Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ম্যান ইটার্স অফ সাভো থেকে প্যালেস্তাইন ক্যাম্পেন

Eli Cohen
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close
(Eli Cohen)

এলি কোহেনের কাহিনি আদতে ইজরায়েলের কাহিনি।

১৯২৪ সালের শেষে আলেকজান্দ্রিয়াতে তাঁর জন্মের সময় ‘প্রোমিজড ল্যান্ডে’ ইজরায়েল রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন চূড়ান্ত আকার নিতে চলেছে, যা সিকি দশক পরে রূপায়িত হয়। অর্থ্যাৎ তাঁর কিশোর ও যৌবনের সিকি দশক, কোহেন এই ইহুদি রাষ্ট্র গড়ার আন্দোলনের মধ্যে কাটিয়েছেন। কিন্তু ইহুদিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গড়ার আধুনিক আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল কোহেনের জন্মের আড়াই দশকেরও বেশি আগে। বিশ্ব ইতিহাসের নাগরদোলায় ঘুরপাক খায় এই আন্দোলন। দেখা যায় জন হেনরি প্যাটারসনের মতো হাজারো নিঃস্বার্থ যোদ্ধার রক্তে রঞ্জিত হয়ে এই আন্দোলনের দিকনির্দেশিকা ঠিক হয়। তাই ইজরায়েল গড়ার ইতিহাসে ইহুদি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে প্যাটারসনের নামও উল্লেখ্য। (Eli Cohen)

আরও পড়ুন: পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এলি কোহেন- ঊনবিংশ শতকের প্রেক্ষাপট

প্যাটারসনের কাজ পরোক্ষভাবে কোহেন পরিবারেরও দিকনির্দেশিকা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯১৪ সালে যখন ইলিয়াহু বেন-শল কোহেন আলেপ্পো থেকে সপরিবার চলে আসার কথা ভাবেন, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্যালেস্তাইনে যাননি। কারণ প্যালেস্তাইন তখনও তুর্কিদের দখলে। তাই তুর্কিদের দখলে থাকা আলেপ্পো ছেড়ে আরেক তুর্কি শাসনাধীন জায়গায় গেলে তাঁর ও তাঁর পরিবারের ভাগ্যের কোনও উন্নতি হবে বলে শলের মনে হয়নি। বরং ব্রিটিশ শাসনাধীন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর তাঁর কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। তাই ব্রিটিশ শাসনাধীন মিশরে যাওয়াই তিনি মনস্থ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৭ সালে প্যাটারসনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জিউস রেজিমেন্ট তুর্কিদের সঙ্গে লড়াই করে প্যালেস্তাইন ও সিনাই উপদ্বীপ মুক্ত করে। ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের ভূখণ্ড, ইহুদি আন্দোলন পেয়ে যায়। এরপরে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হলে কোহেন পরিবার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সে দেশে চলে যান। তাই এক অর্থে প্যাটারসন আখ্যান ছাড়া এলি কোহেন কাহিনিও সম্পূর্ণ নয়। আরম্ভ হল এলি কোহেন দ্বিতীয় পর্ব। (Eli Cohen)

উগাণ্ডা পরিকল্পনা

আর একটু হলেই হয়তো পশ্চিম এশিয়ায় না হয়ে পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়াতে ইজরায়েল রাষ্ট্র তৈরি হত। বিশ্ব ইতিহাসের উথাল-পাথাল উর্মিমালায় চড়ে আদতে ইজরায়েল গড়ার ইতিহাস। ইতিহাস বলে, ইজরায়েল দেশটার বীজ রোপিত হয়েছিল ইউরোপের মাটিতেই। ১৮৯৭ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় আইনজীবী তথা সাংবাদিক থিওডোর হেরজেলের আহ্বানে রাইন নদীর তীরে সুইস শহর বাসেলে প্রথম ইহুদি কংগ্রেস বসে। তাতে যোগ দেওয়ার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ইহুদিরা বাসেলে আসেন। এই কংগ্রেসেই প্যালেস্তাইনে ইহুদিদের বাসভূমি হিসাবে চিহ্নিত করেন হেরজেল। শুধু তাই নয়, একদল ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯০৪ সালে ৪৪ বছর বয়সে তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু না হলে হয়তো ১৯৪৮ এর আগেই ইহুদিরা তাদের পিতৃভূমি পেয়েও যেতেন। (Eli Cohen)

“প্যালেস্তাইন ছাড়াও কেনিয়াতে ইহুদিদের ‘প্রোমিজড ল্যান্ড’ হতে পারে এমন প্রস্তাবও ইংরেজদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। যদিও সেই প্রস্তাব আদতে ধোঁপে টেকেনি।”

কিন্তু ইতিহাসের গতি এত সরলীকৃতও নয়। যেহেতু ইহুদি রাষ্ট্রের জন্মের রাস্তায় ব্রিটেনের অন্যতম মুখ্য ভূমিকা ছিল, তাই অবশাম্ভাবীভাবে তৎকালীন বিশ্বে ব্রিটিশ স্বার্থও সেখানে পর্দার আড়ালে কাজ করেছে। তাই প্যালেস্তাইন ছাড়াও কেনিয়াতে ইহুদিদের ‘প্রোমিজড ল্যান্ড’ হতে পারে এমন প্রস্তাবও ইংরেজদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। যদিও সেই প্রস্তাব আদতে ধোঁপে টেকেনি। কিন্তু এই ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছিল লন্ডনের স্বার্থে। (Eli Cohen)

তাহলে ব্যাপারটা বিশদে বলা যাক। বিংশ শতকের গোড়ায় পূর্ব আফ্রিকায় কেনিয়া ও উগাণ্ডা ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন। কিন্তু লন্ডন শত চেষ্টা করেও সেখানে ইউরোপীয়দের এনে বসবাস করানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করতে পারছিল না। এদিকে সেই কাজ করার জন্য ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আদলে ১৮৮৮ সালে ইমপেরিয়াল ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকা কোম্পানি তৈরি করে ফেলেছে ব্রিটেন। এই সংস্থার তত্ত্বাবধানে ১৮৯৬ সাল থেকে ১৯০১ এই পাঁচ বছরে ভারত মহাসাগর তীরে কেনিয়ার বন্দর নগরী মোম্বাসা থেকে ভিক্টোরিয়া লেকের ধারে কিসুমু পর্যন্ত ১০৬০ কিমি দীর্ঘ মিটার গেজ রেললাইন তৈরি করা হল। কেনিয়ার রেললাইন হলেও এটিকে পরে পড়শি দেশ উগাণ্ডাতেও বাড়ানো হবে বলে নাম দেওয়া হল উগাণ্ডা রেলওয়ে। আশা করা হল এই পাহাড় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এই ট্রেন সফর করতে এবার ইউরোপীয়দের ঢল নামবে। কিন্তু সেভাবে প্রাথমিকভাবে সাড়া মিলল না। উল্টে এত ব্যয়বহুল পরিকাঠামো প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল। (Eli Cohen)

Eli Cohen
আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর

এখানে উগাণ্ডা রেলওয়ে নিয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার। যদিও বলা হয় সড়কপথে মাল পরিবহনের কাজে ক্রিতদাস প্রথা বন্ধ করার জন্য এই রেললাইন পাতা হয়, কিন্তু ঐতিহাসিকরা তা মানতে নারাজ। তাঁদের মতে, দক্ষিণ আফ্রিকায় বোয়র যুদ্ধের শিক্ষা নিয়ে মূলত সেনা চলাচলের জন্য এটা করা। এছাড়া আফ্রিকার অভ্যন্তরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে পা রাখতেও সাহায্য করে লাইনটি। মূলত এই রেললাইন তৈরির রসদ ভারত থেকে আনার জন্য মোম্বাসার অদূরে কিলিন্দিনি বন্দর গড়ে তোলা হয়। এক কথায় ব্রিটিশ পূর্ব আফ্রিকার ব্রিটিশ শাসনের ধমনী ছিল এই রেলপথ। (Eli Cohen)

“তবে এই উগাণ্ডা রেলওয়ে কিন্তু ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে জড়িত। এই রেলপথ নির্মাণের জন্য যে হাজার তিরিশেক ভারতীয় শ্রমিক জড়িত ছিলেন, তাঁরাই কেনিয়াতে ভারতীয় বংশোদভূতদের প্রথম প্রজন্ম।”

তবে এই উগাণ্ডা রেলওয়ে কিন্তু ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে জড়িত। এই রেলপথ নির্মাণের জন্য যে হাজার তিরিশেক ভারতীয় শ্রমিক জড়িত ছিলেন, তাঁরাই কেনিয়াতে ভারতীয় বংশোদভূতদের প্রথম প্রজন্ম। এ বাদে ১৮৮৮ সালে যে স্কটিশ শিল্পপতি স্যার উইলিয়াম ম্যাককিনন উগাণ্ডা রেলপথ নির্মাণের জন্য ইমপেরিয়াল ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকা কোম্পানি তৈরি করেন, তাঁর কলকাতায় জাহাজ ব্যবসা ছিল। অফিস ছিল কাশীপুরে। ১৮৫৬ সালে তাঁর গড়া ক্যালকাটা  অ্যান্ড বার্মা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি কলকাতা আর রেঙ্গুনের মধ্যে জলপথে ডাক পরিষেবার কাজ করত। তবে ক্রমে এই জাহাজ সংস্থা ব্যবসা বাড়ায়। ১৮৯৩ সালে লন্ডনে ম্যাককিনন মারা গেলেও তাঁর সংস্থার জয়যাত্রা থেমে থাকেনি। ১৯২২ সাল নাগাদ এই সংস্থা তার ১৬০টা জাহাজে বিশ্বের নানা প্রান্তে ব্যবসা করত। ২০০৬ সালে সংস্থাটিকে মার্কিন সংস্থা ডি পি ওয়ার্ল্ড কিনে নেয়। (Eli Cohen)

ম্যান ইটার্স অফ সাভো ও জন হেনরি প্যাটারসন

তবে আর পাঁচটা রেলপথের মতো এই উগাণ্ডা রেল কিন্তু ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যায়নি। সম্পূর্ণ এক ভিন্ন কারণে তা উল্লেখযোগ্য হয়ে থেকে গেছে। কেনিয়ার সাভো নদীর উপরে রেলপথ তৈরির সময় এক রোমহর্ষক ঘটনা ঘটে। ১৮৯৮ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর-এই দশ মাসে দুটো কেশরহীন সিংহের আক্রমণে রেলপথ নির্মাণে কর্মরত শতাধিক শ্রমিক প্রাণ হারান। রাতে তাঁবুতে ঘুমন্ত শ্রমিকদের নিঃশব্দে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সিংহদুটো। দিনের আলোয় মিলছিল তাদের আধ খাওয়া দেহাংশ। শ্রমিকরা আতঙ্কে কাজই করতে চাইছিল না। নির্মাণকাজ প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। (Eli Cohen)

“অন্ধকারে প্যাটারসন শুধু শ্বাপদের ঝোপের মধ্যে চলার আওয়াজ পাচ্ছিলেন। বুঝতে পারছিলেন জানোয়ারটা তাঁকে আক্রমণের সুযোগ খুঁজছে। এইরকম করে রুদ্ধশ্বাস দু’ঘণ্টা গেল।”

এদিকে ১৮৯৮ সালের মার্চ মাসেই সাভো নদীর উপর এই রেলপথ তৈরির কাজ দেখভাল করতে পাঠানো হল ব্রিটিশ সেনার বছর তিরিশেকের ক্যাপ্টেন জন হেনরি প্যাটারসনকে। ভাগ্যের পরিহাসে প্যাটারসনের সাভোতে আসা আর সিংহের আক্রমণ শুরু হওয়া কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে শুরু হল। একে শ্রমিকরা আতঙ্কে সিংহদ্বয়কে শয়তানেরই আরেক রূপ ভাবা শুরু করেছিল, তারপর তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে ভাবনা এল যে প্যাটারসনই আদতে অপয়া। এই সাহেবের আসার জন্য সিংহের ক্রোধের মুখে পড়েছে তারা। দল বেঁধে এসে তারা জানিয়ে দিল কাম বন্ধ। (Eli Cohen)

যে কাজের জন্য এই জঙ্গলে আসা সেই কাজই শিকেয় উঠছে দেখে প্যাটারসন নড়েচড়ে বসলেন। উপরন্তু তাঁর উপর আনা অপবাদও ঘোচানো দরকার। কেনিয়া আসার আগে প্যাটারসন ছিলেন ভারতে। বাঘ শিকারী হিসাবে বেশ নামও ছিল। তাই নিজের পয়েন্ট ৩০৩ রাইফেল আর দোনলা বোরগান নিয়ে সিংহ শিকারে নেমে পড়লেন। বহু চেষ্টার পরে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্যাটারসন শ্বাপদদ্বয়কে মারতে পারলেন। (Eli Cohen)

Eli Cohen
আলেপ্পো

নিজের এই শিকার কাহিনি ১৯০৭ সালে প্যাটারসন লেখেন তাঁর বই ‘দ্য ম্যান ইটার্স অফ সাভো’ তে। সিংহদ্বয়ের শিকার প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন, ১৮৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর, ভোরেই প্রথম সিংহের খোঁজ মেলে। সে শ্রমিকের দলের উপর হামলা চালিয়ে একটা খচ্চর মেরে খাচ্ছিল। খবর পেয়ে বন্দুক নিয়ে প্যাটারসন দৌড়ান। সিংহকে নাগালের মধ্যে পেয়ে গুলিও চালান। কিন্ত জখম হয়ে খাওয়া ছেড়ে সিংহ পালায়। গুলিতেও সিংহ মরল না দেখে ওটা যে আদতে শয়তান শ্রমিকদের মধ্যে সে ধারনা আরও বদ্ধমূল হল। (Eli Cohen)

আরও পড়ুন: তিব্বত, টিনটিন অথবা এক প্রেম কাহিনি

তবে প্যাটারসন হাল ছাড়লেন না। সকালে খচ্চরটা সবে খেতে শুরু করেছিল সিংহটা। রাতে যে সেটা ফের খেতে আসবে তা তাঁর শিকারী মন বুঝতে পারল। কিন্তু যেখানে খচ্চরটার আধখাওয়া দেহ পড়ে আছে, তার ধারে কাছে কোনও গাছ নেই। তাই মৃতদেহের ফুট দশেক দূরে মাটিতে চারটে বাঁশের পায়া পুঁতে বারো ফুট উঁচু এক মাচান বানানো হল। দিনের শেষে বন্দুক নিয়ে সেই মাচানে চড়ে বসলেন প্যাটারসন। (Eli Cohen)

রাত গভীর হলে সিংহ ঠিকই এল কিন্তু যেই মাত্র সে প্যাটারসনের উপস্থিতি টের পেল, তার লক্ষ্য মাচানে হামলা হয়ে দাঁড়াল। নিকষ কালো অন্ধকারে শ্বাপদ মাচান ঘিরে ঘুরতে শুরু করল। অন্ধকারে প্যাটারসন শুধু শ্বাপদের ঝোপের মধ্যে চলার আওয়াজ পাচ্ছিলেন। বুঝতে পারছিলেন জানোয়ারটা তাঁকে আক্রমণের সুযোগ খুঁজছে। এইরকম করে রুদ্ধশ্বাস দু’ঘণ্টা গেল। একসময় প্যাটারসন বুঝলেন মাচানে হামলা করার জন্য শ্বাপদটা সন্তর্পণে এগোচ্ছে। তার অবস্থান বুঝে প্যাটারসন ট্রিগার টিপলেন। বন্দুকের গর্জন ছাপিয়ে সিংহের হুংকার কানে এল। এবারও সে লুকোল ঝোপে। তারপরও শব্দ লক্ষ করে গুলি চালান প্যাটারসন। ধীরে ধীরে সিংহের হুংকার থেমে গেল। পরদিন ভোরে প্যাটারসন সিংহের দেহ দেখেন। সকালের গুলিটা তার পায়ে লেগেছিল। রাতের গুলি মাথা থেকে লেজ অবধি ৯ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বা কেশরহীন সিংহটার হৃদপিণ্ড এফোঁড়ওফর করে দিয়েছে। (Eli Cohen)

Eli Cohen
জন হেনরি প্যাটারসন

প্যাটারসনের রাইফেল দ্বিতীয় সিংহকে চিরতরে স্তব্ধ করল এর দিন কুড়ি বাদে-২৯শে ডিসেম্বর ভোরে। ঘটনার সূত্রপাত হয় ২৭ তারিখ রাতে যখন তাঁরই তাঁবুর সামনের গাছে শ্রমিকদের আক্রমন করে দ্বিতীয় কেশরহীন সিংহ। অন্ধকারে গুলি চালিয়ে সে যাত্রা শ্রমিকদের বাঁচান প্যাটারসন। ফের ওখানে সিংহ হামলা করতে পারে ধরে নিয়ে ২৮ তারিখে ফের সেই গাছে মাচান বাঁধেন প্যাটারসন। রাত ৩টে নাগাদ সিংহ ঠিকই আসে ও হামলাও করে। তবে তাঁর গুলিতে সিংহ মারাত্মক জখম হয়। ভোরের আলো ফুটলে রক্তের দাগ দেখে সদলবলে প্যাটারসন তাকে খুঁজতে বেরোন। (Eli Cohen)

‘”উইথ দ্য জুডিয়ান্স ইন দ্য প্যালেস্টাইন ক্যাম্পেন’-এ প্যাটারসন স্পষ্ট লিখেছেন ব্রিটিশ বাহিনীতে থেকে কোনও জাতি নিজেদের ‘প্রোমিইজড ল্যান্ড’এর জন্য লড়ছে, এটা ঐতিহাসিক ঘটনা।”

সিকি মাইল দূরে এক ঝোপের মধ্যে জখমি শ্বাপদকে খুঁজেও পান। প্যাটারসন ফের গুলি চালালে জানোয়ারটা লাফ দিয়ে তাঁকে আক্রমণ করে। গাছে উঠে প্যাটারসন কোনওক্রমে প্রাণে বাঁচেন। এরপর সহকারির কাছ থেকে রাইফেল নিয়ে ফের গুলি করেন। সিংহ এবার পড়ে যায়। মারা গিয়েছে ভেবে কাছে যেতেই ফের সিংহটা হামলার চেষ্টা করে। তবে এবার প্যটারসন প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর নিশানা অব্যর্থ লক্ষ্যে লাগে। প্যাটারসনের থেকে হাত পাঁচেক দূরে ছ’ছটা গুলি খাওয়া, মাথা থেকে লেজ অবধি ৯ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা কেশরহীন সিংহের নিথর দেহ পড়ে যায়। সাভোর মানুষখেকো ত্রাস শেষ হয়। (Eli Cohen)

হলিউডও তিন তিনটে ছবি করেছে এই টান টান উত্তেজনাকর কাহিনিকে কেন্দ্র করে। যদিও ঠিকঠাক করে বললে ১৯৫৩ সালের বাওয়ানা ডেভিল বা ১৯৫৯ সালের ছবি কিলার্স অফ কিলিমাঞ্জারো মূল কাহিনিকে কেন্দ্র করে আরও পল্লবিত হয়েছে। একমাত্র ১৯৯৬ সালে ব্রিটিশ জ্যামাইকান পরিচালক স্টিফেন হফকিন্সের ‘দ্য ঘোস্ট অ্যান্ড দ্য ডার্কনেস’ প্যাটারসনের মূল কাহিনি মোটামুটিভাবে অনুসরণ করেছে। হলিউড সুপারস্টার ভ্যাল কিলমার প্যাটারসনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। (Eli Cohen)

প্যাটারসনের নেতৃত্বে ইহুদি বাহিনীর প্যালেস্তাইন যুদ্ধ

এই প্যাটারসনের সঙ্গে কিন্তু ইহুদি আন্দোলনের ওতপ্রোতভাবে যোগাযোগ ছিল। নিজে ছিলেন প্রোটেস্টান্ট কিন্তু অত্যাচারিত অপমানিত ইহুদিদের পাশে সদাসর্বদা দাঁড়িয়েছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৭ সালের ২৩শে অগস্ট ইহুদি সেনা নিয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে জিউস রেজিমেন্ট গঠন করা হয় যার কমান্ডান্ট হন প্যাটারসন। ১৯২২ সালে লেখা ‘উইথ দ্য জুডিয়ান্স ইন দ্য প্যালেস্টাইন ক্যাম্পেন’-এ প্যাটারসন স্পষ্ট লিখেছেন ব্রিটিশ বাহিনীতে থেকে কোনও জাতি নিজেদের ‘প্রোমিইজড ল্যান্ড’এর জন্য লড়ছে, এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। এই ইহুদি বাহিনী ইংল্যাণ্ডের প্লাইমাউথে প্রশিক্ষণ নিয়ে জর্ডন, প্যালেস্তাইন ও সিনাইতে লড়ে। এই দীর্ঘ যু্দ্ধই প্যালেস্তাইনে অটোমান শাসনের অবসান ঘটায় এবং এশিয়া মাইনরের এই ভূখণ্ডকে মিশরের সঙ্গে ব্রিটেনের শাসনাধীনে নিয়ে আসে। প্যালেস্তাইনের বিজিত অংশেই পরে ইজরায়েল গড়ে ওঠে। সেই অর্থে ইজরায়েল গড়ার পিছনে প্যাটারসনের প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। (Eli Cohen)

“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি অত্যাচারের হাত থেকে ইউরোপীয় ইহুদিদের বাঁচাতে প্যাটারসন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। তবে যে রাষ্ট্রের জন্য তিনি রণাঙ্গনে লড়েছেন তা তিনি দেখে যেতে পারেননি।”

এই ইহুদি বাহিনীর সার্থকতা শুধু যে যুদ্ধ জয়ে ছিল তাই নয়, ছিল আত্মবলিদানেও। সেই কথা স্মরণ করে ‘উইথ দ্য জুডিয়ান্স ইন দ্য প্যালেস্টাইন ক্যাম্পেন’এ প্যাটারসন লিখেছেন, “ইহুদি আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ রুশ ইহুদি সাংবাদিক ভ্লদিমির জাবোতিনস্কি নিজে এই বাহিনীতে সার্জেন্ট হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর তাঁকেই সহায়তা করেন যিনি নিজে চেষ্টা করেন। তাই তিনি মনে প্রাণে চাইতেন হারিয়ে যাওয়া ভূখণ্ড ফিরে পেতে ইহুদি বাহিনী নিজে যুদ্ধ করুক। জাবোতিনস্কি যথার্থ বলেছেন। যদি অলিভ পর্বতের পাদদেশে, প্যালেস্তাইন মিশরের প্রতিটি সামরিক সমাধিস্থলে ইহুদি সেনাদের সমাধি না পাওয়া যেত, তবে আমি নিশ্চিত নই যে ১৯২০-এর প্যারিস শান্তি বৈঠকে প্যালেস্তাইনে ইহুদি রাষ্ট্র গড়ার দাবি বিবেচনা করা হত কী না! আলোচনার টেবিলে ইহুদি আন্দোলনের নেতা ও বিশ্ব ইহুদি কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট রুশ বংশোদ্ভূত চেম ওয়াইজম্যান এত দৃঢ় অবস্থান নিতে পারতেন কী না।” (Eli Cohen)

Eli Cohen
উগাণ্ডা রেলওয়ে

এমনকি নিজের বাহিনীতে ইহুদি সৈন্যের প্রতি যে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মনোভাব ছিল এক শ্রেণীর অভিজাতকূলের মধ্যে তারও সোচ্চার প্রতিবাদ করেন প্যাটারসন। ঐতিহাসিকদের মতে, এই কারণেই হয়তো সামরিক বাহিনীতে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পাননি প্যাটারসন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে যে লেফটানেন্ট কর্নেল পদমর্যাদায় ছিলেন, বিশ্বযুদ্ধে অসাধারণ সাফল্যের পরও ১৯২২ সালে সেনা থেকে অবসর নেওয়ার সময়ও একই পদমর্যাদায় রয়ে গেলেন। (Eli Cohen)

তাতে অবশ্য প্যাটারসনের ইহুদিদের প্রতি সহমর্মিতায় কোনও খামতি হল না। বর্তমান ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর পিতা ও ইহুদি আন্দোলনের তাত্ত্বিক নেতা বেঞ্জনিয়ন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন প্যাটারসন। জেষ্ঠ্য পুত্র যোনাথানের নাম প্যাটারসনের আদলে রাখেন বেঞ্জনিয়ন। যোনাথনের গডফাদারও হন প্যাটারসন। উল্লেখ্য এই যোনাথনের নেতৃত্বেই ১৯৭৬ সালে মোসাদের এক কমাণ্ডো অভিযানে উগাণ্ডার এনটবি বিমানবন্দর থেকে বিমান ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে পণবন্দী যাত্রীদের ও বিমান  মুক্ত করা হয়। অবশ্য এই অভিযানে যোনাথান প্রাণ হারান। (Eli Cohen)

আরও পড়ুন: অন্ধকার সময় বা অ্যার্জের কাহিনি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি অত্যাচারের হাত থেকে ইউরোপীয় ইহুদিদের বাঁচাতে প্যাটারসন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। তবে যে রাষ্ট্রের জন্য তিনি রণাঙ্গনে লড়েছেন তা তিনি দেখে যেতে পারেননি। ১৯৪৭ সালের ১৮জুন ক্যালিফোর্নিয়ার বেল এয়ারে ৭৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন প্যাটারসন। স্ত্রী ফ্রান্সেস হেলেনা গ্রেও, ছয় সপ্তাহের মধ্যে মারা যান। প্যাটারসন দম্পতিকে অনাড়ম্বরভাবে লস এঞ্জেলসে সমাধিস্থ করা হয়। (Eli Cohen)

তবে ইজরায়েল তাঁর এই পরম মিত্র আইরিশ মুক্তিযোদ্ধাকে ভোলেনি। যখন প্যাটারসনের নাতি অ্যালান জানান যে তাঁর ঠাকুরদার শেষ ইচ্ছা ছিল জিউস রেজিমেন্টের অনেক সদস্যের মতো ইজরায়েলের আবিহাহিল সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ হওয়া, তাঁর ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে ২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর প্যাটারসন দম্পতির দেহাবশেষ ফের আবিহাহিলে সমাধিস্থ করা হয়। অনুষ্ঠানে অ্যালেন ও তাঁর পরিবার ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যরা, সেনা প্রধান, ইজরায়েলে ব্রিটিশ ও আইরিশ রাষ্ট্রদূত। প্যাটারসনকে ‘ইজরায়েলী সেনার গডফাদার’ বলেন নেতানিয়াহু। তাঁর সম্মানে ডাক টিকিট প্রকাশিত হয়। (Eli Cohen)

মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ছবি- আন্তর্জাল

তথ্যসূত্র-
(১) জন হেনরি প্যাটারসন-‘দ্য ম্যান ইটার্স অফ সাভো’,
(২) জন হেনরি প্যাটারসন-‘উইথ দ্য জুডিয়ান্স ইন দ্য প্যালেস্টাইন ক্যাম্পেন’
(৩) এনসাইক্লোপেডিকা ব্রিটানিকা

Author kingshuk banerjee

মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে

Picture of কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে
Picture of কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
সপ্তর্ষি রায় বর্ধন
অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

সংস্কৃতি

আহার

অমৃতা ভট্টাচার্য
অমৃতা ভট্টাচার্য
শমিতা হালদার

বিহার

রমেশ দাস
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

নির্মাল্য চ্যাটার্জি

উপন্যাস

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com