পিঞ্জর ভেঙে উড়ে যাবার বাসনা যতই গাঢ় হয়ে থাক, ঘর ছাড়ার পর্বটি ছিল আনন্দ-বিষাদে মেশানো। আমি কলকাতার বাঁধন এড়াতে চাই, বাবা-মাও চান আমি ভালো কাজের সুযোগ না হারাই। কিন্তু যে সন্তান কোনওদিন বাড়ি ছেড়ে থাকেনি, তার না থাকার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়। ট্রেনে করে গেলাম দেরাদুন। ১৯৬৭-র সেই দীর্ঘ ভ্রমণে তুফান এক্সপ্রেসে গিয়েছিলাম। এবার দুন এক্সপ্রেস। আমাকে একা ছাড়া যাবে না তা স্বতঃসিদ্ধ। মা বেড়াতে ভালোবাসেন বেশি। তাঁকে রেখে বাবার যাওয়া চলবে না। সবাই মিলে দেরাদুনের এক হোটেলে গিয়ে উঠলাম।
একদিন সময় ছিল হাতে, ট্যাক্সি করে দেরাদুনের আশপাশ ঘোরা হল। আমাদের হোটেলের ঘরের জানালার পাশে একটা পেয়ারাগাছ ছিল। তার ডালপালা একেবারে হাতের নাগালে। সুপুরির মতো ছোট একটা পেয়ারা ছিঁড়ে (সম্পূর্ণ অকারণে) আমি মাকে দিয়েছিলাম। আমরা সকলেই বুঝতে পারছি বিচ্ছেদ আসন্ন, লাল মেঝের ঐ বাজারের বাড়ির দু’কামরার ফ্ল্যাটে আমি আর ফিরব না। কিন্তু সে কথা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনও আলোচনা হচ্ছে না। মায়ের মৃত্যুর বছরখানেক আগে পর্যন্ত ওই পেয়ারাটা আলমারিতে সযত্নে রাখা ছিল দেখেছি।
মসুরি জাতীয় আকাদেমি এখন অনেকটাই বড়সড় ও ঝকঝকে নতুন। অনেক হস্টেল হয়েছে পাহাড়ের ঢালে। টেনিস কোর্ট, লন। নতুন অডিটোরিয়াম হয়েছে। ক্যাম্পাসটা উটের কুঁজের মতো। পাহাড়ের খাঁজে ছড়ানো বাড়িঘরের চুড়ো হচ্ছে ডায়রেক্টরের অফিস ও বাংলো, লাউঞ্জ ও ডাইনিং হল। ‘গোবিন্দবল্লভ পন্থ হোস্টেল’ যেখানে আমি প্রথম উঠেছিলাম, এবং মেইন বিল্ডিংয়ের অনেকটা ১৯৮১ সালের বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে যায়। পুড়ে গিয়েছিল বহু বই ও পান্ডুলিপির আগার লাইব্রেরিটিও। তখনকার অ্যাকাডেমি দেখতে সাদামাটা পুরনো, কিন্তু আমার চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল। ডাইনিং হলের লাগোয়া যে বড় লাউঞ্জ, তার বারান্দা থেকে হিমালয় দেখা যায়। শীতের আরম্ভ থেকে রোদে ঝকঝক করে ওঠে বানরপুচ্ছ, নন্দাদেবী। তখন পোস্ট অফিসটি ছিল মনকেমনের কালে আমাদের খাম ইনল্যান্ড কেনার, চিঠি পোস্ট করার আর ট্রাংককল বুক করে হাঁ করে অপেক্ষা করার জায়গা। অনেক কিছু চকচকে নতুন হয়ে গেলেও পোস্ট অফিসটির পুরনো চেহারা এখনও ধরা আছে।

প্রথমে অফিসে কিছু কাগজপত্রে সই করা। আমি কয়েকদিন দেরিতে পৌঁছেছিলাম কোনও কারণে, ক্লাস আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। চন্দ্রলেখা বলে ইন্ডিয়ান ইকনমিক সার্ভিসের একটি মেয়েকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সে আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব দেখাবে। অ্যাকাডেমির একটি জিপ বিকেলে দেরাদুন যাবে। সেই জিপে ফিরবেন বাবা মা। দুপুরের খাবারে রাজমা নামক এক দুরূহ আইটেম, আটার রুটি ও মাছের বদলে দুষ্পাচ্য মুরগির ঝোল খেয়ে মা হতোৎসাহ। জিপে তুলতে গিয়ে দেখি, মায়ের চোখে জল। বললেন, শোন এই খেয়ে এত কষ্ট করে তোকে শীতের মধ্যে পড়ে থাকতে হবে না। আমাদের সঙ্গে ফিরে চল, কলকাতায় একটা কিছু জুটে যাবে। জিপটা দাঁড়িয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে। তার ভিতরে দেরাদুনগামী আরও যাত্রী।
এই সময় কি এতবড় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? তাছাড়া আমি তো ফিরতে চাই না, পৃথিবীর মুখ আমি দেখিয়াছি। হিমালয়ের বঙ্কিম রেখা সামনে, ঝকঝকে নীল আকাশ দুপুরের, বড় বড় পাহাড়ি ঝাউয়ের গাছ থেকে ঝাউফল খসে নীচে পড়ছে। চারিদিকে আনন্দের হাট বসে গেছে, নানা রাজ্যের ছেলেমেয়ে রেশমের শাড়ি চুড়িদার কুর্তা আর টাই ব্লেজারে সেজে লেকচার থেকে বেরচ্ছে, ডাইনিং হলে ঢুকছে। এখন সবাই অচেনা, তারপর অনেক বন্ধু হয়ে যাবে। এই দুনিয়া ছেড়ে ওই হাজরা রোডের দু’কামরার ফ্ল্যাটে কে ফিরবে? তাও কলকাতায় একটা কিছু জুটিয়ে নেবার ভরসায়। মায়ের নাক লাল, চোখের কোলে জল, দেখে আমারও চোখে জল এল। তবু মাথা নেড়ে বললাম, তোমরা যাও, সবাই অপেক্ষা করছে। আমি লেকচার হলে যাচ্ছি।
কলকাতা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ই নিঃশব্দে বাংলাভাষা ও লেখার সঙ্গে আমার বাঁধন ছিন্ন হয়ে গেল। প্রথম অভিঘাতটা এত প্রবল ছিল, যে আমার অসাড় মন জানতেই পারল না। রোদ ঝলমলে দিনটা যেন বাবা-মা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে উধাও হয়ে গেল। বৃষ্টি মেঘ কুয়াশার মধ্যে কেবলি হারিয়ে যেতে থাকল পাহাড় আর আশপাশের বাড়ি গুলি। আমার সঙ্গে বাংলা কে বলবে এখানে, আর কখন? লাইব্রেরি ছিল আমার বিরাট সান্ত্বনার জায়গা। লাউঞ্জের সামনের দিকে ধাপে ধাপে নীচে নেমে গেছে কার্পেট মোড়া সিঁড়ি। কাচের দেওয়ালের পিছন থেকে ঝাপসা দেখা যায় দূরের পাহাড়, ঝাউয়ের সারি, নীচের কটেজের মত বাড়িগুলি। কীভাবে বই সাজানো আছে বুঝে নেওয়ার পর সব খোঁজা সহজ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ থেকে সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সবাই আছেন। ঘুরে ফিরেই আমি এসে দাঁড়াই বাংলা বইয়ের তাকগুলির সামনে, আর মনে মনে ভাবি, একদিন এখানে থাকবে আমারও বই!
আর কী কাজে ঠাসা দিনগুলো! সকালে ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই আগমচাঁদের রেখে যাওয়া ড্রাম সদৃশ পাত্রের চা আর দুটো বিস্কুট খেয়ে পিটির লাইনে। স্নান? কাঠের পিপের মত এক গিজারে জল গরম হচ্ছে বটে তবে স্নানের কথা ভাবলে হাত পা পেটের ভিতর ঢুকে যায়। সকালের ব্যায়ামের পর সোজা ব্রেকফাস্ট। সেখানে দুধ পরিজ অমলেট ব্রেড খেয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ক্লাসে। কোর্স ডায়রেক্টর আর রামকৃষ্ণন। আইএএস ও বিদেশের এমবিএ। সময়ানুবর্তিতার পরাকাষ্ঠা। ওঁর ক্লাসে ঢুকতে দুমিনিটের বেশি দেরি হলে দরজা বন্ধ। পোডিয়াম থেকে বলে দেবেন ‘ইউ আর টু আর্লি ফর দ্য নেক্সট ক্লাস’। তারপর লাঞ্চ আওয়ারের পর নিজের চিঠির লকারের ড্রয়ারে পাওয়া যাবে ‘মেমো’। কারণ দর্শাও কেন তুমি দেরিতে এসেছিলে। ক্লাসের পর রোজ কিছু না কিছু থাকে। ডিসকাশন গ্রুপ। কোনও স্পেশাল গেস্ট লেকচার। পরের দিনের ক্লাসের জন্য পড়া। লাঞ্চের অনেক আগে হজম হয়ে যায় ব্রেকফাস্ট।

সন্ধে বেলা অনেকেই মেইন গেটের কাছে হ্যারি’স (আসলে হরি) ক্যান্টিনে স্টাফড পরাঠা কিংবা পকোড়া খেতে যায় কফির সঙ্গে।সেসব খুব উপাদেয় খাবার কারণ খাঁটি ঘি দিয়ে পরাঠা বানিয়ে পরিবেশন করেন হরি নিজে, ওঁর স্ত্রীর হাত দেখা যায় পর্দার পিছন থেকে। আমাকে ভেবে চিন্তে খেতে হয়। আকাদেমির মেস খরচ খুব বেশি। ট্রেনিংয়ের সময় পাওয়া টাকায় কুলোয় না। বাবা টাকা পাঠান মাসের শেষে মানি অর্ডারে। যে সব মুর্শিদাবাদি সিল্ক আর তাঁতের শাড়ি নিয়ে আমি উপস্থিত হয়েছি আমার পিচবোর্ডে তৈরি গোলাপি ছিটকিনি দেওয়া সুটকেসে, সেসব এই আবহাওয়াতে অচল। সোয়েটার মাফলার ইত্যাদি কিনতে হয়েছে লাইব্রেরি পয়েন্টে গিয়ে। এই সব উথালপাথালের মধ্যে আমার হাতের আঙুল গলে কখন যেন টুক করে খসে গেছে বাংলা কবিতা।
কলকাতা থেকে কবে চিঠি আসবে, তার পথ চেয়ে বসে থাকি। মা নিজে লেখেন না, হাতের লেখা খারাপ। মায়ের জবানীতে বাবা লেখেন, সুন্দর হাতের লেখায়। কিন্তু তাতে থাকে মন খারাপ করানো মৃদু তিরস্কার। আমি কেন আইএএস পাইনি, তাতে আমাদের সামাজিক মর্যাদাহানি হয়েছে, মা কোথাও মুখ দেখাতে পারছেন না ইত্যাদি। যাঁর হাতের লেখা তাঁর মন আমি খুব ভালো করেই জানি। এমন আঘাত তিনি দিতেই পারেন না। হাতের লেখা আর বয়ানের এই অমিল প্রতিটি বাড়ির চিঠিকে আমার কাছে করে তোলে এক যন্ত্রণার চাবুক।বুঝতে পারি, কলকাতার বাড়ির বাঁধন ছেড়ে চলে এসেছি বলে অতীত সহজে ছাড়বে না। যেখানে এসে পৌঁছেছি সেখান থেকেও বেরোবার জন্য চাপ দিতে থাকবে আমায়। আমার সুন্দর জমজমাট ট্রেনিং জীবনকে করে তুলবে অনিশ্চয়তায় ভরা এক গোষ্পদ। না, এমন সময়ে কবিতা লেখা যায় না, ঠোঁট থেকে সে ফিরে চলে যায় বুকের ভিতর।
*ছবি সৌজন্য: Wahoo Art, Fine Art America, Saatchiart
কলকাতায় জন্ম, বড় হওয়া। অর্থনীতির পাঠ প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখক জীবন আরম্ভ। সূচনা শৈশবেই। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য লেখায় অনায়াস সঞ্চরণ। ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার সদস্য ছিলেন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়। মহুলডিহার দিন, মহানদী, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, ব্রেল, কবিতা সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ ইত্যাদি চল্লিশটি বই। ইংরাজি সহ নানা ভারতীয় ভাষায়, জার্মান ও সুইডিশে অনূদিত হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। শরৎ পুরস্কার, সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণপদকে সম্মানিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর সোমেন চন্দ পুরস্কার ফিরিয়েছেন নন্দীগ্রামে নিরস্ত্র মানুষের হত্যার প্রতিবাদে। ভারতের নানা প্রান্তের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর উন্মোচিত তাঁর লেখায়। ভালোবাসেন গান শুনতে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে, প্রকৃতির নানা রূপ একমনে দেখতে।