Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

কলোনির রাহুল, রাহুলের কলোনি: এক অচ্ছেদ্য বোঝাপড়া

তন্ময় ভট্টাচার্য

আগস্ট ১, ২০২৫

Rahul Purakayastha
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close
(Rahul Purakayastha)

যে-এলাকায় বড় হয়ে ওঠা রাহুল পুরকায়স্থর, তা এককালে ছিল ফায়ারিং প্র্যাকটিসের ঠিকানা।

বাক্যটি পড়ে ধন্দ লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাসে উঁকি দিলে, স্পষ্ট হয়ে ওঠে পুরোটাই। জায়গাটা ছিল ব্রিটিশদের চাঁদমারি। চলতি নাম ‘টার্গেট ময়দান’। স্বাধীনতা তথা দেশভাগের পর সেই পরিত্যক্ত চাঁদমারিতেই গড়ে ওঠে কলোনি, নাম হয় ‘যতীনদাস নগর’। কলোনি গঠনেরও প্রায় দেড়যুগ পর, ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে সেখানে বাড়ি ভাড়া নেয় কবির পরিবার। ছেলেবেলায় খেলাধুলোর পরিসরে, কখনও ফাঁকা কার্তুজ কুড়িয়ে পেয়েছিলেন কী না তিনি, আমরা জানি না। তবে কলোনি তাঁর জীবন ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে অচ্ছেদ্য, এ-কথা সমালোচকেরা বলে থাকেন প্রায়ই। এ-লেখায় কলোনির সঙ্গে রাহুলের নিজস্ব বোঝাপড়ার সূত্রটুকুই বুঝতে চাইব আমরা। (Rahul Purakayastha)

আরও পড়ুন: রাহুল পুরকায়স্থ: সময়, শূন্যতা ও দেহপাঠাগার

বেলঘরিয়া স্টেশনের পূর্বদিকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে, উনিশ শতকে রাইফেল রেঞ্জ তথা চাঁদমারি গড়ে তোলে ব্রিটিশরা। মূলত সেনাবাহিনীর টার্গেট প্র্যাকটিসের ঠিকানা হলেও, ক্ষেত্রবিশেষে সুযোগ পেতেন ভারতীয়রাও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, ১৯১৮ সালে খোদ সুভাষচন্দ্র বসুও টার্গেট প্র্যাকটিস করতে এসেছেন, থেকেছেন বেলঘরিয়ার চাঁদমারি ক্যাম্পে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিত্যক্ত হয় সেই চাঁদমারি। সেখানে ও সংলগ্ন জমিতে ১৯৪৯ সালের ২২ অক্টোবর পত্তন হয় ‘শহীদ আশ্রয় শিবির’ নামক কলোনির। ১৯৫০ সালে, সেই নাম বদলে রাখা হয় ‘যতীনদাস নগর’। (Rahul Purakayastha)

Rahul Purakayastha
১৯৪২ সালের মানচিত্রে বেলঘরিয়ার রাইফেল রেঞ্জ ওরফে চাঁদমারি

রাহুল পুরকায়স্থের পরিবার সিলেটের। দেশভাগের পর, আসাম-সহ বিভিন্ন জায়গায় জীবন কাটান তাঁরা। ১৯৬৪ সালের ৬ ডিসেম্বর কলকাতায় জন্ম রাহুলের। তারপর গোড়ার কয়েক বছর আসামে কাটলেও, রাহুলের শৈশবাবস্থাতেই তাঁর পরিবার বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে আসে যতীনদাস নগরের ১ নং ব্লকে। সেখানেই বড় হয়ে ওঠা, স্কুলজীবন পর্যন্ত ঠিকানা সেই বাড়িই। পড়াশোনা যতীনদাস বিদ্যামন্দিরে। শৈশব থেকে আঠেরো বছর বয়স অবধি রাহুল কাটিয়েছেন কলোনির ভেতরে, কাছ থেকে দেখেছেন সে-জীবন। দেখেছেন তৎকালীন রাজনৈতিক চাপান-উতোরও। বড় হয়েছেন ইনু মিত্তির-ননী সাহা তথা কংগ্রেস-সিপিএমের সংঘর্ষের কাহিনি শুনে। (Rahul Purakayastha)

“২০০৭-এ বেলঘরিয়ার অপর প্রান্তে, নীলগঞ্জ রোডে নিজস্ব ফ্ল্যাটে আগমন। একেবারে শেষ পর্বে, ২০২৩-এ বেলঘরিয়াতেই, বিটি রোডের অপর পাড়ে একটি হাউজিং কমপ্লেক্সে স্থানান্তর।”

কৈশোরে মিথের মতো ভেসে এসেছে নকশালদের একের পর এক কাহিনি। পরিচিত হয়েছেন নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কলোনির বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে। ’৭৯ সালে, বেলঘরিয়া স্টেশনের কাছে যখন স্থানীয় ও আশেপাশের এলাকার নিহত নকশালদের নিয়ে তৈরি হচ্ছে শহিদ বেদি, তারও সাক্ষী ছিলেন তিনি! কালক্রমে সে-ভাবধারার প্রতি দুর্বলতাও জন্মেছিল, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ২০১৭ সালে তাঁর সম্পাদিত কবিতা সংকলন ‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা’। (Rahul Purakayastha)

Rahul Purakayastha
‘উত্তরায়ণ’, ১/২৯ যতীনদাস নগর, কলোনির যে-বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকতেন রাহুল পুরকায়স্থ

উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর রাহুলের পরিবার বাড়ি ভাড়া নেয় কলোনিসীমার বাইরে, কিন্তু কাছেই— বেলঘরিয়ার গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার-সংলগ্ন এলাকায়। অতঃপর, সেখানে দু-দশকের বেশি বসবাস। তারপর, ২০০৭-এ বেলঘরিয়ার অপর প্রান্তে, নীলগঞ্জ রোডে নিজস্ব ফ্ল্যাটে আগমন। একেবারে শেষ পর্বে, ২০২৩-এ বেলঘরিয়াতেই, বিটি রোডের অপর পাড়ে একটি হাউজিং কমপ্লেক্সে স্থানান্তর। ফলে, শৈশব থেকে আজীবন বেলঘরিয়ার চৌহদ্দির মধ্যেই কেটেছে তাঁর। একটা সময় পর কলোনির বাসিন্দা না-হলেও যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি কোনওদিনই। বেলঘরিয়াকে কেন্দ্র করে চার প্রান্তে যে-চারটি কলোনি গড়ে উঠেছিল (নন্দননগর, যতীনদাস নগর, দেশপ্রিয় নগর ও প্রফুল্লনগর), সেগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিকভাবে অগ্রণী ছিল যতীনদাস নগরই। কলোনিজীবন, রাজনৈতিক আবহের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যেও রাহুলের দীক্ষা সেখানেই। আজীবন স্বীকার করেছেন সেই ঋণ, এমনকি, বিভিন্ন আড্ডাতেও ফিরে এসেছে সেখানকার স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা। (Rahul Purakayastha)

Rahul Purakayastha
রাহুল পুরকায়স্থ, ২০১৬

এই প্রসঙ্গে, ২০১৬ সালে রাহুলের একটি লেখার অংশ উল্লেখযোগ্য— ‘…তা প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর তো হবেই আমি এই অঞ্চলে আছি। জীবনের একটি বড়ো অধ্যায়ে যতীনদাস নগর ও তার আশেপাশে কাটিয়ে আপাতত নোঙর ফেলেছি নীলগঞ্জ রোডে। ছোটোবেলা থেকেই এই অঞ্চল, এর মানুষজন, শিল্প-সংস্কৃতিতে আমার মন। একসময় বেলঘরিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী যতীনদাস নগরের ইতিহাস-উপাদান সংগ্রহেও মন দিয়েছিলাম। শ্রদ্ধেয় কালীপ্রসাদ রায়চৌধুরী এ-কাজে পাশে ছিলেন। কিন্তু আমার যা হয়, মাঝপথের অনেক আগেই কাজটা বন্ধ হয়ে যায়।’ (Rahul Purakayastha)

সমালোচকেরা যখন রাহুলের কলোনিজীবনের প্রসঙ্গ আনেন, ইতিহাস ও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়। তাঁর কবিতায় উঁকি দিলেও বিভিন্ন সময়ে তা উঠে আসে টুকরো-টুকরো পরিসরে। ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘কলোনির কবিতা’ শীর্ষক গ্রন্থ এ-বিষয়ে বেশ-কিছু উদাহরণ তুলে ধরে। তবে এ-কথা পাঠকমাত্রেই জানেন যে, তাঁর কবিতা সঙ্কেতধর্মী, ইঙ্গিতময়। ফলে বিবরণ কুড়িয়ে পাওয়া ও তার সঙ্গে বাস্তবের সংযোগস্থাপনের চেষ্টা বেশ কঠিন। তদুপরি দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সব কলোনিরই প্রাথমিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যগুলি এক। ফলে, রাহুলের কবিতায় কলোনি-প্রসঙ্গ তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত হলেও, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমা পেরিয়ে তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।

Rahul Purakayastha
কলোনির কবিতা, ২০০৯

রাহুল লেখেন—
‘এখন দখিন খোলা
হাওয়া বহে
দোলা দেয় স্মৃতির আরক
শহর বদল হয় দ্রুত মফস্‌সলে
কলোনিরা জেগে ওঠে
চরিতেরা জাগে’


আবার, অন্যত্র উঠে আসে দেশভাগের প্রসঙ্গও—
‘দেখেছি স্মৃতির ভাঁজে
              দেশভাগ
যদিও তা সম্যক দেখিনি’

এই দুটি কবিতাংশেই ‘স্মৃতি’ এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অন্যত্র রাহুল লিখেছিলেন— ‘স্মৃতিই সংস্কৃতি। যার স্মৃতি নাই তার সংস্কৃতিও নাই।’ এই স্মৃতিই ফিরে-ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। উঠে এসেছে কলোনিজীবন, দারিদ্র্য, মা-বাবার প্রসঙ্গ, পরিপার্শ্ব। আবার, প্রত্যক্ষ উল্লেখ না-থাকায় নিশ্চিত দাবি করা না-গেলেও বেশ অনুমিত হয়, তাঁর অন্যান্য কবিতাতেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এসব অভিজ্ঞতা।(Rahul Purakayastha)

ষাট-সত্তরের যতীনদাস নগর, প্রাথমিক টানাপোড়েন ও অস্তিত্ব-সংকট পেরিয়ে ধীরে-ধীরে স্থায়িত্বের দিকে এগোনো এক কলোনি। তবে বেশিরভাগ পরিবারই প্রথম প্রজন্মের উদ্বাস্তু হওয়ায়, আর্থিক স্থিতি আসেনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। রাহুলের শৈশবও কেটেছে সেই দারিদ্র্যের ভেতরেই। তিনি নিজে উদ্বাস্তু না-হলেও, পরিবারের সঙ্গে কলোনিজীবন দেখেছেন গোড়া থেকেই। বেড়ে উঠেছেন সেই আবহে। ঘরছাড়া একদল মানুষের পারস্পরিক বোঝাপড়া, সুখ-দুঃখের আদানপ্রদান, সর্বোপরি স্মৃতি তাঁকে পুষ্ট করেছে। তাই তিনি লেখেন— (Rahul Purakayastha)

“দেশভাগের দু-দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে তখন। তবু বিচ্ছিন্নতা নয়, কলোনিতে নবাগত তাঁর পরিবার মিশে গিয়েছিল অনায়াসেই।”

‘কলোনির উনুনেরা একসাথে জ্বলে ওঠে
একইসাথে নেভে
টিউকল টেপে এক, জল ধরে আরও একজন’


যতীনদাস নগর কলোনি গড়ে ওঠার সঙ্গে রাহুলের পরিবার যুক্ত ছিল না। বরং সেই কলোনিরই এক বাসিন্দার বাড়ি ভাড়া নেন তাঁরা। দেশভাগের দু-দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে তখন। তবু বিচ্ছিন্নতা নয়, কলোনিতে নবাগত তাঁর পরিবার মিশে গিয়েছিল অনায়াসেই। সে-জন্যেই বাসিন্দাদের যৌথ দিনযাপন, যা এক অর্থে আত্মীয়তারই নামান্তর— কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন রাহুল। (Rahul Purakayastha)

‘গ্রীষ্মের দুপুরে এজমালি টিউবয়েলের
পাশে আমার কলোনি
এ বাড়িতে ভাত রাঁধা হলে ও বাড়িতে নড়ে শিরদাঁড়া…’


প্রত্যেক পরিবারের উনুনের একসঙ্গে জ্বলে ওঠা ও নেভার মধ্যে যে যৌথতার ইঙ্গিত, তা খানিক ভিন্নভাবে ধরা দিল দ্বিতীয় টুকরোতে। ‘এ বাড়িতে ভাত রাঁধা হলে ও বাড়িতে নড়ে শিরদাঁড়া’— কেন? ভাতের গন্ধে। উপার্জনের আকাঙ্ক্ষায়। কলোনির মানুষের অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও সম্পন্নতার ফারাকের ছবি এ-লাইনে। রাহুল না-লিখলেও আমার ধারণা, যে-পরিবার অভুক্ত, ঘ্রাণে চঞ্চল, পাশের বাড়ি থেকে খানিক খাবার পৌঁছে যেত সেখানেও। (Rahul Purakayastha)

“দ্বাস্তু হয়ে-আসা প্রথম প্রজন্মের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির বিষয়ে আমরা কমবেশি সকলেই অবগত। বলা বাহুল্য, রাহুলও বড় হয়েছিলেন সেইসব শুনেই।”

‘মৃত্যুর আগে আমার বাবা যখন দেশের বাড়ির গল্প বলতেন
বলতে চাইতেন ৪৭, দেশভাগ, কোনোক্রমে পালিয়ে আসা…
তার চোখেও তো এমনই একটি পাখি বসত
ডাকত, কা-কা, কাক, কলোনির কাক’
(Rahul Purakayastha)

বাবার (রবীন্দ্রনাথ পুরকায়স্থ) মৃত্যুদিন, ‘৯ ভাদ্র ৯৫’, রাহুল পুরকায়স্থের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম। উদ্বাস্তু হয়ে-আসা প্রথম প্রজন্মের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির বিষয়ে আমরা কমবেশি সকলেই অবগত। বলা বাহুল্য, রাহুলও বড় হয়েছিলেন সেইসব শুনেই। না-দেখা সিলেট তাঁর কাছে ধরা দিত বাবার সূত্রে। উঠে আসত দেশভাগ ও পলায়নের দিনগুলি। বিষণ্ণ ও স্মৃতিমেদুর বাবার চোখে পাখি এসে বসত, ডেকে উঠত। সেই পাখি, কলোনির কাক। সেই ডাক, কা-কা, মৃত্যুদূতের কি? দেশভাগ-পূর্ববর্তী জীবন থেকে শুরু করে, কলোনিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা এক বৃদ্ধের জীবনরেখা ফুটিয়ে তুলেছেন রাহুল, এই ক’টি লাইনের ভিতরে। (Rahul Purakayastha)

তবে শুধু কলোনিই নয়, ভিন্ন অথচ বেলঘরিয়ার অপর একটি প্রসঙ্গও উঠে এসেছিল রাহুল পুরকায়স্থের দুটি কবিতায়। সেই অংশগুলি, পরপর দেখে নেওয়া যাক—

‘যন্ত্রণার কাছে, দূরে, কাছে
মোহিনীমিলের ভাঙা মেশিনের ছায়া
বস্ত্রবিপণির ছায়া, ছেঁড়া গামছার ছায়া
শ্রমিকের কালো কুচো ছায়া ঝুঁকে আছে’

এবং,
‘মোহিনীমিলের পাশে
বন্ধ কারখানাটির পাশে
        মহিষেরা ডাকে
গাই ও বাছুর ডাকে’
(Rahul Purakayastha)

“মোহিনীমিলকে ঘিরে যে-বাস্তুতন্ত্র এককালে গড়ে উঠেছিল বেলঘরিয়ায়, তার শেষ চিহ্নগুলি, মিলের ক্ষয়াটে চেহারা সহ, রয়ে গেছে আজও। রয়ে গেছে রাহুলের কবিতাতেও।”

‘মোহিনীমিল’ শব্দটি ইশারা ও ইঙ্গিত হিসেবে অমোঘ। অজানা পাঠক হয়তো মিল অর্থাৎ কারখানার আগে ‘মোহিনী’ শব্দের উপস্থিতিকে একটি তুখোড় প্রয়োগ হিসেবে ধরে নেবেন। কিন্তু বেলঘরিয়ার বাসিন্দারা জানেন মোহিনীমিলের কথা। একসময় বাংলার অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাপড়ের মিল এটি। ১ নং মোহিনীমিল তৈরি হয় কুষ্টিয়ায়, ১৯০৮ সালে। আর ২ নং মোহিনীমিল, ১৯৩৮-এ, বেলঘরিয়ায়। যতীনদাস নগর থেকে খুব দূরত্ব নয় এর। রাহুল শৈশব-কৈশোরে দেখেছেন সেই মিলের রমরমা, শুনেছেন ভোঁ। সত্তরের দশক থেকে ধুঁকতে থাকা ও নব্বইয়ের গোড়ায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া এই বিশাল মিলের গতিপ্রকৃতিও তাঁর অজানা নয়। তাই তিনি লিখতে পারেন সেই অঞ্চলের বিন্যাস ও পরিণতি— ‘মোহিনীমিলের ভাঙা মেশিনের ছায়া/ বস্ত্রবিপণির ছায়া, ছেঁড়া গামছার ছায়া/ শ্রমিকের কালো কুচো ছায়া ঝুঁকে আছে’। মেশিনগুলি আজ অন্তর্হিত। (Rahul Purakayastha)

মোহিনীমিল বন্ধ হওয়ার পর, তাদের নিজস্ব বস্ত্রবিপণিও লুপ্ত। সারি-সারি স্টাফ কোয়ার্টারে আজ শুধু দরিদ্র, কাজ-হারানো শ্রমিকদের পরিবার। ভঙ্গুর সেই কাঠামোয় হলুদ বাল্ব, ঝুলতে-থাকা শাড়ি, দেওয়ালের ফাটল ইঙ্গিত দেয় তাঁদের দৈনন্দিন লড়াইয়ের। মোহিনীমিলকে ঘিরে যে-বাস্তুতন্ত্র এককালে গড়ে উঠেছিল বেলঘরিয়ায়, তার শেষ চিহ্নগুলি, মিলের ক্ষয়াটে চেহারা সহ, রয়ে গেছে আজও। রয়ে গেছে রাহুলের কবিতাতেও। (Rahul Purakayastha)

Rahul Purakayastha
মোহিনীমিল, বেলঘরিয়া

এভাবেই, নিজস্ব কলোনি ও জনপদটিকে কবিতার শরীরে বুনেছেন রাহুল। তথ্য বলবে, শৈশব-কৈশোরে মাত্র বারো বছরের কাছাকাছি সময় কলোনিতে কাটিয়েছেন তিনি। কিন্তু স্কুলবেলার সেই অভিজ্ঞতা তাঁর সঙ্গে, থেকে গেছে আজীবন। পরবর্তী দু-দশকও কেটেছে কলোনির কাছেপিঠেই। পরবর্তীতে বেলঘরিয়ার অন্যপ্রান্তে সরে এলেও, সচেতনতার শেষদিন পর্যন্ত নিজের ভেতরে লালন করেছেন স্মৃতি। তিনি লিখেছিলেন— ‘জনপদ গড়ে ওঠে। আর সময়ের প্রলেপ পড়তে পড়তে তার রূপ বিচিত্রভাবে বদলে যায়। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনপদটির ইতিহাস ক্রমবিস্মৃতিতে, ক্রময়াবছায়ে তলিয়ে যায়। যদি না কেউ সময় থাকতে জনপদটির আদি কিংবা অতীতকে পুনরুদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন। এই উদ্ধারের ইতিহাস মানবসভ্যতারই এক অনিবার্য অধ্যায়।’(Rahul Purakayastha)

আরও পড়ুন: হস্তাক্ষর: প্রাগাধুনিক বঙ্গীয় হস্তাক্ষর: একটি ঝাঁকিদর্শন

তিনি হয়তো প্রত্যক্ষভাবে যতীনদাস নগর তথা বেলঘরিয়ার ইতিহাস পুনরুদ্ধারে ব্রতী হননি, কিন্তু কবিতায় ছড়িয়ে রেখেছেন অজস্র ইঙ্গিত। যত্ন নিয়ে সেসব উদ্ধার করা গেলে, কবিতার সঙ্গে জনপদের সম্পর্ক তথা আঞ্চলিক ইতিহাসের বিভিন্ন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম উপাদান উঠে আসে। উঠে আসে সময়, যা তিনি বেঁচে নিয়েছেন, তীব্রভাবে। সেই সময়কেই ফিরে দেখতে চেয়ে এই লেখা। এই লেখা, এক অর্থে রাহুল পুরকায়স্থর পথ পরিক্রমাও কি নয়? (Rahul Purakayastha)

মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রচ্ছদের ছবি- ধানসিড়ি প্রকাশন
অন্যান্য ছবি- লেখক

ঋণ:
তন্ময় ভট্টাচার্য, বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে, পরিবর্ধিত সংস্করণ, ধানসিড়ি, ২০২১
রাহুল পুরকায়স্থ, কলোনির কবিতা, অনুষ্টুপ, ২০০৯
রাহুল পুরকায়স্থ, ভাষালিপি-র কবিতা, ভাষালিপি, ২০২৫
সুনীল মুখোপাধ্যায়, পীযূষকান্তি চক্রবর্তী, চিরঞ্জীব শূর, ‘ফিরে দেখা যতীনদাস নগর, ষাট বৎসর পর’, যতীনদাস নগর স্পোর্টিং ক্লাব, ২০১০
সুপ্রিয় চৌধুরী, পাতালপুরাণ, দ্য কাফে টেবিল, ২০২২
সুপ্রিয় চৌধুরী, স্মৃতি বিস্মৃতির শহিদ বেদি ৭০, কাউন্টার এরা, ২০২২
নির্মলকান্তি ঘোষ

Author Tanmoy Bhattacharjee

জন্ম ১৯৯৪, বেলঘরিয়ায়। কবি, প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক। প্রকাশিত বই: বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে (২০১৬), আত্মানং বিদ্ধি (২০১৮), বাংলার ব্রত (২০২২), অবাঙ্‌মনসগোচর (২০২৩), বাংলার কাব্য ও মানচিত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনা ও হুগলি জেলার গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ (২০২৩) ইত্যাদি। সম্পাদিত বই: না যাইয়ো যমের দুয়ার (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-বিষয়ক প্রথম বাংলা গ্রন্থ), দেশভাগ এবং (নির্বাচিত কবিতা ও গানের সংকলন), সুবিমল বসাক রচনাসংগ্রহ (২ খণ্ড)।

Picture of তন্ময় ভট্টাচার্য

তন্ময় ভট্টাচার্য

জন্ম ১৯৯৪, বেলঘরিয়ায়। কবি, প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক। প্রকাশিত বই: বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে (২০১৬), আত্মানং বিদ্ধি (২০১৮), বাংলার ব্রত (২০২২), অবাঙ্‌মনসগোচর (২০২৩), বাংলার কাব্য ও মানচিত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনা ও হুগলি জেলার গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ (২০২৩) ইত্যাদি। সম্পাদিত বই: না যাইয়ো যমের দুয়ার (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-বিষয়ক প্রথম বাংলা গ্রন্থ), দেশভাগ এবং (নির্বাচিত কবিতা ও গানের সংকলন), সুবিমল বসাক রচনাসংগ্রহ (২ খণ্ড)।
Picture of তন্ময় ভট্টাচার্য

তন্ময় ভট্টাচার্য

জন্ম ১৯৯৪, বেলঘরিয়ায়। কবি, প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক। প্রকাশিত বই: বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে (২০১৬), আত্মানং বিদ্ধি (২০১৮), বাংলার ব্রত (২০২২), অবাঙ্‌মনসগোচর (২০২৩), বাংলার কাব্য ও মানচিত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনা ও হুগলি জেলার গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ (২০২৩) ইত্যাদি। সম্পাদিত বই: না যাইয়ো যমের দুয়ার (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-বিষয়ক প্রথম বাংলা গ্রন্থ), দেশভাগ এবং (নির্বাচিত কবিতা ও গানের সংকলন), সুবিমল বসাক রচনাসংগ্রহ (২ খণ্ড)।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

মুন্সী প্রেমচাঁদ
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

সংস্কৃতি

আহার

অমৃতা ভট্টাচার্য
অমৃতা ভট্টাচার্য
শমিতা হালদার

বিহার

রমেশ দাস
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

নির্মাল্য চ্যাটার্জি

উপন্যাস

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com