ছবি: অঙ্ক কি কঠিন
পরিচালনা: সৌরভ পালোধি
অভিনয়: ঋদ্ধিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতশ্রী চক্রবর্তী, তপোময় দেব, প্রসূন সোম, পার্নো মিত্র, শঙ্কর দেবনাথ, সঞ্জিতা, ঊষসী চক্রবর্তী, দীপান্বিতা নাথ ও আরও অনেকে
ছবি মুক্তি: মে, ২০২৫ ছবির ধারা: ড্রামা (হয়তো নিখাদ গল্প বলা)
(Cinema)
আমাকে গল্প বলো, একবার গল্প বলো, একটু গল্প বলো, কী হল তারপরে..
এই গল্প স্বপ্নের। মরুশহরে আকাশভাঙা বৃষ্টির স্বপ্ন। বারুদের গন্ধে সাদা পায়রা ওড়ার স্বপ্ন। ‘অধর্মের’ জিগিরে আজান-কীর্তনের যুগলবন্দীর স্বপ্ন। এবড়োখেবড়ো খোলা মাঠের রানওয়েতে বোয়িং ওড়ানোর স্বপ্ন। পোড়া পাউরুটির উল্টো পিঠে মাখন লাগানোর স্বপ্ন। থুড়ি! পাউরুটি নয়, বাস্তব। শহরের বহুতলীয় মিথ্যে যাপনের মধ্যে একটা সত্যিকারের ‘তল’ খেটেখাওয়া মানুষ। তলানিতে ঠেকা তাদের ধূসর-ধুলোবালির দুনিয়াতেও সবুজ স্বপ্ন ডানা ঝাপটায়। সেই স্বপ্নের চারাগাছে জল দেওয়ার গল্প ‘অঙ্ক কি কঠিন’। (Cinema)
করোনার মহামারিতে ‘অক্সিজেনের’ অভাবে বস্তির শ্যামল কাকুর সঙ্গে পাঠ চুকেছে তাদের পড়াশোনার। তাই বলে কি বাবিন ডাক্তার, ডলি নার্স আর টায়ার ইঞ্জিনিয়ার হবে না?
‘আকাশছোঁয়া’ মহানগরের ‘ছায়া-ছবি’, কঠোরভাবে বললে তলপেট। সেই রগরগে দুনিয়ার দগদগে বাস্তবে স্বপ্নের ত্রিভুজ এঁকেছে বাবিন, ডলি আর টায়ার। তিনজনেই স্কুলছুট। করোনার মহামারিতে ‘অক্সিজেনের’ অভাবে বস্তির শ্যামল কাকুর সঙ্গে পাঠ চুকেছে তাদের পড়াশোনার। তাই বলে কি বাবিন ডাক্তার, ডলি নার্স আর টায়ার ইঞ্জিনিয়ার হবে না? আলবৎ হবে। কুড়িয়ে পাওয়া কাঁচি, জোগাড় করা বেড, তুলে আনা অক্সিজেন সিলিন্ডার, ফেলে রাখা ‘তেথো’ আর শাহরুখ দা’র দেওয়া মাস্ক। দিব্যি গড়ে তুলেছে ‘আব্বুলিশ’ বাড়িতে সাধের হাসপাতাল। শহরের ফেলে দেওয়া টুকরোগুলো জোড়াতালি দিয়ে জমাট বেঁধেছে স্বপ্ন। (Cinema)
আরও পড়ুন: চলচ্চিত্রের চালচিত্র
শাহরুখের কথা তো বলাই হয়নি। তিন খুদে ও তাদের স্বপ্নের উলকাঁটা। পেশায় ‘ডেলিভারি বয়’। পেশাদার শহরের ব্যস্ততায় দুয়ারে দরকারি সবকিছু পৌঁছে দেওয়ার চটজলদি সমাধান। তার ভালোবাসার গল্পটাও নেহাত সাধারণ নয়। হিন্দু পরিবারের কাজলকে ভালোবাসে। এক কথায় শাহরুখ-কাজল জুটি। কিন্তু তাতেও রেহাই নেই। ‘ধর্ম-যুদ্ধের’ দূষণে ভালোবাসার প্রাণখোলা হাওয়ার খোঁজে লুকিয়ে দেখা করতে হয় তাদের। যুগ-যুগ পেরিয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছি ঠিকই, কিন্তু এই গল্পটা পাল্টায়নি। আলোকনগরীতে এখনও কয়েক আলোকবর্ষ পিছিয়েই রইলাম আমরা। (Cinema)

কয়েকটা মুহূর্তের কথা আলাদা করে বলতেই হবে। আলো-অন্ধকার ঘরে বাবিনের বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছে। দুই সংখ্যার গুণে ‘হাতের-টাকে’ যোগ না করেই উত্তর বসানোর সময় মিষ্টি-ধমকে মনে করিয়ে দিতে বাবিন বলে ‘হাতে কিছু একটা তো থাকলো, পরে কাজে লাগবে’। কথাটা শুনে বুকটা ধড়াক করে ওঠে। নুন আন্তে পান্তা ফুরোয় সংসারে ওই একরত্তির সহজ পাঠই জীবনের কঠিন সত্য। ফিশফ্রাই ভাগ করে নেওয়ার দৃশ্যও মনে চওড়া দাগ কাটে। তবে এটা নিছক অভাবের সংসারের রোজনামচা নয়। ‘শেয়ারিং-ইজ-কেয়ারিং’-এর বুলি আওড়ানো দামি দুনিয়ার দৈন্যর সামনে তিন খুদে ও তাদের পরিবারের ছোট ছোট আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার পার্থক্যটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অনেক অভাবের মধ্যেও অল্পটুকু নিয়ে বাঁচতে জানে তারা। যেমন ঝিকিমিকি আলোয় মা-বাবার বাবিনকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধা বা মুচকি হেসে বলা, ‘ব্যথা তো, এই একটু আগেই ইঞ্জেকশন দিল না’। হ্যাঁ, মিথ্যে-মিথ্যে ইঞ্জেকশনের সত্যি-সত্যি ভাললাগাটুকু নিয়েই বাঁচতে জানে তারা। (Cinema)
চুল খুলে,পা ছড়িয়ে মুক্তির আকাশে চেয়ে দেখা কি টায়ারের মায়ের কাছে মার্সিডিজ চড়ার চেয়ে কম কিছু? কোনও মায়ের কাছেই কি কম কিছু?
এতগুলো মন-ছোঁয়া মুহূর্তের মধ্যেও যদি একটাই বেছে নিতে হয় তাহলে অবশ্যই নিজের বানানো ঠেলাগাড়িতে মাকে চাপিয়ে ইঞ্জিনিয়ার টায়ারের রাতভ্রমণ। পর্দায় কয়েক মিনিটের একচ্ছত্র মালিক মা-ছেলের জুটি। কয়েক মিনিটের জন্য যেন ওই রাতটাও তাদের, ওই রাস্তাটাও, ওই তারাগুলোও, এমনকি স্বপ্নটাও ওদের। চুল খুলে,পা ছড়িয়ে মুক্তির আকাশে চেয়ে দেখা কি টায়ারের মায়ের কাছে মার্সিডিজ চড়ার চেয়ে কম কিছু? কোনও মায়ের কাছেই কি কম কিছু? (Cinema)

গল্পটাই যাদের ঘিরে তারা অভিনয়ের প্রধান তিন স্তম্ভ। ঋদ্ধিমান, গীতশ্রী ও তপোময়। ক্যামেরার সামনে সাবলীল, যথার্থ। কোথাও কোথাও ঝাঁকুনি লাগেনি তা নয়, তবে সেই পোস্ট-মর্টেম করে অনাবিল আনন্দকে মাটি করার মানে হয় না। বাবিনের বাবার চরিত্রে শঙ্কর দেবনাথ অনবদ্য। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনমজুরি কাজের চাপ বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে, তাঁর অভিনয়ের খুঁটিনাটিতে। শাহরুখের চরিত্রে প্রসূন সোম দুরন্ত। ঘাবড়ে যাওয়া প্রেমিক হোক বা বাবিন-ডলি-টায়ারের ভরসার মুখ হোক, প্রসূন যে জাত অভিনেতা তা পদে পদে বুঝিয়ে দিয়েছে। টায়ারের মা দীপান্বিতা ও বাবিনের মা সঞ্জিতা দারুণ। পার্নো ও ঊষসী ঠিকঠাক। বাড়ি নিয়ে ফেরা যায় লগ্নজিতার গলায় ‘একটা গল্প বলো’। দুষ্টুমি মাখা বাংলা র্যাপ গোছের ‘চাপ নিয়ে লাভ নেই’ শুনতে ও দেখতে ভাল। বাকি মিউজিক নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। আর নিয়ে ফেরা যায় সৌরভ পালোধির গল্প বলার ধরন। (Cinema)
অঙ্কটা কিন্তু শেষমেশ মিলিয়েই দেয় তিনমূর্তি। কীভাবে? সেটা জানার জন্য একবার দেখে আসুন। ভাল লাগলে আবার দেখুন। তবেই তো হল বাড়বে, শো বাড়বে।
(Cinema) সৌরভের ছবিতে চোখ বন্ধ করে ভরসার জায়গা সংলাপ। প্রখর বুদ্ধির ছাপ, ভরপুর প্রাসঙ্গিকতা, নির্ভেজাল হাস্যরস, মনচুরি মুহূর্ত। ‘কলকাতায় কলম্বাস’ ছবিতে তার অনেকটাই স্বাদ পেয়েছিল দর্শক। এই ছবিতে খেলার মাঠ আরও বড়, পিচটাও মনের মতো। তাই প্রত্যেক বলেই ছক্কা হাঁকিয়েছে সৌরভ। কয়েকটি দৃশ্য বেশি মাত্রায় ‘স্ক্রিপ্টেড’ মনে হতে পারে। কয়েকটি ডায়লগের ভাঁজ খুদেদের মুখে ‘পাকা’ মনে হতে পারে। কিন্তু খুঁতখুঁতে হয়ে খুঁত ধরে ছবির নিষ্পাপ সারল্য ঘেঁটে লাভ নেই। অঙ্কটা কিন্তু শেষমেশ মিলিয়েই দেয় তিনমূর্তি। কীভাবে? সেটা জানার জন্য একবার দেখে আসুন। ভাল লাগলে আবার দেখুন। তবেই তো হল বাড়বে, শো বাড়বে। আসলে বড় বাজেটের সিনেমা হল পেতে পারে, বড় স্বপ্নের সিনেমা কি হল পেতে পারে না? যদি না পারে তাহলে স্বপ্নগুলো আর অবাধ্য হয়ে মাথাচাড়া দেবে না। না পারলে স্বপ্নগুলো জলাভূমির আলপথ বেয়ে হাঁটতে সাহস দেখাবে না। না পারলে স্বপ্নগুলো গলি থেকে রাজপথে ওঠার জেদ করবে না। আর পারলে? পারলে পিচগলা রাস্তার পাশেই হবে রোডোডেন্ড্রন ঝাঁক। সেই হলুদ পাখি আবার বসবে জামরুল গাছের ডালে, করবে ডাকাডাকি। (Cinema)
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
বিদ্যুৎক্ষেত্রে ১৫ বছরের ওপর কর্পোরেট কম্যুনিকেশন পেশাদার যার হৃদয় এখনও ইংরেজি সাহিত্য এবং সাংবাদিকতায় আটকে। দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া এবং দ্য ডেকান ক্রনিকল-এ কাজ করা এই প্রাক্তন সাংবাদিকের প্রথম প্রেম লেখালেখি, বই পড়া ও সিনেমা নিয়ে অবিরাম কথা বলা।