(Mrinal Mukhopadhyay)
ছুটি ছবির নায়ক মৃণাল মুখোপাধ্যায়কে আজও বাংলা ছবির দর্শকরা কি ভুলতে পেরেছে! তার সরল, নিষ্পাপ অভিব্যক্তি ছবিতে এক স্বতন্ত্রতা যোগ করেছিল। ছুটি সফল হওয়ার পরে অভিনয় জগতে আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তপন সিংহর এখনই, আপনজন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনিন্দিতা ইত্যাদি ছবিতেও তিনি সফল। অভিনয়ের পাশাপাশি মৃণালদা ছিলেন সুগায়ক। ভীষণ মিষ্টি গলা! রবীন্দ্রনাথের গান থেকে আধুনিক, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত সহ সব গানেই তিনি সাবলিল! (Mrinal Mukhopadhyay)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: নিমাইসাধন বসু
২০০০ সালে মৃণালদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ওঁর আনোয়ার শাহ রোড সংলগ্ন হরিপদ দত্ত লেনের বাড়িতে। উদ্দেশ্য, তপনদার বিষয়ে, মৃণালদার কাছ থেকে একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া। মৃণালদার তখনকার চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে, সেই চেহারার মধ্যে ছুটির অমলকে খুঁজতে গিয়ে হতাশ হতে হল। মনে ছিল না যে মাঝখানে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর! (Mrinal Mukhopadhyay)

তপনদার কথা বলতে গিয়ে ‘আপনজন’ আর ‘এখনই’ ছবির দুটো গানের কয়েক কলি গাইলেন। বুঝলাম চেহারায় পরিবর্তন হলেও গানের গলাটি আগের মতো সেরকমই মিষ্টি রয়েছে। ওঁকে বলেও ফেললাম সেই কথা। আসার আগে বললেন যেন যোগাযোগ রাখি। এরপর অনেক বছর দেখা-সাক্ষাৎ নেই, ততদিনে কলকাতার একটি সংবাদপত্রে যোগ দিয়েছি। (Mrinal Mukhopadhyay)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: অলোক আলপনায়
আমার এক দাদা শৈবাল পত্রনবীশ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, এই সংবাদপত্রের কতৃপক্ষর সঙ্গে। উনি নিজেও নিয়মিত সেখানে লিখতেন। অতীতের বাংলা ছবির বিষয়ে লেখার কথা উঠতে মৃণালদার প্রসঙ্গ এল। আমি জানালাম কয়েক বছর আগে মৃণালদার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল কিন্তু বর্তমানে উনি কোথায় থাকেন জানি না আর ওঁর ফোন নম্বরটাও হারিয়ে ফেলেছি। শৈবালদা বলে উঠলেন, ‘মৃণাল তো আমার ভীষণ বন্ধু, ফোন নম্বরও রয়েছে, এখন লেক গার্ডেনসে থাকে, একদিন ফোন করে ওঁকে আর ওঁর স্ত্রীকে বাড়িতে আসতে বলব।’ হাতে চাঁদ পাওয়া গেল! একদিন মৃণালদা সস্ত্রীক এলেন, ওঁর সঙ্গে কথোপকথন রেকর্ড করার পরিকল্পনা থাকলেও সেসব প্রসঙ্গ কোথায় হারিয়ে গেল! (Mrinal Mukhopadhyay)
আমার কন্যা মৃণালদার কাছে আবদার করে বসল ‘এখনই’ ছবির, ‘বন্ধু তোমার আসার আশাতে’ গানটি শোনাতে। মৃণালদা, ওঁর দরাজ আর মিষ্টি গলায় তখনই গানটা শুনিয়ে দিলেন। আমার অনুরোধে শোনালেন ‘ছুটি’ ছবিতে ব্যবহৃত, ‘এই লভীনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর’।
কিছু কথার পরে গান শুধু গান। তার মধ্যে আমার কন্যা মৃণালদার কাছে আবদার করে বসল ‘এখনই’ ছবির, ‘বন্ধু তোমার আসার আশাতে’ গানটি শোনাতে। মৃণালদা, ওঁর দরাজ আর মিষ্টি গলায় তখনই গানটা শুনিয়ে দিলেন। আমার অনুরোধে শোনালেন ‘ছুটি’ ছবিতে ব্যবহৃত, ‘এই লভীনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর’। সেদিন গল্পের থেকে গানই বেশি হল। সেদিনের পর থেকে মৃণালদার গানের আসর যেন আমাদের কাছে নেশার মতো হয়ে গেল। কখনও শৈবালদার বাড়ি আবার কখনও মৃণালদার বাড়িতে নিয়মিত বসা হত শুধুমাত্র গানের জন্যই! আমি প্রায়ই মৃণালদাকে বলতাম, ‘অভিনয় করছেন, করুন কিন্তু আপনার গানের একটা সিডি বের করুন।’ (Mrinal Mukhopadhyay)

মৃণালদারও ইচ্ছে ছিল কিন্তু কেন যে হয়নি জানি না! আর একটা মজার ব্যাপার হল, মৃণালদা ভাল হাত দেখতে পারতেন। বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের কত অজানা গল্প বলতেন। সেই সময় আমার নিজের গাড়ি ছিল না, তাই গান আর গল্পে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে মধ্যরাত্রির দিকে এগোলে মৃণালদা নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের কতদিন বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন। আমার মামারবাড়িতে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানেও একবার মৃণালদাকে বলেছিলাম যেতে, উনি গিয়েছিলেন। (Mrinal Mukhopadhyay)
মনে আছে বৈশাখের সন্ধ্যায় ওঁর গাওয়া ‘তবু মনে রেখ’ গানটি সেদিন সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। আজও আমার মুঠোফোনে মৃণালদার সেই গানটি ধরা আছে।
মনে আছে বৈশাখের সন্ধ্যায় ওঁর গাওয়া ‘তবু মনে রেখ’ গানটি সেদিন সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। আজও আমার মুঠোফোনে মৃণালদার সেই গানটি ধরা আছে। খারাপ লাগে ভাবতে যে একসময় যিনি, ‘অনিন্দিতা’, ‘আপনজন’, ‘এখনই’, ‘শঙ্খবেলা’-র মতো ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তাঁকে শেষ জীবনে নিম্নরুচির বাংলা ছবিতে ভিলেনের অভিনয় করতে হত! (Mrinal Mukhopadhyay)
ভাল কোনও রোল ওঁর কপালে জোটেনি! পরের বৈশাখে যখন লোকসভা নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করতে ব্যস্ত ছিলাম, সেই সময়ই অক্ষয়তৃতীয়ার শুভদিনে মৃণালদা আমাদের সবার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেলেন। আজ মাঝে-মাঝে তাঁর কণ্ঠে যেন শুনতে পাই, ‘আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি।’ (Mrinal Mukhopadhyay)
ছবি সৌজন্য- লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ
মুদ্রিত ও ডিজিটাল ভার্শনে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।