকশিস স্পৃহা এত বেড়ে গেছে যে রুবলের চেয়ে কম দামের মুদ্রা প্রায় অচল।

সোভিয়েট ইউনিয়নের আভ্যন্তরিক ব্যবস্থায় উদারনীতির আমদানিই হোক বা সোভিয়েট তরুণ সম্প্রদায়ের একাংশের স্বেচ্ছাবেকারত্বই হোক, দুই-ই সোভিয়েট ইউনিয়নের বৈষয়িক স্বাচ্ছল্যের পরিচায়ক। জীবিকা নির্বাহের চিন্তা এখন আর আঠার বছর আগের মতো সর্বগ্রাসী নয়। তুলনায় সোভিয়েট নাগিরকের জীবন এখন অনেক সহজ। তার স্বাচ্ছল্যের প্রমাণ তার বেশভূষায়, আহারে-বিহারে, সিনেমায়-দেখা পশ্চিমী জীবনের অনুকরণে। সোভিয়েট তরুণীরা শীতকালেও মিনি পরেন; লম্বা চুল ও জুলফি প্রায় সর্বজনীন। দোকানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে এবং সেখানে কেবল নিত্য ও নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসই বিক্রয় হয় না, বিলাস সামগ্রীও প্রচুর আছে। তবু চাহিদার তুলনায় দোকানের সংখ্যা কম বিলাস সামগ্রীরও। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য বিলাসদ্রব্যের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে, দোকানের সংখ্যাও বাড়ছে। 

Solzhenitsyn
সোভিয়েত ইউনিয়নে সোলঝেনিৎসিনের চেয়ে বড় লেখক অনেকে আছেন, কিন্তু তাঁদের উপেক্ষা করে সোলঝেনিৎসিনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে

এই স্বাচ্ছল্য যাতে নাগরিক জীবনকে অবাঞ্ছিত পথে চালিত না করে তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মদ্যপান, অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় ভদকার দাম বাড়ানো হয়েছে। মোটরগাড়ির জন্য এখনও দু’বছর অপেক্ষা করতে হয়। যাতে লাইন দীর্ঘতর না হয় তার জন্য মোটরগাড়ির দাম চড়ানো হয়েছে। সোভিয়েট স্টেট ব্যাঙ্ক লটারির প্রবর্তন করেছেন যাতে সমস্ত উদ্বৃত্ত আয় বিলাসপণ্যে ব্যয়িত না হয়। সরকারি আওতায় মস্কোয় রেস খেলা হয়। আজকের সোভিয়েট জীবনের অনেক কিছুই আঠার বছর আগে অচিন্তনীয় ছিল। এই পরিবর্তনের জন্য যেমন স্টালিনোত্তর নেতারা দায়ী, তেমনই দায়ী সোভিয়েট ইউনিয়নের ও সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েট নাগরিকের অর্থনৈতিক উন্নতি। বৈষয়িক স্বাচ্ছল্যের সঙ্গে ব্যক্তি স্বাধীনতার স্পৃহা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত এবং এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই যে আরও দুই দশক পরে সাধারণ সোভিয়েট নাগরিক বর্তমানের স্বাধীনতায় সন্তুষ্ট থাকবেন না। তিনি শুধু বিদেশী ফিল্ম দেখবেন না, বিদেশে যাওয়ার অবাধ স্বাধীনতাও চাইবেন। তখনকার সোভিয়েট নেতাদের কাছে বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধ ইতিহাসের ও ঐতিহাসিক একটি ঘটনা হবে, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁদের থাকবে না। সুতরাং আজকের সাবধানী নীতি তাঁদের কাছে অযৌক্তিক মনে হওয়া অসম্ভব নয়। সোভিয়েট নেতৃত্ব যদি হঠাৎ দিক পরিবর্তন না করেন, তাহলে সোভিয়েট ইউনিয়নের যেসব বিধিনিষেধ আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয় তার অনেকটাই সম্ভবত আগামী দিনে দূর হয়ে যাবে।

 

*বানান অপরিবর্তিত
*ছবি সৌজন্য: Istock, BBC, Pinterest, Wikipedia

Banglalive.com Logo

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Picture of বাংলালাইভ

বাংলালাইভ

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।
Picture of বাংলালাইভ

বাংলালাইভ

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com