banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

নিবন্ধ: জিপসি সঙ্গীত

আগস্ট ২০, ২০২২

Federico Garcia Lorca
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

১৯ আগস্ট কবি, নাটককার লোরকার মৃত্যুদিন। ১৯৩৬ সালের ১৯ আগস্ট লোরকাকে খুন করা হয়। নিজের মৃত্যু নিয়ে ১৯২৯ সালে লোরকা লিখেছিলেন:

দ্য ফেবল অ্যান্ড রাউন্ড অফ থ্রি ফ্রেন্ডস

হঠাৎ আমার উপলব্ধি হল আমাকে খুন করা হয়েছে
ওরা আমাকে খুঁজছে কফি হাউসে, শ্মশানে, চার্চে…
…কিন্তু আমাকে খুঁজে পেল না।
আমাকে কী কোনওদিনই খুঁজে পেল না?
না, কোনওদিন আর খুঁজে পেল না!

(ঘটনার সত্যতা ও কল্পনা দালির ছবির মতন এখানে মিশে একাকার)

সালভাদোর দালি (জন্ম ১৯০৪) আর ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (জন্ম ১৮৯৮) দুই অসমমনস্ক বন্ধু। একজন নির্জনতার মানুষ, ভালোবাসার কবি। অন্যজন রোজ খবরের কাগজে নিজের মুখ না দেখলে ওয়াইনের বোতল ভাঙেন। একজনের ছবিতে সময় ঘড়ির কাঁটা বেয়ে গলে গলে মেশে সুররিয়ালিস্ট মাটিতে। অন্যজনের সম্বল একটা টেবিল, চেয়ার, বাদামি ডাইরির সাদা পাতা আর কলম। দালি লোরকাকে তাঁরই সদ্য লেখা একটা কবিতা লোরকার বাদামি ঘোড়ার চামড়ার ডাইরি থেকে পড়ে শোনাচ্ছেন-

Quiero volver a la infancia
y de la infancia a la sombra.

আমি চলে যেতে চাই ছোট্টবেলাতে
আর ছোট্টবেলা থেকে ছায়ায়।
             বুলবুল, তুই ও যাবি?
              যাওয়াই ভালো!
আমি ফিরতে চাই ছায়ায়
আর ছায়া থেকে যাবো ফুলে।
                  আতর তুইও যাবি?
                  যাওয়াই ভালো!
আমি ফিরতে চাই ফুলে
আর ফুল থেকে
        আমার হৃদয়ে।

dali-y-lorca
এক অন্যতর প্রেমের গল্প- লোরকা ও দালি

লাল ভেলভেটের মখমলের সোফার হাতলে বাম হাত, পরনে আরবি আলখাল্লা। ডান হাতে লোরকার ডাইরি, সামনে স্পেনের শ্রেষ্ঠ ভিনিয়ার্ড (দ্রাক্ষাখেত) থেকে বোতল বোতল দামী লাল ওয়াইন। লোরকা গতকাল রাত থেকেই দালির প্রাসাদে থেকে গিয়েছেন। আজ একটু বেলাতে দুই বন্ধুর ঘুম ভেঙেছে। লোরকা সাজতে ভালোবাসেন। সবসময় ফিটফাট। সকালে উঠেই কালো সিল্কের ট্রাউজার্স সঙ্গে মানানসই ধবধবে সাদা শার্ট আর কালো চামড়ার জ্যাকেট পরে নিয়েছেন। চুল পরিপাটি করে ব্যাকব্রাশ। আপাতত লাজুক লাজুক মুখে মাথা নত করে দালির মুখে নিজের কবিতা শুনছিলেন। গতকাল নেশাটা বেশি হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ কী মনে করে দালিকে চুমু খেতে গিয়েছিলেন। দালি আস্তে করে ঠোঁট সরিয়ে লোরকার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন—
– আমিগো, তুমি আমার হৃদয় জুড়ে, ঠোঁট তাতে ভাগ বসাবে কী করে, শরীর তাতে ভাগ বসাবে কী করে? আর তুমি তো জানো আমার কোনিওতে (cono- স্প্যানিশ কথ্য ভাষায় এর অর্থ যোনি) কীরকম আকর্ষণ।
দালি বন্ধুর লাজুক মুখ দেখে কবিতা পাঠ শেষ করে বললেন,
— আরে ভুলে যাও কাল রাতের কথা। ওসব সময়ের কাঁটার হাত ধরে গলে মিশে হারিয়ে গেছে গতরাতের অন্ধকারে। আজ আর এক ফুটফুটে দিন। তোমার কবিতা আন্দালুশিয়া ছাড়িয়ে স্পেনের মানুষের মুখে মুখে।
লোরকা বললেন,
— দেখো আমি তো লিখলাম সব প্রেমের কবিতা! তবে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর লোকজন আমার সব বই পুড়িয়ে দিচ্ছে কেন?
সময়টা ১৯৩৬ সাল। দু’জনের মধ্যে নেমে এল এক ফ্যাসিস্ট কালো ঈগল তার লাল দুটো ডানা আর হলুদ বুক নিয়ে।

স্পেনের আন্দালুশিয়া রাজ্যে দু’চোখ জুড়নো গ্রানাডা শহরের উপকণ্ঠে ভেগা গ্রামে এক বর্ধিষ্ণু জোতদার পরিবারে ১৮৯৮ সালে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার জন্ম। বাবা ছিলেন প্রচুর জমিজমার মালিক। মা স্কুলশিক্ষিকা ও পিয়ানোবাদিকা। নদীর উপত্যকা একদিকে, অন্যদিকে সিয়ারা নেভাডা পর্বতশ্রেণি। আর এদের মধ্যে মিশে যায় এক বালকের চৈতন্য। সারাজীবন এই কবিতার মতো নৈসর্গিক উপত্যকা লোরকার লেখায় প্রভাব ফেলেছিল। লোরকার চিঠিই যেন তাঁর কবিতা! ১৯২১ সালে লোরকা এক বন্ধুকে লেখেন:

কিছুদিন আগেই এক শ্যামল চাঁদ সিয়ারা নেভাডার মাথায় এসে বসে আর আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে এক মহিলা উদাত্ত কণ্ঠে ঘুমপাড়ানি ‘বারকেউস’ গাইছেন, যেন সোনার নেকলেস উপত্যকার কণ্ঠে। আর এতকিছুর মধ্যে অস্ত যাচ্ছে সূর্য, আর আমার মনে হচ্ছে এক অলৌকিক ফ্যান্টাসি আর আধোঘুমের মধ্যে করছি বিচরণ। … আমার মনে হয় ইন্ডিয়াতেও এরকম সুগন্ধময় পাগল হওয়া রাত নেই।

লোরকার স্কুলের বন্ধুরা ছিল অধিকাংশই স্থানীয় গরিব চাষির ছেলেমেয়ে। একবার এক বন্ধুর মা লোরকাকে তাদের বাড়িতে আসতে বারণ করে কারণ দিনটা ছিল তাদের কাপড় কাচার দিন। লোরকা পরে লেখেন:

কী ভয়ংকর ব্যাপার! ওদের বাড়িতে সবাই উলঙ্গ হয়ে ঠান্ডায় কাঁপছে যতক্ষন না জামা কাপড় কেচে শুকনো হয়। আর আমার কতরকমের জামাকাপড়! কী খারাপ লাগছে! একটা শীতল ওজন যেন কাঁধে চাপল!

আসলে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় স্পেনের গরিব মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য লোরকার মনকে ভারাক্রান্ত করত। ষাট-সত্তর দশকে বিশ্বময় চে গুয়েভারার মতন লোরকা ছিলেন নিপীড়িত মানুষের বিদ্রোহের প্রতীক। একটা মিথ। কবিদের স্বপ্ন। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ১৯৩৬ সালের ১৯ আগস্ট ডিক্টেটর জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সৈন্যদের হাতে লোরকার মৃত্যু হয়। তাঁর মরদেহ আজও পর্যন্ত নিখোঁজ। তাঁর জীবৎকালে ইউরোপ লোরকাকে চিনত না! বিশ্ব চিনত না। লোরকার বেশিরভাগ লেখা নিষিদ্ধ ছিল স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর শাসনে (১৯৩৯-১৯৭৫)।

Lorca and Mom
মা ও পরিবারের সঙ্গে লোরকা

সঙ্গীত ছিল ছোটবেলা থেকে লোরকার প্রাণ। অসাধারণ পিয়ানো বাজাতেন। শিখেছিলেন ইউরোপিয়ান ক্ল্যাসিকাল মিউজিক। ছ’বছর ধরে পিয়ানো শিখেছিলেন কমপোজার আন্টোনিও সেগুরা মেসার কাছে। লোরকা বাজাতেন বেঠোফেন, চপিন প্রমুখের ধ্রুপদী সঙ্গীত। কবিতার ধারেকাছে ছিলেন না আঠারো বছর বয়সের আগে। তবে হ্যাঁ, আঁকতেন। ছবি আঁকতেন, স্কেচ করতেন পাকা হাতে। সময় পেলেই চলে যেতেন বাড়ির আশপাশের নির্জন জায়গায়, একমনে আঁকতেন। ইতিমধ্যে তাঁর কৈশোরে হানা দিয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হাহাকার। লোরকা ছিলেন চিরকালীন একলা। কবিদের মতন নয়। ছিলেন সবসময় ধোপদুরস্ত পরিছন্ন। পরিপাটি করে ব্যাকব্রাশ করা একমাথা চুল। স্থানীয় মেয়েদের ভীষণ পছন্দ লোরকাকে। কার পছন্দ হবে না এই দীর্ঘ টানা টানা কালো চোখের ছেলেটিকে? বোন ইসাবেলার বন্ধু গ্যাব্রিয়েলার খুব পছন্দ লোরকাকে। কতবার ইসাবেলার হাত ধরে চোখ বন্ধ করে সে শুনেছে লোরকার আঙুলে পিয়ানোর ঝংকারে বিঠোফেনের সিমফনি। মুখ থেকে অস্ফুট বেরিয়েছে- আমর! ইসাবেলা লোরকার আদরের বোন। বাজনা শেষ করে কোনও ভ্রুক্ষেপ না করে ইসাবেলার বাদামি চুলে হাত বুলিয়ে চলে যান লোরকা।

Isabella
লোরকার সবচেয়ে প্রিয় বোন ইসাবেলা

এদিকে লোরকা মেয়েদের প্রতি কোনও আকর্ষণ অনুভব করেন না। মা ভিনসেন্টা আর বোন ইসাবেলা, এঁরা লোরকার প্রাণ। মা ভিনসেন্টার চোখের মণি সে। ভিনসেন্টাও ভালো পিয়ানো বাজাতেন। আর বই পড়া? সেটাও তো মায়ের পাশে শুয়ে শেখা। বই পড়া লোরকার নেশা। বাবা ফেদেরিকো রডরিগেজ় চাষবাস জমিজমা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। কিশোর বয়সে লোরকা যখন স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলত, তাকে টানত ঘামে ভরা পুরুষ বন্ধুদের সুঠাম শরীর। রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে ভাবত সেই দেহগুলোর কথা। গরম হয়ে উঠত কিশোর শরীর। কী এক আশ্চর্য সময়ের সন্ধিক্ষণ। ১৯১৯ সালে ২১ বছর বয়সে লোরকা গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রেসিভ রেসিদেনশিয়া দে এস্টুডিয়ান্তে-তে ভর্তি হন। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পথে। রাশিয়ায় লেনিনের কমিউনিস্ট পার্টির হাতে জারের পতন ঘটেছে। জার্মানি, রাশিয়া, টার্কি, অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি— সর্বত্র রাজারা ক্ষমতাচ্যুত। দু’কোটি সৈনিক ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু। স্প্যানিশ ফ্লুতে পৃথিবীময় পাঁচ থেকে দশ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। রাশিয়া দিয়ে শুরু হয়ে সমস্ত ইউরোপে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে সমাজতন্ত্র।

এই সময় একদল কবি, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, চিত্রশিল্পী জমা হয়েছেন মাদ্রিদের প্রগ্রেসিভ রেসিডেন্সিয়াতে। এঁরা জন্ম দিচ্ছেন সুররিয়ালিসম, ফিউচারিসম, সিম্বলিসম-এর মতো ইউরোপিয়ান মুভমেন্টের। এঁদের মধ্যে দু’জনের সঙ্গে লোরকার খুব বন্ধুত্ব হয়। চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েল আর চিত্রশিল্পী দালি। দালিও স্কুল শেষ করে এই প্রোগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। দালিকে দেখেই লোরকার বুক কেঁপে উঠল। এর জন্যই তো এত অপেক্ষা! দালিও লোরকার কথায়, ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ। জন্ম হল এক বিশ্বখ্যাত বন্ধুত্বের। এর মধ্যে লোরকা মায়ের পরামর্শে বাবার টাকায় প্রকাশ করেছেন প্রথম বই ‘ইমপ্রেশন অ্যান্ড ল্যান্ডস্কেপ’। প্রথম বই স্পেনের ভ্রমণকাহিনি, কিন্তু লোরকার ছবি ও কবিতার চোখ দিয়ে দেখা। লিখতে শুরু করেছেন কবিতা।

García_Lorca
সঙ্গীত ছিল লোরকার প্রাণ। নিয়মিত পিয়ানো বাজাতেন

ভিনসেন্টাও ছেলেকে লিখেছেন: তোমাকে আর মিউজিক নিয়ে পড়তে হবে না। মিউজিক, গ্রানাডা তোমার অন্তরে। ওরা তোমাকে কোনওদিন ছেড়ে যাবে না। কিন্তু তুমি কবিতার মধ্যে তোমার যে রাস্তা খুঁজে পেয়েছ, সেই পথে হাঁটো। আর পায় কে! নামমাত্র ‘ল’ বা ওকালতি পড়ার পাশে পাশে লোরকা বেশিরভাগ সময় কবিতা লেখায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। বন্ধুকে জানালেন, দালি, মা বলেছেন কবিতাই আমার রাস্তা, বুঝলে? দালি একটা ক্যানভাসে তুলির টান দিচ্ছিলেন। মাথা না ঘুরিয়েই বললেন,
— আমিগো, সে তো আমি জানি। তোমার কবিতা একদিন স্পেন ছাড়িয়ে পৃথিবীর মানুষের মুখে মুখে ঘুরবে।
লোরকা বলেন, আজ একটা লিখেছি শুনবে?

কে যেন আমাকে একটা ঝিনুক এনে দিল
তার মধ্যে থেকে ভেসে আসে
মানচিত্র থেকে উঠে আসা এক সমুদ্রের গান
আমার হৃদয়
ভরে যায় সাগরের জলে
আর ছোট ছোট রূপালী
ছায়ামাখা মাছের দলে।

দালি বলেন,
— তোমার কবিতা আমার কানে সঙ্গীত হয়ে বাজে। আমার মাথার মধ্যে জ্বালিয়ে দেয় হাজার সূর্য। তার সাদা রঙ ভেঙে বিচ্ছুরিত হয় অনবদ্য রঙের খেলা। প্যালেটে গলে গলে মেশে তোমার কবিতা আর আমার রঙ। তোমার কবিতাই আমি আঁকি ক্যানভাসে।
লোরকা জড়িয়ে ধরেন দালিকে। ঠোঁটে ঠোঁট, বুকে বুক। উত্তেজনা মাখা উষ্ণ সময়।

Lorca and Dali
প্যালেটে গলে গলে মেশে তোমার কবিতা আর আমার রঙ – লোরকা ও দালি

লোরকার প্রথম কবিতার বই ‘দে লিবরো দে পোয়েমাস’ বা কবিতার বই প্রকাশিত হল ১৯২১ সালে। এর মধ্যে লোরকার প্রথম নাটক আরশোলা আর প্রজাপতির প্রেম নিয়ে ‘দ্য বাটারফ্লাইস ইভিল স্পেল’ চারটে মাত্র শোয়ের পর দর্শকের সমালোচনার ঝড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রথম ভ্রমণকাহিনি, কবিতার বই, নাটক সবই ফেল। এক্কেবারে ফেল। মানুষের মনে দাগ কাটতে পারেনি। লোরকাকে স্পেনের মানুষ বুঝতে পারছে না। হতাশা গ্রাস করছে তাঁকে। একমাত্র বন্ধু দালি আর মা ভিনসেন্টাই তাঁর আশ্রয়। দালি বলেন,
— তোমার এই উদাত্ত কণ্ঠস্বর আমিগো, যাও মানুষকে শোনাও তোমার কবিতা তোমার স্বরে। তাহলে তোমাকে মানুষ বুঝতে পারবে।

এদিকে দালিও নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রচুর ছবি আঁকছেন। মিউজিয়ামে ড্রাফ্টসম্যানের কাজ করছেন, বুনুয়েলের সঙ্গে সিনেমায় সহযোগিতা করছেন। মাদ্রিদে দালির প্রথম প্রদর্শনীতে শিল্পীর জয়জয়কার! ঘুরে এসেছেন প্যারিস। সেখানে পিকাসো তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। কাগজে, ম্যাগাজিনে দালির ছবি, প্রশংসা। ভিনসেন্টা লোরকাকে লিখছেন,  
— তুমি ভেঙে পোড়ো না। তুমি যে কবিতা লিখছ তা দেশের মানুষের কাছে নতুন। তাদের বুঝতে সময় লাগবে। তোমার মন খারাপ লাগলে আমাকে চিঠি দিও।

এবার লোরকা শুরু করলেন স্বকণ্ঠে কবিতাপাঠ। তাঁর উদাত্ত স্বরে নাটকীয় পাঠ মানুষের কাছে নতুন বার্তা নিয়ে এল। ক্যাফেতে, বারে লোরকার কবিতা শুনতে লোক আসতে শুরু করল। প্রকাশনায় লোরকার আগ্রহ কমে গেল। তিনি মঞ্চস্থ করলেন ‘মারিয়ানা পিনেডা’ ১৯২৭ সালে। স্টেজ কে বানালেন? সালভাদর দালি। বন্ধুর জন্য রাত জেগে নিজের হাতে সাজালেন মঞ্চ। নাটক চলল মোটামুটি। সমালোচকরা খুব খারাপ বললেন না। কিন্তু লোরকা তো থামতে পারছেন না। মাথার মধ্যে ঘুরছে আন্দালুশিয়ার জিপসিদের গান, স্পেনের লোকগীতি, জাপানি হাইকু কতকিছু। একসঙ্গে তিনি লিখে চলেছেন বিভিন্ন ধরনের কবিতা। তবে বই করে প্রকাশ করতে তীব্র অনীহা। দালি জোর দিয়ে বলছেন,
— তুমি বই না বের করলে লোকে পড়বে কী করে, জানবে কী করে? কতজনকে তুমি তোমার নিজের গলায় পাঠ করে শোনাতে পারবে? আর তুমি তো সবসময় বলো কবিতা হচ্ছে চারটে সাদা দেয়াল যার মধ্যে কবির কান্না, যন্ত্রণা আর গোঙানি লুকিয়ে থাকে। আমিগো, তোমার হৃদয়সঙ্গীত শুনতে দাও স্পেনের মানুষকে।

Lorca 2
স্বকণ্ঠে কবিতা পড়ছেন লোরকা

লোরকা তখনও জানেন না তাঁর ১৯২২-২৩ সালে লেখা প্রায় পাঁচশোর ওপর কবিতা নিয়ে বই ‘Suites’ বা ‘ঘরের পর ঘর’ প্রকাশিত হবে ষাট বছর পরে ১৯৮৩ সালে। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হল ‘পোয়েমা দেল কানতে জনডো’ বা গভীর গানের কবিতা, ‘ক্যানসিওনেস’ বা গান, ‘প্রিমার রোমানসেরো গিটানো’ বা জিপসিসঙ্গীত। তিন তিনটে কবিতার বই। মানুষ তখন লোরকার কবিতা বুঝতে শুরু করেছে। তিরিশ বছর বয়সি লোরকা আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন স্পেনের সাহিত্যমহলে। সহজ সরল ভাষায়, গানের ভাষায়, লোকগীতের ভাষায় অদ্ভুত আধুনিকতায় তাঁর কবিতা অনন্য।

গ্রানাডা ১৮৫০

আমার জানালা দিয়ে
শুনি ফোয়ারার শব্দ।

একটি আঙুরলতা
ও সূর্যরশ্মিফলা
দেখায় যেখানে
সেখানে আমার হৃদয়।

ভাদ্রের বাতাসে
মেঘ বহে যায়।
আমি স্বপ্ন না দেখার স্বপ্ন দেখি
ফোয়ারার ভেতরে।

জিপসিসঙ্গীত বই থেকে ‘ব্যালাড অফ দ্য স্প্যানিশ সিভিল গার্ড’-এর কিয়দংশ:

…ঘোড়ার রঙ কালো
কালো ঘোড়ার জুতো
ঝকঝকে চামড়ার ঝালরে
জ্বলে মোম ও কালির দাগ
ওদের মাথায় সীসের বাঁধন
তাই ওরা কাঁদে না।
ওরা রাস্তা মাড়ায়
পায়ের তলায় নকল চামড়ার আত্মা।…

self portrait of the poet in new york
লোরকার আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি

এরই মধ্যে দালির পরামর্শে লোরকার প্রথম চিত্রশিল্পের প্রদর্শনী হল ১৯২৮ সালে। ছবি প্রভূত প্রশংসা পেল। স্পেনের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী থেকে লোরকার শেষ দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে। বন্ধু দালির সবচেয়ে আনন্দ হবার কথা। কিন্তু সব আনন্দের মধ্যেই যেমন বিষাদ লুকিয়ে থাকে, এই সময়টাও ঠিক তেমন। লোরকার নিজের ভাষায়: বিষাদ আর আনন্দ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। দালির হয়েছে নতুন গার্লফ্র্ন্ড ‘গালা’ বা ইলিনা, বছর দশেকের বড়ো, রাশিয়ান। গালা লোরকাকে দু’চোখে দেখতে পারেন না। ইতিমধ্যে বুনুয়েল আর দালি, বুনুয়েলের প্রথম চলচ্চিত্র ‘আন্দালুশিয়ান কুকুর’ তৈরি করেছেন। ছবি মুক্তিও পেয়েছে। ছবির নাম শুনেই লোরকা ভাবলেন, এই আন্দালুশিয়ান কুকুর আর কেউ নয়, নিশ্চয়ই লোরকা নিজে! লোরকার মনে হল, তাঁর প্রিয় বন্ধুরা বিশ্বাসঘাতক। দালির প্রতি তাঁর প্রেম কিছু নয়! দালির নতুন ছবির প্রদর্শনীতে লোরকা আমন্ত্রিত নন। লোরকা পানশালায় ঘুরে ঘুরে নিদ্রাহীন রাত কাটান। এ অবস্থায় হাল ধরলেন মা ভিনসেন্টা। জীবনে প্রথমবার তিনি মাদ্রিদ এলেন, সঙ্গে লোরকার বোন ইসাবেলা ও ভাই ফ্রান্সিসকো। শক্ত হাতে সামাল দিয়ে লোরকাকে আমেরিকার জাহাজে তুলে দিলেন। গন্তব্য নিউ ইয়র্ক।

লোরকা ১৯২৯-৩০ সালে নিউ ইয়র্ক শহরের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। থাকলেনল স্প্যানিশ হারলেমে। মাঝে ঘুরে এলেন কিউবা। লিখলেন তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পোয়েটা এন নুয়েভা ইয়র্ক’ বা নিউ ইয়র্ক শহরে কবি। নিউ ইয়র্কে থাকার সময় তিনি ১৯২৯ সালের বিখ্যাত ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ বা শেয়ার মার্কেটের পতন দ্যাখেন। এই সময় থেকেই সাম্যবাদের ওপর তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়। লেখেন,

ও হারলেম! ও হারলেম! ও হারলেম!
তোমার ওই নিপীড়িত লালের থেকে কার আছে বেশি যন্ত্রণা,
রাগে তোমার রক্ত কাঁপছে অন্ধকার ঘূর্ণাবর্তে কিন্তু
তোমার ওই লাল নীলের হিংস্রতা যেন বোবা কালার উপচ্ছায়া
তোমার সম্রাট অট্টালিকার দারোয়ানের পোশাকে বন্দি…

আমেরিকান কবি ওয়ল্ট হুইটম্যানের প্রতি লিখলেন-

কে ওই কয়লা, বিলবোর্ড আর রেললাইনের পাহাড়ে
দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখল নদী হবার, ঘুমলো নদীর মতন
তার মধ্যে কমরেড কে তোমার বুকের মাঝে রাখল
অজ্ঞ চিতাবাঘের মোচড়…

এই সময় থেকে লোরকা কবিতার চেয়ে বেশি করে নাটক লিখতে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে স্পেনে রাজা আলফানসোর একনায়কত্ব শেষ হয়ে নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন হয়েছে। লোরকা ফিরে এলেন নিজের দেশে। নতুন বামপন্থী সরকার লোরকাকে স্টুডেন্টস থিয়েটারের নির্দেশক করে দিল। থিয়েটার দলের নাম ‘লা বারাকা’। এই সময় লোরকা থিয়েটারকে সমাজ বদলের হাতিয়ার করলেন। লিখলেন বিশ্ববিখ্যাত সব নাটক— ব্লাড ওয়েডিং, ইয়ারমা, দ্য হাউস অফ বারনার্ডা আলবা ট্রিলজি। নাটক নিয়ে গ্রামে গ্রামে, শহরতলিতে ঘুরতে থাকলেন। তাঁর কাছে ‘নাটক হচ্ছে কবিতার বুক থেকে উঠে আসা মানুষ যে কথা বলতে পারে, কাঁদতে পারে, চিৎকার করতে পারে যন্ত্রণায়’। কবিতা লেখা তখন অনেক কমে গেছে। এসময়ের লেখা কবিতাগুলো অনেক অনেক বছর পরে বিশ্বের দরবারে পৌঁছবে।

এদিকে স্পেনের বামপন্থী সরকার তখন চাইছে আমূল পরিবর্তন। পুরনো শাসকেরা তা মেনে নেবে কেন? ফলে স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হল ১৯৩৬ সাল থেকে। এরই মধ্যে দালির ১৯৩১ সালে আঁকা ছবি ‘দ্য পারসিসটেন্স অফ মেমরি’ তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে। দালি নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস সব বড়ো বড়ো শহরে প্রদর্শনী করছেন। বিয়ে করেছেন গালাকে। সেই সময় জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর নেতৃত্বে দক্ষিনপন্থীরা যুদ্ধ ঘোষণা করল জনগনের ভোটে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সমাজতান্ত্রিক কমিউনিস্ট চিন্তাধারার মানুষেরা স্পেনের বামপন্থী সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে যোগদান করল। আমেরিকার বিখ্যাত লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়েও যোগ দিলেন যুদ্ধে। ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসের এক বিষন্ন বিকেলে গ্রানাডার বাড়ি থেকে ফ্রাঙ্কোর সৈনিকরা তুলে নিয়ে গেল লোরকাকে। হত্যা করল গোপনে। লোরকার মৃতদেহ আজও নিখোঁজ।

লোরকার প্রিয় বোন ইসাবেলা লোরকার সব লেখা লুকিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৭৫ সালের পরে লোরকার সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ, নাট্য সংকলন প্রকাশ পায় ও লোরকাকে বিশ্বময় মরণোত্তর খ্যাতি এনে দেয়। লোরকা, যিনি একাহাতে স্পেনে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার যাত্রা শুরু করেছিলেন, যিনি চিরন্তন ভালোবাসার কবি, যিনি তাঁর কবিতায় সবসময় প্রেম ও মৃত্যুর মধ্যে চলাচল করতে ভালোবাসতেন, তাঁকে নিয়ে বাঙালির এক প্রিয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখে গিয়েছেন ‘কবির মৃত্যু’। তাতে একটি পভক্তি ছিল— ‘আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না’। তা-ই সত্যি হয়েছে।

‘কেউ নেই যে চুম্বন করতে পারে
মুখহীনদের মুখের হাসির কথা না ভেবে
কেউ কী স্পর্শ করতে পারে শিশুর মুখ
মৃত অশ্বের করোটি ভুলে গিয়ে…’ 

(কবিতার নাম ‘গজল অফ দ্য ফ্লাইট’। লোরকার ‘ডিভান দেল টামারিট’ কাব্যগ্রন্থে (১৯৩৪) অসংখ্য গজল লিখেছিলেন তিনি।)

 

*মতামত লেখকের নিজস্ব
*ছবি সৌজন্য: Barbarous Nights, Public, Twitter

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com