banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

কবুতর যা যা যা…

আগস্ট ৬, ২০২১

Love Letter
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

প্রেমপত্র জিনিসটা আজকের ব্যাপার নয়। প্রাচীনকালের যেসব ব্যক্তি, বস্তু বা ক্রিয়া এখনও টিকে আছে, সেসবের প্রসঙ্গ উঠলে আজও যে ক’টার কথা মনে পড়ে, তার মধ্যে রয়েছে আমাদের ছোটবেলায় কাটানো মফসসল শহরের শ্মশানের বটগাছ, আমাদের পাড়ার সুবলের ঠাকুমা, দাম্পত্য কলহ এবং প্রেমপত্র। আজকের ব্যাপার নয় বাবা। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ পর্যন্ত তাম্বুল টাম্বুল এবং আরও কীসব ভাল ভাল জিনিস সহযোগে রাধাকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, বড়াইয়ের হাত দিয়ে।

সেই প্রেমপত্র নিয়ে দুচ্চার কথা। মানে প্রেম বা প্রেমপত্রের মতো গম্ভীর বিষয় নিয়ে চাট্টি লেখার প্রথম প্রচেষ্টা।

তখন নিতান্ত বালখিল্য। বাপ্পাদের বাড়ি খেলতে তথা বেড়াতে গেছি। একটু ছোটাছুটির পর ওদের ছাদে দাঁড়িয়ে নীচের রাস্তা দেখছি বাপ্পা আর আমি। বাপ্পার দিদি, এখন নাম মনে নেই, টুকটাক ফোড়ন কাটতে ব্যস্ত। এমন সময় রাস্তা দিয়ে পাড়ারই অমুক কাকু আর তমুক দিদিকে হাসি হাসি মুখে হেঁটে যেতে দেখা গেল। বাপ্পার দিদি কঠোর নির্দেশ দিলেন, ওঁদের দিকে যেন না তাকাই, কারণ অমুক কাকু আর তমুক দিদি মানুষ মোটেই সুবিধার নন, কারণ তাঁরা প্রেম করেন। শুধু কি প্রেম! পরস্পরকে চিঠি পর্যন্ত লেখেন। ওদের ছায়া বেশি মাড়ালে খারাপ হয়ে যেতে পারি। বলা যায় না, এত খারাপ হয়ে যেতে পারি, যে ওদের দেখাদেখি প্রেম পর্যন্ত করে ফেলতে পারি, তাতে সমগ্র খানদানের নাক কাটা যেতে পারে।

সেদিন জানলাম, সব প্রেমই চোপড়া নয়। সেই নালায়েক বয়সে একটা ধারণা তৈরি করে নিলাম। এক) পাশাপাশি হাসিহাসি মুখে হেঁটে যাওয়া কোনও দু’জন ব্যক্তি যদি পরস্পরকে চিঠি লেখে তাহলে সেই চিঠিকে ‘লাভ-লেটার’ বলে। দুই) যারা ‘লাভ-লেটার’ লেখে তাদের সঙ্গ বিষবৎ পরিত্যাজ্য। জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে খেতে আঁটি পর্যন্ত পৌঁছে যাবার পর এই নবলব্ধ জ্ঞানের কিছুটা বিবর্তন ঘটেছিল। জানা গেল, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদ্বয়ের একজন পুরুষ ও একজন মহিলা হলে তবেই সেই চিঠিকে ‘লাভ-লেটার’ বলা যেতে পারে, নতুবা তাকে বলে চিঠি। আসলে সমপ্রেম ব্যাপারটা নিয়ে জানা ছিল না।

এবং কিমাশ্চর্যম! প্রেমপত্রের সংজ্ঞা জানার সপ্তাহখানেকের মধ্যে বাপ্পার মা-বাবা আমার দিকে কেমন যেন টেরিয়ে টেরিয়ে তাকানো শুরু করলেন। তারও কদিন পর বাপ্পার কাছেই জানলাম, ওর বন্ধুরা ওর বাড়িতে আর স্বাগত নয়। কারণ ক’দিন ধরে দিদিভাইয়ের কাছে “ইতি তোমারই ড্যাশ” লেখা যে চিঠিগুলো ধরা পড়ছে, সেগুলো আমাদের মতো পাড়াতুতো বালকদের দৌত্যের ফলেই পৌঁছতে পারছে বলে ওর বাবা-মায়ের ধারণা।

Love letter
ফাঁদ পাতা ভুবনে…

খুবই কৌতূহল জন্মেছিল। বাপ্পার যে নীতিবাগীশ দিদিভাই চিঠিলিখিয়েদের মুখদর্শন করার পাপ থেকে বালকদের বাঁচানোর ব্রত নিয়েছে, সেই দিদিভাইকেও কিনা কেউ চিঠি লেখে! “ইতি তোমার ড্যাশ” এর পরিচয় গোপন রাখার চেষ্টার ফলে বছরখানেক মা বাবার কাছে বেশ কিছুটা লাঞ্ছনা সহ্য করার পর বাপ্পাদের বাড়িতে সানাই বেজে উঠল এবং আমরা জানতে পারলাম ‘ড্যাশ’ এর নাম ‘প্রদীপ’ না ‘রঞ্জিৎ’ কী একটা যেন। বাপ্পার দিদি শ্বশুরবাড়ি চলে যাবার পর অবশ্য কাকু কাকিমা আর আমার দিকে টেরিয়ে তাকাতেন না। শুনেছি বাপ্পার ভাগ্নে ভাগ্নি দু’জনেই আজকাল চিঠিচাপাটির, থুড়ি, ‘লাভ-লেটার’ লেখার বয়েসে পৌঁছে গেছে এবং লিখছে। বাপ্পার দিদি আর ড্যাশদা, মানে প্রদীপদা/ রঞ্জিৎদা সেটা নিয়ে খানিকটা গর্বিতও।

তারও ক’বছর পরের কথা। জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ প্রায় সম্পূর্ণ, ছিবড়ে ফেলার জন্য জায়গা খুঁজছি। কোনও অজ্ঞাত কারণে আমাদের বাল্যবান্ধবী আরতির বাড়ি থেকে ছাত্রাবস্থাতেই তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মতো মফসসল শহরে এরকম বিয়ে এক আধটা হয়। কিন্তু এর ফলে ক্লাসের মেয়েরা অপ্রত্যাশিতভাবে একটা আলাদা দল বানিয়ে আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। আরতিকে ঘিরে সারাক্ষণ কেমন একটা গুপ্তসমিতির মিটিংয়ের মতো ব্যাপার চলে, সেই গুপ্তসভার ধারেকাছে কোনও ছেলে ঘেঁষতে গেলে সমিতির সদস্যরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। আবার আমরাও লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ির দু একটা টান দেওয়া মকশো করছি, গোপনে ভিডিও ভাড়া করে সিনেমা দেখছি, রসময় গুপ্ত নামক প্রাপ্তবয়স্ক লেখকের সাহিত্যকীর্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। হেনকালে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত জনপ্রিয় হিন্দি ছবির কল্যাণে ততোধিক জনপ্রিয় ‘কবুতর যা যা যা’ গানের মূর্চ্ছনায় পাড়ার পুজো প্যান্ডেলগুলো মুখরিত হয়ে উঠল।

সম্ভবত সেই গানেরই অনুপ্রেরণায়, ছোট শহরের একটা বিশেষ প্রজন্মের মধ্যে পায়রা পোষার আকাঙক্ষা দেখা দিল। অধিকাংশের মা বাবা ছেলেমেয়েদের এসব বায়নাক্কায় কর্ণপাত করলেন না। তবে যাদের বাড়িতে আগে থেকেই পায়রা পোষা হচ্ছিল, তাদের কেউ কেউ পায়রাদের প্রতি বিশেষ যত্নবান হয়ে উঠল। আমাদের নাড়ু তো তার কলকাতাবাসী পিসতুতো দাদাকে দিয়ে কলকাতা থেকে ‘সচিত্র পারাবত প্রশিক্ষণ’ নামে বই পর্যন্ত আনিয়েছিল। নাড়ুদের বাড়ির ত্যাঁদড় পায়রাগুলো ছাত্র হিসেবে তেমন মনোযোগী না হবার ফলে এবং উপযুক্ত প্রেমিকার অভাবে নাড়ুর আর কোনওদিন চিঠি, মানে ‘লাভ-লেটার’ লেখা বা পাঠানো হয়ে উঠল না। 

Love Letter
এসেছিল নিঃশব্দ চরণে…

তবে সেই সময়টায় আমাদের ছোট মফসসল শহরে পত্রসাহিত্যের বেশ একটা বিকাশ ঘটেছিল বটে। প্রেমপত্রের একটা বড় বিশেষত্ব ছিল ভুল বানান, বিশেষতঃ ‘জীবনকে’ ‘জিবণ’ লেখা। রংবেরঙের (প্রধানত গোলাপি) কাগজ, ততোধিক রংবেরঙের কালিতে লেখা, পারলে কিছু গন্ধদ্রব্য চিঠির ওপর ঢেলে দেওয়া – এগুলোও উল্লেখযোগ্য। প্রাপক মানুষটিকে হৃদয়ের স্পন্দন থেকে শুরু করে সিঙাড়ার আলু পর্যন্ত বিভিন্ন ভাল ভাল জিনিসের সঙ্গে তুলনা করার প্রচলন ছিল। 

আর ছিল প্রেমিককে না পেলে প্রেমিকার এবং প্রেমিকাকে না পেলে প্রেমিকের কী দুর্দশা হবে তার হৃদয়বিদারক বর্ণনা। উদাহরণ: তোমাকে না পেলে দেবদাস হয়ে যাব (প্রসঙ্গত মনে হল, শরৎচন্দ্র এত বছর আগে এমন এক চরিত্র সৃষ্টি করে গেছেন যিনি আজ পর্যন্ত প্রেমিকাদের সহানুভূতি আদায়ের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছেন। শরৎবাবু ও দেবদাসবাবু দু’জনকেই কুর্নিশ)। উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে না পেলে সাধুসন্ন্য়াসী হয়ে যাবার হুমকিও এক আধটা চিঠিতে দেখা যেত। যতদূর জানি, আমাদের সমকালীন সেইসব পত্রলেখকরা পরবর্তীকালে সাধু না হয়ে রেশনের ডিলার কিংবা সরকারি আমলা গোছের পেশা অবলম্বন করেছেন। সে ভালই করেছেন। মালতীকে না পেয়ে রমেশ যদি সাধু হয়ে যায় তাহলে মালতীর কচুপোড়া। মাঝখান থেকে রমেশের জীবনে মিনতির প্রবেশও নিষেধ হয়ে যাবে।

প্রেমিকদের মধ্যে যারা বিশেষভাবে নিবেদিতপ্রাণ তাদের মধ্যে নিজের রক্ত দিয়ে প্রেমপত্র লেখার একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা লক্ষ করা যেত। তবে শুধুমাত্র রক্ত দিয়ে একটা গোটা চিঠি লেখা খুব কঠিন। তখনকার দিনের নিবওয়ালা ফাউন্টেন পেনে রক্ত ভরলে দু’ চারটে আঁচড় কাটার পর নিব অচল হয়ে যেত। আবার একটা এক প্যারাগ্রাফের একটা ছোট চিঠি লেখার জন্য যে পরিমাণ রক্ত দরকার, সেটা শরীর থেকে বার করে নিলে রক্তাল্পতা-সহ আরও নানা রকমের অসুখবিসুখের ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিঠিটা লেখা হত কালি দিয়ে, আর চিঠির তলার সইটা করা হত রক্ত দিয়ে। সইয়ের তলায় তীরবিদ্ধ দুটি হৃদয় এঁকে দেওয়ার সেই রীতি আজও অব্যহত। 

কিছু সেয়ানা গোছের প্রেমিককে উপরোক্ত রক্তাক্ত স্বাক্ষরের জন্য মোরগ জাতীয় প্রাণীর রক্তও ব্যবহার করতে দেখেছি। সেসময় লোকজন এখনকার চেয়ে অনেক সরলমনা ছিল। চিঠির তলার স্বাক্ষরে ব্যবহৃত রক্ত প্রেরকের বদলে অন্য কোনও প্রাণীরও হতে পারে, এই সন্দেহ প্রাপকের মনে জাগলে অনেক প্রেম অকালেই ঝরে যেতে পারত, সৌভাগ্যবশতঃ, সেরকম কোনও ঘটনার কথা শুনিনি।

যাদের জীবনে প্রেম আসেনি, তারা এইসব শোণিতলাঞ্ছিত প্রেমপত্রকে ‘আদিখ্যেতা’ বলত, কিছুটা অবশ্যই ঈর্ষায়। পূর্বোক্ত নাড়ু, প্রশিক্ষিত পারাবতের অভাবে যার জীবনে প্রেম আসতে পারল না, সে বলত, যেসব আত্মসম্মানবোধহীন লোকজন রক্ত দিয়ে প্রেমপত্র লিখতে পারে, তারা যে কখনও মল, মূত্র বা কফ দিয়ে লিখবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

 

আরও পড়ুন: শ্রাবণী রায় আকিলার কলমে প্রেমের শহর টোকিওর গল্প

 

তবে, সব প্রেমিক কি আর নিজের প্রেমপত্র নিজে লেখার আত্মবিশ্বাস অর্জন করে উঠতে পারত? যে ব্যক্তি বাংলা পরীক্ষার খাতায় অম্লানবদনে “ব্রিস্টি পরলে আমি বর্ষাতি পড়ে পরতে বসি” লেখে সে-ও প্রেমিক হয়ে যাবার পর প্রেমিকার নাম লিখতে দশবার ভাবত, পাছে বানান ভুল হয়ে যায়। পরীক্ষার খাতায় বানান ভুল হলে বড়জোর নম্বর কম মিলবে কিংবা স্যর বকবেন। প্রেমপত্রে বানান ভুল মানে ভাল লাগার মানুষটির কাছে প্রেস্টিজের দফারফা। তাই নিজের প্রেমপত্র নিজে লেখা ঝুঁকির ব্যাপার।

এই সমস্যার বহুলপ্রচলিত সমাধান, বাংলায় ভাল নম্বর পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। তারপর মন্টুর চপ বা কাঠি আইসক্রিম খাওয়ানো, বা প্রিয় সবুজ জামা দুদিনের জন্য পরতে দেওয়া- এই ধরনের পারিশ্রমিক বা পারিতোষিকের বিনিময়ে প্রেমপত্র লিখিয়ে নেওয়া। বলতে নেই, বাংলায় নম্বরটা নিতান্ত মন্দ পেতাম না, তাই প্রেমপত্র লেখার ব্যবসায় কদিন একটু করে খেয়েছিলাম।

প্রেমপত্র লেখা তো হল। এবার প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তখনকার মফসসলি অভিভাবকেরা বাড়ির ডাকবাক্স নিজের হাতে খুলতেন। সুতরাং প্রেমপত্র বাড়ির ঠিকানায় পাঠানো নৈব নৈব চ। ঠিকানা লিখে ডাকঘরের বাক্সে ফেলে দিলাম, মফসসলি প্রেমপত্র ঠিক সে ধরনের চিঠি নয়। এ জিনিস পাঠানোর জন্য চাই বিশ্বস্ত মানুষ। পায়রা টায়রা এসব সিনেমায় হয়, নাড়ু জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। মানুষ চাই। এই ব্যাপারে সবচেয়ে উপযুক্ত হচ্ছে দু’পক্ষেরই বিশ্বস্ত কোনও বন্ধু, কিংবা দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না, এরকম কোনও বালক। দ্বিতীয় ধরনের পত্রবাহকের অতিরিক্ত সুবিধা ছিল, অভিভাবকদের সন্দেহ এড়িয়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে প্রাপকের হাতে চিঠি তুলে দেওয়ার জন্য যতটা দরকার ততটা সরল মুখ এবং ধরা পড়ে গেলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য যতটা দরকার ততটা বুদ্ধিমত্তা। 

আর হ্যাঁ, প্রেমপত্র বিষয়ে লিখতে বসে একটা প্রসঙ্গ সংক্ষেপে হলেও ছুঁয়ে যাওয়া উচিত। সেটা হল, কাউকে ভাল লেগে যাবার পর প্রেমের প্রস্তাব পাঠানোর চিঠি, আর সেই প্রস্তাব স্বীকৃত হবার পর শুরু হয়ে যাওয়া ধারাবাহিক পত্রপ্রবাহ, দুয়ের রচনাশৈলী থেকে শুরু করে অনেক কিছুই কিন্তু আলাদা। প্রায়শ দেখা গেছে, প্রথম প্রস্তাব পাঠানোর চিঠিতে প্রেরক যত সৃষ্টিশীলতা ঢেলে দিয়েছেন, পরবর্তী চিঠিগুলোতে সেই আবেগ আর কৃৎকৌশলের সিংহভাগ অনুপস্থিত।

বিচ্ছেদ অর্থাৎ ব্রেকআপের চিঠিও বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। তবে সে ব্যাপারে অভিজ্ঞতা কম। আমাদের সদ্য কৈশোরে দেখা পরিচিতজনের প্রেমগুলোর অধিকাংশই বিয়েতে পর্যবসিত হয়েছে, সম্ভবত মফসসলি অভিভাবকদের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে। অমুক তমুককে চিঠি লিখছে জানতে পারামাত্র প্রথমে তাঁরা এইসব চিঠিচাপাটি বন্ধ করতে সচেষ্ট হতেন, তারপর সে ব্যাপারে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে উঠে পড়ে লাগতেন যাতে অমুকের বিয়ে তমুক ছাড়া আর কারও সঙ্গে না হয়।

ব্যর্থ প্রেম যে একেবারেই ছিল না তা নয়। ব্যর্থ প্রেমিকরা পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেবদাস তথা মাতাল হতেন, চাকরিবাকরি এবং বিয়েশাদি করতেন আর সপ্তাহে একদিন (সাধারণত রবিবার) ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতিতে আধ পেগ হুইস্কি বেশি খেয়ে একটু হইহল্লা করে পাড়ার লোকের সমীহ অর্জন করতেন। অপরদিকে ব্যর্থ প্রেমিকারা মাসে একবার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি আসতেন, কিছু একটা ছুতোয় প্রাক্তনের সঙ্গে দেখা করতেন এবং “ইশ্ কী রোগা হয়ে গেছ শিবুদা” বলে কর্তব্য পালন করতেন। দু’মিনিটের মধ্যে শিবুবৌদি মাটি ফুঁড়ে উঠে এসে “কি রে বুলা, কখন এলি?” বলে হাত ধরে টানতে টানতে বুলাকে পাশের ঘরে নিয়ে যেতেন এবং সেই সন্ধ্যায় শিবুদা আবার আধ পেগ বেশি খেতেন।

Unsuccessful lover
আর আশা নেই… ভালবাসা নেই…

প্রেমপত্র লেখা বা পৌঁছে দেওয়ার মতো আর একটা লাভজনক ব্যবসা (নগদ টাকায় নয়, আগে যেমন বলেছি সেরকম ভাল ভাল খাবারের বিনিময়ে) ছিল প্রেমপত্র শোনা। আসলে প্রথম প্রথম প্রেমপত্র লেখা বা পাওয়ার একটা উত্তেজনা থাকে। লোককে ডেকে ডেকে শোনাতে ইচ্ছে করে। এখন, এত শুনবেই বা কে? বিশেষত, সংখ্যাগরিষ্ঠ যখন প্রেমে ব্যর্থ কিংবা প্রেম ব্যাপারটাকে ‘আঙুর ফল টক’ কিংবা আদিখ্যেতা মনে করে। তখন কাটলেট বা কামরাঙার বিনিময়ে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিত সেইসব ধৈর্যশীল বন্ধু, যারা হাই তুলতে তুলতে অসীম অধ্যবসায়ে শুনতে থাকত, “পরের প্যারাগ্রাফটা শুনলে তোর ভাল লাগবে…প্রাণনাথ…”

প্রেমপত্রশিল্পে লেখক, পত্রবাহক, শ্রোতা ছাড়াও, জিম্মাদারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নিজের পাওয়া প্রেমপত্র নিজের কাছে রাখা নিরাপদ নয়। যে কোনও মূহূর্তে বাবা কিংবা কুচুটে রাঙামাসিমার হস্তগত হতে পারে। তাই চাই বিশ্বস্ত বন্ধু, প্রেমপত্র পড়া হয়ে যাবার পরই যার বাড়িতে চালান হয়ে যাবে। দুর্ভাগ্যবশত সংশ্লিষ্ট প্রেমিকপ্রেমিকাদ্বয়ের সম্পর্ক যদি বিয়ে পর্যন্ত না গড়ায়, তাহলে জিম্মাদার বন্ধুটির দায়িত্ব, তার বন্ধুটির, অর্থাৎ প্রেমিক বা প্রেমিকাটির বিয়ের আগেরদিন চিঠিগুলোকে ধ্বংস করা। সেই ধ্বংস আবার নর্দমায় ফেলে বা অন্য উপায়ে করা চলবে না, পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এই পোড়ানোর দিন অনেকেই বাবার হাতে ধরা পড়ত, তারপর অনেক কৈফিয়ত দিয়ে প্রমাণ করতে হত, আলোচ্য প্রেমটি তার নিজের নয়, আগামীকাল যার বিয়ে হচ্ছে সেই বন্ধুর।

এই হল মোটামুটি প্রেমপত্রের জীবনচক্র। এতক্ষণ অন্যের জন্য লেখা প্রেমপত্র বিষয়ে অনেককিছু বললাম। শেষ করার আগে বলব নিজের জন্য লেখা প্রেমপত্রের কথা। হ্যাঁ, বন্ধুদের হয়ে প্রেমপত্র লেখা ছাড়াও, এই অধম নিজের হয়েও একটা প্রেমপত্র লিখেছিল। নিজেকেই। নিজেকে নিজে প্রেমপত্র লেখার ব্যাপারটা অবাস্তব, এমনকি মিথ্যেও মনে হতে পারে, তবে পুরোটা জানার পর আর মনে হবে না। ঘটনাবলি নিম্নরূপ:

আমার হোস্টেলের বন্ধু পল্টন (নাম পরিবর্তিত) আর তার পাড়ার বান্ধবী ললিতা (নাম পরিবর্তিত) – দু’জনের সঙ্গেই আমার ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। যতটা বন্ধুত্ব থাকলে প্রাণের কথা, মনের কথা বিশ্বাস করে বলা যায়। পল্টন আর ললিতা দু’জনেই দু’জনের প্রেমে পড়েছে, কিন্তু সংকোচ কাটিয়ে কেউ কাউকে বলে উঠতে পারছে না। সুতরাং পত্রলিখন এবং দৌত্যকার্য, উভয় বিষয়ে নিজের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ওদের প্রেমটা করিয়ে দিতে হল। তারপর থেকে ওদের প্রেমপত্রগুলো লিখে দিতাম, ওরা কপি করে নিত। তবে পল্টন জানত আমি শুধু ওর চিঠিগুলোই লিখি, ললিতারগুলো নয়। ললিতাও জানত আমি শুধু ললিতার চিঠিগুলোই লিখি, পল্টনেরগুলো নয়।

Love letter
হাজার কবিতা, বেকার সবই তা…

কিন্তু দিনের পর দিন একজন স্বেচ্ছাসেবককে দিয়ে প্রেমপত্র লেখাতে লেখাতে পল্টন আর ললিতার লেজ মোটা হয়ে গেল। আমার লেখা প্রেমপত্র নিজের মনের মতো না হলে আমাকে কথা শোনাতে শুরু করল। একদিন ললিতার হয়ে পল্টনকে একটা চারলাইনের চিঠি লিখেছি। ললিতা বলল, “তোর আজকাল কাজে মন নেই। আগে কত বড় বড় চিঠি লিখে দিতিস!” আমিও রেগে বললাম, “ফোকটে অন্যকে দিয়ে চিঠি লেখাস, আবার খুঁত ধরিস। দেব পল্টনকে সব বলে, যে তোর চিঠিগুলো আসলে আমার লেখা। তাও যদি চিঠিগুলো আমাকে লিখতিস। তোর বয়ফ্রেন্ড, চিঠি লিখব আমি, আবার গালাগালও খাব? আমার একটা আত্মসম্মান নেই?” তাতে ললিতা কিছুটা ভয় পেয়ে বলল, “রাগ করিস না। অন্তত একপাতা লিখে দে। পাতা না ভরলে ভাল লাগে? আচ্ছা, কাল তোকেও একটা চিঠি লিখব নাহয়।” তখন আগের লেখার চিঠিটায় আরও কয়েকলাইন জুড়ে একপাতা করে দিয়ে বললাম, “তাহলে দিচ্ছিস তো কাল আমাকে চিঠি?” ললিতা বলল, “দেব, একটা বড় ডেয়ারি মিল্ক চকলেট খাওয়াস।” এরকম কথা কিন্তু ছিল না। যাই হোক, নানা দরদামের পর একটা মাঝারি চকলেটে রফা হল।

ওমা! পরদিন একটা মাঝারি চকলেট নিয়ে গেছি ললিতার বাড়ি, গিয়ে বলেছি, “আমার চিঠি কই?” বলে, “আরে আমার চিঠি মানে তো তোরই চিঠি। লিখবি তো তুইই। কষ্ট করে ওই চেয়ারটায় বসে লিখে নে না। এই নে গোলাপি কাগজ, এই নে সেন্টের শিশি।”

আত্মসম্মানবোধটা এত তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল, যে ওখানেই বসে নিজেকে নিজে প্রেমপত্র লিখে, ললিতাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওর জন্য আনা চকলেটটা গলাধঃকরণ করে, ললিতার ব্রহ্মতালুতে এক চপেটাঘাতপূর্ব্বক সেই যে ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম, তারপর ছ’মাস অভদ্রমহিলার মুখদর্শন করিনি, চিঠিচাপাটিও লিখে দিইনি।

কী বললেন? কিচ্ছু বিশ্বাস করলেন না? দেব নাকি আপনাকে একপিস প্রেমপত্র, বেলের কষে গোলা গোবর দিয়ে সই করা?

 

ছবি সৌজন্য: Shutterstock, 123rf.com, irishexaminer.com

5 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com