Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

মৃত্যুর দশ বছর পর ঋতুপর্ণ শুধুই কি সমকামের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর? 

feature on Rituparno Ghosh on his Death anniversary
feature on Rituparno Ghosh on his Death anniversary
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

‘খেলা খেলা দিয়ে শুরু
খেলতে খেলতে শেষ
কেউ বলেছিল ছিঃ ছিঃ
কেউ বলেছিল বেশ
কেউ বেসেছিল ভালো
কেউ খুঁজেছিল আলো
কেউ আলো খুঁজে পায়নি বলেই–
হয়তো নিরুদ্দেশ…’

৩০ মে, ২০১৩,শেষ ঘুমের কাছে নিজেকে সঁপে দেন ঋতুপর্ণ। কনকনে ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল ঋতুর। দুটো এসি অন করার পরও পাখা চালিয়ে শুতেন। চিরকালই ঋতুর অভ্যেস সাড়ে আটটার মধ্যে ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়া। নিজের এই অভ্যেসের তারিফ করতে গিয়ে ঋতুপর্ণ একবার চিরযৌবনা রেখার উদাহরণ টেনেছিলেন। ঋতুপর্ণ গেছিলেন রেখার বাড়ি মুম্বাইতে রেখার সাক্ষাৎকার নিতে। ঋতুর কাছে অকপটে ধরা দিতে চেয়েছিলেন ‘উমরাওজান’। সেখানেই রেখা বলেন, তাড়াতাড়ি ইন্টারভিউ নিতে আসতে হবে। কারণ সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই রেখা ডিনার সেরে নেন।

ঋতুর তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাবার অভ্যাস বরাবরের। আর উঠে পড়েন ভোর না হতেই। ঐ ভোরবেলাতেই ঋতুপর্ণ ফোন করে কখনও মমতা শংকর, কখনও বা অপর্ণা সেনের সঙ্গে খোশগল্পে মাততেন। কিন্তু ৩০ মে, ২০১৩, ভোর ভোর ঋতুপর্ণর ঘুম আর ভাঙল না। ঠান্ডা ভালবাসা ঋতুর দেহ চিরতরে হিমশীতল ঠান্ডা হয়ে গেল। সেদিন ঋতুর দিদিরা, মমতা শংকর,অপর্ণা সেনেরা ঋতুর বাড়ি এসেছিলেন। তাঁদের ফোনালাপের সখ্যতা যেন নিভে গেল চিরতরে।

 ঋতুপর্ণর এই অকাল মৃত্যুর কারণ কী? নিজেকে নিরন্তর রূপান্তর করার খেলাই কি তাঁর মৃত্যুর কারণ? হরমোন থেরাপির প্রয়োগ, নাকি কড়া ডোজের কোনও ওষুধই কাল হল? অবসাদ কি কেড়ে নিল তাঁকে? নাকি সমাজের টিটকিরি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তাঁর অবসাদের কারণ?

Rituparna

সমাজের বিদ্রুপ ঋতুপর্ণর জীবনে শিশুবয়স থেকেই ঈশ্বরের দেওয়া অভিশাপ যেন। সে আর পাঁচ জন ছেলের মতো নয়। ঈশ্বর তাঁকে বানালেন, অথচ কীভাবে সে এই পৃথিবীর বুকে টিঁকে থাকবে বলে দিলেন না। এ লড়াই তো একা ঋতুপর্ণর নয়, সমস্ত নরম-মনা ছেলেদেরই লড়তে হয় এই অসম লড়াই। পুরুষ-স্বভাবী মেয়েরা বরং কিছুটা হলেও প্রিভিলেজড ক্যাটাগরিতে থাকেন। কারণ ঐ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ— এখানে মেয়ে পুরুষের মতো হলে, জিন্স পরলে, ক্যারাটে শিখলে, সেটা আইডিয়াল পুরুষের স্তরে ওঠা। কিন্তু কোনও ছেলে চোখে কাজল পরতে চাইলে বা প্রিয় রংয়ের লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙাতে চাইলে সমাজের হাসাহাসি ছিছিক্কার। পুরুষ হয়েও নারীর মতো হতে চাওয়া যেন সমাজের চোখে কয়েক ধাপ নীচে নেমে যাওয়া। সমাজের এই চাপিয়ে দেওয়া লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। যখন ঋতুপর্ণকে‘লেডিজ’ বলে বিদ্রুপ করত সমাজ, ঋতুপর্ণ তাদের জবাবে বলতেন “ওটা লেডিজ নয়, লেডি হবে! লেডিজ প্লুরাল!”

এই বিদ্রুপাত্মক ‘লেডিজ’ শব্দের অর্থ— সে পুরুষ হতে পারেনি। সে নারীর মতো। তাই সে নারীর মতোই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। দুঃখের বিষয় নরম-মনা পুরুষকে ‘লেডিজ’ ডেকে প্রমোদ লাভ করেন বহু নারীও।

Rituparna Ghosh

যাদের সমাজ প্রান্তিক করে দেয় ঠাট্টায় বিদ্রুপে, ঋতুপর্ণ যেন তাদের কথাই বলেছিলেন। ঋতুপর্ণ শুধু একার লড়াই লড়েননি, একটা কমিউনিটির লড়াই লড়ে জয়ী হন তিনি। কিন্তু মৃত্যুর পর তিনি যেন ক্রমশ ‘লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডার’ কমিউনিটির সম্পত্তি হয়ে গেলেন। ঋতুপর্ণ যেন এখন শুধুই সমকামের মুখ। অথচ ঋতুপর্ণ লিখতে পারতেন, ছবি আঁকতে পারতেন, ঘর সাজাতে পারতেন, ছবি পরিচালনা করতে পারতেন, কবিতা লিখতে পারতেন, গান রচনা করতে পারতেন, অভিনয় থেকে নাচ— সবটাই পারতেন। শুধু তাই নয়, নারী-পুরুষ উভয়কেই অসম্ভব সুন্দর সাজাতে পারতেন ঋতুপর্ণ। কিন্তু আজ সেই আন্তর্জাতিক পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের থেকেও কোথাও যেন বড় করে দেখা হচ্ছে তাঁর লিঙ্গ-সত্তাকে। ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পর আজ শুধুই সমকামী সমাজের ব্র্যান্ড। 

ঋতুপর্ণর ছবিতে পরানো হয় লাল টিপ। ঋতুপর্ণ মানেই তিনি সমকামের গল্প বলেন। মুণ্ডিত শির ঋতুপর্ণর প্রচারে হারিয়ে যেতে বসেছে কোঁকড়া চুলের কার্বন ফ্রেমের চশমা পরা ঋতুপর্ণ।

Rituparna -Prasenjit
নারী-পুরুষ উভয়কেই অসম্ভব সুন্দর সাজাতে পারতেন ঋতুপর্ণ

সিংহ নয় সিংহবাহিনী হতে চাই

সৌরনীল ছোট থেকেই অর্ন্তমুখী। নিজের মধ্যেই সে নিজের বন্ধু খুঁজে নেয়। কারণ শুরু থেকেই সমাজের সঙ্গে সংঘাত তাঁর। সৌরনীল যখন বড় হয়ে উঠছে, তখন কলকাতা শহর এলজিবিটি আন্দোলনের মুখ দেখেনি। সৌরনীল বাড়ির বাইরে হেঁটে পথ চলতে ভালবাসতেন। কিন্তু সেখানেও দমবন্ধ পরিবেশ। সে ছেলে না মেয়ে, এই প্রশ্ন বারবার ছুঁড়ে দিতে থাকে সমাজ। তবু বাইরের জগতকে জানতে ঋতুপর্ণ বরং আরও বেশি উদগ্রীব হয়ে পড়েন। বই পড়া আর ছবি দেখার মাধ্যমে নিজেকে ঋদ্ধ করতে থাকেন।

ঋতুপর্ণর পরিবার ছিল শিল্পী পরিবার। ঋতুপর্ণর মায়ের নাম ইরা ঘোষ, বাবা সুনীল ঘোষ। সুনীল ঘোষ আর ইরা ঘোষ ছিলেন দুজনেই ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রী। সেখানেই প্রেম। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর বিয়ে করেন। ইরা ঘোষ ছিলেন খুবই ধনী পরিবারের মেয়ে। ঋতুপর্ণর ‘তাসের ঘর’ বাড়ি মায়ের দিকের সম্পত্তি। সুনীল ঘোষ সোদপুরের মানুষ আদতে। ‘গঙ্গা’ নামে একটা তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন তিনি। সেখানে ঋতুপর্ণ সহযোগী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন প্রথম। ঋতুর ছোট ভাই ইন্দ্রনীল। যিনি কলকাতা শহরের নামী শিল্প-নির্দেশক। 

বাবা-মা শিল্প-সচেতন হওয়াতে ঋতুপর্ণর ওপর তাঁরা কোনও কিছু চাপিয়ে দেননি। অর্থনীতি নিয়ে প্রথাগত শিক্ষা শেষ করে বিজ্ঞাপন এজেন্সির কাজ সহ দূরদর্শনের অনেক কাজ করেছেন ঋতুপর্ণ। বোরোলিনের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় স্লোগান ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’ ছিল তাঁরই সৃষ্টি।

ঋতুপর্ণর পরিবার ছিল শিল্পী পরিবার। ঋতুপর্ণর মায়ের নাম ইরা ঘোষ, বাবা সুনীল ঘোষ। সুনীল ঘোষ আর ইরা ঘোষ ছিলেন দুজনেই ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রী। সেখানেই প্রেম। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর বিয়ে করেন। ইরা ঘোষ ছিলেন খুবই ধনী পরিবারের মেয়ে। ঋতুপর্ণর ‘তাসের ঘর’ বাড়ি মায়ের দিকের সম্পত্তি। 

শেষ অবধি ছবির জগতে চলে আসা। ঋতুপর্ণ কিন্তু তাঁর ছবিগুলির মধ্যে নিজের কথাই বারবার বলেছেন। ‘উনিশে এপ্রিল’-এর মিঠু দেবশ্রী রায়, ‘বাড়িওয়ালি’র বনলতা কিরণ খের বা ‘দোসর’-এর কাবেরী কঙ্কনা, যেই হন, আদতে সে ঋতুই। আসলে ঋতুও অভিমানে দুঃখে একইভাবে কাঁদত। ঋতু কাঁদলে মুঠো করে হাতটা সামনে চলে আসত। যেন নিজেকেই আয়নায় দেখতেন ঋতুপর্ণ। শেষ দেখা দেখলেন চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে নিজের অস্তিত্বের লড়াইয়ের তুলনা করে। ঋতু বললেন পুরুষসিংহ নয়, সিংহবাহিনী হতে চাই। 

‘স্নেহে সে নারী, বীর্যে সে পুরুষ,
শুনি সিংহাসনা যেন সে সিংহবাহিনী।’

Rituparna with family
বাবা মায়ের সঙ্গে

ঋতুপর্ণর অস্তিত্ব সংকট 

সৌরনীল নাম বদল করে তিনি হয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। ঋতুপর্ণ যখন ইন্ডাস্ট্রিতে এলেন, তখন ঋতুপর্ণা নামে এক উঠতি নায়িকা বেশ নাম করে ফেলেছেন। যার খেসারত চোকাতে হল ঋতুপর্ণকে। ঋতুপর্ণ নামটা খুবই বিরল। হ্যাঁ, ঋতুপর্ণ ঘোষ বিখ্যাত হবার আগেও নিশ্চয়ই ঋতুপর্ণ নামের ছেলেরা ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সংখ্যাটাও হাতে গোনা। বাংলা ছবির দর্শক ঋতুপর্ণ ঘোষ বোঝাতে সটান লিখে দিতেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। 

শুরু থেকেই নাম-বিভ্রান্তিতে ঋতুপর্ণকে নারী সাজিয়েছে সমাজ। এমনকী ঋতুপর্ণর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘উনিশে এপ্রিল’-এর পোস্টারেও কোথাও কোথাও লেখা হয়েছিল ঋতুপর্ণা ঘোষ বা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। শুধু তাই নয়, নারীসুলভ ছেলেদের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠলেন যেন ঋতুপর্ণ। সমাজের বাকি কোমল-স্বভাব ছেলেদের দেখলেই লোকে টিটকিরি দিয়ে বলত “ও তো ঋতুপর্ণ!” ঋতুপর্ণ যেমন এক আন্তর্জাতিক পরিচালকের নাম, তেমনই ‘ঋতুপর্ণ’ নামটাকে পক্ষান্তরে এক গালাগালি, এক বিদ্রুপের সমার্থক করে দিল সমাজ। মৃত্যুর ১০ বছর পর আজও কি তাঁর বদল হয়েছে? সমাজ বোঝেনি ঋতুপর্ণর মতো হওয়া যায়, কিন্তু ঋতুপর্ণ হওয়া যায় না। ঋতুপর্ণ ঘোষ শুধু এলজিবিটি কমিউনিটির মুখ নন, তিনি বহুমাত্রিক, তিনি ঋতুরাজ— যার নাগাল পাওয়া যায় না, যার নাগাল আর কোনওদিন পাব না আমরা। 

ঋতুপর্ণর পদাবলী

ঋতুপর্ণ ঘোষের বিভিন্ন গুণ নিয়ে, তাঁর উৎকর্ষ নিয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি— যা আড়াল পড়ে যাচ্ছে ঋতুপর্ণর লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে। ঋতুপর্ণ নিজেই তৈরি করেছেন নিজের আইডেন্টিটি। তাঁকে শুধু নারীসুলভ পুরুষের পরিচয়ে বাঁধা যায় না। সবার আগে তিনি মানুষ, উৎকৃষ্ট মানুষ। সবার উপরে ঋতুপর্ণ একজন শিল্পী, যাঁকে কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মুখ করে তোলা যায় না। 

ঋতুপর্ণর সত্তা যেন দশভুজার মতোই নানাদিকে প্রসারিত। ঋতুর নানা গুণের পরিচয় দিয়েছি আগেই। এবার বিশেষ করে বলি গীতিকার ঋতুপর্ণর কথা— যাঁর লেখা ছড়া বা কবিতা একবার পড়লে শেষ না করে থাকা যায় না, বারবার পড়তে ইচ্ছে করে।

আরও পড়ুন: ঋতুপর্ণ নিজে হাতে আমার মেকআপ করে দিয়েছিল

অপর্ণা সেনের বড় মেয়ে ডোনার বিয়েতে তত্ত্ব সাজানোর ভার পড়ল ঋতুপর্ণর উপর। তত্ত্বসূচিতে ঋতুপর্ণ এমন ছড়া লিখলেন যা হতে পারত কোনও সর্বাধিক বিক্রিত  ছড়ার বই। ছড়া মানেই তা শুধু ছোটদের সম্পত্তি নয়, বরং বড়বেলার মনের কথাও ছড়ার আকারে সহজ করে নেওয়া যায়। অপর্ণা সেনের বেয়ানের তত্ত্ব উপহারে ঋতুপর্ণ লিখেছিলেন,

“ঝগড়া করে মন্দ লোকে ‘কাঁথায় আগুন’ বলে।
নতুন বেয়ান হলে কি আর তেমন বলা চলে?
অনেক ধকল গেছে ছেলে মানুষ করতে গিয়ে।
এবার না হয় ঘুমোও বেয়ান কাঁথা মুড়ি দিয়ে।।
কাঁথার কাজের রেশমী শাড়ি পাঠাই তোমার তরে।
সোনায় মোড়া শাঁখা জোড়া দু’হাত আলো ক’রে॥”

চটজলদি এমন ঘরকন্নার ছড়া যাঁর কলমে ধরা পড়ত, তাঁর সেই গুণ নিয়ে চর্চা কি আজ কম পড়ে যাচ্ছে?

Rituparna Ghosh young image
সবার উপরে ঋতুপর্ণ একজন শিল্পী

একসময়কার চ্যানেল ‘বাংলা এখন’-এর শীর্ষসঙ্গীত লিখেছিলেন ঋতুপর্ণ। একেবারে হার্ডকোর কমার্শিয়াল ছবি ‘রণক্ষেত্র’ বানালেন হরনাথ চক্রবর্তী। সেই ছবিতে ব্যবহার হল আর্ট-ফিল্ম ডিরেক্টর ঋতুপর্ণর লেখা গান ‘গলি থেকে রাজপথে, ভায়ে ভায়ে একসাথে’। 

যখন নিজের ছবির জন্য গান লিখলেন ঋতুপর্ণ, সে গান বেস্টসেলার হল। ‘তিতলি’ ছবির সেই বৃষ্টিস্নাত গান 

‘মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভেতর
মন খারাপের দিস্তা
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়,
ব্যাকুল হলে তিস্তা।’

সেসময় রিমেক গানের শিল্পী হিসেবে বিখ্যাত শ্রীকান্ত আচার্য নিজের গানের পরিচয় পেয়েছিলেন ঋতুপর্ণর লেখা এই গান গেয়েই। শ্রীকান্ত প্রথম হিট প্লে-ব্যাক, যা তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। গীতিকার ঋতুপর্ণ আর সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্রের জুটি একের পর এক দুর্দান্ত গান রচনা করেছেন। ‘আবহমান’ ছবির সেই কৃষ্ণকলির গান 

‘ কৃষ্ণকলির চোখ হরিণীর মতো
টানা টানা কালো দুটো তারা
কবি কি জানেন সে লুকিয়ে কখনও
লাগিয়েছিল মাস্কারা!
জানলেও সে কথা বলেননি কবি
চেপে গিয়েছেন নিশ্চয়
তিনি গুরুদেব লোক পাক্কা জানেন
নায়িকাকে ছাড় দিতে হয়!!’

ব্রজবুলি ভাষায় লিখলেন “বহু মনোরথে সাজু অভিসারে পেহলু সুনীল বেশ/কাজর নয়ানে সলাজ বয়ানে কুসুমে সাজানু কেশ।।”

মনে রাখার মতো গীতিকার ঋতুপর্ণর অশেষ সৃষ্টি , রেনকোট ছায়াছবির “मथुरा नगरपति काहे तुम गोकुल जाओ”! (মথুরা নগরপতি কাহে তুম গোকুল যাও!) এই গানে যেন নিজের জীবনকাহিনি আগেই লিখে ফেলেছিলেন ঋতু। নিজেও তো সকাল সকাল এভাবেই চলে গেলেন।

ছোটদের ছবি থেকে সম্পর্কের ছবি নির্মাতা

ঋতুপর্ণ মানেই তিনি যেন সমপ্রেমীর গল্প বলেন। সমকামের মুখ ঋতুপর্ণ। বহু সমকামী সংগঠন ঋতুপর্ণকে তাঁদের ইচ্ছামতো সাজিয়ে বানিয়ে নিজেদের প্রচারকাজের ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। অথচ ঋতুপর্ণর প্রথম ছবি কিন্তু ছোটদের ছবি। ‘হীরের আংটি’ কখনও বড় পর্দায় মুক্তি পায়নি। কেউ জানতেও পারেনি কলকাতা শহরের ছেলে ঋতুপর্ণ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে তাঁর প্রথম ছবি বানালেন। তখন গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটিতে কলকাতা দূরদর্শনে ‘ছুটি ছুটি’ অনুষ্ঠান হত। সেখানেই প্রথম সম্প্রচারিত হয় ‘হীরের আংটি’। চেনা মুখ এক ঝাঁক অভিনেতা— বসন্ত চৌধুরী, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, মুনমুন সেন সহ আরও অনেকে। কে ছবির পরিচালক লোকে চিনত না। অথচ নাইন্টিজ টিনএজারদের সেই পুজোর ছবি মন ছুঁয়ে গেল।

 প্রথম ছবি রিলিজ না করার দুঃখ ঋতুপর্ণ বয়ে বেড়ান বহুদিন। তারপরই বাংলা ছবির বাঁকবদল ঘটল ঋতুপর্ণ ঘোষের দ্বিতীয় ছবির হাত ধরে। ‘উনিশে এপ্রিল’। বহুদিন পর বাংলা ছবিতে অপর্ণা সেন, দেবশ্রী রায় হার্ডকোর বাণিজ্যিক ঘরানার ছবির বাইরে জাতীয় পুরস্কার জিতে নিলেন। সেরা বাংলা ছবির জন্য রজতকমল পেলেন ঋতুপর্ণ। দিকে-দিকে ছড়িয়ে পড়ল ঋতুপর্ণর নাম। মিনার-বিজলি-ছবিঘর চেইনে রোজ লম্বা লাইন। বাংলা ছবিতে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক-এর উত্তরসূরী এসে গেল।

Unishe April
'উনিশে এপ্রিল' ছবির একটি দৃশ্যে দেবশ্রী-প্রসেনজিৎ

ঋতুপর্ণ কিন্তু এরপর নারী পুরুষের ভালবাসার গল্প, সম্পর্কের গল্পই বেশি বলেছেন তাঁর ছবিতে। অরক্ষণীয়া বাড়িওয়ালি বনলতার হাহাকার বা রাঙা পিসিমার ‘উল্টোরথ’ পড়ে একাকীত্ব মোচন, মা ডান্সার বলে ডাক্তারি পড়া মেয়ে অদিতির বয়ফ্রেন্ড সুদীপের সঙ্গে বিয়ের কথা ভেঙে যাওয়া কিংবা ‘উৎসব’ ছবির বেকার আর্ট কলেজের জামাইয়ের একাকীত্ব—- সবটাই ঋতুপর্ণর সৃষ্টি। যেসব ছবির উৎকর্ষ চর্চা হওয়া প্রয়োজন। অনেকেই বলেছেন ঋতুপর্ণর ছবি তো পর্ন ছবি! যদি ঋতুর মন পড়তে পারতেন, তাঁরা এ কথা বলতেন না। ‘অন্তরমহল’ ছবিতে সঙ্গমরত জমিদারের কামনার বলি হওয়া স্ত্রী যশোমতীর যন্ত্রণা ঋতুপর্ণ পর্দায় যেভাবে আঁকলেন তাতে যেন এতদিনের আড়াল করা শোবার ঘরের বৈবাহিক ধর্ষণ বেরিয়ে এল পর্দায়। ছোট ছোট নারী-পুরুষের মান-অভিমান ঋতুপর্ণ তাঁর ছবিতে এঁকেছেন সযত্নে। ‘আবহমান’ ছবিতে দীপ্তি তাঁর পরনের কাপড় পরিবর্তন করার সময় পরিচালক স্বামীকে বেডরুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। তিরিশ বছরের দাম্পত্যে অবিশ্বাসের আড়াল যেন দুজন নারী-পুরুষের অবিশ্বাসের পর্দা হয়ে দাঁড়ায়।

movie dosar
'দোসর' ছবির দৃশ্যে

সম্পাদক ঋতুপর্ণ

ঋতুপর্ণ ঘোষ যদি পরিচালক না হতেন তবে তিনি ভালো সাহিত্যিকও হতে পারতেন! তাঁর লেখার হাত ছিল অপূর্ব। সেই লেখালিখির পথ ধরেই সেইসময়কার একটি সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক হন ঋতুপর্ণ। যে পত্রিকার সম্পাদক আগে ছিলেন সেবাব্রত গুপ্ত থেকে দুলেন্দ্র ভৌমিক। তাঁদের সেই পরম্পরাকে ধরে রাখলেন ঋতুপর্ণও। বলা ভালো তাঁর হাতে পড়ে বিনোদন জগতে যেন আরও উৎকর্ষ বাড়ল সেই পত্রিকার।

Rituparna Ghosh image

সঞ্চালক ঋতুপর্ণ

২০০০ সাল। নতুন যুগের সূচনা। শুরু হল নতুন বাংলা চ্যানেল ‘ই-টিভি বাংলা’। এই চ্যানেলের শুভ সূচনায় এল ‘এবং ঋতুপর্ণ’ টক শো প্রোগাম। আড্ডাচ্ছলে তারকাদের থেকে গল্প শোনা, আর সঞ্চালক-রূপে ঋতুপর্ণ ঘোষ। মাথাভর্তি কোঁকরানো চুল, ডিজাইনার লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি, কার্বন ফ্রেমের চশমায় এক বিদগ্ধ চিন্তক ঋতুপর্ণ। অথচ সেই অনুষ্ঠানে গুরুগম্ভীর তর্ক নেই, বরং অনেক বেশি ঘরোয়া আড্ডায় ঋদ্ধ হওয়া। কে না এসেছেন সেই অনুষ্ঠানে ঋতুপর্ণর অতিথি হয়ে—- মাধবী মুখোপাধ্যায়, শমিত ভঞ্জ, পীযূষকান্তি সরকার, অপর্ণা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, শাশ্বতী-চৈতালী, আরও কত প্রিয় মুখ। দশক পেরিয়ে আবার সেরকমই একটি শোয়ের জন্ম দিল স্টার জলসা চ্যানেল। এবার ঋতুপর্ণর পদবী দিয়েই অনুষ্ঠানের নামকরণ ‘ঘোষ অ্যান্ড কম্পানী’। যেটি আজও জনপ্রিয়তার শিখরে সমস্ত সামাজিক মাধ্যমে। যে অনুষ্ঠানের একটি পর্বে এক বিখ্যাত সঞ্চালক ঋতুপর্ণকে মিমিক্রি করায় ঋতুপর্ণ তাঁকে ভরা হাটে কথার জালে নাস্তানাবুদ করিয়ে ছাড়েন। ঋতুপর্ণ যে কত বড় সূত্রধর, কত বড় মাপের কথক তা প্রমাণিত। এমন সঞ্চালক হতে ঋতুপর্ণর মৃত্যুর দশ বছর পর একজনও কি পারলেন? ঋতুপর্ণ-পরবর্তী পরিচালকেরা কেউ কেউ সঞ্চালক হয়ে একই ধাঁচের অনুষ্ঠান করলেও তাঁদের ‘অটোগ্রাফ’ দর্শকের মনের খাতায় জায়গা পেল না।

Rituparno Ghosh and Amitabh_Bachchan

মন পড়তে পারা বন্ধু ঋতু

ঋতুপর্ণ ঘোষ কেন এত মানুষের প্রিয়? একটাই উত্তর, তিনি মানুষের মন পড়তে পারতেন। বিশেষত মেয়েদের মন পড়তে ঋতুপর্ণ সবথেকে বেশি পারতেন। তা বলে পুরুষদের জন্য ঋতুপর্ণ নেই, তা একদমই নয়। যারাই একটু একলা মানুষ তাঁরা যেন আশ্রয় পেতেন, ভরসা পেতেন ঋতুপর্ণর কথা শুনে, লেখা পড়ে এবং তাঁর বানানো ছবি দেখে। সেজন্যেই বোধহয় ঋতুপর্ণর প্রয়াণে সারা বাংলা শোকে দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছিল। উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায়, লতা মঙ্গেশকর বা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে কিংবদন্তি তারকাদের হারিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ঋতু-বিদায়ে আমরা যেন হারালাম প্রাণের বন্ধুকে। দর্শক বলল, কার ছবি দেখতে আর এবার থেকে সিনেমাহলে ছুটে যাব? কার লেখা পড়তে আর সংবাদপত্র কিনব? যেন এক সমবেত শোক। পাড়ার নরম মনের ছেলেটিকে যারা বলতেন “ও তো ঋতুপর্ণ”, সেই তাঁরাও ঋতুপর্ণর হঠাৎ মৃত্যুতে অপরাধবোধে ভুগেছিলেন। এখানেই ঋতুর জয়। 

 

তথ্যঋণ: ঋতুপর্ণর বন্ধু ও সহযোগী, পরিচালক শৌভিক মিত্র ও
মিলনসাগর.কম

ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia

Author Subhadip Bandyopadhyay

বর্তমান সময়ে বাংলা ছায়াছবি ও বিনোদন জগতের লেখালিখিতে জনপ্রিয় নাম শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন বাংলা ছবি সংক্রান্ত গবেষণায় ব্রতী রয়েছেন শুভদীপ। তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা করেন। একাধিক সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'সুরের জাদুকর হেমন্ত' এই সময়ের বেস্টসেলার বই। লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গান তৈরির গল্প নিয়ে শুভদীপের লেখা 'গানে গল্পে বাঙালির লতা' বইটি প্রকাশের পথে।

Picture of শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বর্তমান সময়ে বাংলা ছায়াছবি ও বিনোদন জগতের লেখালিখিতে জনপ্রিয় নাম শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন বাংলা ছবি সংক্রান্ত গবেষণায় ব্রতী রয়েছেন শুভদীপ। তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা করেন। একাধিক সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'সুরের জাদুকর হেমন্ত' এই সময়ের বেস্টসেলার বই। লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গান তৈরির গল্প নিয়ে শুভদীপের লেখা 'গানে গল্পে বাঙালির লতা' বইটি প্রকাশের পথে।
Picture of শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বর্তমান সময়ে বাংলা ছায়াছবি ও বিনোদন জগতের লেখালিখিতে জনপ্রিয় নাম শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন বাংলা ছবি সংক্রান্ত গবেষণায় ব্রতী রয়েছেন শুভদীপ। তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা করেন। একাধিক সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'সুরের জাদুকর হেমন্ত' এই সময়ের বেস্টসেলার বই। লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গান তৈরির গল্প নিয়ে শুভদীপের লেখা 'গানে গল্পে বাঙালির লতা' বইটি প্রকাশের পথে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com