(Charlie Chaplin)
এই ছবির জন্যই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতে চান মানুষের মনে- বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘দি গোল্ড রাশ’ মুক্তির সময়ে এমনটাই ঘোষণা করেছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। সোনার সন্ধানের সঙ্গেই মানুষের সীমাহীন লালসা, তীব্র ক্ষুধা এবং মানবিকতার চূড়ান্ত অবনতির বিষয়টি তীব্র কষাঘাতে তিনি তুলে ধরেছিলেন এই কালজয়ী চলচ্চিত্রে। ছবিতে চ্যাপলিন নিজে তাঁর পরিচিত সেই ‘লিটল ট্রাম্প’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকে। (Charlie Chaplin)

সঙ্গে সহ অভিনেতা ছিলেন জর্জিয়া হেল, ম্যাক সোয়েন, টম মারে, হেনরি বার্গম্যান এবং ম্যালকম ওয়েট। চ্যাপলিন নিজে বিশ্বাস করতেন ট্র্যাজেডি এবং কমেডি- একে অপরের পরিপূরক, সেজন্য আপাত কমেডির মোড়কে তিনি অভাব, বঞ্চনা এবং ভয়াবহতার কথা তুলে ধরেছিলেন এই ছবিতে। সেই কারণে ‘দি গোল্ড রাশ’ কমেডি হয়েও মানুষের নির্মম এক ইতিহাসের দলিল হয়ে ওঠে। (Charlie Chaplin)
আরও পড়ুন: বিশ্বনাগরিক চার্লি চ্যাপলিন
‘দি গোল্ড রাশ’ চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়েছিল, ১৯২৫এর ২৬ জুন, হলিউডের নবনির্মিত এক অসাধারণ থিয়েটার হল গ্রুম্যান’স ইজ়িপশিয়ান-এ। চ্যাপলিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিড গ্রুম্যান তাঁর নিজস্ব এই হলটি সাজিয়েছিলেন প্রাচীন মিশরীয় স্টাইলে, সেই সময়ে তুতেনখামেনের পিরামিড সমাধির যুগান্তকারী আবিষ্কারের খবরে অনুপ্রাণিত হয়ে। (Charlie Chaplin)
গ্রুম্যান সবসময়ই চ্যাপলিনের পাশে থেকেছেন প্রকৃত বন্ধুর মতো। সেদিনও তিনি মনের মতো করে সাজিয়েছিলেন বন্ধুর চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার অনুষ্ঠান পর্বটি। এবছরের ২৬ জুন এই চলচ্চিত্রের শতবর্ষপূর্তি। (Charlie Chaplin)
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানা সময়ে স্বর্ণ রেণুর সন্ধানে পাগলের মতো ছুটেছিল মানুষজন। ক্রমাগত লোভ এবং লাভের কথা ভেবে সৃষ্টি হয়েছিল চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা, বর্বরতা। তবে সব ক্ষেত্রেই যে সেটি মাত্রা ছাড়িয়েছিল, এমনটা নয়! এক্ষেত্রে মনে পড়তে পারে আর এক হলিউডি ব্লকবাস্টার ছবি ‘ম্যাকেনাস্ গোল্ড’ এর কথা। চ্যাপলিনের অভ্যেস ছিল, নানা ধরণের সংবাদ পাঠ করতেন, নিয়মিত। (Charlie Chaplin)
“সোনার সন্ধানের সঙ্গেই মানুষের সীমাহীন লালসা, তীব্র ক্ষুধা এবং মানবিকতার চূড়ান্ত অবনতির বিষয়টি তীব্র কষাঘাতে তিনি তুলে ধরেছিলেন এই কালজয়ী চলচ্চিত্রে।”
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা যায়, এই ধরণের স্বর্ণ সন্ধান বা গোল্ড রাশ হয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়। এরমধ্যে বিখ্যাত হয়ে আছে অস্ট্রেলিয়া গোল্ড রাশ (১৮৫১), কারিবু গোল্ড রাশ (১৮৬০) এবং ক্যানাডার ক্লোনডাইক গোল্ড রাশ (১৮৯৬) ইত্যাদি। এই ক্লোনডাইক গোল্ড রাশের কিছু স্টিরিওস্কোপ ছবি দেখে চ্যাপলিন প্রথম একটি ছবি তৈরির কথা ভেবেছিলেন। তবে সেটা হবে আদ্যন্ত কমেডি। ইতিমধ্যে সিয়েরা নেভাদায় অভুক্ত শ্রমিকদের মৃত মানুষের দেহাংশ বা জুতোর চামড়া সেদ্ধ করে খাওয়ার খবর তিনি জানতে পারেন। সেই মুহূর্তে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তাঁর পরিচিত ‘ট্রাম্প’ চরিত্রটিকে তিনি সোনা সন্ধানকারী হিসেবে তুলে ধরবেন। এবং এরমধ্যে দিয়েই তিনি অর্থ, সম্পত্তি, জীবন ধারণ, লালসা, সংঘাত এবং ভুখা মানুষের তীব্র যন্ত্রণাকে প্রতিবিম্বিত করবেন ছবিতে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি পর্ব। দুই মাসের মধ্যে ছবির কপিরাইট পাওয়ার আবেদন করেন তিনি। এবং ছবির শুটিং-এর জন্য স্টুডিয়ো প্রস্তুতির প্রয়োজনীয় কাজ শুরু করেন তিনি। (Charlie Chaplin)

তাঁর ছবিটি ক্যালিফোর্নিয়ায় সোনার সন্ধানের ইতিহাস অবলম্বনে তৈরি। স্যাক্রামেন্টো থেকে ৮০ কিলোমিটার পূর্বে এক স্থানে, জলচালিত একটি করাতকল নির্মাণের সময় পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে সোনার কণার সন্ধান পান জন সাটার। আসলে ২৪ জানুয়ারি এই সন্ধানটি পেয়েছিল তাঁর কাঠমিস্ত্রী জেমস মার্শাল। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন দু’জনে মিলে এই সোনার সন্ধান ও সঞ্চয় করে বাজারজাত করবেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে দ্রুত দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। ফলে দূরদূরান্ত থেকে ভাগ্যসন্ধানীরা সেখানে দলে দলে আসতে থাকে ১৮৪৮এর শুরুতে। অগণিত মানুষ এসে সাটারের সম্পত্তি দখল করে, তাঁর পোষা প্রাণী ধ্বংস করে তাঁকে পথে বসিয়ে ছাড়ে। যার জন্য ১৮৫২এ তিনি দেউলিয়া হয়ে পড়েন। (Charlie Chaplin)
কলেরা দেখা দিয়েছিল অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য। সেখানে সোনা পাওয়া গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু হঠাৎ করে এত লোকের চাপ সামলাতে পারেনি সেই ছোট জনপদটি। ফলে অস্থায়ী ক্যাম্পগুলিতে একেবারে আদিম মানুষের মতো বসবাস করতে হয়েছিল সোনা খননকারীদের। খবরে প্রকাশ, সে সময় এখানে প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ এসে জড়ো হয়েছিল। একদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অন্যদিকে তীব্র ক্ষুধা– অবস্থা ক্রমেই প্রতিকুল হয়ে ওঠে। লুটপাট, অব্যবস্থা, রোগব্যাধি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে চূড়ান্ত অব্যবস্থা শুরু হয়। পরে আইনি পদক্ষেপে নিয়ন্ত্রণ আসে। (Charlie Chaplin)
আরও পড়ুন: চিরচেনা ভবঘুরে, অচেনা চ্যাপলিন- জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ (১৮৮৯-১৯৭৭)
এ ঘটনা এই রাজ্যের ওপরে ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। কারণ এটিই ক্যালিফোর্নিয়াকে রাজ্যের মর্যাদা দেয় ১৮৫০এ। ক্যালিফোর্নিয়ার স্বর্ণ খনন শীর্ষে পৌঁছায় ১৮৫২এ এবং এক দশকের মধ্যে ভাঁটা পরে এটি শেষ হয়ে যায়। সোনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর পরিত্যক্ত খনি শিবিরগুলি পরিণত হয় এক ভূতুরে শহরে। (Charlie Chaplin)
এই ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে চ্যাপলিনের নিজের রচনা, প্রযোজনা, পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘দি গোল্ড রাশ’ চলচ্চিত্রটি। ১৯২৪ সালের গোড়ার দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রাকির কাছের লোকেশনে চ্যাপলিন এই ছবির বহু দৃশ্যের শুটিং করেছিলেন। দুই সপ্তাহ ধরে তাঁর শুটিং ইউনিটটি সিয়েরা নেভাদার তুষারভূমিতে অবস্থিত ট্রাকির লোকেশনে শুটিং করেছিল। ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে এখানকার চিলকুট পাসে চ্যাপলিন সেই সব হতভাগ্য শ্রমিকদের লড়াইয়ের ঐতিহাসিক চিত্রটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। (Charlie Chaplin)

এজন্য প্রায় ছয় শতাধিক অতিরিক্ত ব্যক্তি (চলচ্চিত্রের ভাষায় যাদের ‘এক্সট্রা’ বলা হয়ে থাকে সিয়েরা নেভাদার সেই পাহাড়ি তুষারপাতের মধ্য দিয়ে ২৩০০ ফুট উঁচু গিরিপথে আরোহণ করে শুটিং সম্পন্ন করেছিলেন। ছবির বাকি অংশের শুটিং করা হয়েছিল হলিউডের স্টুডিওতে। এই হলিউড স্টুডিয়োতে কাঠ, মোটা কাপড়, প্লাস্টার, ময়দা আর লবণ দিয়ে অবিশ্বাস্য একটি পাহাড়ের সেট তৈরি করে তাক লাগিয়েছিলেন সেট নির্মাণ শিল্পীরা। ক্যালিফোর্নিয়ার গ্রীষ্মের তীব্র রোদে সেই বরফাবৃত পর্বতশ্রেণিতে আলাস্কার তুষারদৃশ্য সত্যি অসাধারণ হয়ে উঠেছিল বড় পর্দায়। কে বলবে সেটি নকল! ১৯৪২এ ছবিটির বেশ কিছু অংশ বাদ দিয়ে, নিজস্ব ধারাবিবরণী যুক্ত করে ছবিটির একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেন তিনি। (Charlie Chaplin)
ছবিটি পুনঃপ্রকাশের সময় চ্যাপলিন একটি অসাধারণ অর্কেস্ট্রার সুর নির্মাণ করে যোগ করেছিলেন। এই সময়েই সংযোজিত হয় তাঁর নিজ কণ্ঠে একটি ভাষ্য-পাঠ।
ছবিটি পুনঃপ্রকাশের সময় চ্যাপলিন একটি অসাধারণ অর্কেস্ট্রার সুর নির্মাণ করে যোগ করেছিলেন। এই সময়েই সংযোজিত হয় তাঁর নিজ কণ্ঠে একটি ভাষ্য-পাঠ। আর জর্জিয়ার সঙ্গে যে মিলন এবং চুম্বন দৃশ্য ছিল সেটি বদলে দিয়ে পরিবর্তে যোগ করেছিলেন সেই দম্পতির হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলে যাওয়ার অবিস্মরণীয় দৃশ্য। (Charlie Chaplin)
এই ছবির প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, চ্যাপলিন সাধারণত ব্যক্তিগত জীবনকে তাঁর কাজের ক্ষেত্রে থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন।
এই ছবির প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, চ্যাপলিন সাধারণত ব্যক্তিগত জীবনকে তাঁর কাজের ক্ষেত্রে থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন। লিটা গ্রেকে (যিনি ১২ বছর বয়সে ‘দ্য কিড’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন) ‘দি গোল্ড রাশ’ ছবির প্রধান নারী চরিত্রে পছন্দ করেছিলেন চ্যাপলিন। লিটা তখন ১৬ বছরের কিশোরী। কিন্তু চ্যাপলিন তাঁর সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং লিটা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে ১৯২৪ সালের নভেম্বরে তাঁদের বিয়ে হয়। ফলে ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায় তিন মাসের জন্য। এবং সন্ধান চলতে থাকে নতুন মুখের। এই সময় জর্জিয়া হেল নামের ২৪ বছর বয়সী এক মডেলের সন্ধান পাওয়া যায়। সেই সময়ের একটি ছবির কাজ দেখে চ্যাপলিন তাঁকেই নির্বাচন করেন। লিটা গ্রে অবশ্য ছবিতে এক অতিরিক্ত চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। (Charlie Chaplin)
উল্লেখ্য, এবছর ২৫ জুন নায়িকা জর্জিয়া হেলেরও ১২৫তম জন্মবার্ষিকী।

সিনেমার ইতিহাসে ‘দি গোল্ড রাশ’, পঞ্চম সর্বোচ্চ লাভপ্রদানকারী নির্বাক ছবি হিসেবে স্বীকৃত। ১৯২৬এ বক্স অফিসের হিসেবে এটি আয় করেছিল প্রায় ৪২ লক্ষ ডলার। চ্যাপলিনের নিজস্ব আয় ছিল ২ মিলিয়ন ডলার। ছবিটি প্রকাশের ২৮তম বছরেও এর কপিরাইট নিবন্ধন পুনর্নবীকরণ করা হয়নি দাবিদারদের পক্ষ থেকে, ফলে ১৯৫৩য় (ছবিটির মূল ১৯২৫ সালের সংস্করণটি) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক ডোমেইনে প্রবেশ করে। মূল ছবিটি ছিল দুষ্প্রাপ্য। সম্প্রতি ক্রাইটেরিয়ান এবং ইতালির ‘সিনেটেকা দি বোলোনা’র যৌথ উদ্যোগে মূল সংস্করণটির পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে। মার্কিন জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রিতে- সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং নান্দনিক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ছবিটি অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৯২তে। (Charlie Chaplin)
শতবর্ষ পেরিয়ে নবকলেবরে অনবদ্য ‘দি গোল্ড রাশ’-এর অভিযাত্রা আর এক শতবর্ষের দিকে।
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
তথ্য ও চিত্র কৃতজ্ঞতা
লিঙ্ক:
https://www.charliechaplin.com/
https://www.britannica.com/
সংবাদিক, শিল্পী, সংগ্রাহক, সংগ্রহশালা পরামর্শদাতা।
প্রকাশিত গ্রন্থ: কলকাতার সংগ্রহালয়