Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

নিবন্ধ: ভারতের প্রথমা বাঙালি ডাক্তার

মধুছন্দা চক্রবর্তী

নভেম্বর ১৬, ২০২২

1st Bengali Woman Doctor
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

সেই সময়টায় মেয়েদের জীবন কাটত পর্দার আড়ালে, হেঁশেলের আঁধারে। কিছুদিন আগে সতীদাহ প্রথার সহমরণের চিতা নিভেছে বটে, কিন্তু সেই আগুনের তাত বুঝি সেঁধিয়ে রয়েছে হেঁশেলের চুলোয়।বাল্যবিবাহ প্রথায় আইনের লাগাম ঠিকই। কিন্ত মেয়েদের, ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে পা রাখার ছাড়পত্র মেলেনি তেমন।ফলে মেয়েদের জীবন কাটছিল… রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পর রাঁধা’র আবর্তে।

এমন সময় এক সাহসিনীর আবির্ভাব ঘটল। যে ওই হেঁশেলের আগুন থেকেই জ্বালিয়ে নিল জ্ঞানের প্রদীপ। হাতা-খুন্তি ধরা হাতে তুলে নিল কাগজ-কলম। পায়ের বেড়ি কেটে ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে শুধু বাইরে পা-ই রাখল না, ছুঁতে চাইল আকাশ। যে অর্ধেক আকাশের ভাগ মেয়েদের দিতে চায়নি সেই সময়ের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। সেই মেয়ের পরিচিত নাম কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।

এই কাদম্বিনীর জন্ম এক যুগসন্ধিতে। ১৮৬১ সালে। ঠিক যে বছরটিতে জন্ম নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ডাক্তার নীলরতন সরকারের মতো বিখ্যাত মনীষীরা। কাদম্বিনী অবশ্য তখন বসু। ব্রাহ্ম সংস্কারক, ভাগলপুরের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ব্রজকিশোর বসুর কন্যা। যে ব্রজকিশোর ভারতের প্রথম মহিলা সংগঠন, ভাগলপুর মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা। কাজেই কাদম্বিনীর ছকভাঙা উত্তর জীবনের উত্তরাধিকার জন্মসূত্রেই পাওয়া।

কাদম্বিনী ছিলেন প্রথম মহিলা স্নাতক। তিনি এবং চন্দ্রমুখী বসু একই বছরে ভারত তথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম স্নাতক ডিগ্রি পান। পরবর্তীকালে কাদম্বিনী এবং আনন্দীবাই গোপালরাও জোশী ছিলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা চিকিত্সক, যাঁরা পাশ্চাত্য চিকিত্সাবিদ্যা নিয়ে প্র্যাকটিস করার যোগ্যতা অর্জন করেন। আর কাদম্বিনী গাঙ্গুলি (বসু) ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা চিকিত্সক যিনি ডাক্তারি শাস্ত্রে একাধিক বিদেশি ডিগ্রি– এলআরসিপি (এডিনবার্গ), এলআরসিএস (গ্লাসেগো) এবং জিএফপিএস (ডাবলিন) পেয়েছিলেন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কাদম্বিনীর জীবন অনেক কিছুর প্রথম রেকর্ড গড়ার জন্য খ্যাত। তাই হয়তো তিনি – প্রথমা কাদম্বিনী’।

Kadambini Ganguly
কাদম্বিনীর জন্ম এক যুগসন্ধিতে

কিন্তু এই প্রথমা হওয়ার রাস্তা খুঁজে পাওয়াটা সহজ কথা নয়। সত্যি বলতে সে ঠিক রাস্তা খুঁজে পাওয়া নয়, বরং রাস্তা খুঁড়ে বের করা। কাদম্বিনী বসুর জীবনে এই কাজটার শুরুয়াত্ হয়েছিল একেবারে কিশোরীবেলাতেই। ঢাকা স্কুলের পাঠ চুকিয়ে শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষার জন্যই কাদম্বিনীকে ভাগলপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে আসার মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাবা ব্রজকিশোরই। বাড়ির চার দেওয়ালের অনুশাসন ভাঙার শুরু সেই তখন থেকেই।তারপর থেকে তো শুধুই ছকভাঙা জীবনের আবর্জনা পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলা। ভাঙনের মধ্যে দিয়ে জীবনকে গড়ে নেওয়া।

কলকাতায় এসে কাদম্বিনী ভর্তি হলেন অ্যানেট সুসানা অ্যাক্রয়েড নামে এক উচ্চশিক্ষিত বিদেশি মহিলার সেই বছরই গড়ে তোলা হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে (পরে যার নামকরণ হয় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়)। সেই সময়ে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, দুর্গামোহন দাস, আনন্দমোহন বসু, অন্নদাচরণ খাস্তগীর মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত মেয়েদের সমস্ত বিষয়ে পাঠ নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাচর্চার বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নেন। অন্যদিকে কেশবচন্দ্র সেনের ধারণা ছিল– গণিত, ভূগোল, দর্শনের মতো কঠিন বিষয় মেয়েদের পড়ার জন্য নয়। কিশোরী কাদম্বিনী এই যুক্তি মানতে নারাজ। সে নিজের যোগ্যতায় প্রমাণ করে দেয়, বিজ্ঞান, গণিত নিয়েও মেয়েরা পারদর্শী হতে পারে, উপযুক্ত শিক্ষা পেলে। ফলে ওই বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের মেয়েদের পাঠ্যক্রমে একটা বহুমুখী শিক্ষাচর্চা শুরু হল সেখানকার পড়ুয়াদের। একই সঙ্গে বিলিতি আদবকায়দায় কাঁটা–চামচে খাওয়াদাওয়া, শিক্ষার ফাঁকে বনভোজন, শিক্ষামূলক ভ্রমণ, আবাসিক শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়া সবকিছুর পাঠেই অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল কাদম্বিনী। আর এই শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব যিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, তিনি দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি। বিশ্বের প্রথম মহিলাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার ‘অবলাবান্ধব’ নামে ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন তিনিই। বিদেশিনী অ্যাক্রয়েড দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত বেথুন স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। সেই স্কুল থেকেই ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে কাদম্বিনী বসু এবং দুর্গামোহন দাসের কন্যা সরলা দাস। পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায়, কাদম্বিনী প্রথম এবং সরলা দ্বিতীয় হয়েছে।

ঢাকা স্কুলের পাঠ চুকিয়ে শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষার জন্যই কাদম্বিনীকে ভাগলপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে আসার মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাবা ব্রজকিশোরই। বাড়ির চার দেওয়ালের অনুশাসন ভাঙার শুরু সেই তখন থেকেই।তারপর থেকে তো শুধুই ছকভাঙা জীবনের আবর্জনা পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলা।

এই সাফল্যের পরে পরবর্তী ধাপে এগোনোর পালা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনোর জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসার আবেদন করা হল। সময়টা ১৮৭৭ সাল। কিন্তু ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি মেনে সেসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়েও নারীদের প্রবেশাধিকার ছিল না।

নারীদের প্রবেশাধিকার ছিল না কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ে

কী আশ্চর্য না, আজ থেকে ১৪৫ বছর আগে কলেজে পড়ার কোনও অধিকার ছিল না মেয়েদের। এবং তা শুধু পরাধীন ভারতের মতো দেশেই নয়, ব্রিটিশদের বিশ্ববিদ্যালয়েও। অথচ কত যুগ আগে গার্গী, মৈত্রেয়ী, খনা, লীলাবতীর মতো নারীরা তাদের পাণ্ডিত্যের প্রমাণ দিয়েছে আর্যপুরুষদের সমকক্ষ হয়ে।আসলে উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় নবজাগরণ এলেও নারীর অচলায়তনটি ভেঙে ফেলা যায়নি। তাদের পায়ের বেড়ি খুলে দেওয়া হয়েছে হয়তো, কিন্তু পথ চলতে দেওয়া হয়নি নিজের মতো। কাদম্বিনী পাথর কেটে তৈরি করতে চাইলেন নিজের চলার পথ।

তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে চাইলেন। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি লড়াই করে সেই পরীক্ষায় বসার অনুমতি আদায় করে আনলেন সেই সময়কার ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে। ১৮৭৮ সালে কাদম্বিনীর সঙ্গে দেরাদুন থেকে আসা খ্রিস্টান বাঙালি চন্দ্রমুখী বসু একই সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসলেন। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সরলা দাসের আর সেই পরীক্ষায় বসা হল না। ফলপ্রকাশ হলে দেখা গেল মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারেননি কাদম্বিনী।

উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় নবজাগরণ এলেও নারীর অচলায়তনটি ভেঙে ফেলা যায়নি। তাদের পায়ের বেড়ি খুলে দেওয়া হয়েছে হয়তো, কিন্তু পথ চলতে দেওয়া হয়নি নিজের মতো। কাদম্বিনী পাথর কেটে তৈরি করতে চাইলেন নিজের চলার পথ।

কিন্তু কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখীর এই প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ, মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার পাথরের দরজাটা খুলে দিল। ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন–এর ডব্লিউ ক্রফট শিক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, কাদম্বিনীর জন্যই বেথুন স্কুলকে কলেজে রূপান্তরিত করার কথা ভাবে ব্রিটিশ সরকার। সারা বাংলায় এজন্য সাড়া পড়ে যায়। একজন ছাত্রী এবং একজন অধ্যাপক নিয়ে প্রথমে পাঠদান শুরু হয় বেথুন কলেজে। এই কলেজ থেকেই ১৮৮২ সালে বিজ্ঞান শাখায় স্নাতক হন কাদম্বিনী। চন্দ্রমুখী স্নাতক হন ফ্রি চার্চ অফ স্কটল্যান্ড কলেজ থেকে। কাদম্বিনী এবং চন্দ্রমুখীই ছিলেন ব্রিটিশ অধীনস্থ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এই দুই মহিলার ডিগ্রি নেওয়া দেখতে এত মানুষ এসেছিলেন যে ভিড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে নাকি ট্রামলাইন পর্যন্ত চলে গিয়েছিল।কবি হেমচন্দ্র এই দুই নারীকে নিয়ে প্রশস্তিসূচক কবিতা লিখেছিলেন ‘বাঙালীর মেয়ে’ নামে।

Chandramukhi and Kadambini
চন্দ্রমুখী এবং কাদম্বিনী, ব্রিটিশ অধীনস্থ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক

স্নাতক হওয়ার পরে ডাক্তারি পড়ার জন্য মনস্থির করলেন। এর আগে লেডি অবলা বসুও ডাক্তারি পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। ১৮৮৪ সালে মেডিকেল কলেজের ইতিহাসে প্রথম ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হলেন কাদম্বিনী বসু। মেডিকেল কলেজে ঢোকার পরেই কাদম্বিনী তাঁর শিক্ষক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। সেখানেও এক বিপ্লব আনেন কাদম্বিনী, যা প্রগতিশীল ব্রাহ্মসমাজকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। দ্বারকানাথকে নিজে থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কাদম্বিনী। দ্বারকানাথ তখন উনচল্লিশ বছরের বিপত্নীক আর কাদম্বিনী একুশ বছরের পূর্ণ যুবতী। আসলে কাদম্বিনী বুঝেছিলেন আগামী লড়াইয়ের পথে একজন ভার নেওয়ার মতো শক্ত কাঁধ নয়, কঠিন পথে হাতে হাত রাখার মতো একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ চাই। কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়ার স্বপ্নকে সাকার করতে দ্বারকানাথের মতো মানুষই ছিলেন যথাযোগ্য।

অথচ তত্কালীন রক্ষণশীল সমাজ কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়া নিয়ে এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে… ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায় তাঁদের ব্যঙ্গ করে একটা কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে দেখানো হয়েছিল কাদম্বিনী তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির নাকে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। নীচে লেখা ছিল কাদম্বিনীকে নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য। ‘বঙ্গবাসী’ কাগজের সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালের এই অভব্যতার প্রতিবাদে আদালতে পর্যন্ত নালিশ জানিয়েছিলেন কাদম্বিনী ও তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ। সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন ডা নীলরতন সরকার, শিবনাথ শাস্ত্রীর মতো মানুষরা।বিচারে মহেশবাবুর ছয় মাসের জেল এবং একশো টাকা জরিমানা হয়।

সেইসময়কার মেডিকেল কলেজের গোঁড়া শিক্ষকরাও কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। অথচ তখন ঘরে ঘরে পর্দানসীন মেয়েদের চিকিত্সার জন্য মহিলা ডাক্তারদের খুবই প্রয়োজন ছিল। মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষক রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র কাদম্বিনীর ওপর এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে, তাঁর কাছে জমা পড়া তুলনামূলক শরীরবিদ্যা এবং মেটিরিয়া মেডিকার উত্তরপত্রে এক নম্বরের জন্য ফেল করলেন কাদম্বিনী। এমনকী কর্তৃপক্ষের সম্মতি থাকলেও উত্তরপত্র রিভিউয়ের সুযোগ পেলেন না কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। ফলে এমিবিবিএস পরীক্ষায় পাশ করা হল না কাদম্বিনী গাঙ্গুলির। কিন্তু অধ্যক্ষ কোর্ট সাহেবের বিশেষ ক্ষমতাবলে গ্র্যাজুয়েট অফ দ্য মেডিকেল কলেজ অফ বেঙ্গল (জিএমিসিবি)-এর সার্টিফিকেট দেওয়া হল কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে।কাদম্বিনী গাঙ্গুলির খ্যাতি ততদিনে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল পর্যন্ত ভারতের মতো গোঁড়া দেশে এক বিবাহিতা মহিলার ডাক্তারি পড়া এবং সেই সময়ে এক-দুই সন্তানের জননী হওয়া সত্ত্বেও মাত্র তেরোদিন কলেজ কামাই করার দৃষ্টান্ত দেখে আশ্চর্য হয়ে চিঠি লিখেছিলেন তাঁর এক ভারতবাসী বন্ধুকে। এইসব প্রশস্তি আর প্রতিকূলতাকে পাথেয় করেই কাদম্বিনী গাঙ্গুলি শুরু করলেন তাঁর পেশাগত জীবন।কাদম্বিনী ডাক্তারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন ১৮৮৬ সালে। এরপর ইডেন হাসপাতালে কাজের সুযোগ পেলেন কাদম্বিনী। কিন্তু এমবি কিংবা এলএমএস ডিগ্রি না থাকায় ইডেন হাসপাতালে ডাক্তারের মর্যাদা দেওয়া হত না কাদম্বিনীকে।

মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষক রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র কাদম্বিনীর ওপর এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে, তাঁর কাছে জমা পড়া তুলনামূলক শরীরবিদ্যা এবং মেটিরিয়া মেডিকার উত্তরপত্রে এক নম্বরের জন্য ফেল করলেন কাদম্বিনী। এমনকী কর্তৃপক্ষের সম্মতি থাকলেও উত্তরপত্র রিভিউয়ের সুযোগ পেলেন না কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। ফলে এমিবিবিএস পরীক্ষায় পাশ করা হল না কাদম্বিনী গাঙ্গুলির।

এই অবহেলা আর অপমান নীরবে কাদম্বিনীর মধ্যে জ্বলতে থাকত ধিকি ধিকি করে। তাঁর যে প্রতিভা খনির অন্ধকারে লুকনো ছিল, ওই আগুনই ক্রমশ তাকে অঙ্গার থেকে হীরকখণ্ডে পরিণত করছিল। এরপর কাদম্বিনী সেই হীরকদ্যুতি নিয়ে ছড়িয়ে পড়তে চাইলেন। ঠিক করলেন, ইংল্যান্ডে গিয়ে বিদেশি ডিগ্রি অর্জন করতেই হবে তাঁকে।

Florence Nightingale
ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল পর্যন্ত আশ্চর্য হয়ে চিঠি লিখেছিলেন তাঁর এক ভারতবাসী বন্ধুকে

মেডিকেল কলেজে পড়ান সময়, মাসে কুড়ি টাকা করে স্কলারশিপ পেতেন। মেডিকেল কলেজের পরে ইংল্যান্ড যাওয়ার আগে বেশ কিছুদিন লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে মাসে তিনশো টাকা বেতনে ডাক্তারি করতেন। ১৮৮৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মিশ প্যাশ নামে এক মহিলার সঙ্গিনী হয়ে জাহাজে করে একাই বিদেশযাত্রা করেন কাদম্বিনী। তারপর ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাধিক বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন তিনি।

বিদেশ থেকে ফেরার পরে সেই যুগে দাঁড়িয়ে প্রাইভেট চেম্বার খোলার জন্য নিজেই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন কাদম্বিনী। নেপালের রাজা জং বাহাদুরের মা অসুস্থ হলে তিনি তাঁর শেষ চিকিত্সার জন্য মহিলা ডাক্তার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেখান থেকে উপহার পাওয়া ফিটন গাড়িতে চেপেই পরবর্তীকালে রোগী দেখতে যেতেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের জন্মের সময়েও উপস্থিত ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। আসলে সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সঙ্গে কাদম্বিনী গাঙ্গুলির আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। সম্পর্কে কাদম্বিনীর সৎ মেয়ে বিধুমুখী ছিলেন লীলা মজুমদারের জেঠিমা। লীলা মজুমদারের লেখা… ‘পাকদণ্ডি’তে কাদম্বিনীর যেটুকু উল্লেখ রয়েছে তাতে তাঁর ব্যক্তিত্বের আন্দাজ পাওয়া যায়। লীলা মজুমদার কাদম্বিনী সম্বন্ধে লিখছেন:
“তাঁর জীবনটাই এক আশ্চর্যের ব্যাপার। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তার অনেক আগেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। …মস্ত দশাশই চেহারা, ফুটফুট করত গায়ের রং, থান পরে এবং এত বয়সেও রূপ চাপা পড়ত না, তবে কেমন যেন একটু কড়া ধরনের ভাব। আমরা দূর থেকে দেখতাম।” যেদিন সকালে কাদম্বিনীর স্বামী মারা যান, সেদিন বিকেলেই এক জমিদার বাড়িতে প্রসবের জন্য কলে গিয়েছিলেন কাদম্বিনী।

Kadambini Dwarakanath
দ্বারকানাথ তখন উনচল্লিশ বছরের বিপত্নীক আর কাদম্বিনী একুশ বছরের পূর্ণ যুবতী

আসলে কাদম্বিনীর ব্যক্তিত্বে স্নেহধারা লুকিয়ে বইত অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো। বিরাট দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাহাড়ের নীচে তা নিঃশব্দে বয়ে যেত। তাই তো যে হাতে তিনি ডাক্তারির ছুরি কাঁচি ধরতেন, সেই হাতেই চমত্কার লেস আর কুরুশের কাজও করতেন। মাঘোত্সবের প্রস্তুতির সময়ে রবীন্দ্রনাথও গানের দল নিয়ে মহড়া দিতে আসতেন কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলিদের বাড়িতে। তখন আপ্যায়নের দায়িত্ব পালন করতেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। তাঁর নারীত্বের কোমলতার সঙ্গে ব্যক্তিত্বের কঠোরতার কোনও সংঘাত ছিল না।

ডাক্তারির পেশা সামলেও একাধিক সংগনমূলক কাজের দায়িত্ব পালন করেছেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। বোম্বেতে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে ছয় নারী প্রতিনিধির মধ্যে কাদম্বিনী ছিলেন অন্যতম।কলকাতাতেও কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি। মহাত্মা গান্ধির সম্মানে কলকাতায় আয়োজিত সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন। কবি কামিনী রায়ের সঙ্গে কাদম্বিনী বিহার ও ওড়িশার নারী শ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে পর্যবেক্ষণে গিয়েছিলেন।
আজীবন তিনি নানান কর্মের মধ্যে নিজেকে ব্যাপ্ত রাখতেন।যেদিন তিনি হৃদরোগে আক্তান্ত হয়ে মৃত্যুর শেষ ডাক শোনেন, সেদিনও ডাক্তারির জন্য কলে বেরিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে শয্যা নিলেন, আর উঠলেন না। মৃত্যুর পরে তাঁর ডাক্তারির ব্যাগে মেলে ফি হিসেবে পাওয়া পঞ্চাশ টাকা। শোনা যায়, তা দিয়েই শেষকৃত্য ও পারলৌকিক অনুষ্ঠান সারা হয়েছিল কাদম্বিনী গাঙ্গুলির।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর নারী ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।
আজ যে নারী স্বাধীনতা নিয়ে বড়াই করে থাকি আমরা, তার বহু যুগ আগে উনবিংশ শতাব্দীতে প্রকৃত নারী স্বাধীনতাকে লড়াই করে অর্জন ও সংরক্ষণ করেছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। কিন্তু সে কথা আর কতজনই বা মনে রেখেছে? তিনিই আসলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’-র বাণীরূপের মীমাংসিত উত্তর– “নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার?”

*তথ্যসূত্র- ঝড়ের মেয়ে কাদম্বিনী (নারায়ণ দত্ত)
      মহিলা ডাক্তার ভিন গ্রহের বাসিন্দা (চিত্রা দেব)

শৈশবের পাঠ শুরু কলকাতায়। মায়ের কর্মসূত্রে মেয়েবেলার পড়াশুনো পূর্ব মেদিনীপুরে, লেখালেখিতে হাত পাকানো। নব্বইয়ের দশকে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক। জীবনের বাঁক বদল করে সাংবাদিকতায় আসা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ফিচার ও সংবাদ বিভাগে লেখালেখি। কবিতা ও গল্প নিয়ে একটু আধটু চর্চার মুক্ত বাতাস জোগাচ্ছে পেশাতেও।

Picture of মধুছন্দা চক্রবর্তী

মধুছন্দা চক্রবর্তী

শৈশবের পাঠ শুরু কলকাতায়। মায়ের কর্মসূত্রে মেয়েবেলার পড়াশুনো পূর্ব মেদিনীপুরে, লেখালেখিতে হাত পাকানো। নব্বইয়ের দশকে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক। জীবনের বাঁক বদল করে সাংবাদিকতায় আসা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ফিচার ও সংবাদ বিভাগে লেখালেখি। কবিতা ও গল্প নিয়ে একটু আধটু চর্চার মুক্ত বাতাস জোগাচ্ছে পেশাতেও।
Picture of মধুছন্দা চক্রবর্তী

মধুছন্দা চক্রবর্তী

শৈশবের পাঠ শুরু কলকাতায়। মায়ের কর্মসূত্রে মেয়েবেলার পড়াশুনো পূর্ব মেদিনীপুরে, লেখালেখিতে হাত পাকানো। নব্বইয়ের দশকে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক। জীবনের বাঁক বদল করে সাংবাদিকতায় আসা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ফিচার ও সংবাদ বিভাগে লেখালেখি। কবিতা ও গল্প নিয়ে একটু আধটু চর্চার মুক্ত বাতাস জোগাচ্ছে পেশাতেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com