banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

আফগানিস্তান : অস্ত্র আছে, খাদ্য নেই

Afghanistan and Taliban
সবমিলিয়ে আফগানিস্তান অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত।
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

“…উৎসবে তার আসে নাই কেহ, 
বাজে নাই বাঁশি, সাজে নাই গেহ-…” 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি (বা গানটি) ১৯১০ সালে রচিত হয়েছিল। রচনার সময় তো বটেই, তারপর গত ১১০ বছরেরও বেশি সময়েও কেউ বোধহয় ভাবতে পারেননি যে, ২০২১ সালের ১৯ অগস্ট আফগানিস্তানের জন্য গানটির কথা এমন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে। ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে ১৯১৯-এর ১৯ অগস্ট আফগানিস্তান পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। তারপর প্ৰতি বছর এই দিনটি যথাবিহিত উৎসাহ উদ্দীপনায় সারা দেশে উদযাপিত হয়। কিন্তু এ বছর ছিল ব্যতিক্রম।

এ বছর স্বাধীনতা দিবসে আফগানিস্তানের মানুষ দোরে তালা দিয়ে ঘরের মধ্যে আতঙ্কে দিন কাটালেন। কাবুল শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত আশমাই পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা বাড়িগুলো নিষ্প্রদীপ রইল। অন্যান্য বছর স্বাধীনতা দিবসের সন্ধ্যায় এই বাড়িগুলো উজ্জ্বল আলোয় সেজে ওঠে। পুরো পাহাড়টাই উৎসবের আনন্দে যেন ঝলমল করে। এতই উজ্জ্বল সেই আলো, যে আকাশে উড়তে থাকা বিমান থেকেও সেই ঝলমলানি দেখা যায়। কাবুল শহরের ওয়াজির আকবর খান, শহ্-র-এ-নও, পুল-এ-খিশতি, ম্যাক্রোরিয়ান, কারতে পারওয়ান, খাইরখানা, তৈমুনি ইত্যাদি অভিজাত-মধ্যবিত্ত মহল্লায় এই বছর স্বাধীনতা দিবসের সন্ধ্যায় আলোর রোশনাই দেখা যায়নি। কাবুলের আকাশে আতসবাজি ওড়েনি। নিষ্প্রদীপ নিষ্প্রাণ শহরে এই ঐতিহাসিক দিনেই নিঃশব্দে বদলিয়ে গেল দেশের চরিত্র। ইসলামিক রিপাবলিক অফ্ আফগানিস্তান হয়ে গেল ইসলামিক এমিরেট অফ্ আফগানিস্তান। প্রজাতন্ত্র থেকে শাহীতন্ত্র। 

Taliban
মার্কিন সেনা সরতেই তালিব জঙ্গিরা দখল নিল আফগানিস্তানের

তবে প্রজাতন্ত্র থেকে শাহীতন্ত্রে অবনমনের লগ্নেও কাবুলের বিভিন্ন চহরাই বা চৌমাথার মোড়ে লাল-সবুজ-কালো রঙের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে স্বাধীনতার ১০২তম বার্ষিকী উদযাপন করলেন একদল স্বাধীনচেতা মহিলা। অবশ্যই তাঁরা বোরখা পরিহিতা। এবং কোনও অঘটন ঘটেনি।

প্রথমবারের তালিবান শাসনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করেই দেশের মানুষ তো বটেই, সারা বিশ্বের মানুষ শঙ্কিত। আফগানিস্তানের মানুষ অবশ্য প্রথম তালিবান শাসনের (১৯৯৬ থেকে ২০০১) অনেক আগে থেকেই তালিবান এবং সমগোত্রীয় কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদের কীর্তিকলাপের সঙ্গে পরিচিত। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যদের উৎখাত করার জন্য ১৯৮৫ নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সংগঠিত মুজাহিদিন বাহিনী উৎপাত শুরু করে। তখন থেকেই প্রকারান্তরে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। 

এ বছর স্বাধীনতা দিবসে আফগানিস্তানের মানুষ দুয়ারে তালা দিয়ে ঘরের মধ্যে আতঙ্কে দিন কাটালেন। কাবুল শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত আশমাই পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা বাড়িগুলো নিষ্প্রদীপ রইল। অন্যান্য বছর স্বাধীনতা দিবসের সন্ধ্যায় এই বাড়িগুলো উজ্জ্বল আলোয় সেজে ওঠায় পুরো পাহাড়টাই উৎসবের আনন্দে যেন ঝলমল করে।

শিক্ষার আলো মুছে দিয়ে দেশে কালো আঁধার প্রবর্তনের প্রতীক হিসেবে দেখা দেয় বাধ্যতামূলক বোরখার প্রচলন। সাধারণ মানুষের উপর মুজাহিদিন বাহিনীর নিয়মিত হুমকির ফলে দেশের মহিলাদের প্রকাশ্যে চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। বোরখা না পরে প্রকাশ্যে চলাফেরার সময় বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজনকে হত্যার পর, মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই ভীতির সঞ্চার হয়। আফগানিস্তানের এই প্রজন্মের মা-ঠাকুমারা সেই সময়ের কথা মনে করতে গিয়ে এখনও শিউরে ওঠেন। বাড়ির দেওয়ালে গেঁথে থাকা বুলেটের ছাপ প্রতিনিয়ত তাঁদের পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

সেই আতঙ্ক থেকেই আফগান মহিলা বোরখার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে যান। এমনকি তালিবান শাসনের প্রথম সংস্করণের অবসানের পরও আফগান মহিলা সেই অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেননি। তাছাড়া গত দুই দশকে আফগানিস্তান কখনও সন্ত্রাস মুক্ত ছিল না। সেই কারণেই রাজধানী কাবুল সহ সমস্ত বড় শহরগুলিকে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে মুড়ে রাখা হয়েছিল। 

গ্রামাঞ্চলে, প্রান্তিক এলাকায় ভয় দেখাতে বন্দুকের গুলি খরচ করতে হয় না। সাদামাটা হুমকিতেই মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রাখা যায়। পক্ষান্তরে শহরাঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টির জন্য নিয়মিত বোমা-বন্দুক ব্যবহার করা হয়েছে। যে কোনও হত্যাকাণ্ড বা বিস্ফোরণের পর ন্যাটো বাহিনীর পরিক্রমায় মানুষ আরও শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফলে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকেও  মহিলাদের অধিকাংশই বোরখার আড়ালেই চলাফেরা করতে অভ্যস্ত ছিলেন। বিভিন্ন পেশায় যুক্ত মহিলারাও কর্মক্ষেত্রে মাথায় হিজাব পরে কাজ করলেও সাধারণত বোরখা ছাড়া রাস্তায় চলাফেরা করতেন না। 

women in Afghanistan Burqa
দেশে কালো আঁধার প্রবর্তনের প্রতীক হিসেবে দেখা দেয় বাধ্যতামূলক বোরখা

সঙ্গীতশিল্পী, খেলোয়াড় বা টিভির পর্দায় উপস্থিত অভিনেত্রী, সঙ্গীতশিল্পী, সংবাদপাঠিকা, চিকিৎসক, নার্স, ব্যাঙ্ক কর্মচারী, সরকারি কর্মচারী– এককথায় সমস্ত মহিলা প্রকাশ্যে বোরখা পরিধানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা সমাজ আসলে প্রতি মুহূর্তে মানসিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায়  কালাতিপাত করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। সেটাই স্বাভাবিক। এই বাস্তবিকতা মেনে নিয়েই শহরাঞ্চলের আফগান মহিলা ঘর-সংসার কর্মক্ষেত্র সামলিয়ে দোকান-বাজার, মল-সুপারমার্কেট পরিক্রমা করতেন এবং নিয়মিত বিউটি পার্লারেও উপস্থিত হতেন। গত দু’ দশকে তো বটেই এমনকি ১৯৮৫ থেকেই এমনটাই ছিল আফগানিস্তানের প্রচলিত রীতি। 

নিরাপত্তাহীনতায় বেঁচে থাকতে থাকতে স্বভাবতই মানুষ আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা-আশঙ্কা নিয়ে জীবনযাপন রপ্ত করে নেয়। কাজেই ২০২১ থেকে হঠাৎ করে বোরখার প্রবর্তন হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে যে রকম ভাবে অবিরাম প্রচার চলছে তা মোটেও বাস্তবভিত্তিক নয়। এই পরিসরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রচারের ধরন বদলিয়ে গেছে। তালিবান আর জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসী বলে অভিহিত হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই তালিবানের সশস্ত্র সদস্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে নতুন পরিচিতি পেয়েছে, – যোদ্ধা। সেটাও স্বাভাবিক। তালিবান এখন আফগানিস্তানের শাসক। সরকারের পরিচালক। কোন কোন দেশ এই নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় সেটা বড় কথা নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সরকারি স্তরের যে কোনও বিবৃতিকে এখন আর তালিবানি ফতোয়া বলা যাবে না। বলতে হবে,- সরকারি নির্দেশ। 

তালিবান কোনও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে ক্ষমতাসীন হয়নি। গত দুই দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তালিবানের লড়াই চললেও কখনও সামনাসামনি যুদ্ধ হয়নি। দু’পক্ষই অতর্কিতে হামলা চালিয়েছে। তাতে সেনা-জঙ্গি ছাড়াও হতাহত হয়েছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। বিদেশিরাও বাদ যাননি। তবে এইসব হানা-হামলায় শেষ পর্যন্ত কোনও জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি হয়নি। সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে আপাতত আফগানিস্তানে হানাহানি বন্ধ হয়েছে। কোনও পক্ষই জয়ী হয়নি। কারও পরাজয় হয়নি। শুধু ক্ষমতাসীন হয়েছে তালিবান। 

আরও পড়ুন: কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে: আফগানিস্তান কি ফের গৃহযুদ্ধের মুখে?

কাতার-এর রাজধানী দোহা-য় ২০১৮ থেকে চলতে থাকা আলোচনার শেষে ২০২০-র ২৯ ফেব্রুয়ারি তালিবান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে। সেই চুক্তি মেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ২০২১-এর এপ্রিল মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার কথা ছিল। করোনা সংক্রমণ সংক্রান্ত কারণে সেনা প্রত্যাহারের তারিখ সামান্য পিছিয়ে যায়। সেই সুবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের আফগানিস্তান থেকে চলে আসার শেষ দিন নির্ধারিত হয়েছিল ৩১ অগস্ট। সত্যি সত্যিই তার একদিন আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী আফগানিস্তান থেকে চলে গেছে এবং ফেলে রেখে গেছে বিপুল অস্ত্রসম্ভার।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে গত দুই দশকে যে সোয়া দুই লক্ষ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে, তার অধিকাংশই যুদ্ধের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ও অন্যান্য সাজসরঞ্জাম কেনার জন্য খরচ হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ করা হয়নি।  অস্ত্র উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলি এই সুবাদে গত দুই দশক তো বটেই তার অনেক আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে চুটিয়ে ব্যবসা করেছে। প্রশিক্ষণের পর  আফগানিস্তানের সরকারি সেনাবাহিনীর প্রায় তিন লক্ষ সৈন্যের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল এই বিপুল সংখ্যক অস্ত্রের একটা অংশ। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সেনাবাহিনী যে সব যুদ্ধাস্ত্র, ফৌজি গাড়ি, ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার ইত্যাদি ব্যবহার করত, তাও ফেলে রেখে গিয়েছে তারা। ফলে শেষ বিচারে দেখা গেল, তালিবান শাসিত আফগানিস্তানে থেকে গিয়েছে ন্যাটোর ফেলে যাওয়া বিপুল অস্ত্রসম্ভার। 

সঙ্গীতশিল্পী, খেলোয়াড় বা টিভির পর্দায় উপস্থিত অভিনেত্রী, সঙ্গীত শিল্পী সংবাদপাঠিকা, চিকিৎসক, নার্স, ব্যাঙ্ক কর্মচারী, সরকারি কর্মচারী এককথায় সমস্ত মহিলা প্রকাশ্যে বোরখা পরিধানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা সমাজ আসলে প্রতি মুহূর্তে মানসিক ভাবে নিরাপত্তাহীনতায়  কালাতিপাত করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। সেটাই স্বাভাবিক।

খবরের কাগজে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত, যে ২০১৩ থেকে ২০১৬-র মধ্যে আফগানিস্তানের সেনাবাহিনী বা আফগান ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সকে ৬ লক্ষেরও বেশি লাইট ওয়েপন বা বন্দুক-রাইফেল জাতীয় হালকা অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধে ব্যবহৃত ৮০ হাজারের বেশি অত্যাধুনিক মাইন নিরোধক গাড়িও দেওয়া হয়। এ ছাড়া নাইট ভিশন চশমা, ম্যানপ্যাকও পেয়েছিল আফগান সৈন্যরা। পাশাপাশি, ২০১৭ সাল থেকে দু’বছরের বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাত হাজার মেশিনগান, যে কোনও রাস্তায় চলতে পারে এমন ৪৭০০টি হামভি গাড়ি এবং ২০ হাজারের বেশি গ্রেনেড সরবরাহ করেছে আফগান ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সকে। এছাড়া বড় অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে দু’হাজার সাঁজোয়া গাড়ি ও প্রায় ৪০টি বিমান ও হেলিকপ্টার, যার মধ্যে রয়েছে ইউএইচ-৬০ ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার, স্ক্যান ইগলের মতো ছোট ড্রোনও। বর্তমান পরিস্থিতিতে সে সবই এখন তালিবান শাসিত আফগানিস্তান সরকারের সম্পত্তি।

আফগানিস্তান এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই কোনও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না। দেশের মধ্যেকার বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লেও এত বিপুল অস্ত্রসম্ভার ব্যবহার সম্ভব নয়। তাহলে এই অস্ত্রসম্ভার কোথায় যাবে? আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করার জন্য এই বিপুল অস্ত্রসম্ভার ব্যবহার করা অসম্ভব নয়। বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে সক্রিয়। এই বিপুল সমরাস্ত্রের অংশবিশেষ সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। অর্থাৎ যাওয়ার বেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় উপমহাদেশ-সহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য স্থায়ী সমস্যার উপাদান ও উপকরণ রেখে যাওয়ার ব্যবস্থা করে গেছে। 

আফগানিস্তানের হাতে এই মুহূর্তে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের হাজার মারণাস্ত্র। কিন্তু খাদ্য? দেশের মানুষের পাতে দিনের শেষে রুটি-সবজি-গোস্ত পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত আছে কি? অস্ত্র দিয়ে তো পেট ভরবে না, তার জন্য যথার্থ খাদ্যনীতি তৈরি করতে হবে। এর মধ্যেই তৈরি হয়েছে খাদ্যসঙ্কট। আফগানিস্তানের বাজারে রোজই লাফিয়ে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে আফগান মুদ্রার দাম। এখনই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষের সংকট আরও বাড়তে পারে। তাই হাতে বেশি সময় নেই, এখনই যা করার করতে হবে।

আফগানিস্তান মূলত বিদেশের অর্থসাহায্যের উপর নির্ভরশীল। সরকারের বাজেটের ৭৫ শতাংশ বিদেশি দান খয়রাতিতে চলে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ডি আফগানিস্তান ব্যাঙ্ক বা চলতি কথায় ‘ড্যাব’-এর ৯০০ কোটি ডলার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ্ নিউ ইয়র্কে গচ্ছিত আছে। আপাতত তা নাগালের বাইরে। রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার অর্থাৎ আইএমএফ জানিয়ে দিয়েছে, তাদের কাছে আফগানিস্তানের যে ৪৫ কোটি ডলার জরুরি পুঁজি জমা আছে, তা এখন ব্যবহার করা যাবে না। বিশ্ব ব্যাঙ্কও সহায়তা বন্ধ করেছে। তালিবানের চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণ করতেই হয়তো এমন আর্থিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়ে তালিবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান কী ভাবছে তা এখনও জানা যায়নি। 

afghan refugee
এই শিশুদের ভবিষ্যৎ কী?

রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে দুর্ভিক্ষের দোরগোড়ায় আফগানিস্তান। এ মাসেই শেষ হতে পারে সঞ্চিত খাদ্যভাণ্ডার। ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে তিন কোটি আশি লক্ষ মানুষের দু’বেলা খাবার জোটানো অনিশ্চিত। শীত আসছে। আবহাওয়া প্রতিকূল হবে আরও। অন্যদিকে, এ বছর দেশের বেশ কয়েকটি প্রদেশে খরা হয়েছে। সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ নেই বললেই চলে, এর ফলেও তৈরি হতে পারে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। শীতের আগে যদি যথেষ্ট পরিমাণ আর্থিক সাহায্য এসে না পৌঁছয়, তা হলে সেপ্টেম্বর শেষ হওয়ার আগে খাদ্য সংগ্ৰহ সম্ভব হবে না। ভাণ্ডার শূন্য হয়ে যাবে। খাদ্যপণ্যের সহায়তা না পাওয়া গেলে মাসখানেকের মধ্যেই আফগানিস্তানে ফুরোতে পারে সঞ্চিত খাদ্য। তালিবান ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে খাদ্যের মূল্যের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমেছে।

খাদ্যপণ্যের সরবরাহ নেই বলে বাজার অগ্নিমূল্য। দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি আসন্ন। সরকারি কর্মচারীদের বেতন এমনিতেই অনিয়মিত। তিন থেকে ছয় মাস অনেকেই মাইনে পাননি। কবে নাগাদ পাওয়া যাবে জানা নেই। ব্যাঙ্কগুলিতে অর্থের যোগান নেই। ব্যাঙ্কের সামনে বিক্ষোভ হচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশই নাকি সরকারি কর্মচারী। ব্যাঙ্ক খোলা থাকলেও নগদের অভাবে কোনও কাজই কার্যত হচ্ছে না। এটিএম-এর সামনে কাতারে কাতারে মানুষ সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে। অপেক্ষাই সার। এটিএম-এ আফগানি ফুরিয়ে গেছে। নতুন করে কখন আফগানি ঢালা হবে কেউ জানে না।

নিয়মিত রাজস্ব আদায়ের তেমন কোনও ব্যবস্থা গত দুই দশকে আফগানিস্তানে গড়ে ওঠেনি। আখরোট, কিসমিস্, পেস্তা, হিং, আঞ্জির ইত্যাদি শুকনো ফল আর কার্পেট রপ্তানি করে কতটুকু আয় হয়? ল্যাপিজ লাজুলি জাতীয় মহার্ঘ্য রত্ন-পাথর সামান্য কিছু বৈদেশিক মুদ্রা আনে। তার উপরে সরকারি হুকুমনামা অনুসারে এখন রপ্তানি বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ। 

খনিজ সম্পদ থেকে যথেষ্ট উপার্জনের সুযোগ আছে। কিন্তু তা তো আর এক্ষুনি হচ্ছে না। বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের পর বিদেশি বিনিয়োগ, পরিকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি হাজারও খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নের পর উৎপাদন শুরু হতে পারে। সে এক দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। কাজেই অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে আপাত সুরাহার দিশা দেখা যাচ্ছে না।

পৃথিবীর প্রায় সমস্ত অসামরিক তথা বাণিজ্যিক বিমান আফগানিস্তানের আকাশ ব্যবহার করে থাকে। দক্ষিণ এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া থেকে ইয়োরোপ এবং আমেরিকার দেশগুলিতে যাওয়ার এটাই সবচেয়ে স্বল্প দূরত্বের পথ। করোনা সংক্রমণজনিত কারণে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল এমনিতেই কম। তার উপর আপাতত প্রায় সব বিমান আফগানিস্তানের আকাশ পরিহার করে চলেছে। ফলে অন্য দেশের বিমানের কাছ থেকে পাওয়া ‘ওভারফ্লাইং ফী’ আফগানিস্তান এখন আদায় করতে পারছে না। সবমিলিয়ে সোজা রাস্তায় রাজস্ব আদায়ের প্রায় সব পথই আপাতত বন্ধ।

একটা পথ অবিশ্যি এখনও খোলা রয়েছে। এতদিন পর্যন্ত তা কালোবাজারের বেআইনি পণ্য হিসেবেই বিবেচিত হয়ে এসেছে। কৃষিজ পণ্য পোস্ত এবং সেই ফল থেকে আহরিত আফিম বহুদিন ধরেই আফগানিস্তানের সেরা বেআইনি পণ্য। কোটি কোটি ডলার এই সূত্রে আয় হয় বলে শোনা যায়। তাতে তো আর রাজকোষের শ্রীবৃদ্ধি হয় না। ইয়োরোপের বেশ কিছু দেশ অনেকদিন ধরেই সরকারি নিয়মনীতি অনুযায়ী আফিম কিনতে আগ্রহী। ওষুধ নির্মাণের অন্যতম উপাদান হিসেবে আফিমের প্রয়োজন। আফিম আবার ড্রাগ জাতীয় নেশার সামগ্রী তৈরির অন্যতম উপকরণ। কালোবাজারে সেই কারণেই আফিমের এত রমরমা। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে সেই রাস্তায় তালিবান হাঁটতে শুরু করবে কিনা তা বলা মুশকিল।

বিভিন্ন দেশের সরকার, রাষ্ট্রপুঞ্জ, আন্তর্জাতিক এনজিও ইত্যাদি নিয়মিত খাদ্যশস্য, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, গরম পোশাক ইত্যাদি সরবরাহ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত, দারিদ্রপীড়িত আফগানিস্তানের জীবন রক্ষার দায়িত্ব এতদিন ধরে পালনের চেষ্টা করছিল। এখন সে সব বন্ধ। তা হলে দেশের মানুষ বাঁচবে কী করে? কৃষিনির্ভর যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের অর্থনীতি মোটেও শক্তপোক্ত নয়। বৈদেশিক দান-খয়রাতি ভিত্তিক সরকারি বাজেটে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার সুযোগ নেই। 

তার মধ্যেই পরিষেবা সংক্রান্ত যে সামান্য কাজকর্ম শুরু হয়েছিল তা এখন বন্ধ হওয়ার পথে। কারণ পরিষেবার কাজে গত কয়েক বছরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। মহিলাদের গতিবিধি ইতিমধ্যেই নিয়ন্ত্রিত। কাজেই পরিষেবা ব্যবস্থায় আশার আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে আফগানিস্তান অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত। ব্রিটিশ বাহিনীর হাত থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা আদায়ের ১০২ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে আফগানিস্তানে যখনই মুক্ত বাতাস বইতে শুরু করে, আলোর দিশা দেখা যায়, তখনই হাজারও প্রতিবন্ধকতা সেখানকার সমাজব্যবস্থাকে পিছন দিকে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে গানের মাঝের দু’ছত্র দিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল, সেই গানের প্রথম পঙক্তিই যেন আফগানিস্তানের জন্য যথার্থ। “যতবার আলো জ্বালাতে চাই নিভে যায় বারেবার…”

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com